বল্টুকে সুভাষ পল্লীর কেউ চেনে না এমনটা নয়। বল্টু খুব ভালো ক্যারাম খেলে। ক্লাবের রক্তদান শিবিরে সেই ফার্স্ট ডোনার। পাড়ার দুর্গা পুজোয় বিল হাতে হাসি মুখের যে ছেলেটা প্রথম কলিং বেল বাজায় সেই হল গিয়ে বল্টু। এমনকি চায়ের দোকানের বিশু কাকু অসুস্থ হলে তাকে এ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে যাওয়া, হসপিটালে ভর্তি করা, নিয়মিত খবর নেওয়া সব কিছুই করবে বল্টু। তাই সবাই তাকে খুব ভালোবাসে। ডেকে এনে চা খাওয়ায়। নিজেদের সুখ দুঃখের গল্প করে।
একদিন ঝিরঝিরে বৃষ্টির দিনে বল্টু খবর পায় সে গ্রাজ্যুয়েট হয়ে গেছে। মানে এই জীবনে স্কুল কলেজের লেখা-পড়ার গণ্ডি সে টপকাতে পেরেছে। হাঁপ ছেড়ে বাঁচে যেন সে। জীবনের একটা মহা অধ্যায় যেন পার হলো। সবাই তাকে গড়পড়তা স্টুডেন্ট হিসেবেই জানতো। পরীক্ষার আগে কয়েক রাত টেনে পড়ে নিয়ে পাশ করে যাওয়া। কাজেই ফাঁকি দেওয়া ছাত্রের নামের তালিকায় বরাবরই বল্টুর নাম থেকেছে। বকুনি খেতে হয়েছে। বাড়িতে গঞ্জনাও। অথচ যে ব্যাপারে কেউ তাকে টেক্কা দিতে পারতো না সেটা হলো গল্পের বই পড়া। সেই ছোট্ট থেকে তার বেজায় নেশা গল্পের বই পড়ায়। কেনায়। উপহার দেওয়ায়। রীতিমত তারই উৎসাহে পাড়ায় একটা ছোট্ট লাইব্রেরি খোলা হয়েছে। দেখা গেছে সেখানে বল্টু ছাড়া আর অন্যান্য লোকের যাওয়া কম। পড়ার উৎসাহ তো আরও তলানিতে। কিন্তু বুড়ো বট গাছের তলায় তাকে ঘিরে ধরে গল্প শোনার লোকের অভাব হয় না। কিন্তু বল্টু নিজেও আস্তে আস্তে বুঝতে পারছিল তার এইসব সুখের দিন শেষ হতে চলেছে। ঘরের খেয়ে বোনের মোষ তাড়ানো তার আর বেশিদিন চলবে না। বাবা রিয়াটার করেছে। বোন বুল্টি এবার উচ্চমাধ্যমিক দেবে। বাবার টিভিটা অনেক দিন খারাপ হয়ে পড়ে আছে। চারবার চাঁটি না মারলে চলে না। নিজের যে পুরনো ডেস্কটপ কম্পিউটারটা ছিল সেটার সিপিউ চেঞ্জ করতে হবে। বাড়ির ছাদ ফুটো। একটা সাধাসিধে গেরস্ত সংসারে লিস্টের বহর লম্বা।
বল্টু তাই গ্র্যাজুয়েশান শেষ করে একদম বসে থাকতে চায়নি। উপার্জনের নানা রকমের পরিকল্পনা করতে করতে সে খুব তাড়াতাড়ি ঠিক করে ফেলে সে ব্যবসা করবে। বাবার দেওয়া কিছু টাকা আর ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে বল্টু একটা গাড়ি কিনে ফেলে। যদিও বাবার এই গাড়ি কেনা নিয়ে তীব্র আপত্তি ছিল। স্কুল মাষ্টারের ছেলে কিনা শেষ পর্যন্ত গাড়ি চালাবে? বল্টু সে কথায় কান দেয়নি। তার এই তেইশ বছরের জীবনে সে অন্তত এটা বুঝতে পেরেছে কোন কাজ ছোট নয়। সেটা যদি সৎ পথে হয় আর মাথা উঁচু করে করা যায়। যদিও সে জানতো তাকে নিয়ে তার বাবা অনেক অনেক স্বপ্ন দেখেছিলেন। ছেলে ডাক্তার হবে। নয়তো ইঞ্জিনিয়ার। নিদেন পক্ষে স্কুল মাষ্টার। বল্টু এগুলোর কোন পথেই হাঁটেনি। বলা যায় হাঁটতে চায়নি। পারেওনি। যখন সবে সে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েছে বয়স আঠারো। পাড়ার ক্লাবের এ্যাম্বুলেন্সে হাত পাকিয়ে ড্রাইভার লাইসেন্স বার করে নিয়েছে। তারপর শখে কখনও বন্ধুদের গাড়ি চালিয়েছে। বাড়িতে না বলে কাগজ দেখে ড্রাইভার সেন্টারে নাম রেজিস্ট্রেশান করিয়েছে। বেশ কয়েকবার ডাক পেয়েছে। নিজের রোজগারের টাকা হাতে পেয়ে ভালো লেগেছে তার। এবার নিজের গাড়িটা কিনে বল্টু সেটা একটি বহুজাগতিক সংস্থা যারা যাত্রী পরিষেবা দেয়, সেখানে দিয়ে দিল। আর ঠিক করলো নিজেই গাড়ি চালাবে। এখন তার নিজের ক্যাব। নিজেই ড্রাইভার। এবং চলছিল ভালোই।
কিন্তু সবটাই যদি এক রকম হয় তাহলে গল্প হবে কী করে? বল্টুর জীবনে তাই একদিন এক গল্পের রাত এলো। সেদিন প্রচণ্ড বৃষ্টি। রাস্তাঘাট জলে থই থই। শহরটাকে মনে হচ্ছে কেউ যেন নদীপথ করে দিয়েছে। গাড়ি না চালিয়ে নৌকা নিয়ে বের হলেই ভালো হতো। তখন বেশ রাত। একটা বড় রাস্তার ধারে গাড়িটাকে পার্কিং করে রেখেছে বল্টু। সেদিনের টার্গেট শেষ হতে আরও একটা রাইড প্রয়োজন। এদিকে এতো বৃষ্টি, যাত্রী পাওয়াই মুশকিল। এমন ছোট খাটো অবসরে মেজাজ তিরিক্ষে না করে, আলতু ফালতু চিন্তা না করে বল্টু গল্পের বই পড়ে। সেদিনও সে পড়ছিল। পুরনো কলকাতার এক গোলকধাঁধার গল্প। ক্লাইমেক্স যখন প্রায় জমে উঠেছে ঠিক সেই সময়ে তার ফোন টিং টিং করে জানালো সেদিনের লাস্ট বুকিং পেয়েছে সে। ফোনের ম্যাপ বলছে কাছেই দাঁড়িয়ে আছে সওয়ারি। বল্টু গাড়ি নিয়ে এগোল। গাড়িতে সবুজ আলোর ঘড়িটা সময় দেখালো রাত বারোটা বাজতে চার মিনিট বাঁকি। চারিদিক শুনশান রাস্তা। শুধু তাই নয় ওয়াইপার চালিয়েও তুমুল বৃষ্টির রাতে কিছু ঠাহর করা যাচ্ছে না। গাড়ির ভেতরের এসি, বাইরের জল কাঁচের ওপর এমন জলীয় বাষ্পের আস্তরণ তৈরি করছে যাতে মনে হচ্ছে চারপাশের সব কিছু ঝাপসা। যেন ঘুম স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে গাড়ি। একটু এগোলেই দার্জিলিং। ঠিক এইরকম সময়ে মোবাইলের ম্যাপ একমাত্র ভরসা। সে এখন বলছে তার সওয়ারি খুব কাছেই। একদম কাছে। বল্টু গাড়ি দাঁড় করায়। ফোন করতে যাবে ঠিক সেই সময়ে ধড়মড় করে উঠে বসলো কাক ভিজে হওয়া চিমসে একটা লোক। সামনের লুকিং গ্লাসে ঠিক মতো মুখটাও দেখতে পেল না বল্টু। গাড়ি বুকিং হয়েছে খাল পাড় পর্যন্ত। “দাদা একদম ভিজে গেছেন। আমার কাছে একটা পরিষ্কার তোয়ালে আছে। একটু মুছে নেবেন?” বল্টুর কোন কথার উত্তর দেয় না লোকটা। বল্টু নিজেও কোন কথা বাড়ায় না। একেই অনেক রাত। চারপাশে গাড়ির সংখ্যা কম। নেশা-টেশা করে আছে কিনা সেটাও বোঝা যাচ্ছে না। যাক তার চেয়ে তার নতুন গাড়ির সিট ভিজুক। কিছুক্ষণ পরে শুধু হাওয়ার মতো ফিসফিস করে লোকটা বলে “আপনার বইটা একটু দেখতে পারি?” বল্টুর মনেই ছিল না তার সিটের পাশেই রাখা বই। ‘কলকাতার গোলকধাঁধা’। কিন্তু এই অন্ধকারে বৃষ্টি আর বিদ্যুতের মাঝে লোকটা বইটা দেখতে পেল কী করে? বল্টু গাড়ি চালাতে চালাতে বইটা কোন রকমে পেছনের সিটে চালান করে। বইটা দিতে গিয়ে লোকটার হাতের সাথে তার হাত একটু স্পর্শ হয়। এক্কেবারে হিমশীতল। অনেকক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজলে যেমন হয় তেমন। বল্টুর এমনিতে বকবক করা অভ্যাস। গাড়ি চালাতে চালাতে সে কত গল্প করে। যাত্রীদের কাছে গল্প শোনে। অনেকেই খুশি হয়ে, তার মিষ্টি ব্যবহারে, গল্প শোনার জন্য তাকে অনেক অনেক নম্বর দেয়। বল্টু চুপ করে না থেকে বললো “আপনি গল্পের বই পড়েন? এখন তো আর কেউ পড়তেই চায় না।” লোকটা চুপ করে থাকে কিছু বলে না। বল্টু যে তাকে ঠিকভাবে দেখতে পাচ্ছে তেমনটাও নয়। তবুও চুপ করে বসে থাকতে ইচ্ছে করে না। সে কথা বলতেই থাকে। “অনেকক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজছেন না? গা হাত তো একদম বরফ হয়ে গেছে স্যার। বাড়ি গিয়ে ভালো করে হালকা গরম জলে একটু চান করে নেবেন কিন্তু। মা বলতো বৃষ্টিতে ভিজে বাড়িতে এসে চান করে নিলে আর কোন ঝামেলাই থাকে না। মানে হাঁচি, কাশি, জ্বর কিচ্ছুটা হবে না।” লোকটা বল্টুর কথার সরাসরি কোন উত্তর দিল না। হাওয়ায় ভেসে আসা স্বরের মতো সে বললো “বটকৃষ্টকে আপনি চেনেন?” বল্টু জানতে চাইলো “বটকৃষ্ট? সে আবার কে?” লোকটা বললো “ভালো রাইটার ছিল বটকৃষ্ট এককালে”। বল্টু হেসে ফেলে। “ও...। আচ্ছা লেখক বটকৃষ্টের নাম বলছেন? নানা চিনবো কী করে? সেই কবেকার লেখক। আপনার হাতের বইটা ওনারই। বই গুলো আবার রি-প্রিন্ট হচ্ছে শুনে কিনলাম। আমার আবার ভূত প্রেত। থ্রিলার এইসব ভালো লাগে কিনা। এমন অনেক বই আমার বাড়িতে আছে। মা বলেছে এরপর বাড়িতে বই থাকবে না মানুষ সেটা বোঝা যাবে না।” হুড়মুড় করে অনেক কথা বলে খানিকটা স্বস্তি পায় যেন বল্টু। লোকটা বলে “বেশ। বেশ। বইয়ের কদর আপনি জানেন। এমন একটা লোককেই খুঁজছিল জনার্দন।” বল্টু বলে “জনার্দন কে? তার কাছে কি বই আছে অনেক? আমরা জানেন তো...আমাদের লাইব্রেরির জন্য ডোনার খুঁজছি।” লোকটা এবারেও বল্টুর প্রশ্নের উত্তর দেয় না। “একটু দাঁড়াবেন ভাই।” বল্টু গাড়ির ব্রেক কষে। “কিন্তু এখনও তো আপনার খাল পাড় আসেনি। আরও মিনিট পাঁচেক দেরি।” দুটো একশো টাকার নোট দিয়ে কুড়ি টাকা ফেরত না নিয়ে লোকটা চলে যায়। যাওয়ার সময় হালকা বিদ্যুতের ঝলকানিতে বল্টু দেখতে পায় লোকটাকে। ধুতি পাঞ্জাবি পরা। একটু সামনের দিকে ঝুঁকে হাঁটা লোকটার বয়েস ষাটেরও ওপরে। ঠিক সেই সময়ে মোবাইলে সওয়ারীর নাম ফুটে ওঠে জনার্দন বিশ্বাস। যেটা বল্টুর নজরে পড়ে না। স্ক্রিনে কয়েকটা ব্লিঙ্ক করেই মোবাইল চার্জ আউট হয়ে যায়। বল্টু বলে যাক নিজে থেকেই বিদেয় হয়েছে। না হলে বন্ধ করতে হতো। কিম্বা অন্য রাইডের কল চলে আসতো।
তার কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়ি ফেরে বল্টু। গাড়ি গ্যারাজে রাখতে গিয়ে দেখে একটা সিল করা কাগজের প্যাকেট। গাড়ির পেছনের সিটে ঠিক তার গল্পের বইটার পাশেই রাখা। প্যাকেটের গায়ে কিছু লেখা নেই। শেষ যাত্রীর ফেলে যাওয়া জিনিস। বল্টু আশ্চর্য হল এটা ভেবে, যে লোকটা কাক ভিজে হয়ে গাড়িতে উঠলো তার হাতে কাগজের প্যাকেট ভিজলো না? তাহলে কি তার আগের যাত্রীর? কিন্তু তা কী করে হবে? দুজন বয়স্ক মানুষ উঠেছিলেন। তাদের নিজে হাত ধরে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়েছে বল্টু। দেখে নিয়েছিল গাড়িতে কোন জিনিস পড়ে আছে কিনা। এটা বরাবরই সে করে থাকে। না হলে পরে ঝামেলা হয় খুব। অফিসে রিপোর্ট করতে হয়। বাড়ি খুঁজে জিনিস ফেরত দিতে হয়। উফ। আবার একটা ঝামেলা বাড়লো। তখনও বেশ ভালোই বৃষ্টি পড়ছে। ঘরে ঢুকে দেওয়াল ঘড়িতে দেখলো রাত দুটো বাজে। বাড়ির কার্নিশে এই বৃষ্টিতেও দুটো হুলো ঝগড়া করছে। বল্টু