কথোপকথনের অডিও
যাঁরা এই প্রবন্ধটি পড়ার পরিশ্রম করতে চান না, তাঁদের জন্য লেখক অসীম চট্টরাজের সঙ্গে কয়েকটি কথোপকথনের রেকর্ড তাঁর অনুমতিক্রমেই দিলাম। অসীমের নিজের মুখে তাঁর লেখালিখি সম্পর্কে ভাবনা শুনে নেবেন। প্রশিক্ষিত সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী নই, আড্ডা নেশাড়ু মাত্র, বাচালতা মাপ করবেন।
https://soundcloud.com/user-729923677/ashimchattoraj1
https://soundcloud.com/user-729923677/ashimchattoraj2
https://soundcloud.com/user-729923677/ashimchattoraj3
প্রারম্ভে
এটা সম্ভবত পরিষ্কার করে নেওয়া দরকার, লেখক অসীম চট্টরাজ, (জন্ম ১৯৬৪) বয়সে তরুণ, নিজের গতিতে, নিজের লেখালিখির কাজকর্মে ব্যস্ত রয়েছেন, শুরু করছেন আশির দশকের মাঝামাঝি। প্রকাশকাল দেখলে অবশ্য মনে হচ্ছে, গতি অনেকটাই কমিয়েছেন, নব্বই য়ের দশকের পরে। সীমিত হলেও কিছুটা প্রতিভার স্বীকৃতি একেবারে যে পান নি তা না, তবু তাহলে এই প্রায় পরিচয় পর্বের অবতারণার প্রয়োজনটা কোথায়?
অনলাইন বাংলা লেখালিখির জগতে একেবারেই পরিচিত নন, যদিও যাঁরা 'স্যাস', 'বহুরূপী', 'দিবারাত্রির কাব্য', 'নাট্যপত্র ঘরে বাইরে', আনন্দবাজার রবিবারের সংস্করণে, প্রকাশিত নাটক বা গল্প পড়ছেন গত কুড়ি তিরিশ বছরে, তাঁদের কাছে অসীম খুব অপরিচিত নাম নন।
যথাসম্ভব সম্পূর্ণ রচনাপঞ্জীতে, দশটি নাটক, একটি উপন্যাস, গোটা পনেরো গল্প, আর তিরিশটি প্রবন্ধ/সংলাপ/ স্কেচ প্রকৃতির গল্প /কাহিনীহীন গদ্য পাচ্ছি, গত তিরিশ বছরের চর্চাকালে। অসীমের কবিতাকে, বা গানকে, যা নাটকে, গল্পে, উপন্যাসে ব্যবহৃত হয় নি, তাকে এই আলোচনার বাইরে রেখেছি। সম্ভবত তাঁর নিজের মতেও কোন কাজেরই পূর্ণ মূল্যায়নের সময় এখনো আসে নি। এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্যে গত প্রায় এক বছরের আলাপচারিতায় তাঁকে কুন্ঠিতই মনে হয়েছে, বার বার মনে হয়েছে, বেশি কথাবার্তা, বিচার প্রচেষ্টা তাঁকে বিরক্ত, ক্লান্ত করেছে। নিজের অনেক লেখাই শুধু কুন্ঠাবশত না, সম্ভবত স্রেফ বিস্মৃতি, অনাগ্রহের কারণেই পড়তে দিতে পারেন নি।
কিন্তু এই হয়ে চলা লেখালিখিতে, অন্তত আমার মনে হয়েছে কতগুলো গ্রন্থি আছে, গত তিরিশ বছরে শান্তিনিকেতন, বীরভূমে এবং সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গে কথাসাহিত্য চর্চার সামাজিক ইতিহাস রচনার প্রচেষ্টা হলে যে বিষয়গুলিকে অগ্রাহ্য করা কঠিন। যদিও একেবারে প্রায়-সমসাময়িক কথাসাহিত্যকে বা সাংস্কৃতিক উৎপাদনকে ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করার সূত্র হিসেবে ব্যবহার করার রীতি এখনো তেমন প্রচলিত না, কারণ ধরেই নেওয়া হয়, তার জন্য তো সরাসরি সাংবাদিকতাই রয়েছে।
তারাশংকরের সেই, "জীবন এত ছোটো কেনে?"-র পরে ঝট করে মনে পড়ে যায়, এরকম খুব বেশি বীরভূমের ভাষা ব্যবহার আপামর বাঙালি পাঠকের কাছে পৌঁছয় নি। অসীমের লেখায়, বিশেষতঃ নাটকের গানে এই ভাষার একটা ব্যবহার আছে, যেটা শুনতে পেলে আমার অনতত সারা পৃথিবীতেই মনে হয়, চেনা জায়গায় আছি। যদিও বিষয়টা ব্যক্তিগত।
আরেকটা কারণ আছে, 'প্রগতি' ভালো না 'দুর্গতি' এই লড়াইয়ে, মোটামুটি আমাদের স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলা কথাসাহিত্য চর্চার ইতিহাস কন্টকিত। শিল্প-শহর আমাদের দেশে অনেকাংশে অচেনা বাস্তবের আমদানি করেছে, মানুষকে তার ঘরবাড়ি গ্রাম জমি জঙ্গল চারণভূমি থেকে সরিয়ে করেছে, স্বাভাবিক ভাবেই, শহর, বিশেষতঃ শিল্প শহর আমাদের কল্পনায় প্রায় গব্বরের মতই ভিলেন। 'মুম্বাই মেরি জান' গানে বলা হচ্ছে, "মিলতা য়হাঁ সবকুছ, ইক মিলতা নহি দিল"। একেবারে নব্বইয়ের দশকে এসে, মুম্বাইতে, বস্ত্র ও সুতো শিল্পের কারখানাগুলি একে একে শহরে বন্ধ হওয়ার পরে গিয়ে কাজের অভাবের, নিরাপত্তার অভাব থেকে শ্রমজীবন সম্পর্কে একটা আগ্রহ তৈরি হচ্ছে1, লোকের নস্টালজিয়া হচ্ছে, দশকভিত্তিক সাংস্কৃতিক চিহ্ন ধরে রাখার একটা প্রয়াস তৈরি হচ্ছে। কিন্তু এই কাজ দুর্গাপুর আসানসোলকে নিয়ে বেশ আগে শুরু করছেন অসীম, কারণ কিছুই না, রাষ্ট্রায়ত্ত্ব শিল্পের মৃত্যু ঘন্টা একটু আগে থেকেই বাজছে, শিল্পের পালে রাষ্ট্রের হাওয়া আর লাগছে না। যে চাষা ফেরার পথটি জানে না, তাকে বিপদেই পড়তে হচ্ছে।
বাংলা সাহিত্যে এবং সাহিত্য চর্চায় স্থান-রাজনীতি - সত্তর দশকের পর থেকে পাঠের দৈনন্দিন
বিষয় হিসেবে খুব স্বাভাবিক ভাবেই বৃহত্তর রাজনীতির গতি প্রকৃতি এবং ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু অতি সংক্ষেপে কয়েকটি দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা যেতে পারে।
মুক্তিযুদ্ধের সময়টাকে যদি জলবিভাজিকা ধরা যায় পশ্চিম বাংলার মুদ্রিত সংস্কৃতিতে কয়েকটা আগে পরের ঘটনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।
মতাদর্শের বিবর্তনের হিসেবে আমরা বাঙালি জাতির ইতিহাস রচনার প্রয়াস, সাধারণ ভাবে ইতিহাস রচনায় হিন্দু জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গী পেয়েছি, প্রতিযোগিতা মূলক ভাবে ইউরোপীয়ত্বর বিপরীতে ভারতীয়ত্ব গঠন প্রচেষ্টা পেয়েছি, রাজনৈতিক স্বাধীনতার আকুতি পেয়েছি, রাজনৈতিক স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে ভাবনার স্বাধীনতায় গুরুত্ব প্রদানের প্রয়াস পেয়েছি, সাম্রাজ্যবাদী পাশ্চাত্যের প্রতিক্রিয়ায় একধরণের বিভিন্ন স্তরের অন্তর্মুখী বা দূরপ্রাচ্যর সঙ্গে একাত্মীভূত প্রাচ্যধারণার প্রবর্তন ও ব্যবহার পেয়েছি। কখনো পরিবার ঐতিহ্য ইত্যাদিকে কেন্দ্রে রেখে আধুনিকের প্রতিক্রিয়াও পেয়েছি। স্বাভাবিক ভাবেই কথাসাহিত্যের ইতিহাস তার নানা সাক্ষ্য বহন করে।
বিংশ শতকের তিরিশ-চল্লিশের দশকে এসে একটা নতুন আধুনিকতার চর্চা পাচ্ছি, ৪২এর আন্দোলনের সময় নতুন করে আন্তর্জাতিকতা বনাম জাতীয়তাবাদ পাচ্ছি, আরেকটু পরেই সাম্প্রদায়িকতা সম্পর্কে দুশ্চিন্তা পাচ্ছি, ভাষা আন্দোলনের অভিঘাত আসছে। এবং পরিচয় পত্রিকার প্রখ্যাত বিতর্ককে কেন্দ্র করে শিল্পীর ভূমিকা নিয়ে আলোচনা পেয়েছি। রিয়েলিজম এবং সোশালিস্ট রিয়েলিজম, বিশেষতঃ নাগরিকতার সীমানার সাংস্কৃতিক ভৌগোলিক বিস্তারের প্রচেষ্টা পেয়েছি। জাতীয়তাবাদী এবং প্রগতি সাহিত্য গোষ্ঠীর বিভাজন ও পাচ্ছি সেই ৪২এর আন্দোলনের সময় থেকে, আবার ফ্যাসীবাদবিরোধী লেখক শিল্পী গোষ্ঠীর সংগঠনে তার কিছু ওলটপালটও দেখেছি।
কিন্তু ৭১এর মুক্তিযুদ্ধের সময় যেটা বিশেষ ভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, বাঙালী জাতীয়তাবাদ এবং ভারতীয় রাষ্ট্র শক্তি একে অপরের কাছ থেকে এক ধরণের অনুমোদন পাচ্ছে, যেখানে বামপন্থী অর্থে প্রগতির ধারণা শুধু না, পশ্চিমবাংলায় সামাজিক, রাজনৈতিক, মরাল যে কোনো স্থিতাবস্থাকে প্রশ্ন করাই কখনো সম্ভাব্য রাষ্ট্রবিরোধী এবং বিশেষ করে বাঙালী জাতির ঐক্যে অমনোযোগী বলে পরিগণিত হচ্ছে, এবং সাহিত্য গোষ্ঠীর দ্বন্দ্ব ক্রমশঃ সরাসরি রাজনৈতিক শিবিরের দ্বন্দ্বে পরিণত হচ্ছে। এটাই আরো পরে এসে প্রকৃত শিল্প বনাম বাজারী শিল্পের তর্কে পরিণত হচ্ছে। কবি শিল্পীরা কে কেন কোন পত্রিকায় লিখছেন, আর কোন পত্রিকায় লিখতে গেলে কিরকমটি হওয়া দরকার, এইরূপ বিচিত্র সম্পাদকীয় নিদানে ব্যতিব্যস্ত হচ্ছেন, আবার অন্যদিকে বিষয় হিসেবে সমাজ ও রাজনীতির বা বলা ভালো বিষয় হিসেবে সামাজিক এবং রাজনৈতিক দুটি ধারার মধ্যে একটা কৃত্রিম ভেদ তৈরি হচ্ছে, করা হচ্ছেও বলা যেতে পারে। পাঠক হিসেবে অতি সংক্ষেপে লজ্জা পেলেই চলে।
অন্যদিকে বাংলা ভাষা সাহিত্যের চর্চার ইতিহাসে দেশ ভাগ এবং বিশেষতঃ স্বাধীন দেশ বাংলাদেশ গঠনের পর, পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যে আধুনিকতা চর্চায় নতুন করে কলকাতা কেন্দ্রিকতা প্রকট হচ্ছে। আমরা ঢাকার বা বারেন্দ্র এবং রাঢ় বাংলার পত্রপত্রিকার খবর ঢের কম পেতে শুরু করছি।2 কলকাতার তিরিশের দশকের আধুনিকতা চর্চা সত্তর পরবর্তী আধুনিকতা চর্চার মূল আদর্শ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আবার সত্তর দশকের পশ্চিমবঙ্গে বিশুদ্ধ বিপ্লব প্রচেষ্টা এবং তার মর্মান্তিক ব্যর্থতা নতুন করে হয় ছোটো পত্রিকার আন্দোলনে পরিণত হচ্ছে নয় তো বামপন্থার আভ্যন্তরীণ বিতর্কের পরিসর বা নকশাল আন্দোলনের প্রকৃত উত্তরসূরী হয়ে ওঠার প্রতিযোগিতায় নতুন কোন্দলের পরিসর হয়ে উঠছে। একটা কথা পরিষ্কার করে নেওয়া অবশ্য দরকার, স্বরের বহুত্বের প্রয়োজনীয়তার কথা, অসংখ্য পত্রপত্রিকা যে প্রত্যেকেই নিজের মত করে মানুষের কথা আরো আরো মানুষকে পৌঁছে দিচ্ছিল এবং দিচ্ছে এবং দেবে, এটা মেনে নিতে অসুবিধে নেই, তবে প্রকৃত নিরীক্ষা, অন্তত আখ্যানে বা শৈলীতে বা ভাষায় বা বিষয় বিস্তারে ক্লান্তিকর ভাবে কমে আসছিল, এইটেও পাঠক হিসেবে অনেকের অভিজ্ঞতা।3
