নবারুণ ভট্টাচার্যের লেখার সঙ্গে সহবাস আমার কাছে সাধারণত খুব স্বস্তিদায়ক হয় না। ঠিক যেরকম চ্যাপলিনের ছবি দেখাটা – মানে ঐ মজা, হাসি, ব্যঙ্গ, কৌতুক, খিস্তি খাস্তার আড়ালে থাকা যে বাস্তবের চাবুকটা আছড়ান এঁরা, সেটার শব্দ যাঁরা শুনতে পান… তাদের পক্ষে এই পাঠগুলো খুব সহজ হয় কিনা জানিনা… কিন্তু আমার অস্বস্তি হয়। তারপরে অনেকক্ষণ বা অনেকদিন নানা ভাবে এই আখ্যানগুলোর চরিত্ররা তাদের নানা ঘটনা নিয়ে ঘুরে ফিরে যাতায়াত করে মগজে, মনে… অস্বস্তি হয়।
তবু অপেক্ষায় থাকি… মানে থাকতাম – নতুন কি লিখলেন তিনি তার অপেক্ষায়। আমার প্রথম পরিচয় নবারুণের সঙ্গে ‘হারবার্ট’ এর মাধ্যমে। তখন তুলনামূলক সাহিত্যে পোষ্ট গ্র্যাজুয়েট করছি, আর করছি চুটিয়ে প্রেম। তা সেই প্রেমিক বন্ধু উপহার দিল ‘হার্বাট’। এমনি এমনি। তখন হার্বাট বলতে কবি হার্বাটকেই বুঝতাম। ফলে ‘হার্বাট’ দেখে ঐ কবির জীবনী বা সেই গোছের কিছু একটা ভেবেছিলাম। তারপর পড়তে শুরু করলাম। ওদিকে আবার তখন নানা তত্ত্ব পড়ছি ক্লাসে। ফলে জেনেছি যে প্রতিটি পাঠই নতুন এবং আলাদা। ‘হার্বাট’ একবার পড়ে বুঝলাম আবার পড়তে হবে। সাধারণত আমি এক নিঃশ্বাসে বা গোগ্রাসে বই পড়া পাঠক। শেষ না হওয়া অবধি মনে হয় এই বুঝি কেউ নিয়ে নেবে এক্ষুনি…আর পাবো না পড়তে। তো যাই হোক ‘হার্বাট’ নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। মানে অনেকেই অনেক কিছু বলেছেন। যেরকম মহাশ্বতা দেবীর একটা সাক্ষাৎকার থেকে সম্প্রতি জানলাম যে ওনার মতে ‘অরণ্যের অধিকার’ আর ‘হাজার চুরাশির মা’ নিয়ে বলে বলে লোকে ‘হেজিয়ে’ দিয়েছে… ‘হার্বাট’ নিয়ে আমার অভিজ্ঞতাও কিছুটা সেরকম। পুরোটা খাটে কি না জানিনা। তবে আমার পড়া লেখাগুলোর মধ্যে ‘হার্বাট’ চর্চা আর ফ্যাতাড়ু চর্চাই বেশি রয়েছে। তবু, যেহেতু প্রথম পরিচয় ‘হার্বাট’ এর মাধ্যমেই তাই সেটার উল্লেখ করতেই হোল।
‘হার্বাট’ এর পরে, একে একে ‘নবারুণ ভট্টাচার্যের ছোট গল্প’, ‘অন্ধবেড়াল ও অন্যান্য গল্প’ ‘প্রেম ও পাগল’, ‘কাঙাল মালসাট’, ‘খেলনা নগর’ ‘ফ্যাতাড়ুর বোম্বাচাক ও অন্যান্য’ ইত্যাদি (ঠিক এই ক্রমেই পড়েছি তা নয়, যেমন মনে এল, তেমন লিখলাম) পড়েছি নানা সময়ে। খুব যে নিজেকে একাত্ম করতে পেরেছি নবারুণ সৃষ্ট নারী চরিত্রের সঙ্গে তা নয়। সেটাও খুবই স্বাভাবিক। একে বেশ্যা তায় মাথাবিহীন (‘মাথা নেই তো হয়েছে কি’), অথবা নাইলন শাড়ি পড়া উড়ুক্কু ‘সোনাগাছি, গরাণহাটা ভাল্লুকপাড়ার মাগের পাল’ বা ‘হিজড়ে ফ্যাতাড়ু’ (‘ফ্যাতাড়ু’) বা সেই ‘খানকি মাগী, নিয়নসুন্দরী ফিল্মস্টার যে কিনা ‘বন্ধু’ গজল সম্রাটের হোটেলে রাতের বেলায় আসে দেখা করতে (‘হাওয়া হাওয়া’) অথবা গরীবের বউ মালতী বা ল্যাংড়ার মা মোতি (‘শেষ রাত’) এদের কারোর সঙ্গেই শ্রেণীগত, চরিত্রগত বা মনোগত মিল আমি খুঁজে পাবো না সেকথা বোঝার জন্য খুব একটা গবেষণা করার প্রয়োজন পড়ে না। এদের জগতে আমি বাইরের লোক (‘বহিরাগত’ শব্দটাও কিন্তু বড্ড হেজিয়ে গেছে আজকাল)। আমি সমাজের প্রান্তিক শ্রেণীতে পড়িনা। অতএব যে কথক তাঁর আখ্যানে প্রান্তিক মানুষের কথা বলেছেন এক নির্লিপ্ত উদাসীন ভঙ্গিতে, তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর, ‘প্রতিশোধ’ নেওয়ার কথা অবলীলায় বর্ণনা করেছেন, সেই কথকের বয়ানে উল্লিখিত নারী চরিত্রের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করে