তাড়ালো তাদের। মোবাইল চার্জে বসিয়ে ফোন করলো যে নাম্বার থেকে গাড়ি বুক হয়েছিল। উল্টোদিকে স্বয়ংক্রিয় মেশিনের গলা জানিয়ে দিল এই নাম্বারের কোন অস্তিত্ত্ব নেই। মাঝে মাঝে নেটওয়ার্কের সমস্যা হলে এমনটা হয়ে থাকে। বল্টু অন্য কিছু না ভেবে খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়লো। পরের দিনও ফোনে বললো এই নাম্বারের কোন অস্তিত্ত্ব নেই। ট্রু কলার দেখলো। অফিসে গিয়ে তার বুকিং লিস্ট আদ্যপান্ত চেক করলো। ফোন নাম্বার আছে। সময় আছে। কিন্তু লোকটার কোন নাম নেই। অফিসার জানালো চিন্তার কিছু নেই যার জিনিস খুব দরকার হলে সে নিজেই ফোন করবে। আর বল্টুর যদি খুব তাড়া থাকে লোকটার জিনিস পৌঁছে দেওয়ার তাহলে খালপাড়ে গিয়ে খোঁজ নিক। অতো রাতে যখন লোকটা ওখানে নেমেছে, তাহলে অভিজ্ঞতা বলে লোকটা আশে পাশেই থাকে। বল্টু খালপাড়ে যে পর্যন্ত বুকিং ছিল সেখানেও গেল। কয়েকটা ভাঙা ফ্যাক্টরি শেড। আর একটা বস্তি। তারও পেছনে জলা জঙ্গল। একটা পোড়ো বাড়ি। অনেকদিন কেউ ওদিকে যায় না। কোর্টের কিসব কেস চলছে। বল্টু ওখানকার চায়ের দোকানে জানতে চাইলো। চেহারার বর্ণনা দিল। রোগা, লম্বা, ধুতি পাঞ্জাবি পড়া সামনের দিকে ঝুঁকে হাঁটা একজন বয়স্ক মানুষ। কেউ কিছু বলতে পারলো না। এমন লোককে তারা কোনদিন দেখেনি এই অঞ্চলে।
বল্টুর নিজের ফোনেও কোন ফোন এলো না। এমনকি অফিসেও না। একটা প্যাকেট হারিয়ে যাওয়া নিয়ে কারো মাথা ব্যথা হলো না তেমন। এক সপ্তাহ গেল। দু'সপ্তাহ গেল। প্যাকেটটা পড়ে রইলো বল্টুর ঘরেই। প্যাকেটটার কথা বল্টু যখন প্রায় ভুলতে শুরু করেছে হঠাৎ একদিন বর্ষার মধ্যে অনেক রাতে বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে খুব সুন্দর একটা গন্ধ পেল বল্টু। ঠিক ভালো ধূপ জ্বালালে যেমন গন্ধ হয় তেমন। ভাবলো বাবা বুঝি অমাবস্যার পুজো উপলক্ষে ভালো ধূপ নিয়ে এসেছে। আর মা সন্ধ্যাবেলা তার ঘরে জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। গন্ধ রয়েছে অনেক রাত পর্যন্ত। বল্টু ঠিক করলো মাঝে মাঝে এই ধূপ সে তার গাড়িতেও জ্বালাবে। গাড়ির কিলোমিটারের হিসেব করলো। পাড়ার কয়েকজন বন্ধুকে ফোন করলো। যারা নিশাচর,অনেক রাত জাগে। ক্লাবের খবর নিলো। খোশ গল্প করলো। টুকিটাকি কাজ যত সারতে লাগলো তত সে বুঝতে পারলো ঘরের সুন্দর গন্ধটা বাড়ছে। একটা সময়ে আর থাকতে পারে না বল্টু। ঘরের জানলা দরজা খুলে দেয়। তবুও যায় না গন্ধটা। আরও বাড়তে থাকে। তার কেমন যেন মনে হয় এটা ধূপের গন্ধ নয়। ধূপের গন্ধ এমন বাড়তে পারে না। কারণ তার ঘরে ধূপ জ্বলছে না। তাহলে কিসের গন্ধ? তার বোন কি কোন পারফিউমের শিশি ভুল করে খুলে রেখে চলে গেছে? কিন্তু বুল্টির অতো সাজের শখ নেই। তাহলে কী? সে তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকে কোথা থেকে গন্ধটা আসছে। খাটের তলা। আলমারী। ডেস্কটপের পাশে। টেবিল। ড্রয়ার টেনে খুলতেই আরও ঝাঁঝালো হয় গন্ধটা। তার সামনে সেই ফেলে যাওয়া কাগজের প্যাকেট। আর গন্ধের উৎস ওটাই। কি আছে প্যাকেটের মধ্যে? খানিকটা দোনমনা করেই প্যাকেট খুলে ফেলে বল্টু। আর প্যাকেটটা খুলতেই অবাক হয়ে যায় সে। দেখে খুব পুরনো একটা ডায়রী। সেই ডায়রী ওল্টালে প্রথম পাতায় ঝাপসা কালি পেনে লেখা আছে জনার্দন বিশ্বাস। এম এ। তলায় আরও ঝাপসা হয়ে আসা লেখা ১৯১০। এতো দিনের পুরনো ডায়রি? আর জনার্দন বিশ্বাস? নামটা কোথায় যেন শোনা শোনা লাগছে? চকিতে মনে পড়ে যায় সেদিনের সেই রাত। বল্টু গল্প করছিল তার বই পড়ার। লাইব্রেরীর। শেষ যাত্রী বলেছিল জনার্দন বিশ্বাস এমনই একজন লোকের খোঁজ করছে। বল্টু জানতে চেয়েছিল জনার্দন বিশ্বাস কে? উত্তর দেওয়ার বদলে লোকটা গাড়ি থেকে নেমে গিয়েছিল। কেমন যেন রহস্যের গন্ধ পায় বল্টু। নেশার মতো লাগে। ১৯১০ সালের ডায়রি? ঠিক তার কয়েক বছর আগে বঙ্গভঙ্গ নিয়ে উত্তাল হয়েছে দেশ। রবীন্দ্রনাথ গান বেঁধেছেন “বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পূণ্য হউক, পূণ্য হউক, পূণ্য হউক হে ভগবান”। তাহলে সেই সময়ে কেউ ডায়রি লিখেছে। আর সেই ডায়রি এখন এই মুহূর্তে বল্টুর হাতে? ভাবতেই রোমকূপ খাড়া হয়ে ওঠে। সামনে টেবিল ল্যাম্পের আলোটা আর একটু এগিয়ে নিয়ে আসে বল্টু। কিন্তু পরের পাতাটা উল্টোতেই আরও চমকে যায় যেন সে। কোথায় পুরনো লেখা? এটা তো তাকে উদ্দেশ্য করে কেউ লিখেছে। “আমি নিশ্চিন্ত হলুম অচিন্ত্য বাবু”। প্রথম লাইনটা পড়েই হোঁচট খায় বল্টু। তার ভালো নাম যে অচিন্ত্য সেটা জানলো কী করে যে ডায়রি লিখেছে? নাকি এটা অন্য কোন অচিন্ত্যের জন্য লেখা? তাড়াতাড়ি পরের লাইনে চোখ বোলায় বল্টু। “আপনার হাতে আমার ডায়রিটা পড়ছে ভেবে আমি অনেক বেশী হার্মফুল টাইম কাটাতে পারবো বলে মনে করছি। হ্যাঁ আমি আপনাকেই