মুন্সীডাঙার সরদারপাড়ার কথা আলীর খুব বেশি কিছু মনে পড়ে না। একটা উঠোনের তিন পাশজুড়ে থাকা অনেকগুলো ঘর, পূবের মান্নাফ কাকার ঘর থেকে সেলাই মেশিনের ঘড়ঘড় শব্দ, মুরগী নিয়ে পালিয়ে যাওয়া শেয়ালকে গোরস্থান পর্যন্ত তাড়া করা, ভোরবেলা সরদারপাড়া ছোট মসজিদের বারান্দায় লস্কর মুনশীর বেত উঁচিয়ে ‘আলিফ যবর আ, নুন্ যবর না আনা, ক্বাফ-মীম পেশ ক্বুম আনাক্বুম’ পড়ানো, পাশের হিন্দুপাড়ার স্কুলে সবাই মিলে চেঁচিয়ে ‘বড় গাছ/ ভাল জল/ লাল ফুল/ ছোট পাতা’ পড়া ছাড়া আর তেমন কিছু মনে পড়ে না। বাবা যখন মারা যান তখন তার বয়স মাত্র দুই মাস। বাবার কোন ছবি সে কখনো দেখেনি। বছর পাঁচেকের বড় ভাই নবী তাদের থেকে একটু দূরে দূরে থাকতে পছন্দ করতো, তাই আলীর পৃথিবী মূলত তার মা’কে ঘিরে। অভাব বাড়লে একটা সময় নবীকে তাদের বড় খালা (মাসী) কোবেরা বেগমের কাছে বাকসারায় চলে যেতে হয়। তারপর থেকে দুই ভাইয়ে দেখা হতো কালেভদ্রে। বড় খালু (মেসো) শেখ শামসুদ্দীন আহমদও চাইতেন না ঘরের কাজ নষ্ট করে নবী ঘন ঘন মুন্সীডাঙা যাক। খালু আপিসে চাকরী করে, সুতরাং নবীর মত একটা ছোক্রা ঘরে না থাকলে তার ক্ষেত-খামার দেখবে কে!
সকালে ঘুম ভেঙে মা’কে কখনো বিছানায় দেখতে পাওয়া যেতো না, যেমন রাতে শোবার সময়ও তাকে কাছে পাওয়া যেতো না। আসলে মায়ের অত সময় ছিলো না আলীকে কোন আহ্লাদ দেখানোর। ফজরের সময় উঠে সারা বাড়ীর সবার নাশ্তা বানানো, যারা আপিসে যাবে তাদের দুপুরের টিফিন বানিয়ে টিফিন ক্যারিয়ারে ভরে দেয়া, ক্রমাগত স্তুপ হয়ে ওঠা থালাবাসন ধোয়া, কাপড় কাচা, দুপুরের রান্নার যোগাড় করা, লাকড়ী শুকোনো, ঘুঁটের মুঠি দেয়া, কোন কোন দিন ঘর আর উঠোন লেপা, ধান ওঠার সময় কাঠের গুড়িতে আছড়িয়ে ধান মাড়াই-সেদ্ধ করা-শুকানো-ঝাড়া-ঢেঁকিতে ধান ভানা-তুষ কুড়া আলাদা করা-চাল বাছা-মুনিশদের খাবার দেয়া – সময় কোথা মায়ের! এতো কিছুর পরেও বুয়া (ঠাকুরমা), ইয়ার নবী কাকা বা হারুন কাকার বউ, মাকসুরন বেটি (পিসী) কথায় কথায় খোঁটা দিত এই বলে যে, মা কোন কাজ করে না, সারা দিন শুধু শুয়ে-বসে কাটায়। অকালে ছেলেকে খাওয়ার জন্য বুয়া মা’কে অভিশাপ দিতো, কখনো কখনো আলীকেও। দুই ছেলে নিয়ে ‘ভাতারখাকি মাগী’ তার ঘাড়ে চাপায় তার আফসোসের সীমা ছিল না। দুপুরে বা রাতে খাবার সময় বুয়া মা’কে পাতে নুন্ বা কাঁচালঙ্কা নিতে দিতো না; কারণ এতে বেশি ভাত খাওয়া হবে। রান্নার সময় মা কখনো সুযোগ পেলে কোন শাকের পাতায় নুন্ মুড়ে খোঁপায় লুকিয়ে রাখতো। কোন কোন দিন বুয়া আবার সেটা ধরে ফেলতে পারলে ব্যাপারটা গালাগালি, অভিশাপের বাইরে খুন্তি বা চ্যালাকাঠের বাড়ি পর্যন্ত যেতো।
