রোহতক, এপ্রিল ২০১৮। জনৈক স্মিতা চক্রবর্তি ভারতের সংশোধনাগার ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলছিলেন মানসরোবর পার্কে। উনি সংশোধনাগার ব্যবস্থা নিয়ে স্বাধীন ভাবে গবেষণা করেন। সংশোধনাগারগুলির দুরবস্থার কথা, সেখানকার বাসিন্দাদের দুর্দশার কথা বলতে বলতে হাঠাৎই এক রূপকাথা শোনান তিনি। রাজস্থানের আইজি সংশুরনাগার, এক আশ্চর্য বিপদে পড়ে ওনাকে সাহায্যের জন্য মারিয়া হয়ে ডেকে পাঠান। সমস্যা – সাজাপ্রাপ্ত মানুষেরা সংশোধনাগার থেকে মুক্তি পেতে নারাজ।
এমনটা হয় কি?
কারাগার শব্দটি আমাদের মনে একটা ভয়ের অভিঘাত তৈরি করে। সাথে সাথে মনে আসে লৌহকপাট, আলবাতাসবিহীন নিষ্ঠুর কারাকক্ষ, শিকল ও নানাবিধ দৈহিক শাস্তি। আমাদের মহাকাব্যে, পুরাণে, লোককথায় নরকের বর্ণনা সম্ভবতঃ তখনকার কারাগারের অনুষঙ্গে প্রাণিত। “অন্ধকারে চৌরাশিটা নরকের কুণ্ড / তাহাতে ডুবায়ে ধরে পাতকীর মুণ্ড” – নরক তো এমনই। যুধিষ্ঠির নরকে দেখছেন লেলিহান শিখা গ্রাস করছে পাপীদের, আর তারা আর্তনাদ করছে পরিত্রাণের জন্য। সেখান থেকে দান্তের নরক, সবই তখনকার কারাগারের ছবি। এককথায় প্রচন্ড নিষ্ঠুর, অমানবিক এক শাস্তি ব্যবস্থার মূর্ত রূপ – কারাগার। টাওয়ার অফ লন্ডন থেকে বাস্তিল কি প্রাচীন রোমের মামেরটাইন থেকে কংসের কারাগার সবই নিষ্ঠুরতার প্রতীক।
অবস্থা বদলাতে শুরু করে ১৮শতকের ইউরোপে। জন হাওয়ার্ড (১৭২৬ – ১৭৯১) নামে এক সামন্তপ্রভু, যিনি কারাগার ও হাসপাতালের সংস্কার নিয়ে ভাবনা চিন্তা করতেন, লেখেন, কারাগারগুলি অপরাধ ও রোগ-ব্যাধির আখড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে, এর পরিবর্তন দরকার। ১৭৫০এ জেল ফিভার নামে এক মহামারীতে আক্রান্ত হয় লন্ডন। হতদরিদ্র থেকে অভিজাত কেউ রেহাই পান নি এই রোগের কবল থেকে।
আঠারো শতকের শেষের দিকে জেরমি বেন্থাম (১৭৪৮ – ১৮৩২) নামে এক দার্শনিক কারাস্থাপত্য নিয়ে তাঁর ভাবনা চিন্তা লিপিবদ্ধ করেন। তাঁর চিন্তার অনুপ্রেরণা ছিলো তাঁর ভাই স্যামুয়েলের বানানো একটি কারখানা। এটি তৈরি হয়েছিলো রাশিয়ায়। কারখানাটি গোলাকৃতির, যাতে সর্দার সর্বক্ষণ মজুরদের ওপর নজরদারি চালাতে পারে।
বেন্থাম এই কারখানা স্থাপত্যটিকে প্রয়োগের চিন্তা করেন আরও আন্যান্য প্রতিষ্ঠানে, যেখানে মানুষকে আবদ্ধ থাকতে হয় বাধ্যতামূলকভাবে, যেমন স্কুল, হাসপাতাল ও কারাগার। উনি এই স্থাপত্যের নাম দেন “প্যানঅপটিকান” যার অর্থ সব দেখা যায় – এমন। উনি তাঁর বই “দ্য প্যানঅপটিকান ঃ অর দ্য ইন্সপেকশন হাউস”-এ লেখেন,
“এক কথায় এটি, যেখানে একটি নাতিবৃহৎ পরিসরে একদল মানুষকে নজরদারিতে রাখতে হবে, সেই সমস্ত প্রতিষ্ঠানের জন্য ব্যতিক্রমহীনভাবে প্রযোজ্য, তা সে যে উদ্দেশ্যেই হোক না কেন।”
সে সময় আরও কিছু চিন্তাবিদ, নিকোলাস জুলিয়াস (১৭৮৩ – ১৮৬২) এটি নিয়ে উৎসাহী ছিলেন। জুলিয়াসের মতে এটি (প্যানঅপটিকান স্থাপত্য) শুধুই একটি কারিগরি সমধান নয়, এটি এক নতুন সমাজের দিকে এগিয়ে দেবে আমাদের।
