মুম্বাই, ১১ই মার্চ বিকেলঃ একথা কারো আর অজানা নেই যে, হাজার হাজার কৃষক সুদূর নাসিক থেকে ২০০ কিমি মিছিল করে আসছে শিল্পনগরী মুম্বাই এর রাজপথের দখল নিতে। সেই মিছিল দেখার জন্য তাড়াহুড়ো করে বিকেল ৫ টা নাগাদ ভিকরোলি তে পৌঁছতে দেখা গেল স্রেফ ১০-১২ জন মানুষ মাথায় গেরুয়া টুপি পরে দাঁড়িয়ে। মিছিল টা তো বামপন্থীদের। আরও অনেক বড় হবার কথা। নাসিক থেকে যত এগোচ্ছে, সংখ্যা নাকি তত বাড়ছে। আর ফেসবুক ফিড বা মিডিয়ার ছবিতে যা দেখেছি, লাল পতাকায় ছয়লাপ। এ তাহলে কী? হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করতে জানা গেল, মিছিল এগিয়ে গেছে, ধরতে গেলে জলদি যেতে হবে। আর এরা শিবসেনার লোক, মিছিল হাইজ্যাক করতে এসেছিল কিন্তু পারেনি। কীকরে তাদেরকে আটকানো হল সেটা অবশ্য জানা গেলনা। মিছিল এগিয়ে গেছে।
অগত্যা অটো। তাতে চড়ে কিছুটা এসেই আসল মিছিলের লেজ দেখা গেল। সে এক বিশাল ব্যাপার। অটোকে এগিয়ে নিয়ে যেতে বললাম। মিছিলের আন্দাজ অর্ধেক আসার পর দেখি ৩ কিমি দেখাচ্ছে মিটার। মিছিলের বিপুল দৈর্ঘ্য এর থেকেই বোঝা যায়। এই বিরাট মিছিলে মানুষের সংখ্যা সেই মুহূর্তে ৬৫০০০ পেরিয়ে গেছে। অটো থামিয়ে চলে যাওয়া গেল তাদের ভিড়ে, সেইসমস্ত মানুষগুলোর ভিড়ে যারা প্রায় ১৫০ কিমি পথ খালি পায়ে হেঁটে এসেছে "বেঁচে থাকার দাবী" নিয়ে। ৩৫০০০ কৃষকের ঋণ মকুবের লড়াই, সারা মহারাষ্ট্রজুড়ে এত এত কৃষকের আত্মহত্যার জবাব চাইতে এসেছে তাদের কমরেডরা।
এরই মাঝে কিছু স্লোগান। সেসব মারাঠিতে। পাশের এক ছাত্রকে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল মানেটা। মানেটা এই দাঁড়ালো "আমরা জাতি ধর্মের লড়াই নয়, খাদ্য ও পেটের লড়াইয়ে আছি"। শিবসৈনিকদের হাত থেকে মিছিলকে রক্ষা করার রহস্যটা বোঝা গেল। এই মিছিলে খালি পায়ে পাশাপাশি হাঁটছে নূর মোহাম্মদ ও বিমল শিরসেকর। দুজনের মাথায় লাল টুপি। হাতে লাল ঝান্ডা। গলা চিরে স্লোগান উঠলো " আমদের নেতা কমরেড অশোক ধাবলে আমরা তোমার সঙ্গে আছি"।
মিছিল এগিয়ে চলছে ভিকরোলি থেকে শাওন এর দিকে। রাস্তার দুপাশে আরও আরও মানুষ। ফোনের ক্যামেরা হাতে দাঁড়িয়ে কয়েক হাজার হাজার যুবক যুবতী। মহিলারা দৌড়ে এসে বড়া পাও আর জল দিচ্ছে মিছিলে অংশগ্রহণকারী কৃষকদের। জেদি মানুষদের লং মার্চ এগিয়ে চলছে মহারাষ্ট্রের হাইওয়ে দিয়ে।