বাংলা ও বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির ইতিহাস চর্চায় যেমন প্রাকআধুনিক সময়ের বিষয়ে একটা চর্চা দেখতে পাচ্ছি ভাষাবিদ বা ঐতিহাসিকদের কাজে, কিন্তু সাহিত্যপাঠের জগতে যেন দেখা যাচ্ছে, অন্তত পশ্চিম বঙ্গের পাঠ জগতে দেশভাগের অল্প আগে থেকে প্রায় সত্তর দশক পর্যন্ত সময়টা ধরলে,আগ্রহ মূলত ঊনবিংশশতকের দ্বিতীয় ভাগে বাঙালির তথাকথিত জাগরণের সময় কে কেন্দ্র করে। জাতীয়তাবাদের ইতিহাসের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে। কিন্তু ৭১এর পরে বিশেষ করে বাংলাদেশে ইতিহাসের চর্চাটা জাতীয়তাবাদ নির্মাণের পর্যায়ে গিয়ে থেমে আর যাচ্ছে না, বাঙালি মুসলমান বুদ্ধিজীবীরা তাঁদের বাঙালিত্বের ঐতিহ্য সন্ধানে আরো পিছোচ্ছেন, উপন্যাসের বিষয়ে উঠে আসছে প্রাকআধুনিক। একই সঙ্গে বাঙালী মুসলমানের আত্মানুসন্ধানে একটা ধর্মনিরপেক্ষ ধারা শক্তিশালী হচ্ছে, ধীরে ধীরে প্রাতিষ্ঠানিক আনুকুল্য ও পেতে শুরু করছে নতুন স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশে।
কিন্তু এপার বাঙলায় একই সময়ে,সবধরণের রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক শিবিরের কলকাতা কেন্দ্রগুলি থেকেই যেন ভাঙা দেশের বাঙালি রুচির অগ্রাধিকার ঠিক করে দেওয়ার উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে, অতি ক্লান্তিকর সেই প্রচেষ্টা। রাজনৈতিক ঘটনাবলী যা ঘটছে তাতে সেটা হয়তো অস্বাভাবিক নয়। বাংলার নাগরিক সংস্কৃতির কলকাতা কেন্দ্রিকতা এই কয়েকটা দশকে তৈরি হয় নি, কলকাতা ছাড়া বড় শহর গড়ে ওঠেনি বলেই তৈরি হয়েছে, এতে ব্যক্তিগত ভাবে কেউ দোষীও না, কিন্তু প্রকাশনা সংস্থার পক্ষ থেকে একাধারে রুচি ও বাজার তৈরি করার প্রকট প্রচেষ্টার উল্লেখ না করলে সত্তর ও আশির দশকে পাঠ অভিজ্ঞতার কিছুই বলা হয় না। শ্লীলতাকে চ্যালেঞ্জ জানানো লেখা, মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস, নারীবাদী উচ্চারণের বলিষ্ঠ লেখাগুলিও এই রুচি নির্মাণ তথা বাজার বিভাজন বা বিষয় প্রাধান্যর বিচিত্র অংকে, সমসাময়িক পশ্চিমের উল্টো পথে গিয়ে সমাজ পরিবর্তনে বামপন্থী রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলায় আগ্রহী লেখক গোষ্ঠী বা পত্রিকাগুলির সঙ্গে একাত্ম বোধ করতে পারছে না, অন্য পরিসর খুঁজে নিতে বাধ্য হচ্ছে, যেখানে ব্যক্তিচিন্তার মূল্য ধরে নেওয়া যাচ্ছে বেশি। সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানবিরোধীরা নারীবাদী বা অন্যান্য যৌনতার উচ্চারণকে অনেক পরে, অনেক দেরীতে নিজেদের লড়াইয়ে দোসর মনে করছেন।অত্যন্ত দুঃখজনক ভাবে ন্যারেটিভের ধরণধারণ সম্পর্কে নিরীক্ষাও এই ভাবেই একটি বাহুল্য বিতর্কে পরিণত হচ্ছে, কারণ সমাজ বা ব্যক্তিপ্রাধান্যের সাহিত্যাদর্শ বনাম বামপন্থী রাজনৈতিক সচেতনতা সঞ্জিত সাহিত্যাদর্শের শিবিরের দ্বন্দ্বে তার স্থান কম।
বলা বাহুল্য এই কাঠামোটির বাইরে তো বটেই, ভেতরেও, জীবন সম্পর্কে গভীর ভাবে আগ্রহী, নিরীক্ষায় সাহসী এবং ব্যাপক অংশের পাঠকের রুচি নির্মাণে অনাগ্রহী লেখককে খুঁজে পেতে পাঠককেও পরিশ্রম করতে হচ্ছে। বহু লেখক স্বল্প পঠিত কেন অপঠিতই থেকে যাচ্ছেন।
দুটি বিশেষ প্রবণতার জন্ম সম্ভবত এই সময়েই হচ্ছে। একটা হল, সৃষ্টিশীল মানুষেরা যাঁরা কলকাতার উচ্চ শিক্ষা আলোকিত জগত থেকে নিজেদের বিছিন্ন ভাবছেন, তাঁরা নগরীকে পুনরায় স্খলন এবং সম্ভাব্য স্বীকৃতির আকাঙ্খার সহাবস্থানের বিচিত্র সমন্বয়ের পরিসর হিসেবে দেখছেন। সে দেখার মধ্যে যদিও গ্রামীণ পরিবেশের সাংস্কৃতিক দৃষ্টি, বা জেলা টাউনের দৃষ্টি রয়েছে, কিম্বা শহতরতলী অঞ্চলগুলির ইত্যাদির দৃষ্টি, সেখানে নতুন করে উঠে আসছে রিফিউজি অভিজ্ঞতা।
অন্যদিকে জেলা শহরগুলির সংস্কৃতি চর্চা ক্রমশ পাঠকের জন্য পাগলপারা খোঁজে হয়ত প্রকাশনা এবং পরিবেশন ব্যবসার উপরে নির্ভরশীল হতে গিয়ে আশ্চর্যভাবে কলকাতার বুদ্ধিজীবিদের স্নেহ দৃষ্টির উপরে মুখাপেক্ষী হয়ে পড়ছেন। এবং শহুরে বুদ্ধিজীবিরাও, প্রায় পাঠকদের চাপেই, যতই নগরায়ণ বেশি হচ্ছে, তত নতুন করে বিশুদ্ধ বাঙালি প্রতিভার খোঁজে একবার শহরতলীর দিকে একবার জেলা শহরের দিকে সত্যকারের উৎসুক বা কৃপাদৃষ্টি রাখছেন এবং বাংলার নানা সামাজিক রাজনৈতিক পরিবর্তনকে যে দৃষ্টিতে দেখলে সুখানুভূতি হয় বা কল্পিত জাতি নির্মাণ প্রকল্পের সবচেয়ে কাছাকাছি যায়, সেই দৃষ্টির দ্বারা খানিকটা আক্রান্তই হচ্ছেন। সবটাই পরিহাসের বিষয় না, কল্পনা এবং নস্টালজিয়া এবং রাজনৈতিক শিবির গঠন সাংস্কৃতিক উৎপাদনের বিশেষ অংশ, কিন্তু সমস্যা হল স্থানীয় প্রতিভা খুঁজে পাওয়ার এই আকুতি এবং একই সঙ্গে বড় পাঠক বৃত্তে সংযুক্ত হওয়ার আশা মিলে গিয়ে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে, যে আশ্চর্য ভাবে প্রতিটি ছোটো জায়গার প্রতিভাবান লেখকের একটি করে বড় জায়গার তত-বড়-না হলেও-চলবে-গোছের নাগরিক পৃষ্ঠপোষক দরকার হয়ে পড়ছে। অথবা পরিবেশনের ব্যাপক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও নিজ-উদ্যোগে প্রকাশনার দায়িত্ব নিতে হচ্ছে।
দু দশক পরে, নিজ উদ্যোগে প্রকাশনার দায়িত্ব নেওয়ার সার্বিক কুণ্ঠা কেটে যাওয়া আজকের দিনে বসে এই বিষয়টার গুরুত্ব পুরোটা অনুধাবন করা কঠিন। একটা উদাহরণ দেই, বোলপুরের শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক মুক্তি মুখোপাধ্যায়ের বইয়ের ভূমিকা লিখতে গিয়ে কবি সতীন্দ্র ভৌমিক বীরভূমের সাহিত্য ধারাটি সম্পর্কে 'ক্ষীণতোয়া' শব্দটি ব্যবহার করছেন কিছুটা অনুকম্পার সুরে। মুক্তি মুখোপাধ্যায়ের লেখা একজন ব্যক্তি পাঠকের ভালো মন্দ দুইই লাগতে পারে আবার কোন কিছুই নাও লাগতে পারে, কিন্তু জেলার সাহিত্য চর্চাকে মহানগরের অনুকম্পার অপেক্ষা করতে হচ্ছে যেটা আজকের নব্বই দশক পরবর্তী বা বলা ভালো মহেন্দ্র সিং ধোনী পরবর্তী স্মল টাউনের হইহইয়ের যুগে অপ্রয়োজনীয় মনে হতেই পারে। এটার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ আশ্চর্য্য উচ্চতায় পৌঁছোনো অথচ মূলত প্রাদেশিক একটি ভাষার পাঠক হিসেবে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই, সারা পৃথিবীতেই সাংস্কৃতিক উৎপাদনে বিশেষত ব্যক্তিগত সামাজিক দাতা-গ্রহীতা সম্পর্ক দুঃখজনক ভাবে একটা বিরাট জায়গা নিয়ে আছে।
কিন্তু এর অন্য দিকটি আরেকটু বেশি দুঃখের, এবং পাঠক হিসেবে শান্তিনিকেতনে বড় হওয়া মানুষ হিসেবে অনুভব করি। সেটা হল স্থান প্রতিনিধিত্বের একটা বিচিত্র সামাজিক নির্মাণ হচ্ছে। হ্যাঁ, বিভূতিভুষণকে কেউ দক্ষিণবঙ্গের, বা তারাশংকরকে কেউ শুধু বীরভূমের, মাণিককে কেউ শুধু কলকাতার মানুষ ভাবছে না, ভাদুড়ি মহাশয়কে কেউ শুধু পশ্চিমী টাউনের মানুষ ভাবছে না, অন্তত এটুকু বোঝা যাচ্ছে এঁদের সৃষ্টির উচ্চতা স্থানকে ছাড়াচ্ছে, এমনকি বাংলাদেশের জন্মের পরেও স্থান এবং বিশুদ্ধতা নির্মাণচর্চা যখন নতুন করে বাড়ছে, তখনও ছাড়াচ্ছে, তবু এটা মেনে নিতে অসুবিধে হওয়ার কথা না, স্থানিক প্রতিনিধিত্বের ছোঁয়া ছাড়া সাংস্কৃতিক উৎপাদনকে যথেষ্ট প্রত্যয়ী মনে করা হচ্ছে না। অমিয়ভূষণ কিংবা দেবেশ রায় হয়ে যাচ্ছেন উত্তরবঙ্গের লেখক। পশ্চিমবঙ্গের পাঠক মানসে, মুক্তিযুদ্ধের পরে আবিষ্কৃত শওকত আলি, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শহিদুল জহির বাংলাদেশের বা ঢাকার লেখকই থেকে যাচ্ছেন। বিশ্ব সাহিত্যে সম্মানের দাবী রাখা এই লেখকদের দুর্ভাগ্য, আমরা তাঁদের অনুবাদ করি নি বা অনুবাদের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর প্রয়াস গ্রহণ করিনি।
আন্তর্জাতিক সাহিত্যেও এই একটা সমস্যা হচ্ছে, লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের জনপ্রিয়তায় ষাটের দশকের বিস্ফোরণের পরে, যেটা অবশ্য শুরু হয়েছিল পঞ্চাশের দশকে আফ্রিকার জাতীয়তাবাদী বা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পরে সেখানকার লেখলিখির জনপ্রিয়তা ইউরোপ তথা সারা বিশ্বে ছড়ানোর সময়, এবং তৃতীয় বিশ্বের সহমর্মিতার রাজনীতির ভাষ্য নতুন করে উঠে আসার পরে। ১৯৯০এর পর থেকেই আন্তর্জাতিক অনুবাদ সাহিত্যের জগতে কান পাতলেই একটা অনুযোগ শোনা যাচ্ছে, সবই মাকোন্দো না, লাতিন সাহিত্যেও বড় শহর আছে, শুধুই স্থান প্রতিনিধিত্ব না, অন্য বিষয়ও আছে। কিন্তু এটা বোঝা দরকার এটা একটা যাত্রা।
বোরহেস বলেছিলেন, আর্জেন্তিনার সংস্কৃতি চর্চা ইউরোপের অংশ, ফকনার প্রেমী লাতিন আমেরিকান লেখকরা বললেন, না আমাদের নিজস্ব ইতিহাস আছে, তার পরে আবার স্থানীয় প্রতিনিধিত্বের আর পাল্টা ইতিহাস নির্মাণের প্রচেষ্টার অংশ না থাকতে চাওয়া লেখক লেখিকারাও গুরুত্ব পেলেন। অনেকেই শুধু নাগরিক বর্তমান নিয়েই লিখলেন। প্রায়-গ্রাম ছোটো টাউন না, বড় শহর ফিরে এলো, কিন্তু ফিরে এলো নানা ধরণের অস্তিত্ত্বের সংকট নিয়ে এবং প্রবল বর্তমানে। এঁদের মধ্যে শুধুই নব্বই দশকীয় বিশ্বায়নের সমর্থক মানুষেরা ছিলেন তা না, বরঞ্চ সম্পূর্ণ উল্টো রাজনৈতিক অবস্থানের লেখক লেখিকারা গুরুত্ব পেতে শুরু করলেন, কিন্তু তাঁদের কলোনীর পাল্টা ইতিহাস রচনায় আগ্রহ কম ছিল, ব্যাপক ভাবে প্রসারিত অভিবাসনের অভিজ্ঞতা এঁদের অনেকেই, ভৌগোলিক দেশের বদলে ভাষাকে, তার স্থানিক বৈচিত্র্য সত্ত্বেও, নিজেদের প্রকৃত স্থান বলে ভাবতে শুরু করেন, এবং একে কষ্ট কল্পনা ভাবার কারণ নেই, রাজনীতি অর্থনীতি সাংস্কৃতির ইতিহাস অন্য খাতে এগোলে এই খোঁজও অন্য পথে এগোতো, সৃষ্টিশীল মানুষের লেখনী, সব সময়েই নতুন পরিসর খুঁজবে এটাই স্বাভাবিক।