দেখার কোন কথাই নয় আমার। একাত্ম হতেই হবে এমনটাও নয় অবিশ্যি তবু ভাবলাম একবার ফিরে দেখা যেতে পারে মধ্যবিত্ত বা উচ্চ এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত, তথাকথিত আধুনিক নারীরা কিভাবে এসেছে নবারুণের লেখায়? অবশ্যই তাঁর আখ্যান গুলোতে বেশ্যা আর ফিলম্স্টার (যে কিনা আবার খানকি মাগীও বটে) এবং ল্যাংড়ার মায়ের সঙ্গে সঙ্গে মাঝে মধ্যে কখনো সখনো মধ্যবিত্ত বা উচ্চ এবং নিম্নমধ্যবিত্ত নারীদের দেখাও পেয়ে যাই বইকি। তারা কেমন? আমি দেখি যে তারা বড্ড ছকে বাঁধা। মানে যার যেখানে থাকার কথা বা পিতৃতান্ত্রিক সমাজে এই শ্রেণীর নারীদের যে নির্দিষ্ট ছক কাটা রয়েছে, সেই খোপের মধ্যেই রয়েছে তারা। আর ‘আধুনিক’ বা ‘ফেমিনিস্ট’ শব্দগুলোর আড়ালে অনেকেই যেমন এর আওতায় পড়া সব্বাইকে এক করে ফেলা, কিছু বিশেষ (ইতিবাচক নয় অবশ্যই) বৈশিষ্ট্য বোঝাতে একটা বাঁকা হাসি আর ত্যারছা দৃষ্টি মিশিয়ে দেন তির্যক ব্যঙ্গমূলক সুরে, তেমন সুরটাই কানে এসে লাগে খট্ করে! ছকে বাঁধা কিছু চরিত্রর দিকে প্রথমে তাকানো যাক।
‘টয়’ গল্পে টয়ের মা মিমি। গৃহবধূ। ছেলের রুটিন এদিক ওদিক হতে দেয় না। স্বামীর সঙ্গে তারকোভস্কির ‘নস্টালজিয়া’ দেখতে যায় এবং মিথিল যখন বিদেশী পত্রিকাতে প্রকাশিত ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের কয়েকজন হত্যাপরাধী শিশুকে নিয়ে একটি প্রবন্ধে জনৈক ফরাসি মনস্তত্ত্ববিদের বলা ‘যে রকম ঠান্ডা মাথায়, নির্লিপ্ত ভাবে এরা নিজেদের অপরাধের বর্ণনা দিয়েছে তাতে মনে হয় যে এর মধ্যে কোথাও একটা বিজ্ঞান মনস্কতার ব্যাপারও রয়েছে’ - সে কথা জানতে পেরে সেটা মিমিকে পড়ায়, তখন সেটা পড়ে ছেলে নির্লিপ্ত ভাবে গরম হিটার অ্যাকোয়ারিয়ামে ঢুকিয়ে মাছেদের হত্যা করায় তাদের যে দুশ্চিন্তা তার থেকেও মুক্তি পায়। অতএব সে, উচ্চশিক্ষিত, আধুনিক মনস্ক, বুদ্ধিমান, স্বামী ছেলে নিয়ে সুখে সংসার করা এক মধ্যবিত্ত গৃহবধূ। মিথিল আর মিমি শিক্ষিত শহুরে আধুনিক মধ্যবিত্ত এক দম্পতি। তাঁরা ছেলেকে সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে নিয়ে যেতে দ্বিধা করে না আবার ছেলের নিষ্ঠুরতার মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতার পরিচয় পেয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে যায়। কে না জানে, বিজ্ঞানীরাই বের করেছেন অ্যাটম বোমা, গ্যাস চেম্বার! এবং কে না জানে তাদের নিরীহ, বিজ্ঞানমনস্ক কৌতূহল আর পরীক্ষার বলি হয় কত শত সাধারণ নিরপরাধ ‘মাছে’রা!!! এই মধ্যবিত্ত স্বামীটিও কিন্তু তার জন্য নির্দিষ্ট ছক এর মধ্যেই রয়ে যায় তার স্ত্রী এর মতনই। ফলে এখানে মিথিল এবং মিমি যার যার নির্দিষ্ট ছকেই রয়ে যায়। হ্যাঁ মিথিল এবং মিমি দুজনেই। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে লিঙ্গ নির্মানের দায় নারী পুরুষ উভয়কেই যে নিতে হয়! যে মুহুর্তে মেয়েদের জন্য তৈরী হয় ‘কাঁদুনে’ খোপ সেই মুহুর্তেই যে ছেলেদের জন্য গড়ে ওঠে ‘বয়জ ডোন্ট ক্রাই’ এর অমোঘ নির্দেশিকা! তাই মিমি যে মুহুর্তে ‘আদর্শ’ স্ত্রী এবং মায়ের ভূমিকায় দেখা দেয়, মিথিলকে দেখি ‘আদর্শ’ স্বামী এবং বাবার ভূমিকায়! এমনটাই মনে হতে থাকে আমার! এই গল্পে কথক অন্তত চাননি কোন একজন ছকের বাইরে যাক বা থাক! এরা যেমন ঠিক তেমন ভাবে উপস্থাপিত করতে চেয়েই নিজের মূল বক্তব্য পেশ করেন তিনি!