বলছি অচিন্ত্য বিশ্বাস।” হাত থেকে যেন পড়ে যায় বল্টুর ডায়রিটা। কোন রকমে নিজেকে সামলে নেয়। এই লোকটা তার টাইটেলও জানে? সে ঘুমোচ্ছে না তো? কিম্বা স্বপ্ন? কোন গল্পের বই খোলা আছে কী? চিমটি কাটে নিজেই নিজেকে। ডায়রির পাতায় লেখা আছে “আপনি যা পড়ছেন সবটাই সত্যি। সজ্ঞানে। জানেন আমি কতদিন নিশ্চিন্তে ঘুমোইনি? যাক এখন ভেবেই ভালো লাগছে গোটা কতকদিন আমি একটু গভীর ডুব দিতে পারবো। এরপর থেকে আমার কাজ গুলোর দায়িত্ব আপনার। আর আপনার গুলো আমার।” পাতার লেখাটা এখানে শেষ হয়ে যায়। কিসের কাজের দায়িত্ব নেবে বল্টু? আর বল্টুরই বা কি কাজ আছে যা এই ডায়রির লোকটা নেবে? অনেক রাতে ইলিশ মাছ খেয়েছে বলে তার পেট গরম হলো না তো? কিম্বা পাড়ার কোন বন্ধু ইয়ার্কি মারছে? তাও কী করে হয়? এই রকম ডায়রি এর আগে বল্টু কোনদিন দেখেনি। এমন সুন্দর পাতা। কালিটা কেমন যেন ঘোলাটে। পরের পাতা উল্টোলে দেখতে পেল আরও কয়েকটা লাইন লেখা। “আজ এই পর্যন্ত। কাল আবার হবেখন। মাঝে মাঝে আপনাকে একটু জ্বালাবো। মানিয়ে গুছিয়ে নেবেন দয়া করে। বিনীত জনার্দন বিশ্বাস।” তারপর আর ডায়রিতে কিছু লেখা নেই। অনেক রকম ভাবে ভাবনা চিন্তা করার চেষ্টা করে বল্টু। কেন ডায়রি? কার ডায়রি? তার গাড়িতেই বা কেন? কীসের কাজ? কেন কাজ? কে জনার্দন বিশ্বাস? লোকটা ফড়ে না দালাল? আন্ডারওয়ার্লড না সাইবার ক্রাইম? ছোট মামার বন্ধু? নাকি মেজো পিসের নাত জামাই? কোন কিছুরই কূল কিনারা করতে পারলো না বল্টু। বরং সাত পাঁচ ভাবার মধ্যে ঘুম তাকে এসে জড়িয়ে ধরলো।
সকালে বোন বুল্টির ডাকে যখন ঘুম ভাঙলো বল্টুর। বেলা তখন অনেক। ফোনের এলার্ম কখন বেজে গেছে তার ঠিক নেই। বুল্টি বলে “তুই কেমন রে দাদা? কত বেলা পর্যন্ত ঘুমোচ্ছিস? মা এসে ডেকে গেল। বাবা ডাকলো। তোর কোন হুঁশ নেই? একবারও তো বলিসনি তোর ডেস্কটপটা সারিয়ে নিয়েছিস। আমি তো রোজ যাচ্ছি শ্রাবণীর বাড়ি কম্পিউটার প্র্যাকটিস করতে। সারারাত কম্পিউটার চলছে খেয়াল আছে? মাথার কাছে টেবিল ল্যাম্প জ্বালা। চেয়ারে বসে ঘুমিয়ে পড়েছিস।” ঠিক তার মতই ঝড়ের গতিতে কথা বলে যায় বুল্টি। ধড়ফড় করে উঠে বসে বল্টু। সারা রাত চেয়ারে শুয়েছে? ডেস্কটপ খোলা? কিন্তু সেটা তো অনেকদিন সারানো হয়নি। সিপিউ খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তাহলে কি নিজে থেকেই ঠিক হয়ে গেল? বুল্টি খুশি হয়েছে কম্পিউটার পেয়ে। সে কাজ করতে বসে গেল। আর বল্টু ভাবতে শুরু করলো সিপিউ নিজের থেকে ঠিক হয়ে গেল? নাকি খারাপ হয়নি? তাদের টিভির মতো দু-তিনবার চাঁটি মারার দরকার ছিল তাহলে অনেক আগেই। আপসে বাপ বলে কাজ করতে শুরু করতো। কিন্তু এতো সব ফালতু বিষয় নিয়ে ভাবার সময় নেই বল্টুর। দেরি হয়ে গেছে। গাড়ি বের করতে গেল সে। কী আশ্চর্য কেউ যেন তার গাড়ি ধুয়ে মুছে সাফ করে রেখেছে। তাহলে কি রতন গ্রামের বাড়ি থেকে ফিরে এসেছে? ওদের বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় বল্টু যদিও দেখল তালা দেওয়া। তাহলে তার সাথে যেগুলো হচ্ছে সেটা কি স্বাভাবিক? নাকি বটকৃষ্টের কলকাতার গোলক ধাঁধার নায়কের মতো তার জীবনেও কোন ঘটনা ঘটে চলেছে? ধুর এরপর থেকে আর গল্পের বই পড়বে না। মা ঠিকই বলে এইসব পড়ে পড়ে তার মাথাটা বুঝি গেছে।
সারাদিন সে গাড়ি নিয়ে শহরের এ মাথা থেকে ও মাথা ছুটে বেড়ালো। কত লোকের সাথে নতুন করে পরিচয় হলো। কত নতুন গল্প শুনলো। শোনাল। কিন্তু বকবক করে যাওয়া বল্টু কাউকে ডায়রির কথা বললো না। কারণ সে নিজেই তো এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না। সেদিন তাড়াতাড়ি টার্গেট ফুলফিল হয়ে গেল। সন্ধ্যের মধ্যে বাড়িতে ফিরে দেখলো যেন উৎসব বসেছে। বড় পিসি এসেছে। ছোট মাসি। মার আনন্দ আর ধরে না। ছেলে যে তাদের জন্য বত্রিশ ইঞ্চির একটা ফ্ল্যাট টেলিভিশন কিনে দিয়েছে। তাও নিজে বলেনি। দোকানে বুক করে বলেছে বাড়িতে দিয়ে আসতে তাতে আরও মজা পেয়েছে মা। “আজকের দিনটা তুই কি করে মনে রাখলি বল্টু? তোর বাবাও যে মনে রাখে না। আজ যে আমাদের বিয়ের দিন। পঁচিশ বছর দ্যাখ কেমন হুট করে কেটে গেল”। বল্টুর বাবা মনে মনে খুশি হলেও গম্ভীর হয়ে বললেন “এতোগুলো টাকা এখন খরচ নাই করতে পারতে। গাড়ির ই এম আই এর টাকা শোধ করতে হচ্ছে তো?” বল্টু কী বলবে বুঝতে পারলো না। সে যে টিভির দোকানে যায়নি। অর্ডার দেওয়ার তো দূরের কথা। হ্যাঁ মনে মনে ইচ্ছে ছিল মায়ের জন্য যদি একটা নতুন টিভি কিনে দিতে পারে। হঠাৎ যেন নিজেই নিজেকে থামিয়ে দেয়। যা ইচ্ছে ছিল তাই তো ঘটে চলেছে না? কম্পিউটার সারানোর ইচ্ছে ছিল। কিন্তু পারেনি টাকার জন্য। কম্পিউটার ঠিক হয়ে গেল। টিভি কেনাও তাই। কে করছে এইসব? ডায়রির পাতার আওয়াজ হয় মনে। সেখানে লেখা ছিল “এবার থেকে আমার কাজ আপনি করবেন। আপনার কাজ আমি”। বল্টু বুঝতে পারে কোথাও একটা ভীষণ ভুল হচ্ছে। যা হচ্ছে ঠিক হচ্ছে না। বল্টু অনেক দিন পরে সবার সাথে খেতে বসেও উঠে পড়লো। ঠিক করে খেতে পারলো না। কাউকে কিছু না জানিয়ে ছুটলো রসিদ নিয়ে টিভির দোকানে। তখন দোকান বন্ধ করার প্রস্তুতি চলছে। তারা কোন কথার জবাব দিতে চায়না। বল্টুর নাছোড় অনুনয়ের কাছে হার স্বীকার করতে বাধ্য হল তারা। বল্টু শুধু জানতে চায় এই টিভির জন্য কোন এ্যাকাউন্ট থেকে টাকা এসেছে? ক্যাশে বসা ছেলেটা বলে এটা তো ক্যাশে কেনা হয়েছে। নেট ব্যাঙ্কিং তো হয়নি। বল্টু জানতে চায় লোকটা কেমন? আপনাদের তো সিসিটিভি ফুটেজ আছে? সেটা দেখা যায় না? কিন্তু দোকানের সিসিটিভি ফুটেজ বাইরের কাউকে দেখতে দেওয়া হয় না। তারজন্য স্পেশাল পারমিশান লাগে। বল্টুকে তারা দেখতে দিল না। শুধু ক্যাশে বসা ছেলেটি অনেকক্ষণ চিন্তা করে বললো একজন বয়স্ক, ধুতি পাঞ্জাবি পরা লোক এসেছিলেন। খুব কাশছিলেন তিনি। বেশিক্ষণ দাঁড়াননি। টিভির মডেল নাম্বার বলে টাকা আর ঠিকানা দিয়ে যেন হাওয়া হয়ে গেলেন। অতো এসির মধ্যে দাঁড়িয়েও বল্টু ঘামে। বয়স্ক লোক। ধুতি পাঞ্জাবি পরা। এইরকম একটা লোককে সে সেদিন গাড়ি থেকে নামিয়েছিল। তারপরেই তার গাড়ির মধ্যে পাওয়া যায় সেই ডায়রি। “এনি প্রবলেম স্যার?” সেলসম্যান ছেলেটি তার দিকে তাকিয়ে। বল্টু কী বলবে বুহতে পারে না। শুধু মাথা নেড়ে ‘না’ বলে চলে আসে।
অনেক রাতে আবার যখন ঘরের মধ্যে ঘোর লাগা মিষ্টি গন্ধ। ডায়রি খুলে বসে বল্টু। আগের দিনের লেখা গুলো খুঁজে পায়না সে আর। কেউ যেন মুছে দিয়েছে। কিম্বা লেখাই ছিল না কোনদিন। বরং সেখানে লেখা একটা ছোট্ট ছড়া। নাকি ধাঁধা? “বাতাসে উড়িছে যত/ শত শত শাপ/ তারা কেহ লুকায়েছে/ কেহ করিয়াছে পাপ/ছায়া সেতো ছায়া নয়/উপছায়া যত/ কিম্ভুত কদাকার/জোটে এসে তত।” কেন এমন লেখা? বাতাসে শত শত কাদের শাপ ঘুরে বেড়াচ্ছে? আর তারা কেনই বা পাপ করেছে? কাদের জন্য পাপ করেছে? নাকি তাদের দিয়ে জোর করে পাপ করানো হচ্ছে? হঠাৎ জানলার পাশ থেকে কেউ যেন সরে গেল মনে হল। কে ওখানে? কে? ছুটে গিয়েও কাউকে দেখতে পায় না বল্টু। ঘামছে সে। দূরে কোথাও দুটো হুলোতে ঝগড়া করছে। তাকে কেউ কি ফলো করছে? সে কি বড় কোন এক জালে আটকে গেছে? তার সাথেই কেন ঘটছে এমন? “ছায়া সেতো ছায়া নয়/উপছায়া যত”। কারা উপছায়া? তার বাড়িতেই বা ধাওয়া করে আসছে কেন? যত এইসব প্রশ্ন পাগল করে তুলছে বল্টুকে তত একটা সুন্দর গন্ধ যেন আবেশ করে ঘিরে ধরছে তাকে। খুব শীত করছে তার। খুব শীত। ফিসফিস করে হাওয়ায় যেন কে কথা বলছে “আমার কাজ আপনাকে করতে হবে। আপনার কাজ আমায়”। ঘুম পাচ্ছে বল্টুর। খুব ঘুম। ঝাপসা হয়ে আসছে চারপাশ। কোন এক গভীর গহন অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে যেন বল্টু। সেখান থেকে যেন আর কোনদিন ফিরে আসতে পারবে না। কোনদিন না।
মা সকালে এসে দেখেন ছেলের গায়ে ধুম জ্বর। “আহা রে। এতো কষ্টও কি সহ্য হয় এই ছোট বয়সে? কে বলেছিল তোকে সারাদিন গাড়ি চালাতে? কে বলেছিল এক্ষুনি তোর রোজগার না করলে বাড়িতে হাঁড়ি চড়বে না? জানি এইসব কিছুর মূলে তোর বাবা। সারাদিন কাজ কাজ করে ছেলেটার মাথা খেল। হয়েছে তো এখন...” চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তোলেন মা। বাবা ডাক্তার নিয়ে আসে। পেট গরম আর জ্বরের ওষুধ দিয়ে তিনি চারশোটি টাকা ভিজিট নিয়ে চলে যান। বল্টু হিসেব করে চারশো টাকা মানে নাইট ট্রিপে ভবানীপুর থেকে উত্তরপাড়া। চলে গেল বুড়ো ডাক্তারের পকেটে। রোজগার নেই। কিছু নেই। এইভাবে টাকা জলে যাওয়ার কোন মানে আছে? তাও আবার এক ভুতুড়ে ডায়রির জন্যে? আজকেই দূর করে দিয়ে আসবো। কার না কা ডায়রি। বাড়িতে রাখার কোন মানেই হয় না। জ্বরের খবর শুনে হাবু এলো। পল্টু এলো। এরা সবাই ছোট বেলার বন্ধু। বাড়িতে বল্টুকে পাওয়া আর সিকিম লটারি জেতা এখন এক ব্যাপার। “ভালো কথা একটা চিমসে মতো লোক তোদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। বাড়ি ঢুকতে যাবো বলে কিনা একটু অচিন্ত্যবাবুকে দিয়ে দেবেন। রাতের গাড়ি ভাড়াটা বাকি ছিল।” হাবুর হাতে কড়কড়ে দুটো দু'শো টাকার নোট। চমকে ওঠে বল্টু। চারশো টাকা? এইমাত্র সে ভাবছিল ডাক্তারের চারশো টাকা ফিজ নিয়ে। তার তো গাড়ি ভাড়া বাকি নেই কারো কাছে। আর কী বললি? চিমসে মতন লোক? ধুতি পাঞ্জাবি পরেছিল কি? হাবু ঘাড় নাড়ে। “হ্যাঁ পরেছিল তো”। ছুটে যায় বল্টু জানলার কাছে। কোথায় দাঁড়িয়েছিল বললি? জানলার কাছে? কিন্তু কোথায় কে? কেউ নেই। হাবু বলে এমন করছিস কেন? টাকা না দরকার হলে আমাকে দিয়ে দে। আমি খরচা করে দেবো আইসক্রিম আর কাবাব খেয়ে। পল্টু তার পান খাওয়া দাঁতে ফিক করে হেসে ফেললো। কি ক্যাঁচাল মাইরি!