এই বিষয়গুলি কিন্তু কোন প্রতিভাবান লেখক কোন প্রতিষ্ঠিত বিদগ্ধের স্নেহধন্য, কোন শিবিরের অন্তর্গত,সেই হিসেব নিকেশের থেকে বেশ খানিকটা বড়। আমার মত প্রায় এঁড়ে পাঠকের চোখেও এটা ধরা পড়ছে। অনুরোধ করছি, বীরভূম বর্ধমানের সত্তর, আশি, নব্বই দশকের যে সব লেখকদের পরিচয় করানোর চেষ্টা করছি তাঁদের এই ব্যক্তিগত সমীকরণের বাইরে গিয়ে দেখতে।
নব্বই দশকে এসে অফসেট প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার, কম্পিউটারে ডেস্কটপ পাবলিশিং এ কম্পোজ করে নেওয়ার নতুন পদ্ধতির ব্যাপক ব্যবহারের সুবিধা, সাধারণ ভাবে মহানগরী নির্ভরতা কমাচ্ছে। অবশ্যই এক ধরণের সীমিত অর্থে গণতন্ত্রীকরণের ধাপ। এই সময়টাতেই নগরায়ন নতুন পাঠক গোষ্ঠী তৈরি করছে, মুদ্রণ প্রযুক্তি অন্তত আগের থেকে বেশি ব্যাপ্তি পাচ্ছে। নব্বই দশক বা নতুন শতাব্দীর ইনটারনেট (বড় ইন্টারনেট প্ল্যাটফর্মের ব্যবসা, সরকার, মিলিটারি সকলের নানা আক্রমণ সত্ত্বেও, অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও) এই প্রক্রিয়াটার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে, অতি সঙ্ক্ষেপে মনে করি, পরবর্তী প্রজন্মের ছোটো শহরের লেখক লেখিকাদের আশা করা যায় শুধু স্থানীয় প্রতিনিধিত্বের দায় নিয়ে থাকতে হবে না। এবং স্বাধীন ভাবে বিষয় বা ভাবনা চয়ন করতে পারবেন। অন্যদিকে যাঁরা মাটির সঙ্গে টান অনুভব করবেন, তাঁরাও নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী লেখালিখি করতে পারবেন। যদিও মতাদর্শের শিবির বিভাজন থাকবে, তবে আশা করা যায় পাঠকের রুচি নির্মাণে তাঁরা কম সচেষ্ট হবেন। অন্যান্য সচেতনতা তৈরি হবে। পাঠের পরিসর বড় শহরের পরিবেশন ইত্যাদির কারণে ব্যবসার জটিল অঙ্কের উপরে নির্ভর করবে না। যদি না পারেন, যদি সাংস্কৃতিক মূল খোঁজার, বিশুদ্ধতার উত্তেজনা, সমসাময়িকের যন্ত্রণা অনুভবে বাধা হয়ে দাঁড়ায় বলা যায় তাহলে আমাদের দেশের গণতন্ত্র, রাজনৈতিক ভাবেও, বড় পরীক্ষার মুখে পড়বে। কিন্তু এটা বোঝা দরকার, অসীম চট্টরাজ এবং তাঁর প্রজন্মের জেলার লেখকেরা এই যুগসন্ধির সমসাময়িক লেখক।আশির দশক, যে সময়টাকে জুড়ে অসীম কৈশোর থেকে যৌবনে আসছেন, সে সময়টায় পশ্চিম বাংলায় কোন ধরণের শান্তিপর্বের শৈত্য তো নয়ই, সাধারণ জীবনের উষ্ণতা এবং বিশেষত আপাত দৃষ্টিতে ছোটো স্থানীয় পরাজয়ের ঐতিহাসিকতা খুঁজে পেতে তাঁর অন্তত অসুবিধে হয় নি। তাঁকে পরাজিতের হতাশা, বৃন্দগান, রসপূর্ণ অতিক্রম প্রচেষ্টা সবই জীবনের মধ্যে থেকে খুঁজে পেতে সমস্যায় পড়তে হয় নি।
শান্তিনিকেতনে এবং শান্তিনিকেতন বিষয়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে সাহিত্যচর্চা
প্রাতিষ্ঠানিক আনুকুল্যের বাইরের সংস্কৃতিচর্চার ঐতিহ্যটা যদি ধরা যায়, এবং তার দর্পণ হিসেবে শান্তিনিকেতনের বিশিষ্ট স্মৃতিচারণগুলিকে যদি পড়া যায়, একটা আশ্চর্য্য বিষয় পরিলক্ষিত হচ্ছে।4
গত শতাব্দীর তিরিশ, চল্লিশ, পঞ্চাশ, ষাটের দশক পর্যন্ত শান্তিনিকেতনের সঙ্গে কোন কোন না ভাবে জড়িত থাকা মানুষ যখন স্মৃতিচারণ করছেন, তখন মূলতঃ যেটা পাচ্ছি রবীন্দ্রসান্নিধ্যের কথা অথবা মূলতঃ শিক্ষা চিন্তার ফল হিসেবে একটা আশ্রমিক দৈনন্দিনের জীবনযাত্রার বৈশিষ্টের খবর, দুর্লভ হলেও কখনো কখনো রবীন্দ্র শিক্ষা চিন্তার দার্শনিক দিকটিকে ধরার প্রচেষ্টা, অথবা গুণী মানুষের অবদানের কথা, অথবা উৎসব উদ্যাপনের কথা। অল্প স্বল্প বিবাদী স্মৃতি যা পাচ্ছি অনেকটাই ১৯৫১ থেকে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঘোষিত হওয়ার পরে, ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিক শিক্ষার সংঘাত হিসেবে, যেখানে ঐতিহ্য আর যাই হোক কেন্দ্রীয় তহবিল তথা কর্মী সুরক্ষা নিশ্চিত করছে না, কিন্তু আবার অধ্যাপক, অনধ্যাপক কর্মীদের মধ্যে একটা বিভাজন তীব্রতর করছে।5
৭০এর দশকের একেবারে গোড়াটা কল্পিত স্বর্ণযুগের শেষ উল্লেখ, এর পরে অনেকটাই কী হারালাম ভাব এবং একটা ক্রম অধঃপতনের গল্প, প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা প্রসঙ্গে বিরক্তির বা শ্লেষের প্রকাশ, এমনকি সুষ্ঠু পরিচালনা সম্ভব কিনা তাই নিয়ে নানা কারণে সন্দেহ প্রকাশ।
অথচ, যদি শান্তিনিকেতনের বাসিন্দা বা ছাত্র ছাত্রী অধ্যাপকদের লেখালিখির বা পত্রিকা প্রকাশের যতটুকু নিদর্শন পাওয়া যাচ্ছে, তার মধ্যে আমরা ৭০এর দশকের পরে, বিশেষতঃ আশি বা নব্বইএর দশকে এসে, অন্তত কথা সাহিত্যের ক্ষেত্রে যার মূল দিকটা হল নিজস্বতা, নিজের ভাষা নিজের আঙ্গিক খোঁজার একটা প্রচেষ্টা এবং সর্বোপরি, স্থান হিসেবে দক্ষিণ বীরভুমের এই অঞ্চলটিকে বিষয়ের অন্তর্গত করার একটা ইচ্ছা। অথচ ছবি আঁকা বা মুর্তি গড়ার ক্ষেত্রে এই প্রচেষ্টা আমরা এর অনেক আগেই দেখেছি, হয়তো দৃশ্যমান বাস্তব কোন একটা স্তরে অনতিক্রম্য ছিল। খুব বিশদে না গিয়েও বলা যায়, অসীম চট্টরাজ এই পর্যায়েরই লেখক, যে পর্যায়ে শান্তিনিকেতন বোলপুর অঞ্চলের একটা ব্যাপক নগরায়ন শুরু হচ্ছে, সেটাকে কিভাবে নেওয়া হবে সেটা অন্য প্রসঙ্গ, কিন্তু নগরায়নকে অস্বীকার করা যাচ্ছে না, ক্যাম্পাস বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থানিক বিচ্ছিন্নতাহেতু স্বাতন্ত্র্যটি আর বড় বিষয় থাকছে না। স্থান হিসেবে শান্তিনিকেতন তাঁর কাহিনী বা এস্থেটিক নির্মাণ প্রচেষ্টার কেন্দ্রে না থাকলেও, কাছাকাছি অঞ্চলের মানুষ হিসেবে, রবীন্দ্রনাথের এক ধরণের উত্তরাধিকার অনুভব করছেন প্রবন্ধগুলিতে।
এই রচনায় খুব বিশদের পরিসর নেই, কিন্তু মনে রাখা দরকার, বীরভূম জেলার বুদ্ধিজীবিরা কখনোই শান্তিনিকেতনকে তাঁদের চর্চাকেন্দ্র হিসেবে খুব একটা পান নি, এবং শান্তিনিকেতন ও সংস্কৃতি বা বিদ্যাচর্চার অনেক বিষয়ে নানা সময়ে নানা মাপকাঠি অনুযায়ী উৎকর্ষে পৌঁছলেও, বীরভূম বা অঞ্চলের মানুষের জীবনকে কখনো কখনো বিষয় করলেও, চর্চার কেন্দ্রে আনেন নি, কোনটাই অপরাধ না, হয়তো স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় এইটেই ভবিতব্য ছিল, কিন্তু এই ঘটমান বিষয়টার একটা ছাপ সাহিত্য চর্চায় থেকে যাচ্ছে। একটা সহজ উদাহরণ দিয়ে বলা যেতে পারে, এটা সম্ভবত ধরে নেওয়া খুব অন্যায় হবে না, অশোক সেন প্রতিষ্ঠিত রাঢ়ভূমি পত্রিকার প্রকাশ, এবং আশির দশকে শুচিব্রত সেন, সৌর বসু, অলক রায়দের উদ্যোগে তার নবজন্ম শান্তিনিকেতনে ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রে একটা জলবিভাজিকা, নাটকের ক্ষেত্রে যেমন সুমন্ত্র সেনগুপ্ত, সুজিত ঘোষ, রূপালি মিত্র, বিজয় মিশ্র, দেবাংশু মজুমদারদের উদ্যোগে করা বাদল সরকারের 'মিছিল' নাটক। সম্ভবত ১৯৮২ সালে।6 শান্তিনিকেতনের 'রাঢ়ভূমি' পত্রিকা প্রকাশের পরের শান্তিনিকেতনের বিদ্যাচর্চার সামাজিক দায়বদ্ধতার যে নাটকীয় পরিবর্তন আশা করা যেত, সেটা সব সময়ে না হলেও, এটাও ঘটনা, প্রতিষ্ঠানের বিছিন্নতাকে প্রশ্ন করে বিতর্ক উঠছে সত্তর দশকের পরেই, আবার স্থানীয় বিষয়ে অতি সম্পৃক্তির সমস্যাও তথাকথিত প্রাতিষ্ঠানিক উৎকর্ষের অবনমনের কারণ হিসেবে মনে করছেন অনেকে, কিন্তু উল্লেখ করার মত বিষয় হল, আশির দশকের পরে, নগরায়ণ এতটাই ব্যাপক হচ্ছে, সংস্কৃতি চর্চার স্বাভাবিক গতিতেই, শিক্ষাক্রমের বাইরে চর্চার ভাষার এবং অবশ্যই বিষয়ের একটা খোঁজ শুরু হচ্ছে। সেটা কখনো শান্তিনিকেতনকে তার স্থানিক এবং সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য থেকে কিছুটা বের করে নিয়ে এসে নাগরিক পরিসর হিসেবে দেখছে7, কখনো বোলপুর শহর বীরভূম আশেপাশের গ্রামাঞ্চলকে স্পর্শ কখনো করছে, কখনো করছে না, কখনো কলকাতা মহানগরের সঙ্গে একাত্মীভূত সংস্কৃতি চর্চা হচ্ছে, কিন্তু নিজস্বতার খোঁজ ব্যাপকতর হচ্ছে। আমি এই প্রবন্ধে যেটা প্রস্তাব করছি সেটা হল, অসীম চট্টরাজের লেখালিখি, এমনকি একেবারে হালের বিক্রম এবং বিক্রম সিং পরবর্তী সময়ের অর্ণব, সাহানা বাজপেয়ীদের সঙ্গীত চর্চা বা রচনা এই প্রেক্ষিতে দেখা সম্ভব, যদিও মূল্যায়নের সময় হয়তো আসেনি, সকলেই বয়সে একেবারে তরুণ, শিল্পীরা নিজেরাও প্রয়োজন বা স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব নাই করতে পারেন।
প্রায় ১৯৯৫এ এসে, মৃত্যুর অল্প আগে, কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় বিশ্বভারতীতে কিছুদিন অতিথি-অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেছিলেন, যতদূর মনে পড়ছে, কথা প্রসঙ্গে কোন সংবাদ মাধ্যমে বলেছিলেন, শান্তিনিকেতনের 'শান্তি', সংঘাতহীনতা, সৃষ্টিশীলতার একটা অন্তরায় (যতদূর মনে পড়ছে, উদ্ধৃতিযোগ্য ভাবে নয়), শান্তিনিকেতনের পাঠক হিসেবে বলতে পারি, সংঘাতের অভাব যে নেই, এটা ক্যাম্পাসের ভেতরে আরো অন্তত কুড়ি পঁচিশ বছর আগে থেকে টের পাওয়া যাচ্ছিল, তবে প্রবন্ধ রচনায়, বিশেষতঃ সাহিত্যিকা এবং রাঢ়্ভূমি পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধে, নানা রঙের ছাত্র বা কর্মী বা কর্মহীন যুবকদের আন্দোলনে, সিলেবাসের বাইরের নারীবাদ চর্চায়, আদিবাসী অসন্তোষে বোঝা যাচ্ছিল, কিন্তু নব্বইএর দশকে এসেই কথা সাহিত্যে প্রকাশ হতে আরম্ভ করে।