১৮২০তে বৃটিশ পার্লামেন্ট এই স্থাপত্যেকে প্রত্যাখ্যান করলেও, উনিশশতকের প্রথম দিক থেকেই কারা স্থাপত্যে এই ভাবনা মান্যতা পেতে শুরু করে।
বিশশতকে এসে মানবাধিকারের ধারণা ক্রমশঃ জোরদার হতে শুরু করে। শুধু কারাস্থাপত্য নয়, গোটা বিচারব্যবস্থা, শাস্তিব্যবস্থা প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে যায়।
১৯০৫ সালে প্রকাশিত জি কে চেস্টারটনের দ্য ক্লাব অফ ক্যুইয়ার ট্রেডস-এর শেষ আখ্যানে চেস্টারটন, এক বিচারকের জবানে লিখছেন –
প্রথম জীবনে আমি ছিলাম একজন জজ। সবাই যাতে সুবিচার পায় সেই চেষ্টাই তখন আমি করেছি। কিন্তু সে চেষ্টা যে সম্পূর্ণই অর্থহীন, ধীরে ধীরে তা আমি উপলব্ধি করতে পারলাম। বুঝতে পারলাম যে মানুষের তৈরি এই আইনকানুনগুলো একটা অর্থহীন ঠাট্টা মাত্র। যে আদালতে সুবিচার হবার কথা, বিচারের নামে সেখানে প্রহসন চলছে। জমকালো পোষাকে জজের আসনে আমি বসে থাকতাম, লোকে বলতো ন্যায়াধীশ। হাঃ, ন্যায়াধীশ! আসলে যে আমি একটা সাক্ষীগোপালমাত্র, তা আর কেউ না বুঝুক আমি বুঝতাম। লজ্জায় আমার মাথা কাটা যেতো। কীইবা আমার ক্ষমতা! দুটি মাত্র ওষুধ আমার হাতে - জরিমানা আর জেল। আর তাকেই সম্বল করে কি না আমি সমাজের সর্বব্যাধি নিরাময় করতে চলেছি। জেলে দেওয়া বা জরিমানা করা আমার উদ্দেশ্য নয়, আমার উদ্দেশ্য কলহবিবাদের মীমাংসা করা। আর তা যদি হয়, তো জেল-জরিমানাতে কিছুমাত্র কাজ হবে না। তার চাইতে বাদী-বিবাদীকে যদি চুমু খেতে বাধ্য করা হয় বা দুজনকেই ধরে যদি চাবকে দেওয়া যায়, তো ঢের সহজেই তার একটা মীমাংসা করে ফেলা যায়। পরস্পরের সঙ্গে কয়েক মিনিট আড্ডা, কিংবা ডুয়েল লড়েও মীমাংসা করা যায়। এ সব দাওয়াই ঢের বেশি কার্যকারী। মুস্কিল হলো আইন তা বোঝে না। জেল-জরিমানার মধ্য দিয়েই সব ব্যাপারের ফয়সলা করতে চায়।
এই উপলব্ধির পরই আমি ঐ বিচারব্যবস্থা ছেড়ে আসতে বাধ্য হই।
তারপর থেকেই আমি এক নতুন বিচারব্যবস্থার প্রবর্তন করেছি। মানুষের যা কিছু নৈতিক অপরাধ তার অবসান ঘটানই আমার এই নতুন বিচারব্যবস্থার উদ্দেশ্য। খুনজখম বা বিনা অনুমতিপত্রে কুকুর পোষা, এসব ছোটখাট অপরাধ নয়, বরং এর চাইতে ঢের বড়ো অপরাধ, সমাজ জীবনকে যা দুর্বিষহ করে তুলেছে - স্বার্থপরতা, কুৎসা রটনা, মা-বাবার বা সন্তানের প্রতি দুর্ব্যবহার এসবরই আমি বিচার করে থাকি। শাস্তি হিসাবে আমি যে দণ্ডই দেই না কেন, অপরাধীরা তা সন্তুষ্টচিত্তেই মেনে নেয়।
ভারতেও কারাভাবনা ধীরে ধীরে পাল্টাচ্ছিলো। ১৯৩৯এ মহারাষ্ট্রের সাতারার কাছে স্বতন্ত্রপুরে, সেখানকার শাসক রাজা ভাবনারাও শ্রীনিবাস এক মুক্তকারা নির্মাণ করেন। সম্ভবতঃ ভারতের কারা ইতিহাসে এই প্রথম মুক্ত কারাগারের পত্তন হলো
যেখানে অপরাধীরা খোলা আকাশের নীচে নিজ নিজ বাসায় থাকবেন।
এই ভাবনায় অনুপ্রাণিত হয়ে ভি শান্তারামের মত চলচ্চিত্র নির্মাতা ১৯৫৭ সালে তৈরি করেন দো আঁখে বারা হাথ। এর পর আরও নানান জায়গায় গড়ে ওঠে মুক্তকারা। এখন ভারতে ১৭টি রাজ্যে মুক্তকারা আছে। এর মধ্যে রাজস্থানে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় (২৯ টি) মুক্তকারা আছে।