মিথিল-মিমির কথা আবার পাই ‘প্রেম ও পাগল’ সংকলনে। এই সংকলনটিকে কেন্দ্র করেই পাঠের চেষ্টা করা যাক এক বিশেষ শ্রেণীর নারী চরিত্রদের। অতএব এই বইতে বেবি কে অথবা মাথা বিহীন বেশ্যা বা সোনাগাছির উড়ন্ত ফ্যাতাড়ুদের দেখা পেলেও, তারা এই পাঠের কেন্দ্রবিন্দু নয়। এই সংকলনে দেখা পাই তথাকথিত ‘কালচার্ড’ নয়, আবার বেশ্যাও নয় বা বস্তিবাসীও নয়, এমন এক দম্পতির - ‘মধুমুনের ভূতুড়ে আলো’ গল্পটিতে। ‘দুটি পরিবারই কাপড়ের দোকানের দৌলতে টেকসই হয়ে উঠেছে।’ ফলে তাদের বিয়ের পরবর্তী করণীয় তালিকায় হানিমুনের কোন জায়গা ছিল না। তীর্থনাথ এমনকি পাড়ার বাইরেও বেশি যায় না খুব একটা। কিন্তু বন্ধুরা চেপে ধরল! অতএব তীর্থনাথ ও ভবানী এক শুক্রবার সকালে রওনা দিল দীঘার বাস ধরতে এসপ্ল্যানেড। হাতে ছোটো সুটকেস আর টয়লেট বক্স। ভবানীকে দেখি এই প্রথম। তার ‘শাড়িটি মেরুন রঙের আমেরিকান জর্জেট। নিজস্ব ভ্যানিটি বাদেও তার সঙ্গে ছিল একটি পলিব্যাগে আপেল, সন্দেশ, নাড়ু ও মাসকা-চাসকা বিস্কুট এবং ডোনাল্ড ডাকের ছবি আঁকা একটি ওয়াটার বটল’। বোঝাই যায় যে ভবানী আর যাই হোক ‘কালচার্ড’ নয়। তারা ছাড়াও বাসে ছিল আরো দুটি নবদম্পতি। এক অসাধারণ বর্ণনায় আম বাঙালির হাতের কাছের ভ্রমণ পীঠস্থান দীঘার ছবি এঁকেছেন এরপর কথক। আর তারই মধ্যে যে কোনদিন বেরোয় না প্রায় পাড়া থেকে সেই ঘরকুনো তীর্থনাথ ‘তার নতুন বউকে নিয়ে আধভেজা ও নার্ভাস অবস্থায় মিষ্টি একটি ছেলেকে পেল যার মুখে পান, মাথায় ছাতা ও হাতে সুপার লাক্সারি সরকার হোটেলের কার্ড’। তো সেই হোটেলের ওপর তলার দুই নম্বর ঘরে যেতে যেতে নবীন বাঙালির স্বভাববশত আড়চোখে তাকিয়ে এক নম্বর ঘরে দেখা যায় যে মহিলাকে তিনি সায়া ব্লাউজ পরা সদ্যস্নাতা বয়স্কা এক আঁটো সাটো মহিলা যিনি ‘ঝটকা দিয়ে দিয়ে জলরেণু উড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিলেন।’ আর ছিল ঘরের ডিফিউস্ড্ আলোয় ছোট টেবিলে পেটমোটা একটি রামের বোতল এবং এক খেঁকুড়ে টাইপের একটা বুড়ো। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে নতুন বউকে জিজ্ঞাসা করে নতুন বর ‘তুমি কিস্ খেতে জানো?’ তারপরেই ‘শেষ কথাটি জ্বালবে এবার / তোমার বাতি আমার বাতি’ ! অতএব ‘মটকা গরম করে দেওয়া’ আবহাওয়ায় জমে গেল হানিমুন। সন্ধ্যেবেলা বন্ধ ছিল এক নম্বর ঘরের দরজা। কিন্তু তবু স্কাইলাইট ও পর্দাটানা কাচে দেখা গেল নীল আলো। তার আগে আসে আবার দুটি পংক্তি ‘অন্ধকারের মাঝে আমায় ধরেছ দুই হাতে। / কখন তুমি এলে হে নাথ, মৃদু চরণপাতে?’ রাতে খেতে বসে আবিস্কৃত হয় যে খেঁকুড়ে টাইপের বুড়োটি আদপেই খেঁকুড়ে নয় কারণ প্রথমত তার ভাষা ‘আরে ইয়াং ম্যান, তিনটে ডিম নো প্রবলেম।’ দ্বিতীয়ত তার আদব কায়দা। ছুরি-কাঁটা সহযোগে চিকেন কারি ও ভাত ঐরকম পটুতার সঙ্গে খাওয়া যে কেউ পারে না। মহিলা কিন্তু হাত দিয়েই খায়। আবার স্বাভাবিক নিয়মেই ভবানী এবং সেই মহিলার হাসি ও কথা বিনিময় হয়। যার ফলে তীর্থনাথ জানতে পারে যে সে অবাক হয়ে এবং অস্বস্তি সহকারে যার নিপুণ দক্ষতায় ছুরি দিয়ে চিকেনের পায়ের হাড় এবং বুকের হাড় থেকে মাংস ছাড়িয়ে কাঁটা দিয়ে মুখে পোরা দেখছিল, সেই বুড়ো আসলে কাঁটাপুকুর মর্গের ডাক্তার! তীর্থনাথ এবং বুড়োর চরিত্রের তুলনায় ভবানী এবং সেই বয়স্কা মহিলার চরিত্র অনেকটাই ‘সাপোর্টিং অ্যাক্টরের’। তীর্থনাথের কাপড়ের দোকান এবং সেই আপাত খেঁকুরে কিন্তু আদতে কাঁটাপুকুর মর্গের ডাক্তার হওয়ার সুবাদে তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং ব্যবহার প্রভাবিত হয় তাদের কাজের ধরণ থেকে! কিন্তু দুজনের স্ত্রীর ক্ষেত্রে এই আলাদা কাজের কোন প্রভাব পড়ে কি? আলাদা পটভূমিকা থেকে এলেও তারা দুজনেই হাত দিয়েই ভাত খায়, হেসে মৌরী বিনিময় করে খাওয়ার শেষে। এবং যৌনতা বিষয়ে হয়ত বা বয়সের কারণেই বয়স্ক আঁটো মহিলা পাত্তাও দেয় না আড়চোখে তাকিয়ে দেখা, ঘরের পাশ দিয়ে যাওয়া তীর্থনাথদের। সে সায়া ব্লাউজ পরে বিন্দুমাত্র অস্বস্তি বোধ করে না। আবার ভবানীও প্রাথমিক ‘আড়’ ভেঙ্গে যাওয়ার পরে তীর্থনাথের দীঘায় থাকতে কেন বা কী ভাল লাগছে জানতে চাওয়ার ন্যাকা প্রশ্নে ঝামটা দিয়ে জানায় ‘নিজে যেন জানে না।’ যৌনতা বিষয়ে ন্যাকা সংকোচ না থাকার ক্ষেত্রেও এই দুই মহিলার মিল পাওয়া যায় কোথাও একটা। ঐ ‘যেমনটা’ হয় তেমনটাই আর কি!