উল্টো দিকে এও প্রস্তাব করছি, বীরভূমের যে সাহিত্য চর্চা, তাতে তারাশংকর পরবর্তী সময়ে, একাধারে আধুনিকতার কিংবা আধুনিকতার সঙ্গে সংঘাতের প্রতিনিধিত্ব করতে হত যে সব চরিত্রগুলিকে, গ্রামের মাস্টার মশাই, গ্রামীণ শিক্ষিত যুবা, সরকারী কর্মচারী ইত্যাদি মানুষদের, সেই আধুনিকতা না হোক সমসাময়িক নাগরিকতার চিহ্নের সীমানা কিন্তু হঠাৎ ব্যাপক ছড়িয়ে যাচ্ছে, নব্বইয়ের দশকে ব্যাপক নগরায়নের সঙ্গে সঙ্গে। সমসাময়িক উল্লেখযোগ্য লেখিকা অহনা বিশ্বাসের পক্ষে ট্রেনের নিত্য যাত্রীদের নিয়ে দীর্ঘ সংলাপ রচনা করা খুব কঠিন থাকছেনা, যেখানে সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে ‘পরিবার’বা ‘সমাজ’ হয় অর্থহীন হচ্ছে বা নব্য অর্থ অর্জন করছে, এই শব্দ দুটি ও তৎসংযুক্ত পরিসরগুলি তাদের সযত্ন লালিত রক্ষণশীল অর্থ হারাতে বাধ্য হচ্ছে, যেটা হয়তো ইউরোপে উনবিংশ শতকেই সম্ভব হয়েছে, কলকাতায় সম্ভব হয়েছে তিরিশের দশকের পরে। নগরায়ণ আর কৌতুহলোদ্দীপক থাকছেনা, বা নগর শুধু যা কিছু স্খলিত তার বাসা থাকছে না, বীরভূমেও জীবনের মত ব্যাপক হচ্ছে প্রায়, তাতে উৎসাহিত অনেকেই হচ্ছেন না, কিন্তু নগরায়ণের অভিঘাত বা প্রতিক্রিয়া বা চিন্তাশীল বর্জন কোনটাই বিষয় হিসেবে আর স্বেচ্ছা নির্বাচনের জায়গায় থাকছে না।
খোঁজ
খুব ভাবনা চিন্তা করে আমি অসীম চট্টরাজের নাটক, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, কবিতা ইত্যাদি পড়তে শুরু করিনি। বইয়ের দোকানে আবিষ্কারের প্রশ্নও ছিলনা। বলা যেতে পারে আমি অসীম চট্টরাজের লেখার সঙ্গে পরিচিত হই, বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন অগ্রজ প্রতিম সমসাময়িকের হয়ে ওঠা লেখার স্বাদ নিতে নিতে, এবং স্বাভাবিক ভাবেই অনেকটাই ঘটনাচক্রে। পাঠকদের কাছে, যে লেখা সব সময়েই 'ওয়ার্ক ইন প্রোগ্রেস', তার একটা আলাদা আকর্ষণ আছে। সকালের রিহার্সালে পরিলক্ষিত একটা অসংগতির কারণে বিকেলের রিহার্সালে যে নাটক বদলে যেতেই পারে, সেই নাটক একেবারে আমাদের জীবনের কথা না বললেও আগ্রহী অনেককেই একেবারে মৃত সৈনিক করে নি। নাটকের একটা বহুত্বের নেশা, প্রায় এখনকার ইনটারনেট মিডিয়ার মত আমাদের অংশগ্রহণের আস্বাদ দিচ্ছিল, অথচ অবয়বহীনতার আড়াল রাখছিল না।
আরেকটা বিশেষ কারণে আমাকে অসীমের লেখা আমাকে একটু বেশিই স্পর্শ করত।আমরা অনেকেই বেশ কয়েকটা প্রজন্ম জুড়ে যাঁরা বিশ্বভারতীতে কর্মসূত্রে আসা শান্তিনিকেতনের বাসিন্দা হয়ে ওঠা মানুষের পরিবারের লোক ছিলাম, তাদের একটা পরিচয়ের বা বলা ভালো অভিজ্ঞতার প্রত্যয়যোগ্যতার সংকট তাড়া করত, জানি না শ্রীনিকেতনে শৈশব কাটানোর অভিজ্ঞতা এই ভাবনাকে তীব্রতর করেছিল কিনা। অন্তত আমাকে করত। বিশেষত একটু আধটু এটাওটা পড়ার পশ্চাৎপক্কতায় আক্রান্ত হওয়ার পরে। বহিরাগত এবং স্থানীয় পরিচিতির একটা দ্বন্দ্ব আমাদের অনেক কেই ব্যতিব্যস্ত করেছিল। সবটা সে বয়সে পরিষ্কার করে ভাবার বা বলার মত জায়গা না থাকলেও, এটা বুঝতাম, অভিজ্ঞতার সীমানা, লিখনে তো বটেই, পাঠে একটা বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, যদিও সবটাই যে অতিক্রম করতে ইচ্ছে করছে তা না।বুঝতে পারতাম, কলিকাতাকেন্দ্রিক বাঙালি জাতিনির্মাণ প্রকল্প, আধুনিকতা চর্চা, বা নগরের রাজপথে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক প্রজ্ঞা সবটাই আমায় আগ্রহী করছে, উত্তেজিত করছে, কিন্তু, বৌদ্ধিক ঐতিহ্যের প্রতিমা থেকে যাচ্ছে মাত্র, অংশগ্রহণের সম্ভাবনা তৈরি করছে না। অন্যদিকে শান্তিনিকেতনের বিচ্ছিন্নতা আমায় কিছুটা ক্লান্ত করত, পুনশ্চ বা খেয়া-র কবিতা যতটা ছুঁয়ে যাচ্ছে, অধ্যাপিকা কৃষ্ণা হাজরার অসামান্য ক্লাসগুলির পরে অন্তত রক্তকরবী বা মুক্তধারা (বা অধ্যাপিকা সুতপা ভট্টাচার্য্যের অরূপরতন বা রাজা বিষয়ে নেওয়া বিশেষ ক্লাসের স্মৃতি ও ভোলার না।)যতটা আত্মোপলব্ধিতে পাচ্ছি, রবীন্দ্র রচনার অনেকাংশেই সেটা ঘটছে না, মায়ার খেলার অভিনয়, বসন্ত আবৃত্তি ক্লান্ত করছে। জীবনানন্দের বাংলা যে আমাদের দেখা বাংলা নয় বুঝতে পারছি। বিভূতিভুষণের অরণ্য টানছে, নেশা চড়াচ্ছে খানিকটা, কিন্তু অন্য লেখাগুলিতে দক্ষিণ বঙ্গের ঐ আশ্চর্য্য সবুজ অচেনা ঠেকছে। যদিও হঠাৎ হঠাৎ চোখ খুলে যেদিন দেখতাম, ক্লাসে শেখা গানের বসন্ত, বর্ষা, শরৎ, গ্রীষ্ম, কোন বিচিত্র যাদুবলে দিকে দিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে, সেদিন একটা স্বেচ্ছা আরোপিত সংশয়ে মন ভরে যেত, বুঝতে চাইতাম না গানের ক্লাশ না প্রকৃতি সত্য, কে কার অংশ। তারাশংকর পড়তে গিয়ে ঘটনাক্রমে প্রাকৃতিক নৈকট্যের কারণ্যে অন্তত এটুকু মনে হচ্ছে, সাইকেলে করে যেতে যেতে গ্রাম দেখছি। অথচ একই সঙ্গে নিজদেশে অভিবাসনের অভিজ্ঞতাটাও তীব্র হত। যদিও বুঝতে পারতাম, সাঁওতাল বিদ্রোহে উল্লেখ রাখা বীরভূম, রাজনগরের বাংলাপ্রেমী আফগান রাজাদের ইতিহাস থাকা বীরভূম, সামাজিক মতাদর্শের ইতিহাসে মোটামুটি উচ্চবর্ণের বুদ্ধিজীবিদের দুশ্চিন্তায় ভারাক্রান্ত। মাতৃশক্তি পূজার ঐতিহ্যের ইতিহাসের বীরভুমে সনাতন ধর্ম আচরণ নির্দেশিত পথের বাইরে বিচরণের ঐতিহ্য থাকলেও, পারিবারিক আরাধ্য দেবতার প্রভাব বা বর্ণ নির্দেশ, জনবসতি বিন্যাসেও রয়েছে।8 নতুন প্রজন্মের নিরীক্ষার দরকার ছিল অনুভব করছিলাম, কিন্তু যা হচ্ছিল তার খবর রাখিনি।। শান্তিনিকেতনে ছাত্র থাকাকালীন, লজ্জার সঙ্গে স্বীকার করি, তারাশংকরের পর থেকে বীরভূম জেলায় (শান্তিনিকেতনের বাইরে) রচিত, উল্লেখযোগ্য নিরীক্ষাগুলির খবর আমরা রাখতাম না।
ঐ তখনো প্রাচীরহীন আকাদেমিক সেটলার কলোনি কমিউনিটিতে, বিশেষত সত্তরের দশকে, আমাদেরকে স্থানীয় মানুষের পক্ষে বাবুদের পোষা বিলিতি কুকুর ছানা ছাড়া আর কিছু হিসেবে দেখা একটু অসম্ভবই ছিল, যদিও প্রাচুর্য দুরস্থান, ন্যূনতম সাচ্ছল্যও কর্মক্ষেত্রে অভিভাবকের স্তর বিশেষে বিন্যস্ত ছিল। একটা কৃষি প্রধান জেলা, বা সেচের জল সর্বত্র সবসময় না পৌঁছনোর ফলে, শ্যালো পাম্পের প্রচলন হওয়ার আগে, অধিক ফলনশীল ধানের বীজ বহুল প্রচলন হওয়ার আগে, বছরে এক বারের বেশি চাষ না হওয়ার সময়ে আমাদের পরিবারের বড়রাই সম্ভবত গোটা জেলায় একমাত্র সরকারী সামাজিক সুরক্ষার অধিকারে বঞ্চিত ছিলেন না, এক কামরার কোয়ার্টারেও বিদ্যুত ছিল, শান্তিনিকেতন বা শ্রীনিকেতন বিদ্যালয়ে প্রায় নিখরচায় উচ্চমানের শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল, গাছের তলায় বা প্রাংগনের ক্লাস ব্রাহ্মবিদ্যালয়ের আদর্শে অনুপ্রাণিত হতে পেরেছিল, স্কুল বাড়িতে পরিসরের অভাবে বা পরিচর্যার অভাবে সরকারী বিদ্যালয়ে দেওয়াল ভেঙ্গে পড়ার ভয়ে নয়।
আমরা বুঝতাম আমাদের পরিচিত সংস্কৃতির ধারা নাগরিক হলেও সমসাময়িক মহানাগরিক না। আবার এটাও বুঝতাম যে লোক-সংস্কৃতির ভাষাকেই নিজের ভাষা করে তোলার মত যে পল্লীজীবনের সম্পৃক্তি প্রয়োজন তাও দূরাগত। সাঁওতাল বা বাগ্দী পল্লীতে যাতায়াত ছিল না তা না, কিন্তু সেখানে আমাদের বহিরাগত পরিচয় অনতিক্রম্য ছিল। শান্তিনিকেতনেও যে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতি চর্চার মধ্যেও যে ভারতের নানা প্রদেশের সংস্কৃতি এসে মিশছিল, তার অভিঘাতকে ভাষায় অনুবাদ করে কথা সাহিত্যে ব্যবহার করার মত বয়স আমাদের অনেকের তখনো হয় নি, তবে সেরকম গভীর প্রচেষ্টা কলাভবনের বাইরে তেমন করে হয়তো হয় নি। হিন্দী, মারাঠি এবং ওড়িয়া ভাষা চর্চার কেন্দ্রগুলি এর ব্যতিক্রম, তবে কতটা উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম সেটা বিশদে পর্যালোচনার পরিসর আপাতত নেই।
আবার অন্যদিকে আবাসিক ছাত্র ছাত্রীদের মত ব্রাহ্ম বিদ্যালয় বা আশ্রমিক দৈনন্দিনের চর্যা বা চর্চা কোনটাই সম্ভব ছিল না, বিদ্যালয় আমাদের পরিচিতি দিলেও, মুক্ত চিন্তা বা আত্মপ্রকাশের প্রাথমিক শিক্ষা দিলেও, বিদ্যালয় এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জীবন, আত্মপরিচয় সন্ধান যাত্রার প্রারম্ভমাত্র ছিল। অন্যদিকে শিক্ষিত বাঙাল পরিবার, দেশভাগের অল্প আগেই চাকুরি সূত্রে দেশের নানা ছড়িয়ে পড়ার ফলে, উদবাস্তু না হলেও স্থানচ্যুত ছিলেন, তারা অন্তত তখনও আঞ্চলিক হয়ে ওঠেন নি, কর্মসুত্রে শান্তিনিকেতনবাসী হলেও, নিবাস নির্দিষ্ট ছিলনা। তো আমাদের অনেকেরই স্থান, অঞ্চল এবং প্রকৃতপক্ষে পরিসর আবিষ্কারের একটা নেশা ছিল।
অসীমের লেখালিখি, অন্তত আমার পাঠক ভুমিকায়, এই খোঁজে একাধারে সঙ্গী এবং অন্যতম প্রাপ্তি। খুব স্বাভাবিক ভাবেই, ব্যক্তিগত পরিচয় যতই দীর্ঘ হোক, প্রগাঢ় হোক, লেখকের পক্ষে তার হদিস রাখা সম্ভব ছিল না।
নাট্য সংগঠন
"তুমি তো জানো-ই আমি মঞ্চ ভাঙি, মঞ্চ সাজাই,
যতোটা আঘাত করো তারও চেয়ে সুসংবদ্ধ তেজে
তুমি তো জানো-ই আমি আলো ঢালি, অন্ধকার ও ঢালি
কখনো নেপথ্যে থেকে, কখনো বা অভিনেতা সেজে।
তুমি তো জানো-ই ঐ নীল পর্দা – অপসরণিকা
সরে যায়, আর তাই দৃশ্য দেখি দৃশ্য ঢেকে যায়।
তুমি তো জানোই আমি মঞ্চ খুলি, মঞ্চ ঢেকে রাখি
কখনো সংলাপে, আর কখনো বা বিনা বাক্যব্যয়।
কথা বলা যার কাজ, তাকে নিয়ে এত কেন কথা
কেনো এতো কূটাভাস যে কিনা ভাষায় সিদ্ধরতি?
সংলাপে যে নীরব তাকে নিয়ে এত শব্দ কেন?
কেন এতো কমা ড্যাস সেমিকোলোন জিজ্ঞাসা যতি?
