সমাজতত্ত্ব, অর্থনীতি, আইন এবং গত তিরিশ চল্লিশ বছরে 'উন্নয়ন পদ্ধতি বিষয়ক পাঠ' (Development studies), বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা, চর্চা এবং কর্মসংস্থান প্রদানকারী বিষয় হিসেবে এগুলির একটা বিচিত্র সীমাবদ্ধতা আছে। রাষ্ট্রের গঠনের সঙ্গে এদের সম্পৃক্তি অবশ্যম্ভাবী। রাষ্ট্র পরিচালিত প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাগুলিতেই এর প্রয়োগ সম্ভব, অথচ সমাজবিদ্যার আধুনিক ঐতিহ্য অনুযায়ী এমনকি সংবিধান স্বীকৃত কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের সমালোচনা গড়ে তোলাও এই বিষয়গুলির কাজের মধ্যেই পড়ে। এই বিচিত্র সংঘাতটিকে মনে না রেখে অশোক মিত্রের কাজের মূল্যায়ণ সম্ভব না। বিষয়টা এমনই, যে অতি কন্ট্রারিয়ান অর্থনীতিবিদকেও প্রাপ্ত শিক্ষার প্রয়োগ করতে গেলে আর কিছু না হোক অন্তত উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটির মেম্বর না হলে চলে না। কমিউনিস্ট অর্থনীতিবিদ অশোক মিত্র, মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ছিলেন, ইন্দিরা গান্ধীর কৃষি মূল্য সংক্রান্ত কমিশনে থেকেছেন, ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ অ্যাপ্লায়েড ইকোনোমিক রিসার্চ এ থেকেছেন, জাতি সংঘের ইকোনোমিক অ্যান্ড সোশাল কমিশন এ কাজ করেছেন, কেরালার বামপন্থী সরকারের বাজেট লিখতে সাহায্য করেছেন, বামফ্রন্ট সরকারের অর্থমন্ত্রী হয়েছেন, শিক্ষা কমিশন চালিয়েছেন এবং এরই মধ্যে প্রখ্যাত, এবং অন্তত একটা সময়ে নীতিনির্ধারণে প্রভাবশালী পত্রিকার সম্পাদক না হতে পারার জন্য মন খারাপ করার সময়ও পেয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গে যখন সিপিআই এম রাজ্য কমিটির আলিমুদ্দিন স্ট্রীট স্থিত আপিসটি, কেন্দ্রায়িত ক্ষমতার সমার্থক, তখন সেই ক্ষমতার কেন্দ্রের বাইরে থেকেও, সংবাদমাধ্যমের শীর্ষ প্রতিষ্ঠানটির সহায়তায় নিজের কথা বলার সুযোগ পেয়েছেন। বিতর্কে অংশগ্রহণ করতে পেরেছেন। কে বা কারা যথেষ্ট কমিউনিস্ট নন এ ব্যাপারে মতামত ব্যক্ত করতে পেরেছেন, এই রসিকতাটি মনে করে ফেলার জন্য কোন পুরষ্কার নেই, কে কতটা দেশপ্রেমী তার চলতি ফিরতি পরিমাপ জনপ্রিয় হওয়ার আগে ঘন ঘন কে কতটা বিশুদ্ধ কমিউনিস্ট বা নতুন শতাব্দীতে কে কতটা বিশুদ্ধ বামবিরোধী তার চর্চা করে বাঙালির অনেকটা সময় গেছে। এই পরিশ্রমের কথা আমাদের মহান মে দিবসে স্মরণে রাখা উচিত। বলা বাহুল্য এই সৌভাগ্য, যোগ্যতা এবং বিশুদ্ধতা নিরপেক্ষে অনেক বামপন্থী বুদ্ধিজীবির হয় নি, এমনকি মহানগরের আলোকবৃত্তের মধ্যেও হয় নি, ক্ষমতার প্রচলিত বৃত্তের বাইরের মানুষদের কথা