ছকে থাকা ভালো স্ত্রী রা যথাযথ পালন করে তাদের ভূমিকা। ‘এক টুকরো নাইলনের দড়ি’ গল্পে পাই অফিসের স্ট্রোক হওয়া সহকর্মীর জন্য হাসপাতালে রাত জাগতে আসা কথকের বউ লিলি ফ্লাস্কে যত্ন করে কফি ভরে দেয়। বাজারে মর্জিনা বলে একটি মেয়ের কাছ থেকে নিয়মিত ডিম কেনে বলে লিলি তাকে নিয়ে স্বামীকে খেপায়ও। বোঝাই যায় দুজনের সুখী দাম্পত্য। কথক রাত জাগে হাসপাতালে আর ভাবে লিলি রাতে মেয়েকে নিয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন আছে! কিন্তু মিথিল যেমন মিমির সঙ্গে তারকোভস্কি দেখে বা বিদেশী পত্রিকার প্রবন্ধ পড়তে পারে, এই গল্পের কথক কিন্তু হাসপাতালে দেখা হওয়া মানুষটির কাছে সেই বিশেষ ‘দড়ির’ অর্থাৎ গলায় দড়ি দিয়ে মরা কোন মানুষের মরার পরে, সেই দড়ির টুকরো সঙ্গে রাখলে ভাগ্য ফেরে… সেই গল্পটা কিন্তু লিলিকে বলি বলি করেও বলে উঠতে পারে না! ঠিক যেমন লিলিও হাসপাতালে রাত জাগতে আসেনা মেয়েকে রেখে স্বামীর সঙ্গে! এর সব কটিই খুব ‘স্বাভাবিক’ ঘটনা। এমনটাই তো দেখা যায় আমাদের আশেপাশের ‘নর্মাল’ স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে!
২০০৭ এ ‘প্রেম ও পাগল’ বইয়ের মুখবন্ধে নবারুণ লিখেছেন ‘... নানা মেজাজ, ভিন্ন ভিন্ন ধরতাই-এর গল্প এর মধ্যে রয়েছে। কী নেকনজরে আমি আজকাল কান্ড-কারখানা দেখছি, আমার মন ও ক্ষমতা কী কী ব্যাপারের মধ্যে গল্পের ‘শর্ট-সার্কিট’ খুঁজছে - সমঝদার পাঠক ধরতে পারবেন’। ‘প্রেম ও পাগল’ গল্পটির শুরুতেই কথক জানিয়ে দেন যে ‘আমরা অর্থাৎ বড়লোকের বাড়ির ছেলেদের একটা নিজস্ব জীবনছন্দ রয়েছে। মেয়েদেরও হয়তো তাই কিন্তু এই গা ছমছম করা গল্পে যে বা একটিমাত্র মেয়ে আসবে সে কেমন ঘরের মেয়ে তা আমরা বুঝতে পারিনি। এমনও হতে পারে যে, সে এই জগতেরই কোনও মেয়ে নয়। শীতকালে হয়তো কুয়াশার ’সঙ্গে ধোঁয়া ও কুহক মিলমিশ করে এরকম মারাত্মক মেয়েদের বানায়।’
এখানে একটা অকপট স্বীকারোক্তি করেন কথক। কোন ঘরের মেয়ে সেটা না বুঝলে মেয়েরা ‘মারাত্মক’ হয়ে ওঠে বইকি। তাকে ঠিক কোন ছকেই ফেলা যায় না যে! অর্থাৎ সে কিভাবে ‘আদর্শ’ ভালো মেয়ে উঠতে পারে অথবা কোন কোন ‘এরিয়া’ তার গণ্ডীর বাইরে পড়ে, এগুলো না জানলে, তার জন্য নির্দিষ্ট খোপের চেহারা বুঝতে না পারলে কোনটা তার পক্ষে ‘স্বাভাবিক’ আর কোনটা ‘স্পর্ধা’ কিভাবে স্থির হবে? সব গুলিয়ে যাবে যে! গুলিয়েও যায় মল্লিকাকার। সুমিতেশের মল্লিকাকা পাগল হয়ে যায়। আর তাকে নাকি পাগল করে দেয় এই ‘মারাত্মক’ মেয়ের প্রেম। মল্লিকাকার প্রথম প্রেম খাঁচায় পোরা বিভিন্ন জাতের পাখিদের ছেড়ে দিলে তবেই তাকে বিয়ে করবে এমন শর্ত দেয় সে। চারটে ছোট বদ্রিকা পাখি বাকি থাকে। আর এই পুরোটা তোলা থাকে ভিডিও ক্যামেরায়...