কখনো বা গাঢ়, কখনো বা গাঢ়তর ফিকে,
তুমি তো জানো-ই, এ আমার জন্মদোষ - একটু নাটুকে।"
('নাটক না লিখেও দায়বদ্ধ থাকা যায়' - ২০০৪)
নিজেকে নিয়ে এবং নিজের লেখা নাটক নিয়ে নির্মম রসিকতা এবং সমালোচনায় দড় অসীমের নাটকের বিষয়ে আলোচনার সবচেয়ে বড় বিপদ অসীমের সম্ভাব্য বদ রসিকতায় ভরা প্রতিক্রিয়া। বিশেষতঃ যিনি নিজেই বলছেন, দায়বদ্ধ থাকতে টাকতে নয়, একেবারে শুধু শুধু প্রায় বিনা কারণে বন্ধুদের নাটকের দলের দাবী মেটাতেই নাটক লেখার সুত্রপাত, তাঁকে নিয়ে আলোচনার বিপদ রয়েছে। যিনি বার বার আলাপ আলোচনায় এবং লিখিত বক্তব্যে প্রায়ই জানান, শিল্প বা সৃষ্টির থেকে জীবন অনেক অনেক বড়, তাঁর কাজ নিয়ে তত্ত্বায়ন, সময়ের নিরিখে দেখার প্রচেষ্টা বা সাধারণ আলোচনাও মুশকিল।
অসীম চট্টরাজ শুধু নাট্যকার নন, নাট্যকর্মীও, ছোট দলের থিয়েটারে যেরকমটি হয়েই থাকে, একাধারে নাট্যকার, অভিনেতা, কখনো কখনো পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত, কখনো মহড়া বা প্রচার সংগঠক। নাটক লেখা থেকে আমন্ত্রণপত্র সজ্জা ও পরিকল্পনা, হাতে হাতে পোস্টার বিতরণ সবই করেছেন একটা সময়ে। বিশেষত আশির দশক থেকে নব্বই দশের শুরু পর্যন্ত নিজের ছাত্রজীবনে আমি যে সময়ে তাঁর কাজের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। শান্তিনিকেতনের সাহিত্যিকা নাট্যগোষ্ঠী বা নির্দিষ্ট নাট্যগোষ্ঠীর বাইরে শান্তিনিকেতনের বাসিন্দা ও স্কুলবিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা এবং বীরভূমের নানা জায়গার নানা গোষ্ঠী তাঁর নাটক বেছে নিয়েছে প্রযোজনার জন্য। বহুরূপী দল তাঁর লেখা 'ধর্মপুত্র' অভিনয় করেছেন। 'গ্রাস', 'অন্দরমহল', 'বিশ্বনাথের আজবকল', 'আস্থিত' ইত্যাদি নাটকগুলির প্রথম প্রযোজনা আমি দেখেছি সবই আশির দশকের শেষে বা নব্বইয়ের একেবারে শুরুতে।
এই লেখাটির প্রয়োজনেই, অসীম চট্টরাজের সঙ্গে যে কয়েকটি কথোপকথন আমি তার অনুমতি নিয়েই রেকর্ড করে নিই, তাতেই পরিষ্কার হয়, অসীম নাটক লিখতে শুরু করেন বিশ্বভারতীতে স্নাতোকোত্তর ছাত্র থাকাকালীন, মূলত সহপাঠী বন্ধু,নাট্যপরিচালক অগ্নিমিত্র ঘোষের উৎসাহে। আমার ধারণা ভ্রান্ত ছিল যে এই রচনার শুরু আরো অনেক আগে, দুর্গাপুরে। অগ্নিমিত্র ঘোষ এবং কিছুটা পরবর্তীতে নাট্যসংগঠক দেবাংশু মজুদার এবং নীলাঞ্জনা সেনগুপ্তদের সঙ্গে নাটক 'নামাতে' গিয়ে, মূলতঃ সাহিত্যিকা সাংস্কৃতিক সংগঠনের নাট্যদলের হয়ে কাজ করতে গিয়ে, অথবা বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগ বা অন্যান্য বিভাগের ছাত্র ছাত্রীদের দিয়ে নাটক করাতে গিয়ে। শান্তিনিকেতনের প্রতিষ্ঠানের সরাসরি আনুকূল্যের বাইরে সংস্কৃতিচর্চা প্রসঙ্গে নানা প্রবন্ধে, একথা অসীম নিজেও বলছেন। আমাদের অনেকেরই স্মৃতিতে, অনেকটাই, অগ্নিমিত্রর পরিচালনা, দেবাংশু, নীলাঞ্জনা, মধুমিতা, বিশ্বপতিদের অভিনয় ছাড়া অসীমের নাটকের প্রযোজনার অবয়বটির পরিপূর্ণতা পাওয়ার যো নেই।
মূলতঃ তিন ধরণের নাটক লিখছেন অসীম। প্রথমত সমসাময়িক সম্পর্কে আধুনিক প্রসেনিয়ামের ধারায়। দ্বিতীয়তঃ গান দিয়ে ভরা লোক-আঙ্গিকের নাটক, লিখছেন ছোটোদের দিয়ে নাটক করানোর জন্য এবং শেষে মহাভারতের বিষয়গুলি নিয়ে লিখছেন কিছু নাটক। প্রথম দুটি ধারায় রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করার জন্যও নাটকও লিখছেন। শান্তিনিকেতনে এবং বীরভূমে মঞ্চের অসুবিধে থাকায় কোথাও কোথাও অনেক নাটকই আবার পথনটিকা হিসেবে বা মঞ্চ থেকে নেমে এসে সামনের চাতালে অভিনীত হচ্ছে, পরিসর সংকুলানের উদ্দেশ্যে।
'অন্দরমহল' নাটকটি আমি প্রথম পড়ি এবং দেখি ৮০র দশকের শেষে বা নব্বইএর দশকের একেবারে শুরুতে। অসীম নিজেই বলছেন একটি প্রবন্ধে, এর অনেক দুর্বলতা ঢেকে দিচ্ছেন পরিচালক অগ্নিমিত্র। আমাকে যেটা কিছুটা নাড়া দেয়, সেটা হল, একক কথনের ব্যবহার, চরিত্রের ধর্ম সঙ্কট উপস্থাপিত করতে বার বার ব্যবহার করেছেন এই একক কথন, কিন্তু হয়তো সেদিনের অভিনেতার অভিনয়ের গুণ এবং কাব্যিক ভাষা আমাকে এই নাটকটি মনে রাখতে বাধ্য করে, বিষয় ছিল যে মধ্যবিত্ত ঘরের বিপ্লবী ছেলের ক্রোধ তো অনেক হলো, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেউই তাকে বিশ্বাস করতে পারছে না। যার জন্য সে মনে করছে বৈপ্লবিক জীবন যাপন করবে, সেই কাজের লোকটি পর্যন্ত তাকে ভরসা করার মত কিছু পাচ্ছে না। ভবিতব্যের কাছে প্রবল আকুতি করে উঠছে যেন সে, সমাজের অনাচার, অবিচার প্রবল ক্রোধে ভেঙ্গে ফেলতে উদ্যত হয়েও সে সেই সমাজের কাছেই যেন আকুতি করছে, তাকে বিশ্বাস করার অনুরোধ করছে।
"বাবাঃ কে বোঝাবে ওকে? পাগলের কথা কে বিশ্বাস করবে?
অনূপঃ মন্টু বিশ্বাস করবে - মন্টু। ও যে আমার মত রাত জেগে কাঁদে। আমার মত ওকেও তোমরা ভয় পাও। পাও না ভয়?
(কোন উত্তর না দিয়ে বাবা মায়ের প্রস্থান)
পালাও, পালাও, পালানোর তো কোন ছলের অভাব হয় না। ভালবেসে পালাও, ঘৃণা করে পালাও। বিশ্বাস করে পালাও, অবিশ্বাস করে পালাও-আনন্দ করে পালাও-দুঃখ করে পালাও- শুধু সত্যের মুখোমুখি হয়ো না কোনদিন। পারবে - পালাতে পারবে তোমরা। তোমরা তো দেখনি কোনদিন গলির ভেতরে পড়ে থাকা যুবকের লাশ। তোমরা তো দেখনি কোনদিন দুর্ভিক্ষে মৃত মানুষ। পারবে - তোমরা পারবে। ভুল ত করেছি আমি। যে দেয়াল ভাঙার কথা - প্রশ্ন করছি সেই দেয়ালকে। ছায়া মানুষেরা আর কিই বা উত্তর দেবে? নাকি কথাগুলো বিশ্বাসযোগ্য নয়? পরপর তিনটেগুলি - সে কি আকাশের দিকে তাক করে? স্বপ্ন? অনাহারে মৃত্যু ত মিথ্যে নয়। মিথ্যে নয় যুবকের লাশ। তবে আমি কেন মিথ্যে হয়ে যাব? মন্টু - একমাত্র মন্টুই আমায় সত্যের মুখোমুখি করতে পারে - মন্টু -মন্টু -শুধু মন্টুর বিশ্বাসেই আমার জয়। মন্টু - মন্টু -
"
(বানান অপরিবর্তিত) - 'অন্দরমহল' - আশির দশকের শেষে রচিত।
'গ্রাস' নাটকটিতে একটা গান ব্যবহার হয়েছিল, দর্শক হিসেবে তার ধুয়োটা আমার বেশ কিছুদিন মনে ছিল।
"দৌড় দৌড় ঘোড়া দৌড়
বালক বৃদ্ধ আর যুবক প্রৌঢ়"
যে সময়টা ধরে নাটকটি রচিত, এই সময়টায় ঐ টিলা উপন্যাসের মতই, দুর্গাপুর, আসানসোল, রাণীগঞ্জ অঞ্চল আর শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানার এলাকা থাকছে না, একদিকে ব্যাপক নগরায়ণ হচ্ছে জনসংখ্যার চাপে, অন্যদিকে সামাজিক সুরক্ষার বা পরিকল্পনা ভিত্তিক নগরায়ন বা সামজিক সুরক্ষা একদম বিদেয় হয়ে তার জায়গায় ছোটো ব্যবসার একটা বিস্ফোরণ ঘটছে। শহরে একটা নতুন হওয়া বড় হোটেলকে ঘিরে ঘটনা আবর্তিত হচ্ছে।
একটি পরিবারএর কর্তা, প্রায় অবশ্যম্ভাবী ভাবে প্রাক্তন কেরানী, বড় মাপের ছোটো ব্যবসায়ী হতে চাইছেন, অন্যদিকে তার পরিবার, তাদের লালিত বিশ্বাসকে, তারা নিজেরাই বুঝতেই পারছে, একেবারে বদলে না নিলে এই নতুন পরিস্থিতিতে তারা বাঁচতে পারবে না। সেই প্রসঙ্গেই ঐ গান। ছোটো শহরের নাগরিক আকাঙ্খা, এই ভাবেই বদলাচ্ছে দেশ,এর কিছুটাকে আমরা প্রগতি বলেছি।সরকারী নীতি এইদিকেই সময়কে পরিচালিত করছে।
যদিও ব্যক্তিগত উচ্চাশার গ্রাস নিয়েই কাহিনীটি, তবুও মনে হয়েছে, এই পারিবারিক পরিবর্তনটিই, অনেক পরের রাজনৈতিক পরিবর্তনের ইঙ্গিতবাহী। এবং এই বড় মাপের ছোটো ব্যবসার বাড় বাড়ন্তের সময়ে আবার একেবারেই কোন বিস্ময়ের উদ্রেক না করেই ব্যবসার বিচিত্র বাঙালিত্ব খোঁজার একটা আগ্রহ দেখা যাচ্ছে, এবং এই সার্বিক গ্রাসে, যেখানে পরিবারের কথক সমালোচক সঙ্গীত শিল্পী শ্যালকবাবুর অনেক তর্কের হেতু তার বন্ধুর তৈরি একটা ছোটো স্কালপচার, তাও শেষ পর্যন্ত ড্রয়িং রুমে জায়গা না পেয়ে চলে যাচ্ছে ব্যবসায়ীর গুদামে, আর শ্যালক এতদিন ধরে মানতে না পারা ক্যাসেট কোম্পানীর শর্ত স্বীকার করার জন্য দিদিকে ছোটো চিঠি লিখে কলকাতা ফিরে যাচ্ছে, এবং সব সামলে বাঁচতে চাওয়া অথচ সবচেয়ে নাটকীয় ভাবে ব্যর্থ পরাজিত ব্যবসাদারের স্ত্রী রুমা, বিস্ময়ে তড়িতাহত হয়ে যাচ্ছেন, তাঁর জন্য পড়ে থাকছে, সেই হাহাকারের গান, যে গান, বড় হোটেলকে ঘিরে বড় শহর হয়ে যাওয়া দুর্গাপুর আসানসোল রাণীগঞ্জকে তোয়াক্কা না করার সাহস রাখে।
"চাঁদের ছেলেকে সাপে কেটেছে
ধন্বন্তরী নাইকো রোজা বাঁচাবে কে
বিষে জ্বর জ্বর অঙ্গ"
এই লেখার পরিকল্পনা নিয়েই আলাপাচারিতার সময়ে প্রশ্ন করেছিলাম অসীমকে, বিষয় নির্বাচনের দিক থেকে দেখছি, সরাসরি সমাসাময়িক রাজনীতি সমাজ সম্পর্কে যখনই কথা বলছেন, তখন নাটক বা গল্প বেছে নিচ্ছেন, কিন্তু এপিক ভিত্তিক বিষয়ের উপরে তাঁর একটা দুর্বলতা রয়েছে সেটা বোঝা যায়। সরাসরি উত্তর পাওয়ার দক্ষতা প্রশ্নকর্তা হিসেবে না থাকায় পাওয়া যায় নি, তবে যতটুকু বোঝা গেছিল, যে নতুন করে মহাভারত ভালো করে পড়ার পরে, ইরাবতী কার্বে, সুকুমারী ভট্টাচার্য্যদের কাজের সঙ্গে পরিচয় ঘটার পর থেকেই তাঁর ইচ্ছা প্রবল হয় বাংলায়, এমন নাটক লেখা, যেখানে এপিক নায়ক নায়িকাদের প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাবেন তাঁদের প্রজারা, শাসিতরা। সত্য, রাজ ধর্ম, যুদ্ধ, ধর্মসংকট, প্রেম, নারী ইত্যাদি বিষয় অবলম্বন মাত্র।
'আস্থিত' নাটকে যেমন সরাসরি কর্ণকে তাঁর প্রজারা প্রশ্ন করছেন, উচ্চবর্ণ ক্ষত্রিয়দের পারিবারিক যুদ্ধে তাঁর অবস্থান নেওয়া ঠিক কতটা প্রয়োজনীয়, খুব স্বাভাবিক ভাবেই কর্ণ উত্তর দিতে পারছেন না, এবং এপিক কাহিনী ভবিতব্য তথা উচ্চ পরিবারের ইমান নির্দেশিত পথে ভয়ানক যুদ্ধ ও সার্বিক ধংসের দিকে এগোচ্ছে।
"...