লেখা শুরু করেছিলাম যে রূপকথার গল্প বলে সেটি এই মুক্তকারার গল্প।
এখানে সকলে পরিবার নিয়ে থাকেন। প্রত্যেকের নিজস্ব জীবিকা আছে। উল্লেখযোগ্য তথ্য, পরিবার নিয়ে থাকা স্বত্ত্বেও এখানে গার্হস্থ্য হিংসা একেবারেই নেই।
এঁরা প্রায় সকলেই খুনের মতো মারাত্মক অপরাধের শাস্তিপ্রাপ্ত। এদের অনেকেই আশেপাশের এলাকায় নিরাপত্তা রক্ষীর কাজ করেন। কেউ কেউ গৃহস্থ বাড়িতে গৃহশ্রম-সাহায্যকারী। কেউ কেউ যাঁরা লেখাপড়া জানেন, তাঁরা হিসাবরক্ষকের কাজও করেন। ১৯৭০এ একজন ডাক্তার এখানেই আশেপাশের এলাকার রোগীর চিকিৎসা করতেন। অর্থাৎ এঁরা সমাজে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করে ফেলেছেন। শুধু যে এঁরাই বাইরে সমাজে গিয়ে মিশছেন, তা নয়, বাইরের সমাজের মানুষও এঁদের কাছে আসছেন। একটা অবাধ মেলামেশার ফলে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে।
এটাই ভবিষ্যতের কারা ব্যবস্থা, শাস্তি ব্যবস্থা, যেখানে অপরাধী নয় অপরাধ নির্মূল হয়।
রাজস্থানের মুক্তকারাগুলি স্বায়ত্তশাসিত। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত হয় পাঁচ থেকে সাত জনের বন্দী পঞ্চায়েত। এঁদের প্রধান দুটি কাজ – ১) বন্দী হাজিরা রাখা, ২) বিদ্যুতের বিল আদায় করা। এছাড়া মুক্তকারার শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্বও এঁদেরই। তেমন গুরুতর শৃঙ্খলাভঙ্গে দায়ী ব্যক্তি/ব্যক্তিদের বন্ধকারায় ফেরৎ পাঠানোর সুপারিশ করতে পারে পঞ্চায়েৎ।
নানা ধরনের মুক্তকারা আছে। কোথাও বন্দীদের পরিবারের সাথে থাকতে দেওয়ার সঙ্গে কাজও দেওয়া হয়। কোথাও বন্দীদের কাজ খুঁজে নিতে হয়। বিকানীরে সরকারী কৃষি গবেষণা কেন্দ্রে কাজ করেন বহু বন্দী।
শুধু একটাই কথা পাক খাচ্ছিলো মনে মনে। মানুষ, কারাগার (তা সে যতো চমৎকারই হোক) থেকে ছাড়া পেতে চাইছেন না কেন? সেখানে যদি “ভালো” থাকা যায়, তো তার চেয়ে কাম্য কীই বা হতে পারে। মার মনে এমন কথাও উঁকি মারতে থাকে, আজ যখন আমাদের এই পোড়া দেশে মানুষের হাতে কাজ নেই, বাসস্থান নেই, দুবেলা অন্নসংস্থান নেই, তারা কি রাজস্থানে গিয়ে দুটি “অপরাধ” করে অমন মুক্তকারায় জীবন অতিবাহিত করতে চাইবে না?
তা বলে কি মুক্তকারাগুলি সমস্যাহীন একধরনের মরূদ্যান সমাজ? তা হয়তো নয়। সমস্যা আছে কাজ না পাওয়ার, কম মজুরি পাওয়ার। তাতে সংসার চালানো মুস্কিল হয়ে পড়ে।
রূপকথা হয়তো ততোটা রূপকথা নয়, তবু রূপকথার শুরু তো বটেই।
কারাগার বা jail বা prison সম্মন্ধে একজন মনীষীর একটি সুন্দর কথা মনে পরে গেল। মনীষীর নাম জানিনা আর উক্তিটিও পুুুুঙ্খানুপুঙ্খরূপে (অর্থাৎ verbatim) জানিনা,
তবে সার কথাটি হ'ল, একটি স্কুল খোলার অর্থ একটি জেল বন্ধ করা! আমাদের কারাগারব্যবস্থার উন্নতিসাধনের সাথে সাথে আমরা যদি আমাদের স্কুলব্যবস্থারও কিছুটা হ'লেও উন্নতিসাধন করতে পারি, তাহলে হয়তো একে একে আমরা সবকটি কারাগারই একদিন বন্ধ করে দিতে পারব।