এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • শম্ভাজি মহারাজের সংস্কৃত শেখা

    upal mukhopadhyay লেখকের গ্রাহক হোন
    ০২ নভেম্বর ২০২৪ | ২৭৬ বার পঠিত
  • শম্ভাজি মহারাজের সংস্কৃত শেখার গল্পটা হয়ত অনেকটা এইরকম :
    আগ্রা থেকে শিশু শম্ভাজিকে নিয়ে পালাচ্ছেন শিবাজি মহারাজ। তাঁকে ধরতে আসছে ঔরঙ্গজেব আলমগীরের ফৌজ। চতুর্দিকে ছড়ানো গুপ্তচর নেটওয়ার্কের থাবা থেকে বাঁচতে বেনারসের সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত কাশী পন্থের হাতে গভীর এক রাতে ছেলেকে সপেঁ দিলেন শিবাজি মহারাজ, বললেন, ''পণ্ডিতমশাই ছেলেটাকে নিয়ে এইভাবে পালাতে গেলে নিঘাৎ ধরা খাব।"
    ---- কিচ্ছু চিন্তা করবেন না মহারাজ।
    ---- মহারাজ !
    ---- আপনি হিন্দুকূলপতি মহারাজ।
    ---- সেতো আপনি বলছেন কিন্তু দাক্ষিণাত্যে কাউকে তো বলতে শুনলাম না।
    ---- কেউ বলে না !
    ---- বিলক্ষণ বলে কিন্তু সে তো কুনবি রায়তের দল, কই কোন ব্রাহ্মণকে তো বলতে শুনি না। সে যাই হোক আপনার কথায় আমি খুশি, এই নিন। এই বটুয়ায় যা অর্থ আছে তাতে রাজকুমার শম্ভাজির প্রতিপালন করবেন।
    ---- যথা আজ্ঞা মহারাজ। আমি জীবন দিয়ে রক্ষা করব।
    ---- শুনে ভালো লাগল। আমার লোক নজরে রাখবে। হাওয়া ঠাণ্ডা হলেই নিয়ে যাবে কুমারকে।
    ---- যথা আজ্ঞা মহারাজ।

    শিবাজি মহারাজ চলে যেতে পণ্ডিত মশাই শম্ভাজিকে বললেন, ‘‘বল তো বাবা গরুকে সংস্কৃতে কী বলে?’’ শম্ভাজি বললেন, ‘‘আমি ছোটবেলা থেকে গরুর ন্যাজ ধরে টান মারতে পারি, দেখবেন।’’ পণ্ডিতমশাই হয়ত অন্য কেউ হলে পীঠে দু কোড়া বেত চালিয়ে দিতেন কিন্তু এ হল গিয়ে শিবাজির ছেলে, তার ওপর পাঁচ হাজারি মোঘল মনসবদার। তাঁর ওপর শিবাজির লোকেরা যে সর্বক্ষণ নজর রাখছে এটা তিনি বুঝতে পারেন কিন্তু তারা যে ঠিক কারা এটা বোঝা তাঁর কম্ম নয়। মোঘল দিদবানরা সরকারি গুপ্তচর, তারা বেশ বুক ফুলিয়ে নিজেদের এলাকায় ঘুরে বেড়ায়, অন্য রাজার এলাকায় গোপনে ঘোরে তেমনি শিবাজির লোকও বারাণসীর জলে হাওয়ায় মিশে রয়েছে, অতি গোপনে তাদের কাজকম্ম। এটাই রাজা বাদশাহের দস্তুর কখনো খোলামেলা কখনো বা ছুপারুস্তম তাঁদের ঘাতকরা। তাই শম্ভাজির কথায় বেশ ভয় পেয়ে তারপর সে ভয় চেপে কাশী পন্থ বলেন, ‘‘জান না তো ? সব শিখে যাবে। কাল সকাল থেকে টোলে বসবে।’’

    বালক শম্ভাজির মাথা নেড়া করে টিকি রেখে, পইতে পরিয়ে ভোল বদলে দেওয়া হয়। কিন্তু তাতেও মোঘল দারোগার কাছে খবর হয়েছিল। সে এসে পণ্ডিত মশাইকে সেলাম ঠুকে বলে, ''এ ছেলেটা কোথা থেকে এলো। কবে থেকে এলো। দিনের আলোতে তো একে কারুর সঙ্গে আসতে দেখিনি হুজুর।'' পণ্ডিত মশাই চোখ মুদলেন, তাঁর কানে ভেসে এলো প্রল্হাদ শ্লোক যা একমাত্র দৈত্যেরই আত্মঘোষণা হতে পারে। সেই কবে যখন অসুর ছিল দেবতার অংশ, তারপর অনেক সময় কেটে গেছে। এখন অসুর অনার্য তা ব্রাহ্মণের গুমোর জানে, কাশী পন্থও জানতেন। তবে দৈত্যই, একমাত্র দৈত্যই এরূপে আত্মঘোষণা করতে পারে আর তা বিষ্ণুর শ্রেষ্ঠ ভক্ত প্রহ্লাদেরই আত্মঘোষণা, একমাত্র বিট্টলের ভক্ত, সন্ত তুকারাম অনুগামী মারাঠারই আত্মঘোষণা। অজান্তেই সেই শ্লোক উচ্চারণ করলেন পণ্ডিত মশাই :

    প্রল্হাদশ্চমি দৈত্যানাম কাল কলয়তামহম
    মৃগনাঞ্চ মৃগেন্দ্রহম বৈনতেয়শ্চ পক্ষীনাম। (ভগবত গীতা শ্লোক ১০/৩০)