অনেক রাতে বল্টুর ঘুম ভেঙে গেল একটা ঠক ঠক আওয়াজে। উঠে বসে বল্টু। লাইট জ্বালায়। ইঁদুর গুলোর বড্ড বার বেড়েছে। বাড়িতে অমন একটা গাবদা হুলো। সারাদিন খাচ্ছে আর রাতে গিয়ে ঝগড়া করে ঘুমের পিণ্ডি চটকাচ্ছে। গজ গজ করে বল্টু। এ্যাই যা হুশ হুশ। কিন্তু আওয়াজ থামে না। কোথা থেকে আসছে এই আওয়াজ? হঠাৎই নজর যায় টেবিলের দিকে। দেখে টেবিলের ড্রয়ারটা যেন কাঁপছে। ঠেলে বেড়িয়ে আসার চেষ্টা করছে যেন ড্রয়ারটা। যে ড্রয়ারের মধ্যে রাখা পুরনো সেই ডায়রি। যে ডায়রির গায়ে গন্ধ। যার মালিককে খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ একটা অদ্ভুত লোক। কিছু ছায়া ঘুরে ঘুরে চক্কর কাটছে তাদের বাড়ির চারপাশে। ঘরের মধ্যে ভেসে বেড়াচ্ছে সুন্দর সেই গন্ধ। বল্টু কী করবে বুঝতে পারে না। এইসময় ভয় ভক্তি চলে গিয়ে মানুষ কেমন যেন অসহায় হয়ে পড়ে। সেকি মাকে ঘুম থেকে তুলে সবটা বলে দেবে? আর তারপর যদি মা ড্রয়ার খুলে দেখে সেখানে ডায়রি নেই? তাহলে কী ভাববে? এর আগে এমন যে একেবারেই হয়নি তেমনটা নয়। বল্টু তখন ক্লাস এইটে পড়ে। ঝুলনদার কম্পিউটারে স্পিলবার্গের ইটি দেখে বল্টুর মনে হয়েছিল তাদের জাম গাছের তলায় একটা স্পেস শিপ এসে নেমেছে। আর ছোট ছোট এলিয়েন ঘুরে বেড়াচ্ছে বাগান জুড়ে। মাঝরাতে বাড়ির লোকজনকে ঘুম থেকে তুলে সে এক যাতা ব্যাপার। বাবা হাসতে হাসতে বলেছিল ওখানে জোনাকির বাসা। এক সাথে সবাই জ্বলছে বলে জায়গাটা অমন আলো হয়ে আছে। আর মিনমিনে আলোয় ওগুলোকে অমন চোখ জ্বলা নেভার মতো মনে হচ্ছে। এর আগে বল্টু জোনাকি দেখেনি। ভুলটা হয়েছিল তারজন্য আরও বেশি। আজকেও যদি তাই হয়? বল্টু বাইরের কোন রিস্ক নিলো না। যা হবে নিজের সাথেই হোক। আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল ড্রয়ারের দিকে। আর ঠিক তখনি দেখলো ড্রয়ারটা আচমকাই খুলে গেল তার সামনে। ছিটকে চলে এলো ডায়রিটা তার হাতেই। মনে হল কেউ যেন জোর করে ধরিয়ে দিল। পাতা উলটে গেল আপনা-আপনি। বল্টু আবিষ্কার করলো ডায়রিটার পাতায় লেখা একটা বাড়ির ঠিকানা। সেই ঠিকানার তলায় শুধু লেখা। বাঁচান, এরপর না হলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। পরের পাতায় লেখা। “গাড়ি গ্যারেজ থেকে বাইরে বের করা আছে।” গ্যারাজে এসে বল্টু নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করতে পারে না। সত্যিই তাই। কে বার করলো তার গাড়ি? চারটে তালা খুলে? জানা নেই। গাড়িতে উঠে বসতে গাড়িটা আপনা আপনি স্টার্ট নিলো। কোন নিয়ন্ত্রণ নেই গাড়ির ওপর বল্টুর। গাড়ি যেন নিজে থেকেই নিয়ে চলেছে তাকে। এটা কি বল্টুর স্বপ্ন? নাকি সে জেগে আছে। নিজেই নিজেকে থাপ্পড় মারলো। ভীষণ লাগলো তার। দেখতে পেল সে খালপাড় পেরিয়ে আসছে। এই জায়গা তো তার চেনা। এখানে নামিয়ে দিয়েছিল ধুতি পাঞ্জাবি পরা চিমসে লোকটাকে। এখানে কেন নিয়ে এলো গাড়ি? খাল পাড় পেরিয়ে রাস্তা সোজা ঢুকে যাচ্ছে ফ্যাক্টরি শেড। তার পাশে বিশাল মাঠ। গাড়ি আর একটু এগিয়ে মাঠের মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। কিছুতেই বল্টু স্টার্ট দিতে পারে না তার গাড়ি। খারাপ হয়ে গেল নাকি? এই রাতে এই জায়গায় খারাপ হলে মুশকিল। তার নতুন গাড়ি। ছিনতাই এর ভয় আছে। গাড়ি থেকে নেমে পড়ে বল্টু এক্ষুনি তাকে সারাতে হবে। যে করেই হোক।
গাড়ি থেকে নেমে বল্টু বুঝতে পারে চারিদিকে ঘন গাছের জঙ্গল। সামনে পোড়ো একটা দোতলা বাড়ি। আর সেই বাড়ির কোনের ঘরে একটা আলো জ্বলছে। আর কি অদ্ভুত ভাবে সারা জায়গাটা যেন মো মো করছে তার চেনা সেই পরিচিত মিষ্টি গন্ধে। দোতলার কোনের ঘরের জানলার ফাঁক দিয়ে এসে পড়া আলোটা যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে বল্টুকে। কোথায় গাড়ি সারাবে, বাড়ি চলে যাবে তা না করে বল্টু ঘুরে দাঁড়ায় বাড়ির দিকে। মোবাইলের টর্চটা জ্বালিয়ে নেয়। অনেক পুরনো কাঠের দরজার ওপরে ক্ষয়াটে টিনে লেখা বাড়ির ঠিকানা। যে ঠিকানা ছিল ডায়রীর পাতায়। দোতলা থেকে কার যেন একটা গোঙানির আওয়াজ ভেসে আসছে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করে বল্টু। সে যাচ্ছে নাকি তাকে কেউ নিয়ে যাচ্ছে বোঝা যায় না। অনেক দিন আগে কোন এক গল্পের বইতে পড়েছিল নিশির ডাকের কথা। তাহলে তাকে কি আজ নিশিতে পেয়েছে? এইসব কিছুই ভাবতে পারছে না বল্টু। তার সামনে তখন দোতলার কাঠের সিঁড়ি। তার ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার ঠক ঠক শব্দ। ভাঙা দেওয়ালে বট গাছের শিকড়ের পাশে কবেকার কলকাতার পুরনো সব ছবি। পেইন্টিং। সিড়ি পার করে বারান্দা দিয়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় বল্টু একদম কোণের ঘরের দিকে। আলো জ্বালা ঘরটার সামনে এসে দাঁড়ায়। তার সামনে আধভেজানো দরজাটা আস্তে আস্তে খুলে যায়। বল্টু স্পষ্ট দেখে তার সামনে ঘরের মধ্যে