জন্ম ইস্তক শুনে আসছি ভারতবর্ষ আমার দেশ। কখনো সেভাবে ভেবে দেখিনি দেশ মানে কি। একটা ভূখন্ড, কিংবা একটা বর্ডার? কিন্তু সেটা নি:সন্দেহে নয়। কেননা, মানচিত্রের বাইরে কখনো নিজের চোখে বর্ডার দেখিনি। ঠিক যেমন রবীন্দ্রনাথকে ছবির বাইরে দেখি নি কখনো। তবুও লিখতে বসলে অবধারিতভাবে কলমের ডগায় চলে এসেছে গান, কবিতা, লেখা বা নাটকের অনুষঙ্গ। দেশটাও যেন সেরকম। চলতে ফিরতে নি:শ্বাস নিতে দেশ চলে এসেছে তার অবয়বহীন অনুভব নিয়ে। সিয়াচেনে সৈন্যরা দাঁড়িয়ে আছে কি না ভাবি নি, কিন্তু আসামে বন্যার ছবি দেখলে কষ্ট হয়েছে, মেরি কম বা পি টি ঊষার সাফল্যে অপরিসীম আনন্দ পেয়েছি। এই আনন্দ-কষ্টগুলোই আমার দেশ। সেটা আমার অনুভব। তাকে সংজ্ঞায়িত করার অধিকার আমি কাউকে দেই নি। এই দেশের সংজ্ঞা আমাদের প্রত্যেকের কাছে আলাদা।
যেমন, আমার বাবা-মা কলকাতাকে বলে দেশ। বাবার কাছে আমার মুম্বাইয়ের বাড়ির ডালে "দেশের ডালের মত স্বাদ" নেই। অথবা, এ দেশে (মানে মুম্বাইতে) কলকাতার মত ঠান্ডা পড়ে না। আমি ওদের বকি। বলি, দুটো কি আলাদা দেশ না কি। আসলে বুঝি না, দেশ মানে একটা রাজনৈতিক-ভৌগোলিক সীমানা নয়, দেশ মানে জবরদস্তির ভক্তি নয়, দেশ মানে একাত্মতা। দেশ মানে একটা ভূখন্ড যাকে আমি চিনি এবং যে আমাকে চেনে। সেই ভূখন্ডের সীমানা যা কিছুই হতে পারে। তাই আমার আমেরিকান সিটিজেন দিদি বৎসরান্তে 'দেশে' ফেরে আর আমার কাজের দিদি 'দেশে' যায়।
আমি বাবা-মাকে কলকাতায় ফোন করি। ফোন রেখে দিয়ে বলি, বাড়িতে ফোন করেছিলাম। আমায় কেউ বকে না। কেউ বলে না, কেন মুম্বাইয়ে যেখানে থাকো সেইটা কি বাড়ি না? সেটা কি গাছতলা? কেউ বকে না। তাই আমি কলকাতায় গেলে নির্দ্বিধায় বলি, "বাড়ি গেছিলাম", ফিরলে বলি, "বাড়ি থেকে ফিরলাম"। আসলে বুঝি, বাড়ি মানে ইঁট, সিমেন্ট, জানলা নয়। বাড়ি মানে অন্যকিছু। ঠিক কি সেটা জানি না। হয়তো একটা কিছু নয়। হয়তো অনেক কিছু। হয়তো ছোটবেলা, হয়তো রোদ পোহানো, হয়তো দেওয়ালে ক্রেয়ন দিয়ে ছবি আঁকা। হয়তো এমন অনেক কিছু যেগুলো ও বাড়িতে হত, এখানে হয় না। এইভাবেই দেশ আর সবাড়্ মিলে মিশে যায়। তাদের সংজ্ঞা পাল্টাতে থাকে সময়ে সময়ে। তাই বম্বের ডালের স্বাদ বাবার কাছে কিছুতেই "আমাদের দেশের ডালের" মত হয় না, আবার কলকাতার গন্ধরাজ লেবুর সুগন্ধ কিছুতেই "দেশের বাড়ির" লেবুর মত হয় না।
