আজ থেকে বছর পঁচিশ আগেও মফস্বল শহরগুলো অন্যরকম ছিল। তখন সাজগোজ বলতে চোখের তলায় কাজল, হাল্কা লিপস্টিক আর কপালে টিপ। প্রায় সব কিশোরীরই তখনও লম্বা ঢালা চুল থাকত। ভেজা চুলের নিচের দিকে আলগোছে বিনুনী বেঁধে তারা ইশকুলে যেত। মায়ের অত্যাচারে অথবা কারো কারো ক্ষেত্রে নিজের শখেই মুসুরডাল বাটা কি দুধের সরের প্রলেপ পড়ত মুখে মাঝেসাঝে। এর চেয়ে বেশি কেউ করতও না। যারা করার কথা ভাবত তাদের যেন একটু দূরেই সরিয়ে রাখা হত। যে রূপচর্চা করে তার লেখাপড়ায় মন নেই এমন নিদান দেওয়া একেবারেই বিরল ছিল না। আমার জীবনও এভাবেই চলছিল। পরিবারের সদ্য বিয়ে হয়ে আসা যুবতীটির নিখুঁত ভ্রূযুগল দেখে কখনও হয়ত ইচ্ছে জাগত নিজেরটিও অমন হোক। কিন্তু সে ইচ্ছা আর বাস্তবের মাঝে "সাজগোজে মন চলে গেছে, এর আর লেখাপড়া হবে না" জাতীয় মন্তব্যের উঁচু দেওয়াল থাকত। তখন ভাবতাম, শুধু মফস্বলের বাংলা মিডিয়ামেরই বুঝি এমন কপাল পোড়া। কলকাতার কলেজে পড়তে এসে বেশির ভাগ সহপাঠিনীর অসংস্কৃত ভুরু দেখে সে ব্যাথার খানিক উপশম হল। লম্বা বিনুনী, তেলতেলে মুখ, এবড়োখেবড়ো ভুরু আর লোমশ হাত-পা নিয়েই কলেজ জীবন পেরিয়ে গেল। এমনকি প্রেম-ভালোবাসার ক্ষেত্রেও এই অমার্জিত রূপ বিশেষ বাধার সৃষ্টি করেছিল সেরকম খবর নেই।
অবস্থা বদলালো মুম্বইতে এসে। যোগেশ্বরীতে ফাইজারের অফিসে যাচ্ছিলাম মাস্টার্স থিসিসের কো-অ্যাডভাইসারের সাথে দেখা করতে। লেডিস কম্পার্টমেন্টে সাঙ্ঘাতিক ভীড়। কোনমতে একটি ঝুলন্ত হ্যান্ডেলের অংশবিশেষ পাকড়াতে পেরেছি। আমার হাতের পাশে হ্যান্ডেলের ভাগীদার আরো গোটা পাঁচেক হাত। প্রতিটি হাত নির্লোম, মসৃণ। তাদের পাশে আমার হাতটি রোঁয়া ওঠা খসখসে কম্বলের মত বিসদৃশ। খুব ইচ্ছে করে হাতখানা সরিয়ে নিতে। নিজেকে জোরে ধমকাই। চেপে ধরি হ্যান্ডেল। মাথার ভিতরে দুই দৈত্যের লড়াই শুরু হয়। একজন বোঝাতে চায় মানুষের গায়ের লোম কোন অস্বাভাবিক জিনিস না, বরং তার অনুপস্থিতিই কৃত্রিম। অন্যজন ঝগড়া করে, হোক কৃত্রিম, তবু তা সুন্দর। সে যুধিষ্ঠিরের মুখে দ্রৌপদীর রূপবর্ণনার উদাহরণ দেয়। মেয়েদের নির্লোম শরীরের প্রশস্তি কোন নব্যযুগের বৈশিষ্ট্য না, এ হয়ে আসছে চিরকাল। প্রতিপক্ষ পাল্টা যুক্তি সাজায়। সে বলে মহাকালের নিরিখে দুতিনহাজার বছর নেহাতই ছেলেমানুষী। নির্লোম নারী যদি প্রকৃতির বিধান হত, তাহলে বিবর্তনের নিয়মেই তার শরীর থেকে ঝরে যেত সব অতিরিক্ত চুল। যাকে বলে সে নিয়ম বোঝে না। সে জানে নারীর নির্লোম ত্বক আকাঙ্খিত। এই আকাঙ্খাও বিবর্তনের সহকারী নয় কি? কূটতত্ত্বে কাল কাটে। স্টেশন এসে যায়। ঘরে ফিরি।
আমার সেই পুরোনো মফস্বল শহরে প্রথম যখন পা ওয়াক্সিং করাতে চেয়েছিলাম, বিউটি পার্লারের দিদি বলেছিল, পা করাচ্ছো কেন? তুমি কি স্কার্ট পর? জীবন গিয়েছে চলে দেড় দশকের পার। সেই মফস্বলে ফুল বডি ওয়াক্সিং এখন কোন নতুন কথা না। ভ্রূ পরিচর্যা করতে ছাত্রীরা আর ভয় পায় না। কাজল আর লিপস্টিক দিয়েই মেকাপ সারা শুনলে এখন সবাই হাসবে। মেয়েরা নিজের খুশিতে সাজে, নিজের যা ইচ্ছে পরে এসব ভালো ভালো জিনিসের মধ্যে একটা কাঁটা খচখচ করে আমার মনে। মুম্বইয়ের ট্রেনের সেই দুই দৈত্য এখনও একই মাথায় সহাবস্থান করে। একজন বলে, দেখেছ মেয়েটা কেমন পিতৃতন্ত্রের চোখ রাঙানীর তোয়াক্কা না করে রাস্তা দিয়ে হাঁটছে! ওর জামার ঝুল হাঁটুর ওপরে থেমেছে, বাহুমূল অনাবৃত। ওর শরীরের ওপর একা ওরই অধিকার। অন্যজন বিষন্ন হয়। এলোমেলো, বেপরোয়া ভাবের নিচে সযত্ন পরিকল্পনা তার নজর এড়ায় না। এর একান্ত অধিকারের শরীরটা সেজে উঠেছে কার ইচ্ছায়? কার তুষ্টিতে? কার ঠিক করে দেওয়া মাপে? গরম মোমলাগানো কাপড় চেপে ধরে তার ত্বক থেকে যখন অনাকাঙ্খিত চুল উপড়ে ফেলা হয় সেই যন্ত্রণা সে কি হাসিমুখে সয়? সকলেই কি হাসিমুখে সয়?