স্থান চেম্বুর, মিছিল ঢুকছে দলিত কলোনীতে। স্লোগান উঠলো "জয় ভীম, লাল সেলাম"। কৃষকনেতা কমরেড অজিত নাউলে প্রদীপ জ্বালাল বি আর আম্বেদকরের ছবির সামনে। পুষ্পবৃষ্টি শুরু হলো দলিত কলোনীতে। আজ নীল পতাকা লাল পতাকা একাকার। ভিড় চিরে গর্জন উঠছে "জয় ভীম লাল সেলাম", "ইনকিলাব জিন্দাবাদ"। ছড়িয়ে যাচ্ছে গোটা মহারাষ্ট্রে। মুম্বাই শহর নাকি সারারাত জেগে থাকে, হ্যাঁ মুম্বাই এর বুকচিরেও আদিবাসী দলিত কৃষকদের পায়ের শব্দ খোদ আম্বানির বেডরুমের দেওয়ালে আঘাত করছে। মুম্বাই জেগে থাকুক, আজ রাত দেবেন্দ্র ফড়নবিশ এর জেগে থাকার রাত।
রাতঃ এই লেখা শুরুর সময় জানা ছিলনা যে সত্যিই মিছিল মুম্বাই শহর দিয়ে হাঁটবে মধ্যরাতে। সেটা জানা গেল একটু আগে। মিছিলের অংশগ্রহণকারীরা সিদ্ধান্ত নিলেন, পরীক্ষার্থীদের কথা মাথায় রেখে, রাস্তা যাতে জ্যাম না হয়ে যায়, তাই মিছিল রাত দুটোয় বিধানসভা ভবনের দিকে হাঁটতে শুরু করবে। মুম্বাই জাগবে সারা রাত।
ভোর চারটে। মিছিল হাঁটছে মুম্বইয়ের পথ ধরে। ভুখা মানুষগুলো সারাদিনের পর, সারা রাত হাঁটবে। খবর পাওয়া গেল মুম্বইকররাও রাত জাগছে। লালবাগ জেগে আছে, শুধু শুকনো সহানুভূতি নিয়ে নয়। মিছিলের জনতার জন্য সকালের খাবার জোগাড় করে রাখা হয়েছে। রাস্তায় স্তূপ হয়ে আছে ফল আর বিস্কুট, পার্ক করে রাখা কালো হলুদ গাড়িগুলোর পাশেই।
দুপুর দুটোঃ কৃষকরা পোঁছে গেছে বিধানসভায়। শুরু হয়ে গেছে সরকারের সঙ্গে বৈঠক। বৈঠকের শেষে সেচমন্ত্রী গিরীশ মহাজন সর্বভারতীয় মিডিয়াকে জানাচ্ছেন, আন্দোলনকারীদের ১০০% দাবীই মেনে নেওয়া হয়েছে। কৃষকদের বাড়ি পৌঁছে দেবার জন্য ব্যবস্থা করা হচ্ছে এক বিশেষ ট্রেনের। আলোচনার পুরো বিবরণ এখনও পাওয়া যাচ্ছেনা। কিন্তু চতুর্দিকে জয়োল্লাস। সোশাল মিডিয়া ছেয়ে যাচ্ছে লাল টুপি পরা নগ্নপদ কৃষকের ছবিতে। সারাদিন মুম্বই আজ ট্রেন্ডিং। বলিউডের বা শেয়ার বাজারের কারণে নয়, আজকের নায়ক কৃষকরা। জাতীয় মিডিয়া ভিড় করছে বাইট নিতে। লং মার্চ শেষ হল। মহারাষ্ট্রের প্রত্যন্ত এলাকার কৃষকরা এবার বাড়ি ফিরবে।
লংমার্চের প্রথম দিনের ভিডিও। ৫ম দিন। https://www.facebook.com/mithun.raj.906/posts/1562254543869750