শব্দহীন কিন্তু সুমিতেশ ‘লিপ রিড’ করে সব বলে দেয়। চারটে বদ্রিকা ছেড়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা ‘ওড়ার অভিজ্ঞতার অভাবে জড়াজড়ি করে পালক উড়িয়ে নিচের দিকে পড়ে’ যায় আর তৎক্ষণাৎ শিকার হয় পাখিজাতীয় কুৎসিত কিছু হিংস্র প্রাণীর যারা ছিঁড়ে খুঁড়ে রক্তাক্ত করে খেতে থাকে বদ্রিকাদের। যাদের নাম পরে সুমিতেশ বলে আরকিওপটেরিক্স অ্যাপোটরনিস্, প্যালিওকারসনিস,... টেরোড্যাকটিল’। মেয়েটি নিচে নামার সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায় আর শূন্য খাঁচার পাশে বসা থাকে মল্লিকাকা। এখানেই ফিলম্ শেষ হয়ে যায়। যদিও কথক এই ‘মারাত্মক’ মেয়েটি কোন ঘরের বুঝতে পারেননি, কিন্তু তার পোশাক দেখি ‘থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট, বড় বোতাম লাগানো হাত-ফোলা শার্ট ও সানগ্লাস পরা’ এবং সে মল্লিকাকাকে ‘মল্লি! ম...ল্লি...!’ বলে সম্বোধন করে আর তারপরে পাখি ছাড়া নিয়ে কথা হয়। যদিও মেয়েটির লিপ পুরোটা মেলাতে পারে না সুমিতেশ তবু ‘চলে যায়’। মল্লিকাকার লিপ মেলে। সে বলে ‘দ্যাখো, এরা জঙ্গলের পাখি নয়। কখনও হয়ত ছিল। কিন্তু জেনারেশনের পর জেনারেশন খাঁচাতেই ব্রিড করা।’ কিন্তু রহস্যময়ী মারাত্মক মেয়ের লিপ হুবহু মেলান এত সহজ! কাজেই সেটা হয় না কিন্তু তবু বোঝা যায় সে প্রায় এরকমই বলে ‘ওঃ মল্লি! সেই একই আর্গুমেন্ট। একটাও নতুন কথা নয়। মল্লি ওদের ছেড়ে দাও। রিলিজ দেম প্লীজ। ওদের আমি ক্যাপটিভিটিতে দেখতে পারি না। চাই না। কতবার বলেছি তোমাকে।’ ... মেয়েটি শর্ত দেয় মল্লিকে বেছে নিতে হবে হয় খাঁচায় পাখি না হয় সে। বলাই বাহুল্য মল্লি বাছে মেয়েটিকে। মেয়েটির পোশাক এবং ভাষা থেকে সে কোন ঘরের তা কি সত্যি একটুও বোঝা যায় না? অন্তত কোন ঘরের নয় সেটুকু তো বোঝা যায়! তবে? সুমিতেশ পরে অবশ্য সাউন্ড দিয়ে ডিজিটালি রেস্টোর্ড করে ভিডিও ক্যাসেট এবং সিডি বানায়। সেই ছবি স্টার মুভিজ, টিসিএম, এইচ বি ও ইত্যাদি চ্যানেলে প্রায়ই দেখানো হয়। সেটা দেখার সময় এখন বড় হয়ে যাওয়া এবং দুধ ছেড়ে মদ ধরা কিন্তু সমান ভাবে একটা গা গুলোনোর রেশ থাকা কথক ও তার বন্ধুদের মল্লিকাকার পাগলের হাসিটাও মনে পড়ে ভয় করে কিন্তু মেয়েটির কথা আর মনে পড়তে দেখিনা। কোন ঘরের তা বুঝতে না পারায় মেয়েটিকেও বোঝা যায় না! কিন্তু কোন ঘরের মেয়ে তা বোঝা গেলে? আখ্যানটিতে খাঁচার পাখি, জন্ম থেকেই খাঁচায় থাকা, উড়তে না শেখা, উড়তে ভুলে যাওয়া পাখিদের স্বাধীনতার নামে উড়তে না শিখিয়েই খাঁচার মালিক যদি ঠেলে দিয়ে উড়তে বলে তাহলে যেভাবে ডানার পালক জড়িয়ে বদ্রিকাগুলো পড়ে যায় বাগানে আর শিকার হয় ভয়ানক হিংস্র জন্তুর - এই ঘটনা পরম্পরাকে যদি তুলনা করা যায় পিতৃতান্ত্রিক সমাজের প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে খাঁচায় থাকা, উড়তে ভুলে যাওয়া, উড়তে না শেখা, খাঁচাকেই ‘স্বাভাবিক’ বলে জেনে যাওয়া নারীদের সঙ্গে? চাইলে আমরা করতেই তো পারি! কিন্তু কথকের বর্ণনায় সেই ‘মারাত্মক’ মেয়েটি আর শেষমেশ বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে দেখানো বিখ্যাত ছবির উপসংহার থেকে তাঁর বক্তব্য অন্য দিকে ইংগিত করে বলেই মনে হয়।
