তাহলে, শিকার শুরু হয়ে যাক
আরে না,না। কোনও যুদ্ধ বিগ্রহের কথা হচ্ছে না! স্রেফ আর একটা চিৎকৃত বিজ্ঞাপন। দেখেছেন হয়তো যে ক’দিন ধরে ‘বহুল প্রচারিত’ দৈনিকগুলোর মুখ ডেকে রেখেছে। কী বেচতে চাইছে বলুন তো? ঠিক ধরেছেন। এস ইউ ভি। আধুনিকতার প্রতীক। কী হল? ‘শিকার’ শব্দটা খচ খচ করছে? দ্যাখো কান্ড! ওটা তো এখন ‘ফূর্তি’র প্রতিশব্দ। শিকার মানেই বেজায় ফূর্তি নয় কি? আচ্ছা নিন, এই আরেকটা দেখুন। “ক্ষমতা মেশে আয়েশ-এ এসে”। আরেকটা এসইউভি। কুল না? আরে, ক্ষমতা তে যদি আয়েশই না হল তাহলে আর ফূর্তি কোথায়? কিম্বা ঝাঁ চকচকে রাস্তা দিয়ে উড়তে উড়তে আয়েশের ক্ষমতাটাই না টের পেলেন?
রাস্তা। উন্নয়নের অনিঃশেষ তৃষ্ণা নিয়ে যে সমালোচকরা দিন রাত্তির খিটখিট করেই যাচ্ছেন তাঁদের মুখের মতো জবাব। প্রগতির জন্য আপনার উদ্বেগেরও। এই রাস্তাটি গেছে দূর্গাপুর শিল্পনগরী থেকে কৃষিভিত্তিক বাঁকুড়া জেলা পর্যন্ত, দু-পাশের চোখ জুড়োনো মাঠ-ঘাটের মধ্যে দিয়ে এঁকে বেঁকে, প্রগতি পরিবহন করে। হ্যাঁ, উন্নয়ন কিন্তু সত্যিই চুঁইয়ে পড়ছে। নৃপেন রুইদাস কে আর হীনম্মন্যতায় ভুগতে হয় না “চাষার ব্যাটা চাষাই” হয়েছে বলে। রাস্তাটা হয়ে যাওয়ায় তার গ্রাম প্রতাপপুর থেকে সাইকেল চালিয়েই দূর্গাপুরের স্পঞ্জ আয়রন কারখানায় যাচ্ছে। সে আর ‘পিছিয়ে পড়া কৃষক’ নেই কিন্তু। রীতিমত একজন সর্বহারা যে দিন-রাত্তির যেকোনও সময়ে কারখানায় যেকোনও শিফটে কাজে যোগ দেওয়ার জন্য সাইকেল নিয়ে রওনা দিচ্ছে। আর এই একই রাস্তায় এসইউভিরাও শিকারে বেরোচ্ছে।
এই রাস্তার ওপরেই ক্ষমতা আয়েশে এসে মেশার সময় একটা এসইউভি নৃপেন রুইদাসকে শিকার করলো। তার বাঁ পাটা হাঁটুর তলা থেকে আক্ষরিক অর্থেই চুরমার হয়ে গেল। এমন ভাবে যে তাকে তুলে দূর্গাপুরের সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় চামড়া আর মাংসের টুকরোগুলোকে রাস্তাতেই ফেলে আসতে হলো। এমার্জেন্সির ডাক্তারবাবুরও এরকম হুশহুশ করে রক্ত পড়ে যাওয়া রুগী আর তার মারমুখো সঙ্গীসাথীদের দেখে হাত পা ঠান্ডা হওয়ার যোগাড়। তবু মোটামুটি সাহস সঞ্চয় করে ব্যাখ্যা করলেন যে, রুগীকে বাঁচাতে হলে ছিঁড়ে যাওয়া রক্তনালিকাগুলোকে এক্ষুণি বেঁধে দিতে হবে আর তার ফলে ওই পা’য়ে রক্তচলাচল বন্ধ হবে। এমনিতেও পায়ের