দ্বিতীয় প্রৌঢ়ঃ মৃত্যুর আগেই এ কোন মৃত্যু গ্রাস করেছে ঐ নিঃসঙ্গ মানুষটিকে!
বৃদ্ধঃজন্মজন্মান্তরের স্মৃতি নিয়ে ও যেন এগিয়ে চলেছে জন্ম জন্মান্তরের অনাগত যুদ্ধের দিকে। তবে কি সর্বকালের সমস্ত মাতার গর্ভ কলুষিত? অভিশপ্ত?
সমবেতঃ মহারাজ! কেন আপনি যোগ দিলেন, অভিজাতদের আত্মকলহে?
বৃদ্ধঃ দুর্যোধনের মিত্রতায় কি আপনার এখনো সন্দেহ হয় না?
কর্ণঃ কৌরবদের মিত্রতায় আমার সন্দেহ উপস্থিত হচ্ছে। বিশেষতঃ ভীষ্ম, দ্রোণ, মদ্রপতি, শল্য, কৃপাচার্য্যের আচরণে আমি ক্ষুব্ধ, অপমানিত। তাঁরা প্রতি মুহুর্তে মনে করিয়ে দিতে চান, অমি হীন, নীচকুলজাত। যা কিছু অর্জন করেছি, বীরত্ব ও জ্ঞানের মধ্যে দিয়ে -- আত্মগৌরব, প্রতিষ্ঠা - এ সবই দুর্যোধনের দান!
যুবক - এই যুদ্ধের কোন পক্ষই আপনার উপযুক্ত স্থান নয় মহারাজ।
কর্ণঃ হয়তো তাই। শুধু একটি কোন পক্ষ নয়, হয়তো পৃথিবী নয় আমার উপযুক্ত স্থান। আমি জানি, আমি তো জানি, আমার জন্ম এক অনাহূত ভ্রান্তি। আমার জন্মের সময় মঙ্গল দীপ জ্বলেনি, প্রতিবেশীর এসে আশীর্বাদ করে নি আমাকে। শুধু গোপনে পরিকল্পিত হয়েছিল এক শিশুকে হত্যার চক্রান্ত। আমি অযাচিত ভাবে বেঁচে আছি এই পৃথিবীতে। এক আত্মীয়হীন, নিঃসঙ্গ অতিথি। এক বহিরাগত-মৃত্যুর সময় যার অর্জিত জ্ঞান ও তাকে ত্যাগ করবে।..."
২০০০ সাল নাগাদ 'ধর্মপুত্র' নাটকটি যখন বহুরূপী মঞ্চস্থ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করবেন বলে আমরা বন্ধুরা খবর পাই, আমাদের বেশ আনন্দ হয়েছিল, মনে হয়েছিল একেবারেই প্রজাদের মুখ দিয়ে বলা এই যুদ্ধের কাহিনী তার উপযুক্ত সম্মান পাবে। আমি নাটকের নিয়মিত দর্শক না, বিশেষত কলকাতার নাটকের ঐতিহ্যকে অভিনয় প্রযোজনা দেখার মধ্যে দিয়ে নয়, অল্প স্বল্প কিছুটা পাঠের মধ্যে দিয়ে ধরার সুযোগ পেয়েছি। বহুরূপীর প্রযোজনা 'ইতিহাসের আত্মা' আমার মনে বিশেষ দাগ কাটে নি। যদিও দেখছি, "আজকাল" পত্রিকায় প্রকাশিত রিভিউতে চন্দন সেন এবং স্টেট্সম্যান পত্রিকায় প্রকাশিত আলোচনায় আনন্দ লাল প্রযোজনাটির প্রশংসাই করছেন।9
কিন্তু ১৯৯৯ নাগাদ স্যাস নাট্যপত্রে বেরোনো নাটকটি প্রথম বার পড়ার পর থেকেই আমি প্রায় কখনোই ভুলতে পারিনি।
কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধের পরে আর আবার যেন অশ্বমেধ যজ্ঞের প্রস্তুতি শুরু হচ্ছে গোপনে, যুদ্ধে ক্লান্ত অবসন্ন আত্মীয় বিয়োগে ভারাক্রান্ত যুধিষ্ঠিরকে রাজি করানো যাচ্ছে না যুদ্ধে, কিন্তু যুদ্ধ যেরকমটি হয়, অনেক উচ্চমার্গীয় সুক্ষ্ম আপত্তি সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত ঘটেই যায়, সেরকমই বিধ্বস্ত ভূমিতে, যেখানে জাত-পরিবার-ধর্ম না মেনে ক্ষত্রিয় বিধবারা প্রেম করে ফেলছেন গ্রামীণ যুবকদের সঙ্গে, ক্ষুধা, অনটন ক্রমাগত বাড়ছে রক্তে বন্ধ্যা জমিতে ফসল হয় নি বলে, ফসল ফলানোর শক্তি দেশে অবশিষ্ট নেই বলে, রাজকর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে সেখানেই নতুন করে অশ্বমেধ যজ্ঞ হচ্ছে। এক ঘর ফেরা, অঙ্গবিচ্যুত সৈনিক চন্দ্রসেনার প্রেমে পড়ছে, গ্রামীণ মোড়লের মেয়ে চন্দ্রাবলী। স্বপ্ন ও শান্তির খোঁজে তখন সেই বিধ্বস্ত ভূমিতে তাদের পক্ষে পথে বেরোনো ছাড়া আর উপায় থাকছে না। কিন্তু শুধু দীর্ঘশ্বাস না, রাজন্যদের প্রতি ছুঁড়ে চন্দ্রাবলী অভিশাপ ও মৃত্যুপুরীর বাতাসে ছড়িয়ে যাচ্ছে।
"বর্ণে ভেঙ্গে পড়ে বৃক্ষ অঙ্গে বড় জ্বালা
কুহু স্বরে ডাকিস কেন আন্ধার কোকিলা
পায়ে ধরে মিনতি হে রাজা যুধিষ্ঠিরে
নিয়ম করো যুদ্ধকালে বসন্ত না ফেরে
আমি যেমন কান্দি তেমন রানীও কান্দে যেন
ও রাজা তোর মরণ হয় না কেন?"
যুদ্ধে ভয়ানক ভাবে আহত, অঙ্গহানির পরে দুর্বল হয়ে পড়া সাধারণ সেনা রূপকার্থে শুধু না, পৃথিবী ব্যাপী অনেক শান্তি আন্দোলনেও অগ্রগণ্য মুখ। এই নাটকটি পড়ার অনেক পরে ইজরায়েলের কিংবা আমেরিকার যুদ্ধবিরোধী ভেটেরানদের কথা কাগজ পত্রে পড়তে গিয়ে বার বার মনে হয়েছে নাটকটির কথা। বেশ কয়েক বছর পরে পড়া সারামাগোর বালথাসার অ্যান্ড ব্লিমুন্দা উপন্যাসে, যুদ্ধের পরে কোষাগার প্রায় শুন্য করে, হাজার হাজার সাধারণ মানুষকে কাজে লাগিয়ে মাফরার চার্চ তৈরি হওয়ার প্রেক্ষাপটে, যুদ্ধে হাত কাটা পড়া সৈনিক বালথাসার, আর ইনকুইসিশনের বলি ইহুদী মায়ের ঘরহারা মেয়ে ব্লিমুন্দার নিজেদের হারিয়ে ফেলার কথাও পড়েছি, এই একেবারেই ছোটো শহরের তরুণ বয়স্ক নাট্যকারের এই রচনাটির কথা আমার বার বার মনে পড়েছে। আবার একেবারে হালে পড়া ফ্রান্সে অভিবাসী আফগানী লেখক আতিক রাহিমির লেখা, 'আ কার্স অন দস্তয়েভস্কি'তে এক প্রায় অসহায় হত্যাকারী র কথা পড়তে গিয়েও মনে হয়েছে। যুদ্ধ যেমন প্রায় অন্তহীন, একটা যুদ্ধের পরেই শুরু হয়ে যায় আর এক সর্বগ্রাসী যুদ্ধ, একেবারে ব্যক্তিগত শান্তি প্রচেষ্টা এবং অভিশাপ উচ্চারণ ছাড়া মানুষের এবং পাঠকের বিশেষ কিছু করার থাকে না।
বিশ্বনাথের আজব কল
আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের পালা চুকিয়ে দেওয়ার অনেকদিন পরে, অসীমের একটা নাটক হঠাৎই অল্পবয়সী বিশেষতঃ স্কুলের ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে ভীষণ জনপ্রিয় হয়, উত্তর শিক্ষা সদনের ছাত্র ছাত্রী রা, অগ্নিমিত্র ঘোষের পরিচালনায় তাতে অভিনয় করেন। জনপ্রিয়তা এতটাই বেড়ে যায় প্রায় কয়েক মাস ধরে মহলা চলার সময়ে বা অভিনয়ের সন্ধেটির পরেও অনেকদিন ছেলে মেয়েদের মুখে মুখে এই নাটকের গানগুলি ছড়াতে থাকে। গানের সুরগুলি এবং আবহ করে দিয়েছিলেন তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র সারণ দত্ত।
নাটকটা একটা পালাগানের মত করে লেখা। পরে কথা বলতে গিয়ে দেখেছি, অসীমদের পরিবারে, বাঁকুড়ায় নাটকের চল ছিল আর দাদামশাইয়ের সঙ্গে মায়ের দিকের গ্রামের বাড়ি শান্তিনিকেতনের কাছে সর্বানন্দপুরে কৃষ্ণযাত্রা দেখার অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল। তাছাড়া বীরভূমের লেটো গানের একটা ওয়ার্কশপে শিল্পীদের মুখে মুখে বাঁধা গান তাঁকে প্রভাবিত করে। নাটকের ঘটনাটা ঘটছে একটা মেলার মধ্যে, একটা আজব কল বেরিয়েছে, সেই কলের মধ্যে ঢুকলেই লোকে বেরিয়ে এসে মনের গোপন কথাগুলি ফস করে বলে ফেলছে, কলওয়ালার ভূমিকায় একবারে কিশোর বয়সের বিশ্বপতির অভিনয় ভোলার না। আমার একটু অবাক লেগেছিল, যে হঠাৎ করে মহাকাব্যের বিষয়ে নাটক বা সমসাময়িক বিষয়ে নাটক করতে করতে, দল হিসেবে সাহিত্যিকা এবং নাট্যকার হিসেবে অসীম পালাগানের দিকে ঝুঁকলেন কেন। তো তার সহজ উত্তর হল লোক সংস্কৃতির ঐতিহ্যতে অংশগ্রহণ করার চেষ্টা, আর ছোটোদের নাটকে একটু হাসি ঠাট্টা গান ইত্যাদি থাকলে ছোটোদেরও ভালো লাগে ইত্যাদি।
কিন্তু লোকসংস্কৃতি ব্যবহারের একটা গভীরতর সমস্যা ছিল। যেটা লোকসংস্কৃতির আঙ্গিকের সঙ্গে নাগরিক সমাজ রাষ্ট্র সমালোচনার ধারার একটা বিরোধ ছিল। ভারতীয়ত্ব এবং দেশ সংস্কৃতির খোঁজের সঙ্গে আধুনিক নাট্য চর্চার বিরোধ এই প্রথম না, বহুবার বহুভাবে হয়েছে আমাদের বিংশ শতকের নাট্য ইতিহাসে। এবং এও লক্ষ্য করা যাচ্ছিল, জনপ্রিয়তার কারণে শুধু না, সরাসরি রাষ্ট্রকে সমালোচনার ধারা একটু কম উচ্চারিত থাকায়, এক ধরণের নাচে গানে জমজমাট লোকসংস্কৃতিধর্মী নাটকের পক্ষে রাষ্ট্রে অনুমোদন বা আনুকুল্য পেতে সুবিধেই হচ্ছে।10 এই পরিস্থিতির সবটা অবশ্য অসীমের নাট্য রচনার সময়ে বাস্তব ছিল না, কিন্তু এই নাটকটি র কথা এখন ভাবলে মনে হয়, বীরভূম(সর্বানন্দপুর) আসানসোল (মিঠানি)এবং দুর্গাপুরের মানুষ অসীমের পক্ষে পালাগান রূপটিকে কখনো না কখনো কোন না কোন বিষয়ে বেছে নিতেই হত। বিষয় হিসেবে আমার যেটা আশ্চর্য্য লেগেছিল, একেবারেই সামাজিক পালার মত বিষয়, বর বিশ্বনাথের কলে ঢুকে বৌকে জিগ্যেস করে ফেলছে, তোমার বাবা কবে মরবে বলোতো ইত্যাদি, কিন্তু কথারূপ কাহিনী যেমন রূপকথার বিন্যাসকে উল্টে ফেলার প্রয়াস নিয়েছিল, তেমনই সামাজিক পালার বিষয়গুলোকে বিশ্বনাথের কলে ঢুকিয়ে পালা গানের দর্শককেই নিজেদেরি রক্ষণশীলতার বা অতি উচ্চাশার মুর্খামিতে হাসতে প্ররোচিত করার একটা প্রচেষ্টা ছিল। এত নানা ধরণের স্থানীয় ভাষার ব্যবহারে গান ছিল, প্রযোজনাটি অগ্নিমিত্র ঘোষের পরিচালনায় মনে রাখার মত হয়েছিল।