    আমি দৈত্যকূলে প্রহ্লাদ, অনেক কিছুর মতো সময় আমার বশে
    প্রাণীদের মধ্যে আমি সিংহতূল্য শ্রেষ্ঠ আর পক্ষীদের মধ্যে গরুড়তূল্য।

    এ শ্লোকের অর্থ বোঝা দারোগার কম্ম নয়। সে বিভ্রান্ত হওয়ায় কাশী পন্থ তার ব্যাখ্যাটা করেন,
    ”আপনি দিনের বেলা একে দেখেনি। কিন্তু এই যুগে সময়ের নিয়ন্ত্রা কে? তিনি অউরং শাহ আলমগীর, তিনিই সময়ের নিয়ন্ত্রা অতএব এ ছেলে কখন এলো, দিনে না রাতে দিল্লীশ্বরই জানেন। আমরা নিমিত্ত মাত্র।''
    বাদশাহের নামে ভালো ভালো কথা বলায় দারোগা আপাতত চলে গেল। কিন্তু ব্রাহ্মণ বিলক্ষণ বুঝতে পারেন তিনি আলমগীরের দিদবান দের কড়া নজরবন্দী হয়ে পড়েছেন তাই তিনি বুঝলেন পরমেশ্বর তাঁর মুখ দিয়ে গীতার যে শ্লোক বলিয়ে নিলেন তাই আসল সত্যি। এ বালক শূদ্র কুনবি সম্প্রদায়ের তাই তাঁর অহম বলিয়ে নিলো গীতার শ্লোক। এ প্ৰহ্লাদই বটে, যাকে রক্ষা করা তাঁর কর্তব্য। তাছাড়া অর্থ গ্রহণ করে তিনি কুনবি দলপতি মারাঠা অতুল কুশলী যোদ্ধা শিবাজিকে মহারাজ বলে সম্বোধন করেছেন তাই বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য তিনি বালক শম্ভাজির সঙ্গে এক থালায় খেতে আরম্ভ করলেন। এতে আলম গীরের প্রশাসন ধোঁকা খেয়ে যায়। তারা ভাবে এ নিশ্চয়ই কোন দরিদ্র্য ব্রাহ্মণের ছেলেই হবে নইলে এই কট্টর ব্রাহ্মণ - শূদ্রের সঙ্গে, শূদ্র শিবাজির ছেলের সঙ্গে এক থালায় ভাত খাবে কেন? তারা বুঝতেও পারে না শূদ্রের সঙ্গে খাওয়ার পাপে কাশী পন্থ নিয়মিত প্রায়শ্চিত্র করছেন গোপনে। এইভাবে এ দ্বিধাগ্রস্থ ব্রাহ্মণের কাছে শম্ভাজি মহারাজের কঠিন পাঠাভ্যাস চলে বছরখানেক। ব্রাহ্মণ দেখেন এ ছেলে সামান্য নয়, অসম্ভব মেধাবী আর চঞ্চল। তিনি আদর্শ শিক্ষকের মতো চঞ্চলতাকে প্রশয় দিয়ে পঠনের গতি বাড়িয়ে দেন বহুগুণ। এরপর দেখা গেল একদিন বালক শম্ভাজিকে নিয়ে শিবাজির বিশ্বস্ত বাহিনী কেটে পড়েছে, যেমন এসেছিল তেমনই, রাতের অন্ধকারে। কাশী পন্থকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, "বালকের মাতৃবিয়োগ হয়েছে সে ফিরে গেছে।" তারপর সময় যায় আর সবাই ভুলেও যেতে থাকে।

    প্রাথমিকে তথ্য সূএ : পুনের ভাণ্ডারকর ওরিয়েন্টাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সংস্কৃতজ্ঞ অধ্যাপক ভেলঙ্কার কৃত বুধভূষণমের ভূমিকা ওই সুভাষিত গোত্রের সংকলনটা শম্ভাজি মহারাজ নিজে লিখেছিলেন বলে বর্ণিত। ভেলঙ্কর বলছেন পুরোটা না হলেও কিছু শ্লোক তাঁরই রচনা। বাকিটা কল্পনা।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • aranya | 2601:84:4600:5410:34bf:42c2:86f6:***:*** | ০৩ নভেম্বর ২০২৪ ০৭:৪৮539067
  • বেশ 
  • Suvasri Roy | ০৫ নভেম্বর ২০২৪ ১১:২৮539132
  • ভালো লেখা
  • প্রতিভা | 2409:40e0:1149:8c3a:30eb:3e99:a51b:***:*** | ১১ নভেম্বর ২০২৪ ২২:৪৩539396
  • সংস্কৃত শিখেছিলেম, কিন্তু শম্ভাজির মন বড় অসংস্কৃত ছিল।
  • Upalm61@gmail.com | 2401:4900:708b:e109:f2f6:3ad2:2299:***:*** | ১১ নভেম্বর ২০২৪ ২৩:২৪539398
  • সংস্কৃত শিখেছিলেম, কিন্তু শম্ভাজির মন বড় অসংস্কৃত ছিল। 
    সেরকম  মনে  করার  কারণ  আছে  কই  ? স্টুয়ার্ট  গর্ডন   বলছেন  তাঁর  প্রশাসন  দিব্বি  চলেছিল ।আর  মেয়ের  দোষ  টো ষ  সেসময়  রাজাদের  কাছে   নস্যি ।আমি  যা  পাচ্ছি  তাতে  তাঁর  দরবারের  এক  সুসংস্কৃত  পরিবেশের  কথা  ।সত্যি  বলতে   কী  বেশ  রসে  বশে  থাকা  চরিত্তির  ।অনেকটা  জাহাঙ্গীরের  মতো ই ।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে প্রতিক্রিয়া দিন