রামু, নুরুল, সুচিত্রা, টুপু সবাই তেঁতুইল্যাদীঘির পাড়ে খেলে, চুরি করা কি কুড়িয়ে জোগাড় করা আম লিচু কি সাকুরকন্দ আলু পোড়া ভাগ করে খায়। পেট তো ভরেই, আনন্দও হয়। খেলাও কতো রকম। দারিয়া বান্দা, গোল্লাছুট, পূজা পূজা খেলা, বিয়া বিয়া খেলা। সুপুরি খোলের নৌকা চড়ে বর বৌ যায়, বরযাত্রীরা পাতার দিকটা টেনে নিয়ে চলে। আরো আছে স্বাধীনতা দিবস খেলা। মাথায় বোঁচকা বান্ডিল আর কোলে একটা পুঁচকে ভাই বা বোন নিয়ে মিছামিছি রিফিউজী রিফুউজী খেলা। বুধুর ঠাম্মা যদিও না করে থাকেন রিফিউজী খেলাটা খেলতে। আরো বারন করেন ভিক্ষা ভিক্ষা খেলা, কাছাগলায় কীরাধারী সেজে খেলতে। বলেন, ইতা খেলা ভালা না। না হোক, বাচ্চারা যা দেখে তার অনুকরণে খেলে। সব কথা কি আর শোনে। বাচ্চাগুলো মহরম খেলে, কের পুজো খেলে, সরস্বতী পুজো খেলে। রাজেশ কুমার রিয়াংএর ফুটফুটে মেয়েটার সঙ্গে নাদুসনুদুস হারুন মোল্লার ছেলে আবুর বিয়ে বিয়ে খেলা হয় দেববর্মা বিয়ের নিয়মে। পৌষ সংক্রান্তির সকালে কুন্ডুকর্তার মা সবজাতের নাতি নাতনীদের জন্যে একধামা নাড়ুমোয়া পাঠান। পৌষ পার্বন জমে যায়। ঈদের দুপুরে রশিদ চাচার মা একগাদা লাড্ডু হালুয়া জোগাড় রাখেন। গোবিন্দ পণ্ডিতের নাতনী আর মসজিদের ইমাম সাহেবের চারবছুরে নাতনী কাড়াকাড়ি করে খায়। কারোর জাত টাত যায়না।
সেদিন তো ঘোমটা আর ঘাঘরা পরা নাচনমণির পুজো হচ্ছিল পেয়ারা তলায় নৈমুদ্দিন দিব্যি পুরুত সেজে ঘন্টা নাড়লো। আঙুরাচাচী হাসতে হাসতে কান ধরে তুলে নিয়ে গেলো এই যা।
ক'দিন থেকে নূতন খেলা শুরু হয়েছে ইফতার। রামু দীপালি রেখা রহিম তৌফিক বুদ্ধুরাম সবাই জানে অন্ধকার থাকতে খেয়ে নিয়ে সারাদিন উপোস থাকতে হয়। সারাদিন উপোসটা অবশ্য এদের অনেকের জন্য আলাদা কিছু না। সন্ধ্যার সময় পেট ভরে খেতে হয় তারপর একদিন আসে চাঁদের দিন, সেদিন ঈদ। নামাজ পড়তে হয়। আকাশে একফালি চাঁদের ওপর সুন্দর তারাটি জাগে সেদিন ঈদ। কোলাকুলি করতে হয়।বন্ধুদের কিছু দিতে হয়।
মনিপুরী বস্তির গোরাচাঁদ আর ললিতা জানে চাঁদের রাতেই রাসপূর্নিমা নাচের উৎসব কিন্তু সেই চাঁদ বড় আর গোল । সে উপোস হলো কি হলো না, কিন্তু সন্ধ্যায় ইফতার হোলো। একদিন ঘরঘর থেকে লুকিয়ে চুরিয়ে আনা মুড়ি, কজন এনেছিলো জমানো পয়সায় কেনা তেলেভাজা। একদিন খাওয়া দাওয়া হোলো কলা আর জাম। আর একদিন মিষ্টি আলু পুড়িয়ে খুব ভালো ইফতার হোলো। আজ চাঁদের উৎসব। চাঁদ দেখা গেছে। নৈমুদ্দিন রসুল রহিম বড়দের সঙ্গে মসজিদে গেছে। নামাজ আদায় করেছে।আতর মেখেছে। কোলাকুলিও করেছে। হালুয়া, হালিম যা যা রান্না হয়েছে, খেয়েছে।