কোন কোন দিন গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে বোঝা যেতো পাশে শোয়া মা কাঁদছেন। মা কি পুরনো পেটের ব্যথাটার জন্য কাঁদছেন নাকি বুয়ার চামচ-খুন্তি-উকড়িমালা’র পিটুনি খেয়ে কাঁদছেন সেটা বোঝা যেতো না। মা কাঁদলে আলীর মন খারাপ হতো কিন্তু সেই মন খারাপের কথা কাউকে বলা যেতো না। একবার মান্নাফ কাকার মেয়ে মাবুদা আর ফাহমিদার সাথে খেলার সময় মুখ ফসকে বলে ফেলেছিল যে আগের রাতে মা খুব কাঁদছিল। ও বাবা! ঘন্টা যেতে না যেতে দু’বোনের কেউ একজন বুয়াকে সেই কথা জানিয়ে দেয়। আরকি! বুয়া তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে মাকে এমন গালমন্দ করলো যে আলীর নিজের ওপর নিজের খুব রাগ হলো, কেন সে বোকামী করে মাবুদা-ফাহমিদাকে এইসব কথা বলতে গেল! সেই থেকে আলী এমনসব ব্যাপারে একেবারে চুপ।
আলী দেখেছে দিনে তিনবেলা খাবার ছাড়া অন্য কোন খাবার সহসা জুটতো না। স্কুলের কাছে বা বাঁকড়া বাজারে ফেরিওয়ালারা লেবেনচুষ, হাওয়াই মেঠাই, আচার, হজমী এমন কত কি বিক্রি করে! তার সাথের অনেক ছেলে তো বটেই মান্নাফ কাকার ছেলেমেয়েরাও ওসব প্রতিদিন খেতো। ওসব কিনতে তো পয়সা লাগে। আলী পয়সা পাবে কোথা থেকে! মায়ের কাছে পয়সা চাওয়ার কোন মানে নেই, আলী জানে মায়ের কাছেও কোন পয়সা থাকে না। বাড়ীর আশপাশের শরীকানা জঙ্গলা জায়গায় থাকা পেয়ারা, কুল, বৈঁচি, আঁশফল, জামরুল, নোনা, ডুমুর, ফলসা গাছে ফল ফললে দুপুরে এক ফাঁকে গাছে চড়ে সেগুলোর স্বাদ নেয়া যেতো। তবে কাকীদের কেউ দেখে ফেললে আর নিস্তার নেই — আলী যে কত বড় চোর, হাভাতে, নোলাঝোলা সেটা পাড়া মাথায় তুলে বলে বেড়াতো। এতে মায়ের হাতে চড়চাপর খাওয়াটা অবধারিত হয়ে যেতো। আলীর তখন খুব ঘেন্না লাগতো, ভাবতো এমন ছোট মনের মানুষদের সাথে আর থাকবে না।
স্কুলে একদিন সুরেনের পাশে বসতে গেলে হঠাৎ সে বলে বসে, “অ্যাই লেড়ে, দূরে সরে বোস্”। ‘লেড়ে’ মানে কী? খোদ সুরেনকেই জিজ্ঞেস করতে জানা গেল “মুচলমানদেরকে লেড়ে বলতে হয়” আর তাদের সাথে ছোঁয়াছুঁয়ি বারণ। ছোঁয়াছুঁয়ি বারণের ব্যাপারটা আলী জানে। সে দেখেছে কোন কারণে হিন্দুদের বাড়ী গেলে তাকে বা তার ভাইদেরকে ভেতরে ঢুকতে দেয়া হয় না, উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। শুধু বাড়ী নয়, বাজারে গণেশ ময়রার দোকানেও কোন মুসলমানকে ঢুকতে দেয়া হয় না। বাইরে দাঁড়িয়ে শালপাতার ঠোঙায় করে মিষ্টি খেতে হয় বা মাটির হাড়িতে করে মিষ্টি নিয়ে যেতে হয়। স্কুলে মুসলমানদের জন্য জলের ঘটিও আলাদা, কিন্তু তাতে ক্লাসে পাশাপাশি বসতে বারণ ছিল না। এখন পাশে বসতে বারণ করলো কে, আর নেড়ে বলে গালি দিতে বললো কে? জানা গেলো সুরেনদের বাড়ীর বড়রা এসব কথা বলেছে। তারা আরও বলেছে, সায়েবদের সাথে জাপানীদের যে যুদ্ধ চলছে সেটা শেষ হলেই গান্ধী দেশ আজাদ করে ফেলবে। তখন সব নেড়েকে ঘটিবাটিসুদ্ধ দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়া হবে। আলী জানে না যুদ্ধ কোথায় হচ্ছে, তা কবে শেষ হবে আর দেশ আজাদ হওয়া মানে কী। সে আরও জানে না ঘটিবাটিসুদ্ধ দেশ থেকে তাড়িয়ে দিলে সে কোথায় যাবে! কখনো তার মনে হয় দেশ থেকে তাড়িয়ে দিলে মন্দ হয় না। তাহলে এই প্রতিদিনকার অভাব আর গালমন্দ সহ্য করতে হবে না। আবার মনে হয়, তাড়িয়ে দিলে কোন দেশে যাবে? সে তো আর কোন দেশ চেনে না।
