ভ্রূণ যশোধরা রায়চৌধুরী --------------- কাচের বীকারে রাখা তরলে শোয়ানো ভ্রূণ, তুমি। চোখ হয়নি, পা হয়নি, পায়ের আঙুল হয়নি, শুধু মাথা হয়েছে আর হয়েছে শ্রুতি। কানের কুহর হয়েছে, তাতে ঢুকেছে মায়ের বুক থেকে আসা ধুপধুপ আওয়াজ , নরম। শব্দ ঢুকে স্থির হয়ে গেছে। আর কিছু হয়নি আর হবেও না কোনদিন, জেনো কেননা লিঙ্গের চিহ্ন , কেননা চিহ্নের লিঙ্গ, কেননা জননযন্ত্রখানি হবার আগেই আজ উপড়ে আনা হবে সব ভ্রূণ। কেননা যৌনতা আজ পাপের বিষয় হয়ে গেছে কেননা ক্ষমতা আজ চেটে নিয়ে খেয়েছে আমূল সমস্ত জননাঙ্গ, সুতরাং সমস্ত ভ্রূণ আজকে বীকারে থাকবে। অবিকৃত। থমকে থামা। রাতে শুধু ধুপধুপ শব্দ। একা, এক গর্ভহারা মায়ের স্পন্দন আমাদের দেশের বুকে ফোঁটা ফোঁটা বৃথা দুধ জমে।
**********বসত রামেশ্বর ভট্টাচার্য ------------- আমি কাঞ্চনমালায় যাইনি কখনো পুড়ছে ঘর, ছনের ছউনি, দরমার বেড়া পুড়ে পুড়ে টেরাকোটা হয়ে যাচ্ছে সব আর বিমল রিয়াং দিগন্তকে সাক্ষী রেখে চলে গেছে দূর পাহাড়ের দিকে আজ নিজভূমে সে হলো পরবাসী যে আরেকবার উদ্বাস্তু হলো তার কথা জেনেছে কি কেউ, শহীদ কলোনীতে বানিয়েছে বসত, কাঞ্চনমালায় এখনো পুড়ছে কি ঘর? আমি কাঞ্চনমালায় যাইনি কখনো আমি যাইনি যাত্রীনিবাসে তুমুল তর্কের পর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘুমপাড়ানি গান আর সমুদ্রের ঢেউ গুণতে আমি যাইনি আলোর রোশনাইয়ের ভেতর হাঁটতে হাঁটতে এখন আর কেউ কাঞ্চনমালা বা বাগমার কথা ভাবছে না পাহাড়ে বৈরীর কাছে যেতে পারে এক বদমেজাজী কবি, সেই পথে চলে গেছে নন্দ, নকুল, মিহির কবিতার বাসন্তী বর্ণমালা ছড়িয়ে রেখেছে কেউ, আঁধার রাতের আকাশে আবার ভেসে উঠেছে নক্ষত্রপুঞ্জ, স্বাতী ও কৃত্তিকা নীচে জল ও মাটি মাখামাখিক হলে আবার বাসনার জীর্ণ শরীর জেগে আছে কেউ ফুটছে ভাতের হাঁড়ি
**********
অসময়
মিঠুন ভৌমিক
-----------
এক সন্ধ্যায় পাখিটা এসে বসলো
আমাদের গাছে, যেখানে অন্ধকার সবে
আসন পেতেছে আর ডালে ক্লান্ত পিঁপড়ের দল
ঠেলে ঠেলে উঠছে জীবন। জঙ্গলে ঝিঁঝিঁ ডাক
চায়ের জল ফুটছে আর প্রায়ই মরে যাচ্ছে পোকাগুলো-
পোকাদের যেমন হয়, সঙ্গীহীন।
বাসব বলেছিলো তার মাথা ধরেছে, পূর্ণিমা বলেছিলো
কাচের মতন দুয়েকটা ঝুটোফুল, কিন্নর চেয়েছিলো ক'টা দিন মুক্তির আনন্দে... এদিকে ক্রমশই
ভুলে যাচ্ছি বলে ফুটপাথে পড়ে থাকছে বাসের টিকিট।
হেরো লোকটা গান গাইতে চাইছে, হেরো লোকটার হাড় জিরজিরে
কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স না জানা বুক, পেট, গলা থেকে উঠে আসছে ঘুম, হেরোর দল নেই দেশ নেই ভাষা তাও পুরোনো ক্ষয়াটে মাদুলির মত লেপ্টে আছে, অপ্রাসঙ্গিক।
এমন সময় পাখিটা এসে বসলো আমাদের গাছে
আমাদের বলে তো আসলে কিছু নেই, কোন এক মানুষের গাছ
যেখানে অন্ধকার বাসা বেঁধেছে, শুকনো বাগানে দোলনায়
শিশুর শবদেহ কাঠ হয়ে পিঁপড়ের দল-
ঠেলে ঠেলে উঠছে জীবন। জঙ্গলে যুদ্ধের ডাক চায়ের জল
জুরিয়ে যাচ্ছে আর বাকিটা ছকে বাঁধা
এক পাটি হাওয়াই চটি পড়ে থাকছে -- পোকাদের যেমন হয়, সঙ্গীহীন।
স্টেশন ছেড়ে সোমনাথ রায় ----------- খুঁজতে খুঁজতে রাত্রি ছেড়ে যাচ্ছি ভিন্নপাড়া চুপ করেছে দেওয়াল বেয়ে পাতার আঁকিবুঁকি অচেনা পথ, খন্দ কাদা পেরিয়ে ছাড়াছাড়ি তারার নীচে দূরের আলো দেখছি কিছু ঝুঁকে পাঁচিল, তার ওপাশে এক বারান্দা আর দড়ি জড়িয়ে আছে গ্রিলের গায়ে গিঁটের মত স্মৃতি জানলা কাঁপে ওপর থেকে হাওয়ার এমন জোর পথের মত তখন যদি হাত বাড়িয়ে দিতে- পিচের ওপর দাগ টেনে যায় ব্যস্ত বাসের চাকা বাদামি হয় গমের ক্ষেত আর জ্যোৎস্না ক্রমে ম্লান আধখানা চাঁদ সন্ধ্যে থেকেই উৎকন্ঠার ফাঁকে দেখল কেমন মিশছে আঙুল ফুটপাথে বাগানে খুঁজতে খুঁজতে স্টেশন আসে- কলিং বেলের মুখে থমকে যাচ্ছি, কারণ রাত্রি, কারণ ভিন্নপাড়া গ্রিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, ওপর থেকে ‘টুকি’- খুঁজছি কি? আর কী খুঁজছি? ঠিক তখনই ট্রেন ছাড়ে
**********অনাহূত জারিফা জাহান ----------- এমনও হয়, দু'একটা অনভিপ্রেত আনাজ নিয়ে এসেছি ব্যাগে যেমন লঙ্কার সাথে শুঁটি চালকুমড়োর সাথে লাউ আলতাআলুর পাশে মুলো তারা সব মৌলিক অথচ রঙের সীমান্তবর্তী বেখেয়ালে চলে আসে কখনও, অনাহূত, স্রোতে গা ভাসাতে। এমনও হয়, আমাদের স্নায়ুছেঁড়া উৎসবদিনে ডানাহীন এসে পড়ে খুন ধর্ম আর রাজনীতির ফাঁকে অপাঙ্গ ধর্ষিত খাটিয়ায় তারা সব নিয়মিত অথচ মুখোশের কাছে মুখ ফেলে এসে খুঁজে ফিরি তৃতীয় পৃথিবী, প্রীতিভাজনেষু, স্বার্থের আরাম।
**********বৈশাখ সায়ন কর ভৌমিক ----- শিশুটি নিহত তবু গালে তার শীতের লালিমা শিশুটিকে খেয়েছে মানুষ তাই মানুষের কষে পরিহাস ক্রূর, এরকম থাকে, মানুষের দেহ যত কাদায় পাথরে নীচে অঙ্গার জল মাটি ভূত হয়ে মানুষের দুর্দিন হয়ে রোদেলা দিনের ধারে কেটে যায় ঘর্ঘর সাঁজোয়ার ধ্বনি মানুষের শিশুগুলি খুঁড়ে তোলে জল মাটি খনিজ পাথর। শিশুটিকে খেয়েছে মানুষ তার গালে তবু বাঁচার লালিমা ছবি গরীবের ঘর তার সামোভার কাংড়ি বাসনা তার এলোমেলো শব নিয়ে খোয়োখেয়ি করে তবু ছবিতে জীবিত আর আংরায় তাপ ওঠে মাটির গভীরে। বাঁচার লালিমা থাক বৃক্ষের দেহ থেকে প্রভূত জ্বালানি শীতের যাতনা থেকে অনাগতবিধাতা জানেন এ দেহ ভাণ্ড নিয়ে সুদিনের খোঁজে তারা যাইবে সাগরে এ লালিমা বেঁচে থাক, এই রোদে আমাদের বর্ষবরণ।