তো ছেড়েই দিলাম। হয়তো শুধু অর্থনীতিবিদ বা আইন বিশারদ না হওয়ার কারণেই হয় নি। বিষয়ের কারণেই কবি বা সাহিত্যিকদের রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হয়ে ওঠার ঐতিহ্য লাতিন আমেরিকায় থাকলেও, আমাদের এদিকে নতুন বা অন্তত ব্যক্তিগত নীতিবিধানের উপরে নির্ভরশীল। তাই মাপ করবেন, অবনত শ্রদ্ধার দিনেও, এই বাংলা লেখার ধরণটা ওনার থেকে অজান্তে টুকে ফেলেও, অশোক মিত্র আমার কাছে বরাবরই প্রতিষ্ঠানের লোক, এটুকু মেনে নিতে অসুবিধে নেই, এটা খানিকটা অর্থনীতি বিষয়ের সীমাবদ্ধতাও বটে, শুধুই এদেশের কমিউনিস্টদের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশ্রগ্রহণের সিদ্ধান্তের জন্য নয়।
অশোক মিত্রের জনপ্রিয় বাংলা বা ইংরেজি লেখাগুলির একটা অন্যদিক ছিল, সেটা হল বাংলা ভাষায় এবং সাহিত্যে, নিজের জীবনেই, শৈলী এবং মতাদর্শ হিসেবে আধুনিকতার সূচনাপর্বটিকে খানিকটা ব্যক্তিগত ভাবেই প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা। আমরা যারা সত্তর বা আশির দশকে, মুক্তিযুদ্ধের পরের প্রজন্ম যারা, আমাদের নতুন করে এই মননে আধুনিকতার সূচনাপর্ব সংক্রান্ত একটা শিক্ষার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। আমরা বাঙালিরা উনবিংশ শতকের শেষ ভাগের আমাদের নাগরিক ইতিহাস নিয়ে যতটা প্রশ্নহীন ভাবে অনুরক্ত ছিলাম বা আমাদের সেভাবে বয়োজ্যেষ্ঠরা গড়ে নিচ্ছিলেন, অশোকবাবুরা, হয়তো বামপন্থী হিসেবেই চেয়েছিলেন, বিংশ শতকের বিশ তিরিশের চল্লিশের দশকে এসে পড়া আধুনিকতা এবং নাগরিক সংস্কৃতির আলোচনাই এই প্রশ্নহীনতাকে কিছুটা ধাক্কা দিতে পারে। আরেকটা ঘটনাও ঘটেছিল, মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যের পরে, বাঙালি সংস্কৃতির চর্চা একধরণের রাষ্ট্রীয় অনুমোদন এর মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েছিল। জাতীয়তাবাদের একটা উল্লাসের সময় এসে পড়েছিল। দেশকে ভালোবেসেও যে দেশের, সমাজের, স্থিতাবস্থার সমালোচনা করা যায়, এইটে নতুন করে বামপন্থী দৃষ্টিকোণ থেকে বলার দরকার হয়ে পড়েছিল। 'কবিতা থেকে মিছিলে', 'অচেনাকে চিনে চিনে' এইখানেই মূলতঃ কিছুটা অনন্য। 'আপিলা চাপিলা' স্মৃতি চারণে সীমাবদ্ধ না থেকে সামাজিক ইতিহাস হয়ে উঠেছিল ঠিকই কিন্তু কমিউনিস্টসুলভ বিশুদ্ধতা চর্চা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হতে পারে নি। অশোক মিত্রর লেখা, ভাষার প্রয়োগের কারণে যাঁরা ভালো বেসেছেন, তাঁদের বরাবরই সাবধানে থাকতে হয়েছে, সামাজিক রাজনৈতিক আন্দোলন বা ভাষা সাহিত্যের আধুনিকতার সুচনাপর্বের গৌরবে যেন রাজনীতিতে কিম্বা সংস্কৃতিচর্চায়, সমসাময়িকের সম্ভাবনাকে, খাটো না করে ফেলি।