যুদ্ধ শেষ হবার ঢের আগে একদিন আলী আর তার মাকে মুন্সীডাঙার সরদারপাড়া ছেড়ে চলে যেতে হয়। সেটা ঘটে বুয়া মারা যাবার পর পর। গ্রামে ওলাওঠা শুরু হয়েছিল। প্রথমে অন্য গ্রামে দুয়েক জন মারা যাবার খবর পাওয়া যায়। এরপর দেখা গেলো প্রতিদিনই কেউ না কেউ মারা যাচ্ছে। যেদিন সকালে বুয়া ভেদবমি করা শুরু করলো সেদিন বাড়ীর সবাই ভয় পেয়ে গেলো। আলী সারা দিন ভয়ে চৌকির এক কোনে গুটিশুটি মেরে শুয়ে ছিলো। সন্ধ্যায় মাগরেবের ওয়াক্ত পার হতে না হতে উঠোনের উলটো দিকে বুয়ার ঘর থেকে যখন মা আর মাকসুরন বেটি’র সম্মিলিত কান্নার রোল উঠলো তখন আর কাউকে বলে দিতে হলো না যে বুয়া আর নেই! বুয়াকে আলী ঠিক পছন্দ করতো না। সেটা যতোটা না তার সাথে দুর্ব্যবহারের জন্য তারচেয়ে ঢেড় বেশি মাকে গালমন্দ বা মারের জন্য। মায়েরও বুয়াকে বিশেষ ভালো লাগার কথা না। কিন্তু আলী অবাক হয়ে দেখলো বুয়া মারা যাওয়ায় মা বুকফাটা মাতম জুড়ে দিয়েছে। মায়ের মাতমের কারণটা বোঝা গেলো বুয়ার চল্লিশার পরদিন যখন সব কাকা-কাকী আর বেটি-ফুফা এক বৈঠকে বসে ঠিক করলো বাড়ী ভাগাভাগি হবে, এবং কার ভাগে কী পড়বে। বাড়ী ভাগ হওয়া মানে হাড়িও আলাদা হওয়া। মান্নাফ কাকা ঠিক করলেন তিনি সপরিবারে বাড়ী ছেড়ে ডমজুর বাজারের কাছের মুসলমানপাড়ায় চলে যাবেন। এখানে থাকলে নাকি তার কাপড়ের ব্যবসায় খুব অসুবিধা হয়। আসলে উনি অনেক দিন ধরেই বাড়ী ছাড়ার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু বুয়া বেঁচে থাকায় সেটা সম্ভব হয়নি। ইয়ার নবী কাকা আর হারুন কাকা বাড়ী না ছাড়লেও তাদের হাড়ি আলাদা হলো, এবং সেই আলাদা হাড়িতে তাদের কেউই আলী বা তার মাকে নিতে রাজী হলেন না। আলীদের ভাগে পড়লো মূল বাড়ীর বাইরে ছোট ডোবার পাশের জংলা জমিটা। সেখানে ঘর তোলা বা প্রতিদিনের আহার জোটানো মায়ের পক্ষে সম্ভব ছিলো না, সুতরাং তাদের পক্ষে পদ্মপুকুরে নানা’র (দাদু) বাড়ীতে চলে যাওয়া ছাড়া আর উপায় থাকলো না।
নানাদের বাড়ী পদ্মপুকুর রেলকলোনী ছাড়িয়ে বেশ খানিকটা ভেতরে। নানা বেঁচে থাকলেও নানী (দিদিমা) মারা গেছেন আলীর জন্মের আগে। বাড়ীতে দুই মামা-মামী আর তাদের ছেলেমেয়েরা আছে। পদ্মপুকুর রেলস্টেশনের কাছের বাজারে নানা শেখ ইদ্রিস আলীর কাপড়ের দোকান আছে — নাম ‘শেখ ক্লথ মার্চ্চেন্ট’। সেই দোকানে মিলের ধুতি-লুঙ্গি-শাড়ি, জলগামছা, কাটা কাপড় বিক্রি হয়। নানা’র পুঁজিপাটা কম, দোকানে ক্রেতা আরও কম। যুদ্ধ আর অভাবের কারণে কাপড়ের সাপ্লাই আর বেচাবিক্রি আরও কম। বড় মামা শেখ ময়ুখ আলী কাজ করেন চেঙ্গাইলের ল্যাডলো জুট মিলের ওয়ার্পিং সেকশনে আর ছোট মামা শেখ সেকান্দার আলী কাজ করেন লিলুয়ার রেল ওয়ার্কশপে স্যান্ড কাস্টিং সেকশনে। ছোট মামা বাড়ীতে থেকে প্রতিদিন লিলুয়া যাতায়ত করলেও বড় মামা চেঙ্গাইলে মেসে থাকেন, প্রতি শনিবার সন্ধ্যায় বাড়ী আসেন আর সোমবার খুব ভোরে উঠে চলে যান। বড় মামার ঘরে এক মেয়ে আমিনা আর এক ছেলে আশরাফ দুজনেই আলীর চেয়ে বয়সে বড়। ছোট মামার দুই মেয়ে বিবি আর বানু দুজনেই বয়সে তারচেয়ে ছোট। আলী আর তার মা আসায় বাড়ীতে যে ঠিকে ঝি ছিল তাকে ছাড়িয়ে দেয়া হলো, আর আলীকে পদ্মপুকুর হাই স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি করে দেয়া হলো।