মূল গল্পের ‘উপলক্ষ্য’ হিসেবে এসে অদৃশ্য হয়ে যায় আরেকটি নামহীন মেয়েও। যে কিনা অফিসে চাকরি করে, হয়ত ট্রেকিং এও যায় এবং চাকরি চলে গেলে কান্নাকাটিও করে কিন্তু বসকে বোকার মত প্রশ্ন করে নিজেই নিজের বারোটা বাজিয়ে ফেলে। ‘বাদুড় উৎসব’ এর কথক জানায় সেই মেয়েটি এমনিতে বেশ ছিল। ‘সেজেগুজে আসতিস, দুলকি... ’কিন্তু একটা এমন প্রশ্ন অফিসে আসার সময় গাড়িতে সে অখিলেশকে করে ফেলল... জানতে চাইল যে স্যার কোন ফেয়ারনেস ক্রীম ইউজ করেন? কোন মানে হয়?!!! যদিও কথক জানিয়ে দেন - ‘ফ্র্যাঙ্কলি স্পিকিং মেয়েটা কিন্তু অ্যাবসার্ড কোনো ফালতু কথা বলেনি। অখিলেশ, এমনিতেই মোটা ও ফরসা, গুজরাট অম্বুজার এই চারতলার ফ্ল্যাটে শিফ্ট করার পর থেকে দিনকে দিন আরও ফর্সা হয়ে উঠছে। মাসদুয়েক মেয়েটা এটা ভালোভাবেই ওয়াচ করেছিল। এবং তার বুদ্ধিতে যা বলে সেইমতোই মুখ ফুটে বলে ফেলেছিল। এবং তারই রেজাল্টে তাকে এই বাজারে ফুটে যেতে হোল। মালিককে খচালে এরকম তো হবেই। মেয়েটি ছিল ফুটতে বদ্ধপরিকর একটি ফুল, ফুটলও। বরং বলা যায় ফুটফুটে ফুলটিকে ফুটিয়ে দিল অখিলেশ। যে ফুল ফুটবেই তাকে কে ঠেকাবে?’ অতঃপর মেয়েটি স্যাকড্ হয় এবং এরপর অখিলেশ এর বাদুড় উৎসবের আয়োজন এবং তৎপরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ। বলা বাহুল্য এই উৎসবে আনম্যারেড অখিলেশের মোটা এবং ফরসা বন্ধুরা থাকবে কিন্তু তাদের ফরসা এবং মোটা বউয়েরা থাকবে না। ফলে যে পার্টিতে ‘নো বউ ওনলি হুলোজ’ সেখানে ‘মেয়েলি’ এবং খুব ‘সুইট স্বভাবের’ অধিকারী হরমোহন ওরফে ‘হরমোন’ আসবে সেখানে বন্ধুরা ‘ফাইন, ওকেই টিপবো’ বলে উল্লসিত হয়ে পড়ে। বউয়ের ভূমিকা এখানে আবার পালটে যায়! তারা থাকলে ঠিক মত ‘মাল’ টানা যায় না! বোঝাই যাচ্ছে এই বউয়েরা ঠিক অতটা ‘আধুনিক’ নয়। আর বউয়েরা না আসলে ‘টেপার’ জন্য একজন অন্তত লাগবে! যে কিনা নিজের বা পরের বউয়ের মতো ‘মেয়েলি’ এবং ‘সুইট’ হবে এবং অবশ্যই যাকে ‘টিপে’ দেহ-মনের প্রশান্তি হবে! এমনটাও তো হয়! মানে এমনটাই তো হয় অখিলেশের এবং তার ফরসা মোটা বন্ধুদের জগতে! তারা এভাবেই দেখে মেয়েদের! বা বউদের! বা ‘মেয়েলি’ পুরুষদের! আর যে মেয়েটি চাকরি করতে এসেছিল সেই ‘ফুটফুটে’ মেয়েটি ফুটেই যায় ‘বুঝে’ চলতে না পারার জন্য!
এই সমস্ত আখ্যানেই দেখি যে চরিত্রর যে ভাষায় কথা বলা কথকের মতে ‘স্বাভাবিক’, সাধারণত তারা সে ভাষাতেই কথা বলে থাকে। ন্যারেটিভ লেখিকা চন্দ্রা যেমন মাদার টেরেসার সেইন্ট্ হওয়ার আলোচনায় বলে ওঠে ‘আসলে এটা যদি মাদার না হয়ে কোনো ফাদার হতেন আপনারা মেনে নিতেন। এটা আপনাদের জেন্ডারবায়াস’ (‘মির্যাকল’)। ছয়জন মেয়ে, ‘থুম্বোমতো, ’মোটাপানা একজন সমালোচক’, একজন বিখ্যাত ‘উনি’ যিনি কিনা বিখ্যাত সাহিত্যিক এবং যার নাম জানতে পারি না এবং যার জন্য যাওয়া সেই গল্প লেখক তপস্বী ট্রেনে যেতে যেতে আলোচনা জমায়। মেয়েরা ‘পাঁচজন লেখেন কবিতা’। সবাই সকালে সেজেগুজে আনন্দানুষ্ঠানে চলেছে ‘প্রসাধনের গন্ধ, শ্যাম্পু করা চুলের বাহার, সানগ্লাস’ তার মধ্যে মূর্তিমান ছন্দপতন একটি ‘চোখ বসা, গালভাঙা বেমানান এক পাগল’। চন্দ্রা - জেন্ডারবায়াসের কথা বলেন যিনি, তিনিই ‘সেদিন একমাত্র মহিলা যে পরেছিল একমাত্র সালোয়ার কামিজ।’ বাকি মেয়েদের পোশাক বলা নেই কিন্তু ধরে নেওয়া যায় বাঙালি নারীর অভ্যেস অনুযায়ী অনুষ্ঠান বাড়িতে তারা শাড়িই পরেছেন। এবং অনুমেয়, যেহেতু ঐ দলের মহিলাদের মধ্যে চন্দ্রাই একটু অন্যরকম, তিনিই একমাত্র খোলামেলা ন্যারেটিভ লেখেন, সমান তালে তর্ক করেন, তিনি অন্যরকম ভাবেই শাড়ি না পরে সালওয়ার কামিজ পরেছেন!