তা বলে দীঘির পাড়ে বন্ধুদের সঙ্গে ঈদ হবে না? রামু ললিতা, বুধন সবাই মিলে নৈমুদ্দিনদের সঙ্গে নামাজ পড়লো। কচি গলার প্রার্থনা আল্লার দরবারে পৌছলো নিশ্চয়, ভুল ছিলো হয়তো তবু। আমিনার নানীর দেয়া একথালা সিমুই, লালুর বাবার দোকানের একহাঁড়ি বোঁদে, হালিমের আম্মার দেয়া ছোলা ভাজা দিয়ে দিব্যি দাওয়াত হচ্ছিল।
কিন্তু গোল একটা বাঁধলো; সাঁঝ পেরিয়ে গেছে, শাঁখ বাজানো হয়ে গেছে। বাচ্চাদের ঘরে ফেরার নাম নেই। গেল কোথায়? ও তেঁতুইল্যাদীঘির পাড়ে ঈদের খানাপিনা হচ্ছে? চিন্তা হয়, আজকাল দিন বদলাচ্ছে, ঈদ, মহরম, পুজোর সময় শহর থেকে অতি উৎসাহী খবরদার আসে, নজর করে, ঘোঁট পাকায়। শেখাতে চায় অন্যের ধর্ম তোমার নয়, তোমার ধর্মে অন্যের নজর, ছোটরা তো বোঝে না, বড়রা ভয় পায়। তেতুইল্যার দীঘির পাড়ে কত ঘরপোড়া মানুষের বাস, সিঁদুরে মেঘে তারা ডরায়। জীপগাড়ির আলো দেখা যায় দীঘির ধারে, মোবাইল ফোনের আলো দেখা যয় যেন টিমটিম। পতাকা লাগানো গাড়ির কাছে যেতে সাহস হয় না, ভয় করে বড়দের।
মসজিদের মৌলবী আর গোবিন্দ জীউ আখড়ার গোঁসাই, সূফিয়ার নানী এক পাঠশালায় ছোটবেলা পড়েছে, এই খুদে গুলোর মতোই দৌরাত্ম্যি করেছে। মণিপুরি বস্তির বুড়োকে ডেকে আনে, গুটিগুটি চলে সব দীঘির পাড়ে। পেছনে লন্ঠন, বাংলাদেশ মার্কেটের চার্জলাইট নিয়ে পাড়া।
কি কথা হয় গাড়িওলাদের সঙ্গে, গাড়িওলারা গলা চড়ায়, তিনমাথা যাদের এক হয়েছে তারা নির্বিকার। শান্তভাবে বলেন বাচ্চাদের বাপু ধমক চমক করতে যেওনা। ফিরতে পারবে না। সিমুই খাও, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাও।
তারা সিমুই খায়না, ধোঁয়া উড়িয়ে জীপগাড়ি চলে যায়। পাকাচুলেদের চোখে চিন্তা, কিন্তু আজ যে আনন্দের দিন, দেখাই যাক না, আমরা যদ্দিন আছি...।
বাচ্চারা ঘরে ফেরে, পথে বকাঝকা কানমলা চুলটানাও জোটে, এ রোজকার ব্যাপার, আজ একটু বেশীই রাত হয়ে গেল, সে যাক, ঈদের দাওয়াত তো হলে। তেতুইল্যার দীঘি দেখে এপারে ঝুপড়ি বাড়ি সারিসারি, দাওয়ায় বসে বুড়োদের অস্পষ্ট আলাপ, ওপারে মাঠ পেরিয়ে শহর, জীপগাড়ির ধোঁয়া, অন্ধকার ফুঁড়ে মোবাইলের টাওয়ার।
আকাশে একফালি চাঁদ, তারা, একটুও মেঘ নেই। কোথায় ফুটেছে হাস্নুহানা। আতরসুবাস বাতাসে। আজ খুশির ঈদ। চাঁদের উৎসব।