
প্রতিবার আটই মার্চ আসে, ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ, ইমেল নানা শুভেচ্ছায় ভরে ওঠে, আর আমি ভাবতে বসি এই শুভেচ্ছাগুলোর কতটুকু আমার প্রয়োজন আছে। ছাত্রাবস্থায় মেয়ে হিসেবে কখনও অপদস্থ হতে হয় নি, কর্মজীবনে মেয়ে হওয়ার জন্য অকর্মণ্য তকমা লাগেনি, যাকে বিয়ে করেছি সে তুমুল কনজার্ভেটিভ পরিবেশে বড় হয়েও কোনদিন আমায় হতাশ করেনি, বিবাহসূত্রে যে পরিবারের সাথে জড়িয়েছি তাঁরাও নিজেদের সমস্ত সংস্কারের সাথে যুদ্ধ করে উদারতার পরীক্ষায় সসম্মানে পাশ করেছেন। নারীদিবসে যেসব বঞ্চনার গল্প সামনে আসে তার সিংহভাগই জীবনের এই অধ্যায়গুলোর সাথে জড়িত। আমি জানি এই বঞ্চনাগুলো এখনও প্রতিনিয়ত হয়, যাদের সাথে হয় তাদের আমি চিনি, কিন্তু এই গল্পগুলো আমার গল্প নয়। তা বলে এমনও নয় যে মেয়ে হওয়ার জন্য কোন স্যোসাল প্রেশার আমার ওপর নেই। অনেকসময় ভেবেছি এই কথা লিখব না, ভয় হয়েছে অন্য কারোর সংবেদনশীলতায় হয়ত আঘাত করে ফেলব। তবু আজ লিখেই ফেলি।
একটা বয়েসের পরে কর্মক্ষেত্রই হোক বা অন্য কোন সামাজিক ক্ষেত্র, দুজন মহিলার আলাপ শুরু হয় তাদের বাচ্চাদের নিয়ে। ছেলেদের ক্ষেত্রে এটা একেবারেই হয়না এমন নয়, তবে সন্তানপালন এখনও দেশ-জাতি নির্বিশেষে যেহেতু মূলত মেয়েদের দায়িত্ব এবং মা না হওয়াকে অনেকে নারীত্বের অপচয় মনে করেন, তাই মেয়েদের আলোচনায় এই প্রসঙ্গ আসে অনেক বেশি। সেজন্যই বোধহয় আমাদের সন্তানহীনতার জন্য আমার জীবনসঙ্গীটিকে তেমন কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় না, অথচ আমার জন্য থাকে অনেক প্রশ্ন। সন্তানহীনতার সিদ্ধান্ত আমাদের যৌথ সিদ্ধান্ত। আমাদের দুজনের সামনে এই নিয়ে প্রশ্ন করা হলে (যেটা আমাদের বাড়ি থেকে করা হয়েছে) আমরা দুজনেই তার উত্তর দিয়ে থাকি। কিন্তু যেখানে প্রশ্নের মুখোমুখি একা আমি সেখানে তো অন্য মানুষটির কিছু করার থাকে না। আর এই জায়গাটায় এসে আমাদের সচেতন প্রতিরোধ সত্ত্বেও লিঙ্গবৈষম্যের শিকার হতেই হয়।
অনেকেই প্রশ্ন করেন, কেন সন্তান চাই না। আমরা বর্তমান পৃথিবীকে একটা শিশুর জন্য যথেষ্ট সুস্থ ও নিরাপদ মনে করি না। তাই আমরা সন্তান চাই না। আমরা যখন জন্মেছিলাম তখনও পৃথিবী সুস্থ ছিল না, কিন্তু সেই সিদ্ধান্তে আমাদের কোন হাত ছিল না। যেটা আমাদের হাতে আছে আমরা বড়জোর সেটুকু করতে পারি। আমরা না জন্মালেও পৃথিবীর কোন ক্ষতি ছিল না। পৃথিবী তার মত চলত, অথবা চলত না। আরো অজস্র পৃথিবীর মত গ্রহ আছে ব্রহ্মাণ্ডে যাতে প্রাণ নেই। তারাও সুন্দর। অবশ্য চেতনা না থাকলে আর সুন্দরই বা কি! এসব দার্শনিক কথা থাক। নিতান্ত বস্তুতান্ত্রিক ভাবনাতেও