নতুন কী লিখবো বলুন তো! আমি আপনাকে স্টেজে দেখিনি, আপনার নাকতলার দেড়তলা বাড়ির আড্ডা, দীপক মজুমদারের ‘বিসর্জন’-এ রঘুপতি আপনি, বাউলের আপনি, স্যাক্সোফোনের আপনি- কোনোটাই আমার জানা-চেনা নেই। আপনার বানানো ডকুমেন্টারি, ‘সময়’, ‘নাগমতী’ও দেখিনি।এদিক-ওদিক থেকে কুড়িয়ে পেয়েছি ডিজিটাইজড কয়েকটুকরো মহীন, অ্যালবামের সঙ্গে বেরোনো বই, লাইভ শোয়ের রেকর্ডিং, আর চেনাশোনা লোকজনের কাছ থেকে মহীন-মিথের ভাষ্য, এতেই হাতড়ে হাতড়ে বোঝার চেষ্টা করি। বেসিক্যালি, আপনাকে নিয়ে, আপনাদের নিয়ে একটা লাইন লেখার জন্য আমি কোয়ালিফাই-ই করি না, অনেস্টলি। প্লাস, এগুলো নিয়ে এত এত কথা হয়ে গেছে... তবু, আপনাকেই মুরশিদ মানি, তাই, দু’হাজার সালের বইমেলায় ‘গৌতম’ বেরোনোর পাক্কা তেরো বছর পর আরেকটা বইমেলায়, কয়েকটা প্রশ্ন করি? উত্তর পাওয়ার জন্য নয়, প্রশ্নগুলো নিছক শেয়ার করার জন্যই। আট কুঠুরি নয় দরজার ক্লু তো আর জিগ্যেস করে জানা যায় না, তাই নিজের মতন করে খোঁজার চেষ্টা করি দু’টো কর্ডের মাঝের লুকোনো সুরটাকে?
মহীনের গান-বই-বাউল-জ্যাজ তো মহীন-যাপনের রক্তমাংস, কিন্তু এই বাহিরানাটায় খুঁজলে মহীনকে কতটা পাবো? এখন নাহয় মহীনের আত্মা নেই, তাই ঘোড়া আঁকা টিশার্ট পরে খাঁচা ঢেকে রাখার চেষ্টা, কিন্তু, সেই আত্মাটাকে খুঁজবো কোথায়? গানগুলোকে আমাদের সত্ত্বায় ল্যান্ডমাইনের মতো পুঁতে দেওয়ার, আর বছর কুড়ি পরে বিস্ফোরণটা ঘটানোর কী দায় ছিল মহীনের? কী প্রয়োজন ছিল একটার পর একটা স্টেজ পারফরম্যান্সে অডিয়েন্সের স্নায়ুতন্ত্রের ওপর, গান শোনার অভ্যেসের ওপর গেরিলা আক্রমণের? শুধু গান তো না, দীপক মজুমদার যে বলেছিলেন, “...শ্রমণের ধর্ম শিখতে হবে, গানকে মন্ত্রাচারে পরিণত করতে হবে, গান নিয়ে অনুষঙ্গ সৃষ্টির কাজে শ্রোতাদের জন্য বর্ণপরিচয় ও হাসিখুশি প্রকাশ করতে হবে, দেশের সমস্ত বাউল-বটতলায় গিয়ে শুয়ে থাকতে হবে আকাশের দিকে চোখ ছুঁড়ে, সবসময় চুষতে হবে লোক-ঋদ্ধ জীবনের নাতি-শুকনো স্তন”, কী দরকার? কোন মহাযজ্ঞের মন্ত্রোচ্চারণ?? অতি-পাস্তুরাইজড কৃত্রিম বিশুদ্ধতায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে শেকড়ের সম্মোহনে ছোটা? বাঙালি শ্রোতাকে ঘাড় ধরে ঝাঁকিয়ে দেওয়াটাই উদ্দেশ্য? কোথায় একটা যেন পড়ছিলাম, আপনি নাকি ‘বাংলা গানের চে’! খালি গান!!
মানেবইয়ে আরেকটা উত্তর আছে, ‘মনিদার জীবনীশক্তি’। গীটার-স্যাক্সোফোন-একতারা থেকে স্ট্যান্ড-বুম-ক্যামেরা, লিরিক হোক বা সেকেন্ডে চব্বিশ ফ্রেম, একটার পর একটা ম্যানিফেস্টো সৃষ্টি করেছেন নাকি খালি ‘জীবনীশক্তি’র তাড়নায়, শুধু সৃষ্টিসুখের উল্লাসে! স্বাভাবিক, কারণ মহীন তো এখন মেইনস্ট্রীম, ‘ভদ্রলোকের কৃষ্টি’। আপনার খোলসটুকুকে সাজিয়ে গুছিয়ে ‘আর চিহ্নওলা মহীন’ বলে প্যাকেজ করে সেফলি গায়ে গলিয়ে নেওয়া যায়, চে আঁকা টিশার্টের মতন। গোটা গৌতমটাকে বিশুদ্ধ স্বতঃস্ফূর্ততা আর জীবনীশক্তিতে রিডিউস না করা অবধি তো বিপজ্জনক, হ্যান্ডেল উইথ কেয়ার!