**********চোদ্দোশ পঁচিশ শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় ---------------- আমি আর শুভ নববর্ষ বলবোনা , দেখা হলে করবোনা কুশল জিজ্ঞাসা আপনিও অনর্থক দাঁত কেলিয়ে হাসবেন না বিশ্বাস করুন আমার গা বিনা কেরোসিনে জ্বলছে পশ্চাতে লাথি মারার আবেগে আমি গড়িয়ে যাচ্ছি, গড়িয়ে যাচ্ছি পাহাড়ের থেকে প্রতিদিন প্রতিদিন আমার একই রূপ পালটাচ্ছে নাম অষ্টোত্তর শত পুরুষে আমাদের একই কীর্তন সন্ধ্যায় এগিয়ে যাচ্ছে দিন থেকে প্রতিদিন ক্রমাগত মৃত্যুর দিকে আমি আর শুভ নববর্ষ বলবোনা, দেখা হলে করবোনা কুশল জিজ্ঞাসা আপনিও অনর্থক দাঁত কেলিয়ে হাসবেন না যে আজ নিহত, একা শুয়ে আছে ঘাসের ভিতর যদিও নিরাপদ আমারা জেনেছি এই চোদ্দোশ পঁচিশ
**********চৈত্র সংক্রান্তি, নববর্ষের শুভকামনায় সুমন মান্না --------- ১ চৈত্র সংক্রান্তি কুকুরের বিরক্তিকর ডাক চিন্তাপ্রবাহ ছিঁড়েখুঁড়ে দেয় বেওয়ারিশ চায়ের দোকানের কুকুর, সহবত জ্ঞানহীন, ঘরের আসবার তছনছ করে সোফা ছিঁড়ে ফেলে, ঘরদোর ময়লা সঙ্কুল - করে তার নিজস্ব খেঁকুটে ভাষায়। এ ঠিক কুকুর নয়, অথচ কুকুরের মতো জিভ বের করে ঘোলাচোখে অপলক সারাক্ষণ চেঁচিয়ে যাচ্ছে বলে কেউই তদের নিজস্ব কাজকর্ম আনন্দ করতে পারছে না। খাবারে নুন ঠিক থাকছে না। অঙ্ক মিলছে না। শুধুই বাড়িতে নয়, রাস্তায়, টিভি রেডিওয় উদ্বিগ্নতা, ভয় বাড়িয়ে দেওয়া ছাড়া কাজে আসছে না কারও- এ কুকুরের সারাক্ষণ ঘেউ ঘেউ। আরও বিরক্তি লাগে এই ভেবে এ কুকুর চলে গেলেও ফেলে যাবে বিস্বাদ ফেউ। ২ নববর্ষের শুভকামনায় আপাতত নুনের মধ্যে রাখা আমাদের পকেটের লাশগুলি তাতে যে যা রেখেছিল সব গেছে। সঞ্চিত শিক্ষা, রুচি, অধীত বিদ্যাসমূহের মৃতদেহগুলি সন্ধ্যায় দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল। ফলে আজ কেউ ভালো চোখে দেখে না, কানে শোনে না, হিতাহিত জ্ঞানশূন্য, হাতড়ায় প্রতিবেশি ঘরে সিঁদ কাটে সন্দেহে সামান্য সুযোগে তার অন্ধত্বটুকুও চুরি করে যদি তাতে কিছুটা সুরাহা হয়। খাবলা খাবলা নুনের মধ্যে তখন আমাদের পকেটের লাশ গুলি থেকে উদ্বায়ী শুভেচ্ছা, শিক্ষা, রুচিবোধ গুলি ধীরে ধীরে বের হয়ে হয়ত জোটবাঁধা শিখতে ঘুরতে বেরোবে সবার অলক্ষ্যে মেঘেদের দরজায় দরজায়। সত্যিকার নববর্ষের বিশল্যকরণী শুভকামনায়।