দেখতে পাই মানুষজন্ম কেমন একটা অনর্থক ব্যাপার। এত বেশি মানুষ হয়ে গেছে পৃথিবীতে, না আছে পর্যাপ্ত খাবার, না আছে পর্যাপ্ত জমানো সম্পদ। সোজা কথা সোজা ভাবেই বলি। ছোট থেকেই শিখেছি খুব ভালো রেজাল্ট করতে হবে, ভালো চাকরি করতে হবে, তারপর একটা ভালো বিয়ে, সন্তান এবং তাদের প্রতিপালন। এই জিনিসগুলোর একটাও এমন লোভনীয় নয় যে তার জন্য জীবনভোর প্রাণপাত পরিশ্রম করা যায়। যারা পারেন তারা করেন। আমরা আরো একটা মানুষকে তার মতামত ছাড়াই নিয়ে এসে এই বোঝা চাপিয়ে দিতে চাই না। আর মতামত নেওয়ার তো কোন উপায়ই নেই। একটি শিশুকে জন্ম দিয়ে তাকে তো আর সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করা সম্ভব নয়, তুমি কিভাবে বড় হতে চাও জানাও। নিজেদের মত তার ওপর চাপাতেই হবে, এমনকি তার মধ্যে এমন কিছু মতও থাকবে যা নিজেদেরই নীতিবিরুদ্ধ। যেমন ধরা যাক, বন্ধুস্থানীয় ভারতীয় বাবা-মায়েরা যেভাবে গেটেড কমিউনিটিতে বাসা বেঁধে গেটেড স্কুলে পড়শোনা করিয়ে যতখানি সম্ভব নোংরা পৃথিবীর ছোঁয়া বাঁচিয়ে বাচ্চা মানুষ করেন, সেটা আমাদের একান্তই অপছন্দ। একটু সমালোচনাই করলাম। তবে এটাও জানি, নিজেদের বাচ্চা থাকলে আমরাও এই পথই নিতাম। আরেকটি মানুষের জীবন নিয়ে বাজি লড়ার সাহস আমাদেরও হত না। আমরা জানি, আপনারা নিরুপায়।
আমাদের প্রশ্ন হল, এমন হাত-পা বাঁধা অবস্থাতেও কিসের প্রেরণায় মানুষ সন্তানের জন্ম দেয়? হ্যাঁ, এতদিন পর আমাদেরও উল্টে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হচ্ছে। মেয়েদের মা হওয়া, বা না হতে পারলে আক্ষেপ করা এমনই স্বাভাবিক বিষয় যে সন্তানহীনতার জন্য আমিই সব সময় সবার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে এসেছি। এই সামাজিক নির্মাণ এতটাই গভীর যে আমি কখনও কাউকে প্রশ্ন করার কথা ভাবি নি, কেন সন্তান জন্ম দিতেই হবে? আপনি কেন দিয়েছেন? আমরা যখন বলি সন্তান চাই না, তখন অনেকে জিনের কথা বলে। এও এক ধাঁধা। পৃথিবীতে কত শিশুই তো আছে। সকলের বড় হয়ে ওঠার সুস্থ পরিবেশ তো দূরের কথা, পর্যাপ্ত খাবারও নেই, তবু মানুষের নিজেরটিকেই চাই। আমরা জীবনে যা কিছু বিদ্যাবুদ্ধি অর্জন করেছি তা নাকি আমাদের জিনের মাধ্যমে বাহিত হবে, পৃথিবীর কাছে আমাদের ঋণ শোধ হবে এই উপায়ে। মেয়েদের এখন অপেক্ষাকৃত বেশি বয়েসে বিয়ে হয়। সে কারনেই কিনা জানি না, অনেকেরই মা হতে সমস্যা হয় শুনেছি। কাজের জায়গায় স্ট্রেসের জন্য প্রেগন্যান্সি আসতে দেরি হচ্ছে এটাও খুবই শুনি। ভারতেএখন ফার্টিলিটি ক্লিনিকের খুবই রমরমা। অনেক অনেক টাকা খরচ করে সেখানে চিকিৎসা হয় যাতে নিজেদের জিনের ধারাকে বইয়ে দেওয়া