সেই চিমসে বয়স্ক ধুতি পাঞ্জাবি পরা লোকটা। বিছানার সাথে যেন প্রায় মিশে গেছে। অসুস্থ সে। বল্টুরই দিকে তাকিয়ে। বল্টু মনে মনে বলে আরও ভেজো এই বয়েসে বৃষ্টিতে। তাহলে এমনটাই হবে। লোকটা যেন বল্টুর মনের কথা পড়ে নেয়। হাওয়ায় ফিসফিস করে সেই আগের মতো বলে “আপনাকে কেন ডাকলাম জানেন? এইগুলো সব উদ্ধার করতে হবে।” যেদিকে লোকটা দেখায় সেই দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায় বল্টু। ঘরের দুটো দেওয়াল শুধু ঠাসা আছে বইতে। বল্টু এগিয়ে যায় বই গুলোর দিকে। এতো পুরনো বই সে আগে কখনো দেখেনি। এখনও কেমন যেন চকমক করছে তার মলাট। বুড়ো বলে “না হলে কি আর এতো চিন্তা করি? যক্ষের মতো আগলে রাখি? লোক পাচ্ছিলাম না যে তাকে সব বুঝিয়ে দিয়ে যাই।” এগিয়ে আসে বল্টু। কে আপনি? কি করে আমার মনের কথা পড়ে ফেলছেন? কেন আমাকেই ডেকেছেন? বুড়ো বলে “ভালোবাসেন যে বই...।” বুড়ো আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলো। কিন্তু প্রচণ্ড কাশি পায় তার। যেন হাঁপ ওঠে। বল্টু বলে বইয়ের কথা পরে হবে। আপনাকে এখনি হসপিটালে নিয়ে যাওয়া দরকার। দাঁড়ান, আমার পাড়াতেই এ্যাম্বুলেন্স আছে। বললেই এখনই চলে আসবে। ফোন করে বল্টু পাড়ায়। হাবুই ফোন ধরে। বিরক্ত হয়ে বলে “এতো রাতে আমার মোবাইলে ফোন না করে এ্যাম্বুলেন্সের নাম্বারে ফোন করছিস কেন? বাড়ির সবাই ঠিক তো?” বল্টু বলে তারা ঠিক আছে। এখনি আসতে হবে খালপাড়ে। খুব তাড়াতাড়ি। মাঠের শেষে। জঙ্গলের মধ্যে দোতলা বাড়ি। কেটে দেয় ফোন। হাবু অবাক হয়। ওখানে কোন মানুষ থাকতো বলে তার জানা ছিল না তো। এই তো জ্বর ছিল ছেলেটার। আবার মরতে ওখানে কেন গেল? যাই এ্যাম্বুলেন্স নিয়ে। কার আবার কী হলো? একটু যদি নিজের দিকে খেয়াল রাখে।
এদিকে বল্টুর সামনে কাশতে কাশতে বুড়োর এমন অবস্থা হয়েছে আর যেন কথা বলতে পারছে না। মনে হচ্ছে যেন এক্ষুনি তার প্রাণটা বেড়িয়ে যাবে। বল্টু জল খোঁজে। ঘরের কোনে একটা মাটির কুঁজো দেখতে পায়। পাশে রাখা কবেকার পুরনো একটা কাঁসার গ্লাসে জল ঢালে। বুড়োর সামনে এসে তাকে বলে এই যে শুনছেন...জল...জল খান একটু। আমি এক্ষুনি এ্যাম্বুলেন্সে ফোন করেছি তারা চলে আসলো বলে। বুড়ো কী যেন একটা বলতে চাইছে। কানের কাছে মুখ নিয়ে যায় বল্টু। “বই গুলো...বই গুলো...”। বল্টু বলে আপনি সুস্থ হয়ে গেলেই ওদের ব্যবস্থা করবো। একা থাকেন নাকি? কী করে থাকেন বলুন তো? সেদিন বললেই হয়ে যেত। এতোদিনের মধ্যে আপনার বই সব ঠিক জায়গায় পৌঁছে দিতাম। এই নিন জল খান। বুড়ো হা করে। বল্টু জল দেয় তার মুখে। কিন্তু এটা কোথায় জল ঢালছে বল্টু? সব জল যে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে মুখ থেকে। আর পড়বে নাই বা কেন? বল্টু তো জল খাওয়াচ্ছে মানুষকে না। এটা তো একটা কঙ্কাল। একটা কঙ্কাল হা করে শুয়ে। তার সেই ফাঁকা মুখের মধ্যে জল ঢেলে চলেছে বল্টু। ছিটকে সরে আসে সে। তার সামনে বুড়ো কোথায়? বিছানার শুয়ে একটা কঙ্কাল। তার চোখ গুলো ভাটার মতো জ্বলছে। বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে “আমার বই গুলো...আমার বই গুলো...তোমাকে দিলাম...রক্ষা করো...”। বল্টু প্রচণ্ড ভয় পেয়ে ঘর থেকে বেরোতে যাচ্ছে। চৌকাঠে হোঁচট খাচ্ছে। ধড়াম করে পড়ে যাচ্ছে সে। একটা ক্ষীণ রক্তের ধারা এগিয়ে চলেছে কাঠের সিড়ির দিকে।
চোখ খুলেই বল্টু দেখতে পায় একটা কালো মোটা মতন লোক। ইয়া বড় গোঁফ নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে। এটা কি যমদূত? যমপুরীতে বুঝি এতো আলো থাকে? লোকটার হাতে ওটা কী ধরা? একি? ওটা যে মিনারেল ওয়াটারের বোতল। ধুর। যমদূত কখোনো মিনারেল ওয়াটার খায় নাকি? বল্টু বুঝতে পারে সে হসপিটালে শুয়ে আছে। তার সামনে খাঁকি পোষাকে পুলিশ। ততক্ষণে লোকটা বল্টুকে চোখ পিটপিট করতে দেখে বাইরে খবর দিয়েছে। খবর পেয়ে মা বাবা বুল্টির সাথে আরও একজন ঘরে ঢুকলেন খালপাড় থানার ওসি দেবব্রত রায়। বললেন “আপনি তো একটা বিরাট কাজ করেছেন মশাই। বেশ কিছু দুষ্প্রাপ্য এবং দুর্মূল্য বই উদ্ধার করে দিয়েছেন। আর কিছু দিন চোখে না পড়লে তো সব হাওয়া যেত। এমনিতেই ওদিকে কেউ যায় না। সাপ খোপ। জলা জঙ্গল। কোর্টের রায় ঝুলে আছে বলে জমিও বিক্রি হয়নি। ওখানে যে ওরকম একটা নাইটিন্থ সেঞ্চুরির বাড়ি ছিল কেউ জানতোই না।” বল্টু বিড়বিড় করে বলে “নাইটিন্থ সেঞ্চুরি?” ওসি বলে “তাহলে আর বলছি কি মশাই? কলকাতায় যে ক'টা পুরনো বাড়ি আছে তারমধ্যে এই বাড়িটা একটা। আপনার দুদিন অজ্ঞান থাকার মধ্যে কত কী জেনে নিয়েছি দেখুন। বল্টু বিড় বিড় করে বলে দু-দিন অজ্ঞান হয়েছিলাম? মা বলে মাথায় ক'টা স্টিচ হয়েছে তার খবর রাখো তুমি? সারাদিন শুধু টইটই। বল্টু ওসির দিকে তাকিয়ে বলে কী খোঁজ নিয়েছেন? ওসি বলার সুযোগ পায়। এক্কেবারে ঝাঁপিয়ে পড়ে যেন। “কোন এক পতুর্গিজ সাহেবের কাছ থেকে বাড়িটা কিনেছিলেন হ্যামিংটন বলে একজন সাহেব পেইন্টার। তার কাছ থেকে সেকালের ইংরেজ সরকারের এক দালাল গোছের লোক জনার্দন বিশ্বাস বাড়িটা কিনে নেয়”। কেমন যেন চমকে ওঠে বল্টু। চোখের সামনে ভাসে ধুতি পাঞ্জাবি পড়া চিমসে লোকটা। একটা কঙ্কাল।