আলী যখন পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে তখন সে প্রথম বারের মতো কলকাতা যায়। সেবার হুগলী নদীর উপর বিশাল লোহার ব্রীজ হয়েছে। আজব সে ব্রীজ! তার তলায় থাম নেই, উপর দিয়ে বাস-ট্রাম-ট্যাক্সি চলে, লোকে পায়ে হেঁটে যায়, আর নিচ দিয়ে লঞ্চ-স্টীমার যায়। আলীদের বাড়ির সবাই গোটা ব্রীজ হেঁটে হেঁটে পার হয়। ওপাড়ে গিয়ে আরও হেঁটে ময়দান, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, হাইকোর্ট সব ঘুরে দেখেছিলো। নিউ এম্পায়ার থিয়েটারের সামনে দাঁড়িয়ে দেয়ালের ছবি দেখেছিলো। মামীদের খুব ইচ্ছে ছিল থিয়েটার দেখার, কিন্তু এতগুলো মানুষের টিকিট কেনা সম্ভব ছিলো না। এই দিন আলী জীবনে প্রথম বারের মতো দোকানে বসে কাবাব-রুটি আর কুলফি খেয়েছিলো। অমন খুশবুদার আর মাখনের মতো মোলায়েম কুলফি আলী আর কোনদিন খায়নি। দোকানে আরেকটা খাবার দেখেছিল, তার নাম ‘ফালুদা’। নানা রকমের ফল, বাদাম, সিরাপ, ক্ষীর, বরফ দিয়ে বানানো। কি লোভনীয় দেখতে, আর কি তার খুশবাই! কিন্তু মামাকে ফালুদার কথা বলতে সাহস হয়নি। এত ভালো খাবারের দাম নিশ্চয়ই বেশি। আলী যখন বড় হবে, অনেক টাকা কামাবে তখন সে প্রতিদিন কুলফি আর ফালুদা খাবে।
নানা বাড়ীতে আলী যে খুব আরামে ছিল তা নয়। মা’কে যেমন দিনরাত খাটতে হতো তেমন তাকেও ছোট মামাতো বোনগুলোকে রাখা থেকে শুরু করে ঘরের নানা কাজ করতে হতো, নানাকে দোকানে দুপুরের খাবার দিয়ে আসতে হতো, দোকানে ফুটফরমাশ খাটতে হতো। বুয়া, বেটি, কাকীদের মতো এখানেও মামীদের কাছ থেকে নানা রকমের খোঁটা শুনতে হতো। তবে সে খোঁটা চলতো নানা যখন বাড়ীতে থাকতেন না তখন। তবু নানাবাড়ীতে সে আর তার মা দুজনেই ভালো ছিলো বলে মনে হয়। এই ভালো থাকার দিন শেষ হয়ে গেলো খুব হঠাৎ করে। যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবার পর আজাদী নিয়ে দেশ উত্তপ্ত হতে থাকে। এই প্রথম আলী ‘পাকিস্তান’ শব্দটা শুনলো, কিন্তু সেটা যে কী ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না। কলকাতায় ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে নিয়ে যে বীভৎস হত্যাকাণ্ড আর নৃশংস সব ঘটনা ঘটলো তাতে গোটা বাংলা থমকে গেলো। হিন্দু আর মুসলিমদের মধ্যে সন্দেহ আর অবিশ্বাস ক্রমে বাড়তে থাকলো। গতকাল পর্যন্ত যারা আপনজন ছিল আজ তারাই ‘আমরা আর ওরা’তে ভাগ হয়ে গেলো।
ল্যাডলো জুট মিলের শ্রমিকদের একাংশ ছিলো পূর্ববঙ্গ থেকে আসা মুসলিমরা। মিলের কাছের মেসগুলোতে তারা থাকতো। মেসগুলোতে যে তাসের আসর বসতো সেখানে মেসের বাসিন্দারা তো বটেই মিলের অন্য শ্রমিক-কর্মচারীরাও বসতো। সেখানে ধর্ম বিভাজন কোন ব্যাপার ছিল না। তাসের যে আসরগুলোতে হারজিতের সাথে টাকাপয়সার ব্যাপার জড়িত থাকতো সেগুলোতে প্রায়ই ঝগড়া বাঁধতো। সেই ঝগড়া উঁচু গলায় কথা থেকে গালাগালি ছাড়িয়ে কখনো হাতাহাতিতেও