প্রখর বুদ্ধিমান লোক ছিলেন, তাঁর নিজের এটা না বোঝার কথা না, হয়তো সে কারণেই, আমরা-ওরা বিভাজনের পরে একটা নতুন নাগরিক বামপন্থার খোঁজে নতুন পত্রিকা তৈরি করেছেন। পত্রিকাটি আমার নিজের খুব নিয়মিত পড়া হয় না, যে কয়েকটা রচনা পড়েছি, সব সময়েও উৎসাহও পাই না, কিন্তু এটা মেনে নিতে দ্বিধা নেই, সাহিত্যপ্রেমী অর্থনীতিবিদ অশোক মিত্র, ভারতের স্বাধীনতার অল্প আগে থেকে মৃত্যুর অল্প কয়েকদিন আগে পর্যন্ত এই দীর্ঘ সময় জুড়ে একজন নিরলস প্রায় অনন্যোপায় স্বপ্ন এবং স্বপ্নস্মৃতিতাড়িত বামপন্থী সমাজ ভাষ্যকার।
প্রাথমিক মুগ্ধতা কেটে যাওয়ার পরে, আমার অশোক মিত্রের লেখা খুব ভালো লাগতো না। তবে এটুকু স্বীকার করে নিচ্ছি, আমি তাঁর লেখাতেই সঞ্জয় ভট্টাচার্য্য, অরুণ কুমার সরকারদের কথা পড়েছি। শুধু এই জন্যেই তাঁকে মনে রাখা যায়। পরে যোগাড় করে কিছুটা পড়েছি, কিন্তু আধুনিক সমসাময়িক সাহিত্য চর্চা মানেই যে একেবারেই বহুল প্রচলিত পাঠকের রুচি নির্মাণে আগ্রহী সাহিত্য পত্রিকা, কিম্বা শুধুই ক্রুদ্ধ, সমান্তরাল অন্তর্মুখী অতি নাগরিক জগত তৈরি করে নেওয়া ছোটো পত্রিকার লেখা পাঠ নয়, তার যে একটা খোঁজ আছে, ইতিহাস আছে, এবং আধুনিকতা জিনিসটা যে একেবারে টুপ করিয়া পড়িল গোছের কৃষ্ণপ্রেমে নিবেদিত কদম্ব পুষ্প না, এই বোধটা যে কজনের লেখা পড়ে তৈরি হয়েছিল, অশোক মিত্র তাঁদের মধ্যে একজন।
যেহেতু ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল না, প্রজন্ম / জগত সবটাই আলাদা, কোন সম্ভবনাও কোনদিন ছিল না, তাই দুটি বিষয়ে আমার কৌতুহল কবে নিবৃত্তি হবে তা জানি না।
প্রথমতঃ এটা অনস্বীকার্য্য, সত্তর এবং আশির দশকে, রাজ্যের হাতে অধিক ক্ষমতার দাবীকে যাঁরা কংগ্রেস বিরোধী একটা রাজনৈতিক প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জে পরিণত করেন, সার্বিক সংগৃহিত কর সুষম বন্টনের যুক্তিকে সর্বজনগ্রাহ্য করে তোলেন, তার মধ্যে অশোক মিত্র নেতৃত্ত্ব স্থানীয় ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। মাসুল সমীকরণ নীতির বিরোধিতা করেছিলেন। এই অবস্থান থেকে পরের দিকে বামফ্রন্ট সরকার দেশ জুড়ে জি এস টির নীতিতে যে এসে পড়ল, এ ব্যাপারে তিনি পার্টির মধ্যে কী ধরণের বিতর্ক চালিয়েছিলেন এবং জি এস টি বিষয়ে পার্টির মধ্যে অথবা বাম অর্থনৈতিক প্রশাসকদের মধ্যে বিতর্কের চেহারা ঠিক কী ছিল, এই বিষয়ের কাগজপত্র প্রকাশ সম্ভব কিনা, কখনো সুযোগ পেলে জিজ্ঞাসা করতাম। বামপন্থীরা অনেক সময়েই রাস্তা বদলেছেন, সেটাই কাম্য, কিন্তু রাজ্যের হাতে অধিক ক্ষমতার ডিবেটকে যাঁরা এক