ওসি বলে "কী ভাবছেন মশাই? কলকাতা পুলিশ আপনাকে জাতীয় সম্পত্তি উদ্ধারের জন্য পুরস্কার দেবে বলেছে।” বল্টু অবাক হয়ে তাকায়। কেন? আমি করলাম? ওসি বলে “কী করেননি সেটাই বলুন। সব মরক্কোর চামড়ার মলাট। সোনার জলে বইয়ের নাম লেখা। খান দু'শো বছর আগের তো হবেই।” বল্টু জানতে চায় আর কঙ্কালটা? ওসি বলে আবার কার? জনার্দনের নিশ্চই। প্রাথমিক ময়না তদন্তে অনুমান খুন হয়েছিলেন ভদ্রলোক। তাও সে কত বছর আগে।” বল্টু বিড়বিড় করে বলে খুন? ওসি বলে “না হলে বলছি কি? তাও কি যে সে ছু্রি? এক্কেবারে নবাবি ছুরি দিয়ে খুন। সিরাজদৌল্লার বুঝলেন?” বল্টু ঘাড় নাড়ে। সে কিছুই বুঝতে পারছে না। ওসি বলে “লোকটা অনেক পুরনো কিছুর হদিস জানতো বলে মনে হয়। সাহেবদের গুপ্তচর ছিল। নিজেদের খেয়োখেয়িতে এক্কেবারে শেষ। তা আপনি ওদিকে গেলেন কী করে? ভাড়া ছিল বুঝি?” বল্টু উত্তর দিতে যাবে ঠিক সেই সময়ে খুব পরিচিত কণ্ঠে হাওয়ায় কেমন যেন কথা ভেসে এলো “সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কি খুব দরকার আছে?” বল্টু চকিতে ঘুরে তাকালো দরজার দিকে। কিন্তু না কাউকে দেখতে পেলো না সে।
সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার পরে একবার লালবাজারে যেতে হয়েছিল বল্টুকে। ডায়রির কথাটা কাউকে বলতে পারেনি কারণ বাড়ি ফিরে ড্রয়ারে ডায়রিটা পায়নি। শুধু যেদিন জনার্দন বিশ্বাসের কঙ্কালটাকে মেডিকেল কলেজে দিয়ে দেওয়া হল সেদিন গিয়েছিল বল্টু। সই সাবুদ করার দরকার ছিল সাক্ষী হিসেবে। আরও সরকারি কিসব নিয়ম কানুনের জন্য। এর মধ্যে একদিনও ঘরের মধ্যে সেই পরিচিত সুন্দর গন্ধটা পায়নি। পাড়ায় তো বটেই এখন রাজ্যের অনেকে চিনেছে তাকে। খবর কাগজে বেড়িয়েছে ইন্টারভিউ। অনেক কিছু উদ্ধার করেছে একজন সাহসী ক্যাব ড্রাইভার।
ছয়মাস কেটে গেছে।
পুরস্কার পেয়ে এসেছে পুলিশ ডিপার্টমেন্ট থেকে। মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী নিজেই পুরস্কার তুলে দিয়েছেন বল্টুর হাতে। এক স্মরণীয় দিন। সারাদিনের অনেক খাটাখাটনি, বকবকানির পর বল্টু ঘরে ফিরেছে। ঘুমোবে সে। ঠিক সেই সময়ে বল্টু বুঝতে পারলো তার ঘরে আবার সেই সুন্দর গন্ধটা পাওয়া যাচ্ছে। এবং গন্ধটা ঠিক তার আগেই মতোই তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। বল্টু আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল ড্রয়ারের দিকে। টেনে খুললো ড্রয়ার। কি আশ্চর্য! ডায়্টারি। যেটা সে খুজে পায়নি এতোদিন। ডায়রির প্রথম পাতা খোলে বল্টু। যা যা লেখা ছিল তাই আছে। জনার্দন বিশ্বাস। এম এ। তলায় সাল ১৯১০। পরের পাতা উল্টোতেই কেমন যেন রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে যায় তার। লেখা আছে একবার “একবার ঘুরে দেখো তো বাপধন”। বল্টু ঘুরে তাকাতেই দেখলো টেবিল ল্যাম্পের সামনে আধো আলো আধো অন্ধকারে বসে আছে চিমসে মতন সেই লোকটা। যার কঙ্কালকে সে কয়েকদিন আগেই দিয়ে এসেছে মেডিকেল কলেজে। জনার্দন বিশ্বাস। লোকটা খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসে। হাওয়ায় কথা ভাসে। “ভেবেছিলাম মুক্তি পাবো। কিন্তু তা আপনারা আর আমাকে মুক্তি দিলেন কই? পুরনো অবজেক্ট করে ক্লাসের মধ্যে টাঙিয়ে রাখলেন। তাই ভাবলাম একবার আপনাকে একটু কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আসি। আমার বইগুলো উদ্ধার করার জন্য। সাহেবকে কথা দিয়েছিলুম। আমার যা হয় হোক। বইগুলোর কিছু হতে দেবো না। আপনিও হতে দেননি। তাই আমার তরফ থেকে এইটা।” লোকটা যেখানে বসেছিল সেখান থেকে বল্টুর দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। বল্টু দেখে একটা বিশাল মইয়ের মতো কঙ্কালের হাত তার সামনে এগিয়ে আসে। তাতে প্যাকেটের মধ্যে কি যেন একটা। প্যাকেট নেবে কী? বল্টু ওখানেই ধপাস করে পড়ে যায়।
অনেক সকালে ভোরের স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যায় বল্টুর। চোখ কচলে দেখে তার সামনে সত্যি সত্যি একটা প্যাকেট। সেই প্যাকেটের ওপর লেখা “অচিন্ত্যবাবুর করকমলে...”। প্যাকেট খুলে দেখে বল্টু একটা অনেক পুরনো বই। যে বই এর আগে ওই পুরনো বাড়িটায় দেখেছে। মরক্কোর চামড়ায় বাঁধানো সোনার জলে বইয়ের নাম লেখা। “কলিকাতার গুপ্তধন”। লেখক জনার্দন বিশ্বাস। মনে মনে ভাবে লোকটা লেখক ছিলো নাকি? আস্তে আস্তে পাতা ওল্টায় বল্টু। পরের পাতায় সেই চিমসে মতো জনার্দনের ছবি। ধুতি পাঞ্জাবি পরে হাতে হরিণের শিঙের তৈরী লাঠি নিয়ে বসে আছে। হঠাত ছবির মধ্যের মানুষটা কথা বলে ওঠে। গল্প তো এখনও শেষ হয়নি অচিন্ত্যবাবু।