গড়াতো। তবে ওই পর্যন্তই – হাতাহাতি কখনো বড় ধরনের মারামারিতে পরিণত হয়নি। ময়ুখ আলী কখনো সখনো তাসের আসরে বসলেও কখনো জুয়া খেলেননি। একে তো জুয়া খেলতে তার ভালো লাগেনা, তারওপর নষ্ট করার মতো পয়সা তার ছিলোনা। মিলের যে সেকশনে তার কাজ সেখানে বাড়তি কোন আয়ের সুযোগ নেই। যুদ্ধের বাজারে পাটের ব্যাগের চাহিদা বেড়েছে বটে তবে ওভারটাইম খাটলেও বাড়তি মজুরী ঠিকমতো মেলে না। তাই যুদ্ধের মহার্ঘ্য বাজারে বেতনের টাকায় সংসার চালানো মুশকিল। এক রাতে মেসের জুয়ার আসরের ঝগড়া হঠাৎ খারাপ রকমের মারামারিতে রূপ নিলো। সেই মারামারি আবার কী করে যেন পূর্ববঙ্গীয় মুসলিম আর পশ্চিমবঙ্গীয় হিন্দুদের মারামারিতে পরিণত হলো। কোথা থেকে লাঠি, সড়কি, কোরবানীর সময়কার লম্বা ছুরি, কসাইয়ের দোকানের চাপাতি এগুলো বের হতে থাকলো। শেষ পর্যন্ত সাধারণ একটা ঝগড়া খুনোখুনিতে পর্যবসিত হলো। ময়ুখ আলী নিশ্চিতভাবেই জুয়ার আসরে ছিলেন না। তিনি আসলে ঝগড়া বাঁধার সময় মেসেই ছিলেন না। সেদিন মিলেই কিছু বাড়তি কাজ ছিলো, তাই মারামারির খবর তিনি পাননি। কাজ সেরে মেসে ফেরার পথে তিনি পশ্চিমবঙ্গীয় হিন্দুদের দলটার সামনে পড়ে যান। ময়ুখ আলীকে মেস এলাকার সবাই চেনে। তিনি পূর্ববঙ্গীয় নন্ বটে, কিন্তু মুসলিম তো! অতএব মুহূর্তে একটা ছোরা আমূল তার বুক-পেটের সংযোগস্থলে ঢুকে গেলো। পুলিশ তার লাশ নিয়ে যায়নি, তাই লাশ নিয়ে কাউকে কোন হুজ্জত করতে হয়নি। পরদিন গরুর গাড়ীতে করে তার লাশ যখন পদ্মপুকুরে পৌঁছায় তখন সারা শরীর থেকে রক্ত ঝরে তার মুখ কাগজের মতো সাদা হয়ে গিয়েছিলো। সেই প্রথম আলী কোন নিহত মানুষের লাশ দেখতে পায়। আলী জানতো না সেটা ছিলো শুরু মাত্র।
বড় মামা খুন হবার মাসখানেক পরের কথা। একদিন বাজারের ইজারাদার বীরেন সাঁপুই নানাকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি দোকান বিক্রি করবেন কিনা। নানা’র তো আকাশ থেকে পড়ার দশা। হঠাৎ দোকান বিক্রির কথা আসে কোথা থেকে! বীরেন যা বললেন তা হচ্ছে, যেহেতু দিনকাল ভালো না, এবং যেহেতু ইদ্রিস আলীর বড় ছেলেটা অকালে মরলো, অতএব তার মতো বিপত্নীক বৃদ্ধ মানুষের উচিত দোকানপাট বেচে দিয়ে কলকাতায় বা ঢাকায় চলে যাওয়া। চাইলে সে বোম্বাই থেকে জাহাজে করে মক্কায় গিয়ে হজ্ব করতে পারে এবং আরব দেশে থেকে যেতে পারে। পরিস্থিতি বিবেচনা করে নানা ক্রোধ দমন করে শুধু জানালেন, তিনি দোকান বিক্রি করতে আগ্রহী না, তিনি মারা যাবার পর যদি তার ছোট ছেলে দোকান না চালায় তাহলে তার এতিম ছোট নাতি (আলী) দোকান চালাবে। এর কয়েকদিনের মধ্যে উখো দিয়ে ঘষে দোকানের দরোজার কড়া কেটে বড় রকমের চুরি হয়। নানা এমনটা আঁচ করেছিলেন। তিনি কাউকে কিছু বললেন না। কেউ কেউ তাঁকে পুলিশের কাছে যেতে বলেছিলেন, কিন্তু নানা জানতেন পুলিশের কাছে গিয়ে নালিশ করলে চোরাই মাল উদ্ধার হবে না। এর সপ্তাহ দুই-তিন পরে এক রাতে নানা দোকান থেকে বাড়ী ফিরলেন না। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পরও যখন তিনি বাড়ী ফিরলেন না তখন হ্যারিকেন আর লাঠি নিয়ে ছোট মামা আর আলী তার সন্ধানে বের হয়। গোটা বাজারে তখন কেবল একটা পানবিড়ির দোকান খোলা। নানার দোকানে দেখা গেলো বাইরে থেকে দরোজায় তালা মারা। বোঝা গেলো নানা দোকান বন্ধ করে বের হয়েছেন, কিন্তু তিনি কোথায় যেতে পারেন তা ভেবে কূল পাওয়া গেলো না। বাড়ীর কারো কারো মনে হলো তিনি হয়তো আজানগাছীর পীর সাহেবের দরগাহে গেছেন। তিন দিন পার হলেও নানা বাড়ী ফিরলেন না। এদিকে কে যেন খবর দিলো নানার দোকান থেকে নাকি খুব পঁচা দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। ছোট মামা, মামাতো ভাই আশরাফ আর আলী বাজারে ছুটে গিয়ে দেখে বীরেন সাঁপুই পুলিশ নিয়ে এসেছেন। পুলিশ দোকানের দরোজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে দেখে একটা বড় চটের বস্তা রাখা, দুর্গন্ধ সেখান থেকে আসছে। শুধু আলী কেন, গোটা বাজারসুদ্ধ মানুষ বুঝে গিয়েছিল বস্তার ভেতরে কী আছে। আলী মনেপ্রাণে চাইছিল তার ধারণাটা যেন সত্য না হয়, কিন্তু সেটা তো আর হয় না! পুলিশ বস্তা খুলে ভেতর থেকে শেখ ইদ্রিস আলীর খণ্ড খণ্ড লাশ উদ্ধার করে। খুন, লাশ কাটা, বস্তায় ঢোকানো সব দোকানের ভেতরেই হয়েছিল। তার সব স্পষ্ট আলামত চারপাশে ছড়ানো। যারা এসেছিল তারা চুরি বা ডাকাতি করতে আসেনি। ক্যাশ বাক্সে রাখা সামান্য টাকা আর তাকে রাখা নতুন কাপড়ের ছোট চালানটি তারা ছুঁয়ে দেখেনি। খুন করে, লাশ কেটে, বস্তায় ঢুকিয়ে নানার কোমরে রাখা চাবি দিয়ে দরোজা বাইরে থেকে তালা মেরে চলে গেছে। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে বাজারের কোন দোকানদার বা দোকান কর্মচারী কোন কিছু দেখার বা শোনার কথা স্বীকার করলেন না। পুলিশ লাশ নিয়ে চলে যাবার সময় দোকান সীল মেরে রেখে যায়। এরপর ‘শেখ ক্লথ মার্চ্চেন্ট’ আর কোনদিন আবার চালু হয়নি। দোকানটা একসময় বীরেন সাঁপুইয়ের হয়ে যায়।
নানা’র খুন হওয়াটা সামলে উঠতে না উঠতে একদিন সনাতন হালদার বাড়ী এলেন। সনাতন পাড়ার মাতব্বর গোছের লোক। যুদ্ধের বাজারে নানা রকমের সাপ্লাইয়ের কাজ করে বেশ দু’পয়সা করেছেন। কিছু দিন হয় হিন্দু মহাসভার লোকাল কমিটিতে যোগ দিয়ে নেতা হবার চেষ্টা করছেন। একথা সেকথা বলার পর সনাতন আসল কথা পাড়লেন। বললেন, “ও সেকান্দার, পাড়ার ছেলেরা ধরেছে তোমার বার্বাড়ীর ঘরটা ক্লাবঘর বানাবে। তোমাদের বাড়ীর লোকজন তো এখন কম, একটা ঘর তো তুমি ছাড়তেই পারো”।
এমন দাবীতে ছোট মামা হতবুদ্ধি হয়ে গেলেন। তিনি বললেন, “এটা কী বলছেন দাদা! আমার বাড়ীতে ক্লাবঘর কেন? বাজারে করতে বলুন”।
“আহা! এটা তো ক্যারম, দাবা, লুডু খেলার ক্লাব না। এখানে ছেলেরা একটু ভক্তি গান গাইবে, ব্যায়াম করবে। বাজারে অত জায়গা কোথায়! আর একটু নিরিবিলি না হলে কি আর ভক্তি গান আর ব্যায়াম হয়”?
“ তাই বলে আমার বাড়ীতে কেন? আপনি নেতা মানুষ, আপনার বাড়ীতে করুন”।
“আরে আমার বাড়ী তো হাটবাজার হয়ে গেছে। দিনমান লোকজন আসছে যাচ্ছে। সেখানে আর নিরিবিলি কই”!
“আমি কী করে বাড়ীতে ক্লাবঘর বসতে দিই, বাড়ীভর্তি মেয়েছেলে”!