আরেকটা কিছুটা মজার দিক অবশ্য আছে, বিশ্বভারতীতেও নব্বইয়ের দশকে সম্ভবত পেরেস্ত্রৈকার নব্য নগরায়নের হাওয়া লেগেছিল। অথবা কর্তৃপক্ষ রাজনীতির গতিপ্রকৃতি দেখে বুঝতে পেরেছিলেন, বিপ্লব প্রতিবাদ প্রতিরোধ প্রচেষ্টা সমাহিত প্রায়, সত্তর বা আশির দশকের মত বিপজ্জনক নয় আর, শিল্প চর্চা, শীতাতপনিয়ন্ত্রিত প্রদর্শনীশালার বিষয় হয়ে ওঠাই মঙ্গল। আশির দশকে স্কুলে দেখেছি, বিবাদী স্বরের হাতে লেখা পত্রিকা বের করতেও অসুবিধে হচ্ছে,11 নিরীক্ষা এবং ভাবনার এক ধরণের নিয়ন্ত্রণ কাজ করছে, বাদল সরকারের নাটকের অনুমতি পাওয়া যাচ্ছে না, কর্তৃপক্ষের সঙ্গে রীতিমত সংঘাতে যেতে হচ্ছে, সেখানকারই ছাত্রদের, প্রিয় অধ্যাপক রা ঐতিহ্যের কথা তুলে আপত্তি জানাচ্ছেন, যদিও সত্তর বা আশির দশকেও আমরা শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের হোস্টেলের ছেলে মেয়েদের ভাদু গান গাওয়ার অনুমতি পেতে অসুবিধে হতে দেখি নি, বা "যেমন খুশি সাজো" প্রতিযোগিতায় গ্রামীণ ভাষার রসিকতায় প্রাকৃত শব্দ ব্যবহার হতেও দেখেছি। তেমনই নব্বইয়ের দশকে বাদল সরকার একটা সময়ে অতিথি হিসেবে কাজ করতে আসছেন বিশ্বভারতীতে। তো লোক সংস্কৃতির একটা ছাড় আছে, আধুনিক নাট্যকারদের ব্যক্তিগত চয়নের উপরে নির্ভর করছে সে স্বাধীনতা কি কাজে ব্যবহৃত হবে।যাঁরা অসীমের নাটক দেখেছেন বা পড়েছেন তাঁরা এই সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন অসীম এই ছাড়ের কোন অপব্যবহার করেছেন কিনা।
বিষয় দুর্গাপুর
অসীমকে একটা সময় পর্যন্ত দুর্গাপুরের লেখক12 বললে অত্যুক্তি হত না, তাঁর কল্পনার মূল ও বিস্তার ক্ষেত্র দুই এরই আধার ছিল দুর্গাপুর, কিন্তু তা সোভিয়েত সাহিত্যের অনুকরণে, রাষ্ট্রায়ত্ত্ব শিল্পের সুরক্ষা ও শ্রমিক সংহতির আমলেও, কোন নতুন সমাজ গঠনের পরীক্ষাগার 'মে দিবস কলোনী'ও হয়ে ওঠে নি, আবার শ্রমিকের অশিক্ষিত অথচ সংঘবদ্ধ অধিকার উচ্চারণে খানিকটা ঘাবড়ে যাওয়া, চাকুরিপ্রেমী মধ্যবিত্ত পাঠক মহলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা, 'সাগিনা মাহাতো'র প্রদর্শিত পথে, ব্যক্তি শ্রমিকের দার্শনিক বা জীবিকা এবং জীবন সম্পর্কে ছোটো থেকে বড় সব প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারা অপরাধী ইউনিয়নের বিচারকাণ্ডও হয়ে ওঠে নি,বরঞ্চ যে মাটিতে কারখানা শহর গড়ে উঠছে, সেই মাটি, আশের পাশের গ্রাম, নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি অতি সাধারণ মানুষ এবং কখনো কখনো তাদের সেয়ানা কিন্তু আমুদে বাহাদুরির প্রচেষ্টা এবং রাষ্ট্রের মুখ ফেরানোর দুর্দিনে ধ্বংসস্তুপে ইতিহাসের রচয়িতা হওয়ার দুঃসাহস না দেখিয়েও অন্তত ধ্বংসের সাক্ষী হওয়ার সামান্য আকাঙ্খা নিয়েই এই সব গল্প, মহত্ত্বের আরাধনা বিশেষ নাই।
"সাত ঘোড়া এক রথ
আর এই আমি - একা রথী
সামনে সহস্র হাত,
সহস্র-লোচন জনপ্রতি।
কোলাহল! হে জীবন!
আমাকে আড়াল করে রাখ
আমাকে চালনা কর
হে আমার অনিবার্য্য সারথি
--পাঠককে"
(২০০০ সালে প্রকাশিত কথারূপ / হারাধন মন্ডলের গল্প গ্রন্থের উৎসর্গ পত্র থেকে।)
যদিও ২০০০ সাল নাগাদ প্রকাশিত হচ্ছে, গল্পগুলি পড়লে বোঝা যাচ্ছে আরো বছর পনেরো কুড়ি আগে লেখা। বোঝা যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে বড় করে কৃষি বনাম শিল্প বিতর্ক শুরুর কিছুটা আগেই, অনেক পুরোনো একটি বিষয়ের অবতারণা করার প্রয়োজন অনুভব করছেন অসীম। বাঁকুড়া এবং বীরভূমের গ্রামে যাঁর পারিবারিক শিকড় রয়েছে, যিনি রাষ্ট্রায়ত্ত ভারী শিল্প নগরীতে বড় হচ্ছেন, তাঁকে শিল্পনগরের যন্ত্র এবং উৎপাদনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা জনজীবন, নতুন রকমের সমাজ এবং বিচিত্র মানুষকে নিয়েই তাঁর রোজগেরে বাস্তব, কিন্তু কৃষি র সঙ্গে জড়িত মানুষ কি ভাবে যন্ত্র জিনিসটার মুখোমুখি হচ্ছেন, তার প্রায় কয়েকশো বছরের পুরোনো প্রায় শিল্প বিপ্লবের সময়কার সংঘাতটা তাঁকে ভাবাচ্ছে।বা বলা ভালো এক দেড় দশক পরেকার আমাদের রাজ্যের সম্ভাব্য সংঘাত ও প্রতিভাত হচ্ছে।
হারাধন মন্ডলের গল্পতে দেখা যাচ্ছে, "হারাধন মন্ডল - দি ওয়েল্ডার, মেড ইন পাথরঘাটা - এ ভিলেজ নিয়ার শান্তিনিকেতন", বিচিত্র ঠোঁটকাটা আমোদ গেঁড়ে, হাতের কাজে উৎকর্ষের সীমানায় পৌছনো, ‘লোহায় লোহায় বিবাহ’ দেওয়া শ্রমিক, মুক্তধারার যন্ত্রবিদের মত যন্ত্রের জয়ের গান না গেয়েই প্রায় বিনা বাক্যব্যয়ে, শেষ পর্যন্ত ফিরে যা্চ্ছে তার গ্রামে। এবং বাসে গান গেয়ে পয়সা জোটানো বাউল, যে নিজে চিরায়ত জীবন দর্শন চর্চার বিশুদ্ধতার দাবী বিশেষ করছে না, গান বাঁধছে শুধু,
"চাগরি যদি করবি চাষা
আজব কলে বাঁধরে বাসা
চাষা পরাণ বলে বুদ্ধি খাসা
ফিরতে তোমার চাই জানা।" 13
অথচ বাউল ও হারাধন, দুজনেই যেন কোথাও একটা ভবিতব্যকে অস্বীকার করতে পারছে না, তাদের চোখের সামনেই "একপেট স্কিলড আনস্কিল্ড ওয়ার্কার নিয়ে বাস ছুটে চলে দুর্গাপুরের দিকে", সকলের ফেরার পথটি জানা আছে কিনা জানা নেই, বাস রাস্তার অবিশুদ্ধ বাউলের গানে সমাধান বিশেষ নাই।
আশির দশকের মাঝামাঝির প্রেক্ষিতে লেখা, নব্বই য়ের দশকে পূর্ণাবয়ব পাওয়া হারাধন মন্ডল তার শান দেওয়া জিহ্বাখানি নিয়ে প্রায় দু দশক পেরিয়ে ফিরে আসছে, ধ্বংসস্তুপে বৃষ্টি নাটকে।14 সময়ের হিসেবে অল্প পর থেকেই, নব্বই দশক থেকেই, একেবারে অন্ধ না হলে দুর্গাপুর আসানসোলের শিল্পোদ্যোগে সরকারী বাতাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার গল্প থেকে মুখ ঘুরিয়ে থাকা যায় না। হারাধন এবং তার এক কর্মপ্রেমী উচ্চপদস্থ ম্যানেজার বস দুজনেই শেষে ফিরে আসছে একটা ভাঙা এবং বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানায়। রাষ্ট্রের আশ্চর্য্য অগ্রগতিতে ততদিনে তারা দু পক্ষই ব্যবহৃত জ্বালানি মাত্র। এবং তারা নতুন করে ঝালিয়ে নিচ্ছে পুরোন শত্রুতা এবং নতুন অসহায়তাগুলি। অন্ধকার বর্ষাস্নাত রাতে, অল্প পানীয়ের সাহায্য পেলেই, বড় বড় জঙ ধরা চাকা আর অ্যাসেম্বলি লাইনগুলোর আর জীবন্ত হয়ে উঠতে অসুবিধে থাকছেনা। পরাজয়ে একাকীত্ব থাকলেও, পরাজিতের বৃন্দ গানে সুর লাগানো যেন ভালো দিনের চেয়ে কিছুটা সহজই হয়ে উঠছে।
টিলা উপন্যাসটিতে, প্রেক্ষিতের দিক দিয়ে দেখতে গেলে, একটা পরিস্থিতি আসছে, যখন দুর্গাপুর কেবল মাত্র রাষ্ট্রীয় ভারী শিল্প নির্মাণ প্রকল্পের জায়গা আর নয়, তাকে অন্যান্য অঙ্গরাজ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে বিনিয়োগ আমন্ত্রণ করার একটা দায় পোহাতে হচ্ছে, কারণ রাষ্ট্র সরাসরি উৎপাদনে অংশগ্রহণ করতে শুধু না, শ্রমিক জীবনের সুরক্ষা কবচ গড়ে গোলার কাজে অংশগ্রহণ করতেও অস্বীকার করছে। এবং খুব স্বাভাবিক ভাবেই মধ্যবিত্তীয় কর্মসংস্থানের দুশ্চিন্তা আর শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষার দৃষ্টিভঙ্গী সংঘাতে লিপ্ত হচ্ছে, পার্টি ও প্রশাসন, একাধারে সংঘাতে লিপ্ত হচ্ছে অন্যদিকে নিজেদের মধ্যে স্বাস্থ্যকর দুরত্ব রাখতে অনিচ্ছুক ও ব্যর্থ হচ্ছে। একই সময়, যখন দুর্গাপুর আর শিল্পনগরী থাকছে না, একটি নগরী হয়ে উঠছে, তার উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত না, এরকম মানুষ, নাগরিক সমাজের মানুষ বা নাগরিক সমাজকে নাগরিক থাকতে সাহায্য করা ততটা নাগরিক নন মানুষের ভীড় বাড়ছে।
এখন এই প্রেক্ষাপটে, প্রায় লোহার ঝনঝনানি আর অবিশ্বাস এবং সন্দেহের বিচিত্র পরিবেশকে এবং পাড়ায় পাড়ায় অনতিক্রম্য দূরত্ব তৈরি হওয়া সময়ে, প্রেমের উপন্যাস লেখার প্রায় আদর্শ পরিবেশ এবং প্রেক্ষিত হিসেবে বেছে নিচ্ছেন অসীম। একটু বিচিত্র রসিকতার মত শোনালেও, প্রেম সংসার বৈধতা নানা টানা পোড়েনেও শ্রেণী এবং ব্যক্তিগত অবস্থান নিরপেক্ষে এবং কারখানা বন্ধ হওয়ার ঘটনাবলীতে নানা ভাবে অংশগ্রহণ করা সমস্ত ধরণের মানুষেরা ক্রমশঃ আশ্চর্য্য একলা হয়ে গেলেও, শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করছে যে, সে প্রেমিক, প্রতিভাবান, প্রাতিষ্ঠানিক নেতা, অতি বিপ্লবী, তাত্ত্বিক, প্রাক্তন স্বাধীনচেতা সহধর্মিনী, সংগঠন বা পরিস্থিতি বিশেষজ্ঞ, মস্তান, নাগরিক, ভীতু বৌ, সাহসী প্রেমিকা, রাগী বা সুবোধ ছাত্র, কেউই না, এক নিজেদের হাতে সর্বজনগ্রাহ্য ভবিতব্য গড়ার অতীতে অতি-বিশ্বাসী অতি আস্তিক কর্মী মাত্র।
গল্পঃ কথারূপ, বৃত্তের চার বাহু, গুহাচিত্র
'কথারূপ' গল্পে ঘটছে বিচিত্র কান্ড কারখানা, এক টাউন বাজার থেকে কেনা, স্বাধীনচেতা একটি মোপেড, যার লুকোনো দেমাকের চোটে মালিক চাষীর প্রাণ অস্থির, সে আস্তে আস্তে গ্রাম্য জীবনের নানা চাপে একটি লক্ষ্মীমন্ত বাছুর হয়ে যাচ্ছে, তার যান্ত্রিক ছটফটানি সুবোধ গাভী শিশু হতে মাত্র এক গল্প সময় নিচ্ছে। তাকে কিছুটা বুঝতে পারা বৈজ্ঞানিক এবং অবশেষে হাম্বা-সর্বস্ব প্রয়াত মোপেড অথবা বাছুরখানি পরস্পরের সঙ্গী হচ্ছে, কারণ গ্রামের কেউ, কামার, বায়েন, তাঁতি বা তাদের বৌরা কেউ মোড়লদের চালে একমত হতে পারে নি রৌদ্র বিষয়ে।
"কামার বলে রৌদ্র আঙার
বায়েন বলে ছন্দ
তাঁতি বলে রৌদ্র তো রঙ
মালি বল্লো গন্ধ।
গাছের উপর বৌ-কথা কও
বললো-মুর্খ অন্ধ।
রৌদ্র আমার শীতের চাদর
রৌদ্র আমার পাখা
রৌদ্র আমার রসিক নাগর
রৌদ্র আমার দেখা।"
গ্রামীণ সমাজের নিয়ম রক্ষার দায়ে রৌদ্রকে বার বার আবিষ্কৃত হওয়ার অপেক্ষা করতে হচ্ছে।এমনকি সুশীল যন্ত্রটিকেও অপেক্ষা করতে হচ্ছে তার বৈজ্ঞানিকের সাধনার জন্য।