সমালোচক এবং ‘উনি’র নাম আমরা জানতে পারি না। মেয়েদের মধ্যেও চন্দ্রা ছাড়া আরেকজন কবি সুচরিতার নাম পাই বাকিদের নাম পাই না। কিন্তু সেই পাগলটা এদের সব মির্যাকলের আলোচনা থামিয়ে দিয়ে, এক অদ্ভূত মির্যাকলের ‘ঘটনা’ বলে নেমে যায়। সবাইকে থামিয়ে দিয়ে যায়। সেটাও বুঝি এক মির্যাকলই বটে! প্রথম থেকেই এক ব্যঙ্গের সুরে উপস্থাপনা করা ‘উনি’ এবং তার ‘ছজন মেয়ে বন্ধু নিয়ে ভায়া শেয়ালদা কলকাতা ছাড়ার’ বর্ণনা হালকা চালে বলা হতে থাকে। ন্যারেটিভ যিনি লেখেন - ওনাকে একডাকেই লোকে চেনে এবং উনি ‘জেন্ডারবায়াস’ নিয়ে সরব! তিনি অন্যরকম! তিনি মিমির মত নন। মিমি কিনা মনের ভুলে আপনমনে একমাত্র ছেলে টয়কে বাসে রেখে তার স্কুল ব্যাগ আর ওয়াটার বটল নিয়ে নেমে গেল বাস থেকে! টয় বাসে ঘুমিয়ে পড়েছিল বলে! (‘বেল্টের দাগ’)। টয় যদিও বোঝে, মা ভেবেই ছিল যে সে সঙ্গেই আছে, রোজ যেরকম থাকে। কিন্তু পাড়ায়, আশেপাশে এবং সর্বোপরি মিমির মনের মধ্যে যে অপরাধবোধ কাজ করে চলে, যার ফলে সে ভাবে মিথিল তাকে বেল্ট দিয়ে মারবে মনের ডাক্তার সেটাকে আখ্যা দেন ‘অবসেসিভ পার্সনালিটি সিনড্রোম’ বলে যার রুট রয়েছে ‘ডিপ-সিটেড কোনও অ্যাংজাইটির মধ্যে’। মাইল্ড সিডেটিভ তার কাজ করে, অঘোরে ঘুমোয় মিমি আর তখনই বারান্দা থেকে আসা অল্প ম্লান রোদ্দুরে বারান্দাতেই টয়ের জামা যে রডের ওপর শুকিয়ে যায়। মিথিল জামা আর মোজা পাকিয়ে ঘরের ভেতরের চেয়ারে ছুঁড়ে দেয় আর রড রাখে সোজা করে। পাঠক আর কথক দেখে সেই রডের ছায়া পড়ে মিমির পিঠে এমন ভাবে ঠিক যেন বেল্টের দাগ যেটার কথা মিথিল বা মিমি কাউকেই বলা হবে না বলে কথক জানিয়ে দেন।
এই অদৃশ্য বেল্টের দাগ দৃশ্যমান হয়, মিলিয়েও যায় ক্রমে কিন্তু মিমির ‘ডিপ-সিটেড অ্যাংজাইটি’র কি পরিণতি হল? যার ফলে মিমির ভয় হয় সে বোধহয় পাগল হতে চলেছে এবং চেন দিয়ে বেঁধে বা ইলেকট্রিক শক দিয়ে তার চিকিৎসা করানো হতে পারে কিনা! তাকে মারলে তার অসুখ সারবে কি না! সে যে গভীর ‘অন্যায়’ করেছে তার জন্য কতটা শাস্তি তার প্রাপ্য সে ভেবে চলে! বেল্টের দাগের মতই একটা অদৃশ্য ছাপ মিমির সন্তান কেন্দ্রিক জীবনে রয়েই যায়! যে রড মিথিল সোজা করে রাখে? অসাধারণ এক আখ্যান এটি যেখানে সেই সমাজের আভাস দেখি যে সমাজে বর্তমানে সন্তানের সাফল্য-ব্যর্থতা দিয়ে মায়েদের বেঁচে থাকার মানে নির্ধারিত হয়! যেখানে মায়েরা সকাল থেকে রাত ঘুমে জাগরণে শয়নে স্বপনে শুধুই ছেলে মেয়ের স্কুল, টিউশ্যন,পরীক্ষা, নম্বর, কেরিয়ার নিয়েই ভেবে চলে সেখানে মিমি কি করে নিজেকে ক্ষমা করবে এই ‘অন্যায়’ এর জন্য! মায়েরা করেই বা কেন এরকম? কোথায় এর উৎস? এই যে নিজের নিজেকে মারতে চাওয়া, এই যে মনের গভীরে প্রোথিত হয়ে যাওয়া গ্লানি, এই যে ‘আদর্শ’ মা না হতে পারার ব্যর্থতা এর শিকড় যে অনেক গভীরে সেটা বলেন মনোবিদ মিমিকে। কিন্তু তারপর! সেই বেল্টের দাগ মোছা গেল কি মিমির মন থেকে? জানা যায় না। কারণ মিমি ঘুমিয়ে থাকে মাইল্ড সিডেটিভের প্রভাবে!
মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নারীরা এভাবেই আসে নবারুণের আখ্যানে। প্রতিবাদ বলতে ঐ ‘জেন্ডার বায়াস’ বলা আর বসকে বোকার মত কোন ফেয়ারনেস ক্রীম ইউজ করেন জিজ্ঞেস করে ফুটে যাওয়া চাকরি থেকে। (না বুঝে বোকামো বলাই ভাল, এটা প্রতিবাদ নয়, অন্যরকম)। বর্তমান সমাজের ছবি তুলে ধরা গল্প সংগ্রহে পরকীয়া প্রেমও আছে স্ব-মহিমায়। রজতের স্ত্রী রতি - আরতি থেকে রতি। তাদের একমাত্র ছেলে রাজ স্প্যাস্টিক। রজতের প্রিয় এবং সবথেকে কাছের বন্ধু রজতের মৃত্যুর পরের জন্মদিনে, একঘর দর্শকের সামনে (যার মধ্যে তার স্ত্রীও রয়েছে) আবিষ্কার করে যে তার এবং রতির গোপন সাক্ষাৎকারের কিছু দৃশ্য ভিডিও ক্যামেরা বন্দী করে রেখেছিল রজত ‘মাছ’ নামের একটি ছবিতে (‘ফুল, মাছ…’)। না রজতের মুখোমুখি হতে হয় না তাকে কারণ তার আগেই রজত, এবং রতি তাদের ছেলে সহ কুমায়ুনের পাহাড়ি রাস্তায় ঝরনার জলে ভেজা রাস্তায় গাড়ি স্কিড করে খাদে পড়ে যায় সন্ধের মুখে। গাড়ি ড্রাইভ করছিল রজত। সুমন