দেশের কথা বলতে গেলেই মনে পড়ে যায় রাখালের মা-এর কথা। দেশভাগের পর স্বামী সন্তানের হাত ধরে এপারে আসা। তারপর লোকের বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঠিকা কাজ। আমি যখন কোলের শিশু তখন আমাদের বাড়ীতে রাখালের মায়ের আগমন, আমার দেখভালের দায়িত্বে। কাজকর্ম যে খারাপ করত তা নয় তবে একদিন হঠাৎ দেখা গেলো তিনি আমার জামা দিয়ে ঘর পরিষ্কার করছেন। কারন জিজ্ঞাসা করতে তার অতি সরল উত্তর, "জামাটা তো এমনিতে ধুইতেই হইব, তাই আর কি"।
এই ছিল রাখালের মা। মাথায় তার গোলমাল ছিল তাই কোনও বাড়ীতেই বেশিদিন কাজ করতে পারত না। রেগে গেলে মুখ দিয়ে অশ্রাব্য গালাগাল আর অভিশাপ ফোয়ারার মত বের হত। আর তাকে রাগিয়ে দেওয়াও ছিল সহজ। শুধু চেঁচিয়ে বলতে হত, বলহরি হরিবোল। পাড়ার ছেলে ছোকরারা রাখালের মাকে রাগিয়ে দিয়ে মজা পেত। পরে জেনেছি, অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে স্বামী-সন্তানদের কলেরায় হারিয়ে রাখালের মা ওই রকম হয়ে গেছিল।
শুধু আমাদের বাড়িতেই রাখালের মা কেমন যেন আটকে গেছিল। কাজ ছিল না, তবু আসত, আমরা পিসী বলে ডাকতাম। মা ওঁকে শাড়িটা, জামাটা, তেল সাবান দিত। কিন্তু যাই দাও না কেন, রাখালের মায়ের পরনে থাকত শত ময়লা শাড়ি। মা বকাবকি করত, রাখালের মা পাত্তাও দিত না। রোগা হাত পা, তার ওপর কালো কুঁচকোনো হিজিবিজি চামড়া, দোক্তা খাওয়া দাঁত আর সাদা চুল। দূর্ভাগ্য আর দারিদ্রের প্রতিমূর্তি যেন। কিছু খেতে ইচ্ছে হলে মায়ের কাছে এসে আবদার করত, "বৌদি, দুইডা টাকা দ্যান তো, বেগুনী খামু।"
পিসী আমাদের ভাইবোনদের খুব ভালবাসতো। মনে আছে, আমার মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরনোর পর দুটো রসগোল্লা নিয়ে এসে আমাকে সামনে বসিয়ে খাইয়েছিল। "ছেলে পাস দিসে, গরীব পিসি আর কি আনব কও? মিষ্টি দুইটা আমার সামনে খাও, আমি দেহি"।
রাখালের মায়ের আর কাজ ছিল জলপড়া নিয়ে আসা। আমাদের কারোর অসুখ বিসুখ হলে পাশের মসজিদ থেকে গিয়ে কাচের বয়ামে করে নিয়ে আসত পীরের জলপড়া। গায়ে মাথায় বুলিয়ে দিত সেই ভালবাসার জল। মা ভোরের আজান নিয়ে গজগজ করত, কিন্তু রাখালের মায়ের নিয়ে আসা মসজিদের জলপড়া নির্দ্বিধায় আমাদের মাথায় দিয়ে আমাদের সুস্থতা কামনা করত। আর ধর্মের আগুনে পোড়া দেশভাগে সব হারানো রাখালের মা আমাদের কপালে হাত ঠেকিয়ে বলত, জ্বরটা তাড়াতাড়ি কমিয়ে দাও ঠাকুর।
রাখালের মা নেই অনেক দিন। থাকলে বলতাম, ও রাখালের মা, একটু জলপড়া নিয়ে এস না গো। আমার দেশটার গা যে আবার জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।