“আরে সেজন্যই তো বলছি। তুমি দিনমান কারখানায় থাকো, এদিকে বাড়ীতে তোমার বউ, ময়ুখের বিধবা বউ, তোমার বিধবা বোন সব জোয়ান মেয়েছেলে। আবার ময়ুখের মেয়েটাকেও সেদিন দেখলাম গায়েগতরে বেশ ডাগর হয়ে গেছে। এতগুলো মেয়েছেলে দেখেশুনে না রাখলে হয়! এমনিতেই জানো দিনকাল ভালো না। তারওপর তোমার পরিবারের উপর দিয়ে একটার পর একটা বিপদ যাচ্ছে”।
সনাতনের হুমকিটা বুঝতে ছোট মামার কোন অসুবিধা হয়নি। “আচ্ছা ভেবে দেখি” বলে সেদিন সনাতনকে বিদায় করলেও তিনি বুঝতে পারেন এটা বিপদের শুরু মাত্র।
বিপদটা যে বহুমাত্রিক সেটা কয়েক দিনের মধ্যে বাড়ীর সবাই নানাভাবে টের পেতে শুরু করে। প্রায়ই দেখা যায় সাইকেলে করে একজন যুবক আরেকজনকে তাড়া করে ভেতর বাড়ীতে ঢুকে পড়ছে। ভেতরের উঠোনে কয়েকবার চক্কর দিয়ে যাবার সময় দড়িতে শুকোতে দেয়া কাপড় টেনে ফেলে দেয়া, রোদে দেয়া আচার বা মশলা ছড়িয়ে ফেলার সাথে উঠোনে মেয়েদের কাউকে পেলে তাকে ধাক্কা মারার ঘটনাও ঘটতে থাকলো। একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে একদল ছেলে আলীকে ঘিরে ফেলে। নানারকমের টিটকিরি দেবার সাথে সাথে হঠাৎ তাদের একজন আলীর ধুতির কোঁচা ধরে টান মেরে বলে, “অ্যাই সালা কাটুয়া! তোর কাটাটা দেখা তো দিকি। আর লুঙ্গী না পরে ধুতি পরেছিস্ ক্যানো”! আলী কিছু না বলে একহাতে ধুতি চেপে ধরে দৌড়ে বাড়ী চলে আসে। বাড়ী ফিরেও সে কাউকে কিছু বলে না। যেদিন একদল লোক তাদের বার্বাড়ীর ঘর থেকে তাদের জিনিসপত্র উঠোনে ছড়িয়ে ফেলে বাইরে ‘পদ্মপুকুর যুব সমিতি’র সাইনবোর্ড লাগিয়ে দিলো সেদিন বাড়ির সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেলো যে পদ্মপুকুর থেকে পালানোর সময় হয়ে গেছে।
পদ্মপুকুরের বাড়ী বিক্রি করাটা খুব সহজ ছিলো না। নানা হঠাৎ করে মারা যাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই কোন উইল ছিলো না। নানা মারা যাবার পর ওয়ারিশানদের মধ্যে নামজারী করার বা বাড়ী মিউটেশন করার কথা কেউ ভাবেনি। কিন্তু বেচার সময় দেখা গেলো এসব না করা হলে বাড়ী বেচা কঠিন। তারওপর বাড়ী বেচার কথা যখন সনাতন হালদারের কানে গেলো তখন বিষয়টা আরও কঠিন হয়ে গেলো। সনাতন নিজে বাড়ীটা পেতে আগ্রহী, কিনতে নয়। সুতরাং অন্যরা যারা কেনার ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছিল তারা একটু একটু করে পিছু হঠা শুরু করলো। শ্যামল ব্যানার্জী রাজনীতি করেন না তবে কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, হিন্দু মহাসভা সব দলের নেতাদের সাথে তার দহরম মহরম আছে। তার মূল ব্যবসা জমি কেনাবেচা, জমির দালালী এবং সুদে টাকা খাটানো। শ্যামল স্থানীয় মানুষ নন্, তিনি আসলে কোথাকার মানুষ সেটাও কেউ খুব নিশ্চিত না। এমনকি তার আসল নাম শ্যামল ব্যানার্জী কিনা সেটা কেউ হলফ করে বলতে পারবে না। তবে এগুলো কোন সমস্যা না, শ্যামল ক্ষমতাবান মানুষ, এই এলাকার অন্য ক্ষমতাবান মানুষেরাও শ্যামলকে সম্ঝে চলেন। শ্যামল বিপদগ্রস্থ মানুষের জমি, ভেজাল লাগানো জমি কিনতে ভালোবাসেন। এতে সস্তায় কেনা যায়, পরে ভালো দামে বেচা যায়। এই পর্যায়ে সাপের হাত থেকে বাঁচার জন্য ছোট মামা কুমীরের শরণাপন্ন হলেন, তিনি বাড়ী বেচতে শ্যামলের দ্বারস্থ হলেন।
নানাবাড়ী বিক্রি হবার ব্যাপারটা চূড়ান্ত হতে বড় মামী তার দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে মির্জাপুরে তার বাপের বাড়ীতে গিয়ে উঠলেন। বড় মামী বা তার ছেলেমেয়ের সাথে আলীর খুব সদ্ভাব ছিল তা নয়, তবে বিরোধও ছিল না। পাঁচ-ছয় বছর এক বাড়ীতে থাকলে, বয়সে কাছাকাছি হলে একরকম সম্পর্ক তো তৈরী হবেই। তাই যেদিন ওরা চলে গেলেন সেদিন আলীর মনে হয়েছিল তার চোখের সামনের পৃথিবীর এক খাবলা কেউ তুলে নিয়ে গেল।