ভাবছেন ওভারস্টেপ করছি? বিশ্বাস করুন, আপনি আমার কাছে ঠিক এতটাই তীব্র! নিরানব্বইয়ের বিশে জুনের ঠিক পাঁচ বছর পরের জুনে আমার কলকাতায় আসা, মহীন শুনতে শেখা। মহীনে গা ভাসানো, সত্যি বলতে, বন্ধুদের দেখাদেখিই, হিস্টিরিয়ার চোটে। সাঁতারটা শিখে উঠতে পারিনি (এখনো), কাজেই মাধ্যাকর্ষণ ক্ষমা করেনি। কখন যে বেহুঁশ হয়ে পড়েছি, বেলোয়ারি স্বপ্নের মতো নীল দেওয়াল...মেরুন সন্ধ্যালোক মুড়ি দেওয়া একলা রানওয়ে... মাছের কাঁটার শিল্যুয়েট ভেঙ্গে নেমে আসছে অ-উ-ব... অলৌকিক সাততলা বাড়ি... পলাশের রঙ আর কোকিলের ডাক মেখে পাশ ফিরছি বিছানায়... ঘুম ভাঙ্গে দু’হাজার সাতের নভেম্বর-ডিসেম্বর নাগাদ,বাঘাযতীনের একতা হাইটসের পেছনে একটা মাঠে। তার কটা দিন পরেই নিক্কোপার্কে ‘আবার বছর তিরিশ পরে’ নাম দিয়ে যে কনসার্টটা হবে, তারই একটা ওয়ার্ম আপ গোছের প্রোগ্রামে মহীনের এক ঘোড়া গানের ব্যাকগ্রাউন্ডের গল্পগুলো বলছিলেন। ‘বিনীতা কেমন আছো’ নাকি সত্যিই পার্ট টু পরীক্ষার আগে লেখা, ইন্টারেস্টিং! তারপর, ‘কথা দিয়া বন্ধু ফিরা না আইলা’ নাকি... শেষ পথটুকু পেরোতে না পারা দিনবদলের স্বপ্নটার জন্য! সেই স্বপ্নটা, এখন অনেকের কাছেই মরীচিকা ঠেকে, যেটার জন্য বছরখানেক বোধয় জেলেও থাকতে হয়েছিল আপনাকে, না? তারপর, ডিসইলিউশনড? যাঁরা বলছেন ‘এ বিশ্বরূপ দেখে/ চুপ করে থাকি যদি/ আমি নেহাতই বেহায়া’, তাঁরা ডিসইলিউশনড?? বরং নিজেদের আরো আরো বেপরোয়া একেকটা মলোটভ ককটেল করে তুলতে চেয়েছিলেন বলেই বোধয় খোলাবাজারের হাওয়ার ঝাপটার প্রতিরোধ গড়ে পৃথিবীটা সাজাবার স্বপ্ন দেখছিলেন, আরো অনেক ‘বোকা’দের সঙ্গে।
অনেক মহীনবেত্তা এক্ষুনি হাঁ হাঁ করে উঠবেন। মহীন নাকি মোটেই এরম নয়, একেবারেই অরাজনৈতিক-বিশুদ্ধ ভালোলাগার গান! প্লাস অ-গৌতম গানগুলো গৌতমের কাঁধে চাপিয়ে দিচ্ছি বেমালুম! হাঁ, দিচ্ছি। এটা একান্তভাবেই আমার মহীন, এবং এটাই আমার মহীন। আমার মহীনকে ডানদিক-বাঁদিকের বিচ্যুতি থেকে খাবলে সরিয়ে নিরাসক্ত মধ্যিখানে রাখতে হলে মহীনের পরাণটাকে জলাঞ্জলি দিতে হবে। নিষ্ঠাবান বিশুদ্ধতাবাদীরা ইতিহাসবিচ্যুতি ভাবতে পারেন, ডাঁহা গুল ভাবতে পারেন, স্বাধীনতা তো আছেই, থাকুন ইচ্ছে হলে কিম্বা ফেটে যান! মহাকালকে ধন্যবাদ, আমি এমন একটা সময়ে জন্মাইনি যখন আরেক পরত পুরনো বিশুদ্ধতাবাদীরা যোগেশ মাইম বা রবীন্দ্রসদনে মহীন শুনে (র্যা দার, দেখে) ‘রোলার স্কেট পরে, শীর্ষাসন করে এসব কি গান হচ্ছে নাকি জাম্বো সার্কাস!’ বলে চেঁচামেচি করতেন! আপাতত, এই মহীনে নাড়া বেঁধে ফেলেছি, ‘অনেক মানুষ নিয়ে সাথে/ সুখী দিনের ইশারাতে’ পথ চলা জারি রইল।
লেখাটি গুরুচন্ডালি প্রকাশিত 'অনন্য মহীন ১' সংকলন থেকে গৃহীত।