সময়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাঁরা অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে কী পরিবর্তন লক্ষ্য করে এই অবস্থান বদলালেন, সেটা সম্পর্কে একটু ব্যক্তিগত আগ্রহ ছিল। অসীম দাশগুপ্ত বনাম অশোক মিত্র বিতর্ক বই হিসেবে প্রকাশ হয়েছে বলে জানা নেই। অবশ্য আমি অর্থনীতি বিশয়ে প্রশিক্ষিত নই, এই বিষয়ে হয়তো আকাদেমিয়ায় অনেক আলোচনা হয়ে গেছে। আমি শুধু এটুকু বুঝি রাজ্যের হাতে স্বাধীন ভাবে পরিষেবা ক্ষেত্রে নানা ধরণের কর বসানোর ক্ষমতা থাকায়, বা রাজ্যগুলি ব্যবসায়িক সংস্থার ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রকারের নিয়ম কানুন স্বাধীন ভাবে প্রনয়ন করতে পারায়, অর্থনৈতিক ভাবে এগিয়ে থাকা দেশ আমেরিকায় অন্তত অর্থনৈতিক প্রগতির বা বিশেষতঃ 'ধনরাশি সৃষ্টির' সাংঘাতিক অসুবিধে হয়েছে এমন দাবি নিয়মিত কেউ করেন না।
দ্বিতীয়তঃ সাহিত্যপ্রেম জিনিসটা প্রায় নিষিদ্ধ প্রেম কিম্বা চর্মরোগের মত, একটা (পাঠ) অভিজ্ঞতার উত্তেজনা গোপন রাখা মুশকিল, অশোক মিত্রকে সাধারণ পাঠক অর্থনীতিবিদ, রাজনৈতিক ভাষ্যকার হিসেবে মনে না রাখলেও সাহিত্য প্রেমী হিসেবে মনে রাখবেন। কিন্তু আমার জানতে ইচ্ছে করে শুধু সাহিত্যপ্রেমের জন্যই, অর্থনীতির জগতে তাঁকে খাটো হতে হয়েছে কিনা, 'তুমি ওদিকে গেলেই পারতে' গোছের মন্তব্য শুনতে হয়েছে কিনা। এটা শুধু নিছক কৌতুহল না, নীতি নির্ধারণের জগতে, শাসনের দৃষ্টিভঙ্গীতে, আমাদের দেশে যে বড় বড় পরিবর্তন এসেছে, বিভিন্ন সময়ে, তাতে অশোকবাবুদের কর্মজীবনের শুরুতে, আমলাতন্ত্র-রাজনীতি-আকাদেমিক সম্পৃক্তি ঘনিষ্ঠ হওয়ারই কথা, কিন্তু গত তিরিশ বছরে এতে যোগ হয়েছেন কর্পোরেট সাফল্যবাদের উৎসাহীরা এবং সর্বশেষে উন্মত্ত রক্ষনশীল দেশপ্রেমীরা । আমার শুধু জিজ্ঞাসা করার ছিল ৯০এর দশকের পরে এই সাহিত্যপ্রেমের কারণে তাঁর বিষয়ের কাজের জগতে নতুন অসুবিধে কিছু হয়েছে কিনা। আড্ডায় একটা বই পড়ার কথা ভুল করে বলে ফেললেই লোকে যেরকম, “বেসি-দ্যাকাচ্ছে” গোছের ভ্রু কুঁচকান, চিড়িয়াখানার অদৃশ্য ঘেরাটোপের বাইরে চলে গিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন, নতুন আবিষ্কৃত দ্বিপদ স্তন্যপায়ীটিকে দেখতে থাকেন, প্রতিটি মনোযোগী পাঠকই যে দেশে ক্রমশ একলা হচ্ছেন, যুক্তি চর্চাই যে সমাজে আক্রান্ত, সেখানে শুধু ব্যক্তিত্ত্ব দিয়ে এই ক্রুদ্ধ কমিউনিস্ট অথচ ঘোর প্রাতিষ্ঠানিক বৃদ্ধ এই আশ্চর্য্য অকারণে উচ্ছল সময়ে একলা হওয়াটা কতটা ঠ্যাকাতে পেরেছিলেন। অন্তত নিজের বিষয়ের জগতে। জানা হল না। নিন্দেমন্দ-প্রিয় বুড়োবুড়িরা মেমোয়ার না লিখে পারেন না, অন্য কারো লেখায় জানা যাবে নিশ্চয়।