ছোট মামীর বাপের বাড়ী বকুলতলায়। ঠিক হলো বকুলতলায় মামীদের বাড়ীর কাছে একটা ছোট বাসা ভাড়া নেয়া হবে। সেখানে আলী আর তার মা উঠবেন। ছোট মামা, মামী, তাদের দুই মেয়ে আপাতত মামীর বাপের বাড়ী উঠবেন। পরে বাড়ী বিক্রির টাকা পাওয়া গেলে বকুলতলায় জমি কিনে বাড়ী তুলে সবাই একসাথে উঠবেন। এইসব কথাবার্তা যখন চলছে তখন মা কিছু বুঝতে পেরেছিলেন কিনা আলী নিশ্চিত না, তবে সে নিজে বুঝতে পারেনি আসলে পরিবারটা এখানেই ভেঙে যাচ্ছে। বকুলতলায় জমি কিনে ছোট মামার আর কখনো বাড়ী করা হয়নি, কিন্তু সেসব তো আরও পরের কথা।
বকুলতলায় যে বাসায় আলী আর তা মা উঠলো অমন বাসা আলী আগে কখনো দেখেনি। খুব সরু একটা গলি যেখান দিয়ে দুজন মানুষ গায়ে গা না লাগিয়ে চলা কঠিন অমন একটা গলির দুপাশে টানা দুই সারি একচালা টিনের চাল দিয়ে বাঁশের বেড়ার গায়ে গায়ে লাগানো ঘর, কাঁচা মাটির মেঝে। কাঠের দুই পাল্লার দরোজা খুললে ভেতরে একটাই ঘর। সে ঘরের পেছনে একটা ছোট বারান্দামত জায়গা, সেখানে কাঠের উনুনে রান্নার ব্যবস্থা। গলির শেষ মাথায় একটা কুয়ো — তার জল দিয়ে স্নানাহারশৌচ সব কিছু সারতে হয়। কুয়োতলার পরে গলির কুড়িটা পরিবারের জন্য দুটো কাঁচা পায়খানা — একটা পুরুষদের, আরেকটা মেয়েদের। এসব দেখে মা গুম হয়ে যান, আলীরও দম বন্ধ লাগে। ওরা গ্রামের মানুষ। গ্রামের ঘরদোর যেমন হোক, সব ছিলো খোলামেলা — এমন সরু ঘিঞ্জি নয়। এখানে একটা গাছ নেই, কোন ঝোপঝাড় নেই, কোন পুকুর নেই। এখানে পাখি মানে কাক আর চড়াই। আর আছে কয়েকটা হাড় জিরজিরে বেড়াল আর ছালওঠা কুকুর।
আলীকে কাছের থানামাকুয়া হাইস্কুলে ভর্তি করে দেয়া হয়, তবে সে শুধু নিয়মরক্ষার্থে। দুবেলা আহার জোটানো যখন কঠিন হয়ে পড়লো তখন আলীকে স্কুলের কাছে একটা দর্জি দোকানে দেয়া হলো খলিফার কাছে আজ শিখতে আর দোকানের টুকটাক কাজ করতে। দোকানে সেলাই মেশিনের ঘড়ঘড় শব্দে আলীর সরদারপাড়ার বাড়ীতে মান্নাফ কাকার ঘর থেকে ভেসে আসা সেলাই মেশিনের শব্দের কথা মনে হয়। আলীর মনে হয় গত কয়েক বছরে সে আর তার মা নিজেদের ঠাঁই থেকে নড়ে ক্রমে দক্ষিণপূবে প্রথমে পদ্মপুকুর, তারপরে বকুলতলায় ঠাঁই পেলো। এই ঠাঁই যে সাময়িক সেটা বুঝতে কষ্ট হয় না। খাস জমি দখল করে তোলা ঘর থেকে যে কোন সময় উচ্ছেদ হয়ে যেতে হতে পারে। তারওপর জোর আলাপ চলছে খুব শীঘ্রি দেশে আজাদী এসে যাবে, সায়েবরা বিলেতে ফেরত যাবে, আর মুসলমানদেরকে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয়া হবে। সুরেন যে বলেছিল ঘটিবাটিসুদ্ধ দেশ থেকে তাড়িয়ে দেবে শেষমেশ সেটাই সত্যি হতে যাচ্ছে।
এর কয়েক বছর পরে একদিন সত্যি সত্যি আলী আর তার মাকে দুটো পুঁটলি সম্বল করে আরও পূবে চলে যেতে হয়েছিলো। ট্রেনে করে কলকাতা থেকে গোয়ালন্দ, সেখান থেকে স্টীমারে করে নারায়ণগঞ্জ, আবার সেখান থেকে ট্রেনে করে ঢাকার ফুলবাড়ীয়া স্টেশনে — এক অজানা দেশ পাকিস্তানে, যেখানে তার ঊর্ধ্বতন চৌদ্দ পুরুষের কেউ কখনো যায়নি। আলীর পুঁটলিতে কয়েকটা কাপড় আর দরকারী কিছু জিনিসের সাথে দুটো অদরকারী জিনিস ছিলো — একটা আশুতোষ দেবের ‘ইংলিশ-বাংলা অভিধান’, আর একটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সঞ্চয়িতা’।
পাকিস্তানে আলী আর তার মায়ের কী হলো, আর তার ভাই নবীই বা কোথায় গেলো সেসব আরেক গল্প। ওসব অন্য কোন দিনের জন্য তোলা থাক।