একাকীত্ব এবং পরাজয় শুধু না, পরাজয় এতটাই বিস্তৃত, প্রথম থেকে কোন ধরনের সাফল্য বা বিজয় সম্ভাবনা সম্পূর্ণ নিরর্থক, এই ধরণের মানুষের কথা নিয়ে এই গল্পটি পড়ার প্রথম অভিঘাত কাটাতে সময় লেগেছিল। পিকারেস্ক শব্দটার সঙ্গে তখনো পরিচিত হইনি।সম্পূর্ণ নির্জীব একটা লোক, যে শুধু একবার কথা বললেই হয়তো যারা বৌ তাকে ছেড়ে যেত না, যে বেড়াল পোষে নি, কিন্তু যার কাছে বেড়ালটা রয়ে গেছে, সম্পূর্ণ অকারণে মানুষের পরিহাসের লক্ষ্য হওয়া সত্ত্বেও, রিটায়ার করার পরে শুধু রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ে এটুকু না করলে মানায় না ইত্যাদি কারণে এম এ পাশ করে ফেলা এক কেরাণী, বলিয়ে কইয়ে হকারদেরকে কাজে লাগিয়ে দেশে সেলসের বিপ্লব আনার স্বপ্ন দেখা এক মুর্খ আশাবাদী, আরেকটা লোক যে সব কিছুই জড্ডাউন করে রাখে, কোন চলচিত্তচঞ্চরীতে উল্লেখ করবে বলে নয়, শুধুই পরের বার জড্ডাউন করতে সুবিধে হবে বলে, এই রকম হেরো এবং অপদার্থ চারটি মানুষ নিয়ে রচিত হয়েছিল 'বৃত্তের চার বাহু'।
গুহাচিত্র গল্পে এক লেখক হঠাৎ মনে করতে শুরু করছে, তার সৃষ্ট চরিত্ররা সবাই তাকে নিয়ে রসিকতা করছে, তাদের সৃষ্টির পেছনে সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন করছে তাকে, পরিহাস করছে, প্রত্যয়ের খোঁজে বেরিয়ে পড়তে বাধ্য করছে। চরিত্রগুলির সঙ্গে শেষ বোঝাপড়ায় যাওয়ার আক্রোশে, এক বন্ধ হওয়া খনিতে নামছে সে, আচ্ছন্ন স্মৃতিতে আসছে এক গুণীনের ছেলে পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে কথোপকথন, গিয়ে আবিষ্কার করছে সেই বন্ধ খনির গায়ে গায়ে আঁকা রয়েছে বিভিন্ন গল্প আর চরিত্র, লেখক উল্লাসে ফেটে পড়ছে, এতদিনে যেন তার প্রত্যয় ফিরে আসছে, বুঝতে পারছে এদের নিয়েই এতদিন লেখা লিখি করেছে সে, হয়তো হয় নি, কিন্তু সে চেষ্টা করেছে, এক প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ছে সে, তার বন্ধুটির সাথে, এই গুহাচিত্রে অধিকার বিষয়ে, কে এই ছবিগুলির অধিকারী এই নিয়ে পাগলের মত ঝগড়া করছে সে, আরো নানা ঘটনা ঘটছে গল্পে, কিন্তু খুব স্বাভাবিক ভাবেই প্রখ্যাত খনি দুর্ঘটনা মনে করানো বন্ধ খনি র চরিত্রদের বিস্মৃতির আড়ালে ঠেলে দেওয়ার পাপবোধ এক লেখককে দুঃস্বপ্ন দেখানোর ক্ষমতা তখনো রাখছে সেই ঝাঁ চকচক নব্বইএর দশকেও, এটাই আশ্চর্যের কথা। সরকারী বামপন্থী সংস্কৃতি শিবিরের স্মৃতি দায়িত্ব সম্ভাব্য প্রতারণার দ্বন্দ্বকে আলোচনার মধ্যেই ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা করছেন সম্ভবত।
অবশ্য এটুকু বলতেই হয়, হাতে গোণা হলেও কয়েকটি গল্পে, কয়েকটি সংলাপের মতই একটা অমনোযোগ আছে। তাড়ার ছাপ রয়েছে, বিশেষত ক্রোড়পত্র বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত গল্পগুলিতে। এটা মনোযোগী পাঠকের পক্ষে দুঃখের।
প্রবন্ধ/মুক্তগদ্য/সংলাপ
নাটক এবং গল্প ও উপন্যাসে যতখানি যত্নবান অসীম, প্রবন্ধে ততখানি নন। একটা অংশকে আজকের ভাষায় সংলাপ বা মুক্তগদ্য বলা যেতে পারে। একটা অংশ পোলেমিক, গণনাট্য র নানা সভার জন্য লেখা। বনফুলকে নিয়ে একটা প্রবন্ধ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে একটা প্রবন্ধ এবং নাটক এখন, আজকের বিশ্ব ও ঐতিহ্যের ভিন্ন পাঠঃ কিছু সংশয়, কিছু জিজ্ঞাসা শীর্ষক প্রবন্ধটিগুলিতে যত্নের এবং একটা সন্ধানের ছাপ স্পষ্ট। যদি কখনো প্রবন্ধ সংকলিত হয়, আমি অন্তত শেষোক্ত প্রবন্ধটিকে রাখতে চাইবো, ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের এবং ঐতিহ্য ইত্যাদি র বিষয়ের সমস্যা ও সংশয়গুলি নাট্যচর্চায় কি সমস্যা তৈরি করছে, তার সম্পর্কে লিখছেন।
আরেক ধরণের লেখা লিখছেন অসীম, ভাষ্যকার হিসেবে নাম গ্রহণ করছেন দুরকম, 'বকাই' ও 'বাঁধন'। বকাই হুতোম প্রদর্শিত পথে এগোচ্ছে, নানা বিষয়েই টীকাটিপ্পনী করছে, আবার যেরকমটি হয়, কথার ফাঁকে দামী কথাও ঢুকছে, ব্যঙ্গের ছলেই, কিন্তু বাঁধন নামক স্বরটি সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত ভাবে একটু বিশেষ দুর্বলতা আছে, খুব বিশদে যাচ্ছি না, তবে মূল বিষয়টা হল, বীরভূমের শান্তিনিকেতনের নিকটবর্তী গ্রামের এক কিশোর কি চোখে শান্তিনিকেতন, পৌষ উৎসব ইত্যাদিকে দেখছে এবং রবীন্দ্রনাথকেই বা কি ভাবে দেখছে, নগর, গ্রাম, মানুষের মেলা ইত্যাদি প্রসঙ্গ আসছে, অনেকটাই, শান্তিনিকেতনের উত্তরাধিকারে বীরভূমের মানুষের স্থান বিষয়ে, কিন্তু যেটি একেবারে শালের নতুন পাতার মত সুন্দর, সেটি হল সত্তর দশকের মাঝা মাঝি, দাদুর সঙ্গে পৌষমেলা বেড়াতে আসা কিশোরের মেলা দেখার একটা স্মৃতি।
বাঁধন আমার কাছে উল্লেখযোগ্য একটা বিশেষ কারণে। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্র পরবর্তী যুগের উৎকর্ষ সন্ধানে নানা বিতর্ক হয়েছে। একটা অনুন্নত জেলায়, যেখানে সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা সহ প্রায় কোন কর্ম সংস্থানের প্রশ্ন প্রায় নেই, সেখানে ভূমিপুত্র যুক্তিতে স্থানীয় মানুষের চাকুরির দাবী এবং তৎসংক্রান্ত বিতর্ক হবে এটা না বলে দিলেও চলে, এটাই বাস্তব। কিন্তু এই বিতর্কে স্থানীয় মানুষ অদ্ভুত ভাবে, হয় উৎকর্ষের ভাবনাহীন যোগ্যতাহীন স্থানীয় চাকুরিপ্রার্থী অথবা আতংকিত আশ্রমিক হিসেবে পরিচিত এবং দুজনেই নাগরিক শিক্ষা প্রেমীর বা করদাতার বিস্ময় ও ক্রোধ উদ্রেককারী। কিন্তু এই বিতর্কে আশ্রমের বাইরের জেলার বুদ্ধিজীবিরা কেন দীর্ঘদিন ধরেই শান্তিনিকেতনের সঙ্গে বিশেষ সম্পৃক্ত হন নি সেই প্রশ্নের কোন উত্তর নেই। অসীমের এই বাঁধন নামক কিশোরটির ভাষ্যে তার একটা উত্তর খোঁজার প্রচেষ্টার শুরু অন্তত হয়েছে।
এই সংলাপগুলির একটা অংশ ইতিমধ্যে সংকলিত। কিছুটা চালিয়ে খেলা রয়েছে 'আঃ হাঃ আমি! বা হাঃ আমি' বইটির ব্লার্বে। "কোটা দুই প্রকার। সরকারি এবং বেসরকারি। প্রতিটি কোটার দুই ভাগ- রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক। তার আবার দুটি ভাগ --রাজধানী ও জেলা। কেননা পত্রিকা বিক্রি, রাজনৈতিক সংগঠন দুটোকেই জেলা পর্যন্ত বিস্তৃত না করলে সংগঠন টেঁকে না।....লেখক এবার মন দিয়েছেন কোটার লেখক হতে।"
এই সংকলনটির শ্লেষের লক্ষ্য পশ্চিম বঙ্গের সংস্কৃতির জগত, তবে তার সঙ্গে প্রভিনশিয়াল বুদ্ধিজীবির সাধারণ হতাশা এবং তৎসংক্রান্ত চর্চার সীমাবদ্ধতা নিয়ে কিছু কথাবার্তা রয়েছে। রবীন্দ্র চর্চার প্রাতিষ্ঠানিকতার সমস্যার মত পুরোনো বিষয় ও রয়েছে। কিন্তু এটির উল্লেখ করছি তার মূল কারণটি ঐ, মহানগরের বাইরের সংস্কৃতি চর্চা যখন স্বীকৃতি ও বাজারের জন্য মহানগরের মুখাপেক্ষী, তখন স্থানিক প্রতিনিধিত্ব সংক্রান্ত বিতর্কগুলি এড়ানোর উপায় থাকে না।
একটি সঙ্গত প্রশ্ন
যে গুটি কয় পাঠক, এই পর্যন্ত ধৈর্য্য ধরে পড়েছেন, তাঁদের ধন্যবাদ। অনেকের মনেই প্রশ্ন উঠতে পারে, কে এমন অসীম চট্টরাজ যাকে নিয়ে হাজার পাঁচেক শব্দের একটা পরিচয় প্রবন্ধ লিখতে হবে। সে কি রচনার গুণে, নাকি এটি আসলে পাঠক হিসেবে আমার বয়ঃপ্রাপ্তির কাহিনী, শুধু ছাপা বই না, 'ওয়ার্ক ইন প্রোগ্রেস"এর নেশায় নেশায় থাকা। এই যদি মানে দাঁড়ায়, প্রবন্ধের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া যাবে।
হ্যাঁ বাংলা ভাষা সাহিত্যের দীর্ঘ গৌরবজনক ইতিহাসে অসীমের জায়গা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, আদৌ দাঁড়াবে কিনা, সে মূল্যায়ন এই লেখার উদ্দেশ্যও নয়, তার সময় আসেও নি, এটুকু বলা যেতে পারে, পাঠকের কথা জানি না, অসীম নিজে চাইলে তবেই বৃহত্তর ক্ষেত্রে তাঁর কাজ সম্পর্কে আলোচনা হবে, যে ভাবে লেখা কমিয়ে এনেছেন, তাতে তিনি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন কিনা তাও জানি না।
প্রারম্ভে কিছুটা বলার চেষ্টা করেছি, আরেকবার মনে করিয়ে দিতে চাই, শুধু এই কারণেই অসীমের লেখা পড়া যেতে পারে বলে মনে করি, যে স্থানকে পরিচিতি হিসেবে ব্যবহার না করেও যে মহানগরের বাইরের স্থানকে নিয়ে গভীর ভাবে সম্পৃক্ত থেকে সৃষ্টি প্রচেষ্টা করা যায়, এবং সেই সৃষ্টি, এবং তার সম্পর্কে প্রয়োজনীয় সংলাপ সহ নানা ফুটনোট যে আমাদের ভাষার শুধু না, সমসাময়িক বিশ্বের কথা সাহিত্য ও নাট্য রচনার প্রতর্কে অংশগ্রহন করতে প্রচেষ্টা পেতে পারে, অসীমের লেখা তার স্বাক্ষর বহন করে। তারাশংকর পরবর্তী অপঠিত এবং স্বল্প পঠিত বীরভূমের বহু লেখকের কাজ সম্পর্কেই নব্বই দশকের পরবর্তী প্রজন্মের খোঁজ এই জায়গাটুকু আবিষ্কার করতে পারলে, এই প্রবন্ধের আর নতুন কোন প্রয়োজন থাকবে না। তার কাজ অনেকটাই সমাধা হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যাবে। আর আন্তরিক ভাবেই চাইব, অসীম আরো লিখুন।
বীরভূমের সাহিত্যচর্চা তার নিজের গতিতে চলবে, সবসময়ে স্থিতাবস্থাকে প্রশ্ন করবে না, আবার কখনো কখনো বড় প্রশ্ন তুলবে, পাঠকরা নতুন করে বীরভূমের সাহিত্যিকদের আবিষ্কার করবেন কিনা জানিনা, তবে অগ্রাহ্য করা কঠিন করে তোলার কাজ সম্পূর্ণ অসংগঠিত বিক্ষিপ্ত ভাবে যে চলছে, তাতে সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ব্যক্তিগত ভাবে আমার একটা আগ্রহ থেকেই যাবে, এটুকু বলতে পারি।