যায়। এখানে এসে আমরা হোঁচট খাই। আমরা তো এখনও নিজেদের কাছে এতখানি প্রিয় হয়ে উঠতে পারিনি যে নিজের জিনের অংশ যে কোন মূল্যে পৃথিবীতে না ছড়াতে পারলে চলবেই না। জানি, এ লক্ষ বছরের ইনস্টিঙ্কট। এই প্রবৃত্তি যদি না থাকত তাহলে বিবর্তন হত না, প্রাণ বিলুপ্ত হয়ে যেত। হয়ত মানুষও একদিন বিলুপ্ত হবে এই পথেই। সেজন্যই কি সন্তানহীনতার ওপর এই স্যোসাল প্রেশার? কিছুতেই যাতে আমরা হারিয়ে না যাই? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পোলান্ডে, আজ সিরিয়ায় এইজন্যই কি অগণিত শিশুর জন্ম দিতে বুক কাঁপে না, যে একটা-দুটোও যদি বেঁচে থাকে তারা ছড়িয়ে দেবে তাদের পিতৃপুরুষের জিন? কিন্তু সন্তানের জীবনের মূল্যে নিজের জিনের বিস্তার সুরক্ষিত করা কি একরকম স্বার্থপর ভাবনা নয়? আমরা তো দেখতে পাই, পৃথিবীতে কিভাবে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। যুদ্ধ বাধার সম্ভবনা খুব বেশি। যুদ্ধ না বাধলেও সময় বিক্ষুব্ধ, জীবন নিরাপদ নয়। এই পরিস্থিতিতে আরো নতুন নতুন শিশুরা যখন পৃথিবীতে আসে, তারা তো আসে আমাদের আনন্দের ভান্ডার হয়ে, তাদের ঝলমলে তারুণ্যে আমাদের বার্ধক্য বিলম্বিত হয়, কিন্তু তার বদলে আমরা তাদের কী দিতে পারি? নাকি, সন্তানজন্মের জৈবিক তাড়না এমনই যে এ চিন্তা মানুষের মনেই আসে না? যাঁরা জন্ম দেন তাঁদের আনন্দ হয় বুঝতে পারি, কিন্তু যে জন্মাল তার এতে কী উপকার হয়? সন্তানের দিক থেকে ভাবলে তার জন্মের সিদ্ধান্তটা কি আদৌ কোন র্যাশনাল সিদ্ধান্ত? নাকি জন্ম দেওয়ার পরে নিজের কাছেও একথা স্বীকার করা কঠিন হয়ে পড়ে যে এ সিদ্ধান্ত আসলে র্যাশনাল ছিল না?
একথা স্বীকার করি, আজ যে এত কথা খোলা পাতায় লিখতে পারলাম তা গত কয়েকশো বছরের মেয়েদের অক্লান্ত লড়াইয়ের ফল। এই লড়াইটা জারী রাখার জন্য বংশবিস্তারের প্রয়োজন আছে। আবার মহাকালের নিরিখে দেখলে এই পৃথিবী গ্রহের জীবৎকালও বিন্দুবৎ ঠেকবে। ব্যক্তি মানুষ তো দূরের কথা, পুরো প্রজাতির অবদানও এখানে তুচ্ছাতিতুচ্ছ। আমরা খুব বেশি হলে পরবর্তী দুই প্রজন্ম দেখতে পাই, তার বেশি তো নয়। ক্ষুদ্র মানুষ আমরা। কী করে নিজেদের সন্ততির বিনাশ দেখব! তার চেয়ে ভালো মনে হয় যতটুকু সম্পদ এখনও অবশিষ্ট আছে তাই দিয়ে যারা এসে গেছে তাদের ভরণপোষণ করা। এ পৃথিবী এখন নতুন শিশুর জন্য প্রস্তুত নয়।
dc | unkwn.***.*** | ১৮ মে ২০১৭ ০৫:৫৪82612
dc | unkwn.***.*** | ১৮ মে ২০১৭ ০৬:০৫82613
avi | unkwn.***.*** | ২০ মে ২০১৭ ০২:২৭82615
Atoz | unkwn.***.*** | ২০ মে ২০১৭ ০৯:৩০82616
Du | unkwn.***.*** | ২০ মে ২০১৭ ০৯:৩৯82617
Atoz | unkwn.***.*** | ২০ মে ২০১৭ ১২:১২82614