যা অবস্থা তাতে ওটা সারানোর কোন উপায় নেই। তাই যাই করা হোক না কেন, ওই পা বাদ না দিয়ে উপায় নেই। তবে অঙ্গচ্ছেদ খুব একটা সুখকর প্রস্তাব তো নয়, তাই রুগীর বন্ধুরা আরও ক্রোধান্বিত হলো। কিন্তু সৌভাগ্যের বিষয়, তাদের কেবল ক্রোধটাই ছিলো না, আধুনিকতা নিয়ে কাঙ্খিত সচেতনতাও ছিলো। উন্নয়ন আর প্রগতির প্যাকেজের মধ্যেই আধুনিক চিকিৎসা এবং ‘সুপার স্পেশালিটি’ হাসপাতাল সম্পর্কে এই ‘সচেতনতা’ চুঁইয়ে আসে। নৃপেন রুইদাস আর তার বন্ধুরাও তার প্রসাদ থেকে বঞ্চিত নয়। কাজেই অযথা সময় নষ্ট না করেই ওখানে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালগুলোর মধ্যে একটার কাচের দরজা ঠেলে তারা ঢুকে পড়লো।
একদম সঠিক সিদ্ধান্ত। কর্পোরেট হাসপাতালের সামনের ডেস্কে বসে থাকা সপ্রতিভ মহিলা আশ্বস্ত করলেন। ওই হাসপাতালেই তো রয়েছেন সেরা ভাস্কুলার সার্জেন। সেটা কী বস্তু? সার্জেন নিজেই ব্যাখ্যা করলেন। তিনি ইউএস থেকে ডিগ্রী এনেছেন, ছেঁড়া রক্তনালিকা জোড়ার ট্রেনিং নিয়েছেন সিঙ্গাপুরে। মিঃ রুইদাস প্রতাপপুর থেকে আসতে পারেন, কিন্তু বন্ধু, এটা তো বিশ্বায়িত গ্রাম। ওনাকে একটা সুযোগ তো দিন। হ্যাঁ, ব্যাপারটা শুধু একটা চেষ্টা করে দেখা। সে চেষ্টাতে ওনার পা ঠিক হতে পারে, নাও পারে। আর... ইয়ে... মানে এতে কিছু খরচাও হবে। কিন্তু তা বলে তো আর তাকে সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা যায় না। তা সে সুযোগে ভাল হওয়ার সম্ভাবনা যত ক্ষীণই হোক না কেন!
নৃপেন রুইদাস সুযোগ পেলো। কিছু খরচাও হল। এই পাঁচ লাখের মতো। সপ্তাহখানেক পর আরও কিছু দিতে হলো। মানুষে তো আর তাত্ত্বিক সম্ভাবনায় ভর করে হাঁটে না। তাই আট দিনের মাথায় তার পা কেটে বাদ দিতে হল। সেটার জন্য আরও পঞ্চাশ হাজার পড়লো।
না, তারা কোনও নালিশ করেনি। আফশোষও করেনি। শত হলেও, তারা তো নৃপেনকে বাঁচাতেই চেষ্টা করেছিলো। কপালে নেই তো কি করা যাবে। আর কপাল তো টাকা দিয়ে কিনতে পাবেন না। তাই না?
এই জন্যেই শিকার এত মিষ্টি। এততো মজার। শিকার সর্বত্র আদৃত। এসইউভি’র নতুন নতুন ল্যান্ডস্কেপের খোঁজে, বিনিয়োগের নতুন নতুন চারণভূমি’র খোঁজে। স্পঞ্জ আয়রন কারখানাতেও, আবার কর্পোরেট হাসপাতালেও। শিকারীর কাছেও, শিকারের কাছেও।
হ্যাপি হান্টিং!
অনুবাদঃ সোমেন বসু