আখ্যানের কথক। নীলা সুমনের স্ত্রী। নীলা রজতের হ্যান্ডিক্যাম কিনতে চাওয়া নিয়ে বরের সঙ্গে আলোচনা করতে করতে আদুরে গলায় তাকে গাড়ি থামাতে বলে আইসক্রীম খাওয়ার জন্য। তাদের মেয়ে পিউ। সুস্থ স্বাভাবিক। কথক বা সুমন রজতের মৃত্যুপরবর্তী জন্মদিনের এবং ‘মাছ’ নামক ‘ফিলম্’ দেখার জমায়েতে পাঠককে জানায় যে নীলার সঙ্গে ‘প্রদীপের ডিভোর্সড স্ত্রী শর্মিলা’র বন্ধুত্ব অতটা নেই, রতির সঙ্গেই শর্মিলার বন্ধুত্ব বেশি ছিল। একজন ডিভোর্সড এবং আরেকজন নারী যে বরের ‘ক্লোজেস্ট’ বন্ধুর সঙ্গে গোপনে মেলামেশা করছে, যার আছে একটি স্প্যাস্টিক সন্তান তারা দুজনেই কোথাও নীলার ছক থেকে আলাদা হয়ে যায় বলেই কি দুজনে কাছে আসতে পারে সহজে? সুস্থ সন্তান, বর নিয়ে সুখে ঘর করা নারীর সঙ্গে তাই কি ঘর ভাঙা শর্মিলার বন্ধুত্ব অতটা জমতে পারে না? আসলে এটাই ‘স্বাভাবিক’ বোধ হয়।
মূলত ‘প্রেম ও পাগল’ বইটির গল্পগুলিকে কেন্দ্রে রেখেই যেহেতু এই আলোচনা, এই বইয়ের অন্যান্য গল্পগুলিও এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য। আরেকটি গল্প ‘একটি যুগল’ এ ‘সম্ভবত স্বামী ও স্ত্রী’ একটি যুগলের কথা বলা হয়েছে। স্বামীর বয়স আটষট্টিও হতে পারে আবার আটাত্তরও ভাবা যেতে পারে আর সেক্ষেত্রে স্ত্রীর বয়স যথাক্রমে আটান্ন এবং আটষট্টি ভেবে নিতে হবে। এঁরা ঠিক মধ্যবিত্ত কি না বলা যাচ্ছে না কারণ ‘বৃদ্ধের পরণে ছিল একটি হাঁটু ছেঁড়া খাকি প্যান্ট, এবং নোংরা টেরিকটনের ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবির ওপর তিনি যে বুনোট আলগা হয়ে যাওয়া হাতকাটা সোয়েটারটি পরেছিলেন তা একটি দিকে অস্বাভাবিক ঝুলে রয়েছে। মহিলার পরনে ছিল নোংরা শাড়ি ও গায়ে একটি চাদর জড়ানো, যাতে একাধিক পোকায় খাওয়া ফুটো ছিল।’ ওষুধের দোকানে বুকে ব্যথার ওষুধ চাইতে এসেছিলেন তারা। কথাবার্তা যা বলার পুরুষিটিকেই বলতে শুনি। অকপটে জানান ‘... আমি ওর বুকে মেরেছি। লাথি মেরেছি। তাই ব্যথা হচ্ছে।’ অগুন্তি দশ বিশ পয়সার খুচরো বের করে ওষুধের দাম মিটিয়ে দুটো পেন কিলার নিয়ে চলে যান তারা কিন্তু বার বার ঘুরে ফিরে আসতে থাকেন কথকের জগতে। কারণ তারা আছে কলকাতাতেই। থাকবেও। অনেক গবেষণা চলেছিল কথকের বন্ধু ওষুধের দোকানের মালিকের সঙ্গে। কোন পরিবার থেকে এসেছেন এঁরা? ছেলেরা বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে কি না! বদরাগী বৃদ্ধ হয়ত তার মারাত্মক রাগের কারণেই নিজের আর স্ত্রীর সর্বনাশ করেছেন! হয়ত নিঃসন্তান দম্পতি চিটফান্ডে টাকা রেখে সর্বস্বান্ত হয়েছেন! হয়ত অন্য কোন কিছু... ভিক্ষে করেন? কিন্তু দেখে তো ভিক্ষের অভ্যেস আছে বলে মনে হয় না? এমনি আরো অনেক কিছুই ভেবেছিলেন তারা। উত্তর বলা বাহুল্য মেলে না। শুধু রয়ে যায় জট পড়া চুল আর জীর্ণ দড়ির মতো হাতে শাঁখা নিয়ে সেই মহিলা আর সেই নোংরা টেরিকটনের পাঞ্জাবি পরা সেই বৃদ্ধ আর তার সেই অকপট স্বীকারোক্তি! সেটাই যেন এক মূর্ত প্রতিবাদ হয়ে যায় এই গোলকায়নের যুগে, মাল্টিপ্লেক্সে সিনেমা দেখা আর শপিং মলে অনবরত অপ্রয়োজনীয় জিনিস সেল এ কিনে চলা কলকাতার উচ্চবিত্ত আর উচ্চমধ্যবিত্ত বাসিন্দাদের প্রতি! মহিলাটি কিন্তু চুপ করেই থাকেন। যেন লাথি খাওয়া এবং ব্যথা হওয়া এবং যে লাথি মেরেছে তার কাছ থেকেই ওষুধ খাওয়া সব কিছুই ‘স্বাভাবিক’! আর বৃদ্ধও জানে যে এভাবে স্বীকার করলেও তার অন্য কোন শাস্তি হবে না! জানা যায় না এই ধরণের স্বীকারোক্তি সে আগেও একবার বা বারবার করেছে কি না! মহিলাটি কোন নালিশ, কোনও অভিযোগ করে না! চলতে থাকে তাদের যুগল যাপন!
এক অন্যরকম ‘যুগল-বন্দী’ গড়ে উঠতে দেখি, মানে যাকে বলে ‘সেয়ানে–সেয়ানে’ ঠিক তেমনটি পাওয়া যায়, অপর এক গল্পে যেখানে এই কলকাতারই বাসিন্দা এক ‘নিকৃষ্ট প্রজাতির ধান্দাবাজ’ ‘চুতিয়া’ ভারতীয় লেখক লেখকদের দলে ভিড়ে জাপান যাওয়ার আমন্ত্রণ যোগাড় করে ফেলে। এই লেখকটি আসলে বামন। ‘অতি হারামি এক ফেমিনিস্টের সঙ্গে ইংরেজিতে গয়নাবড়ির ওপরে একটি বইও লিখেছে।’ বাড়িতে বউও রয়েছে। (‘প্রবাসে দৈবের বসে...’) সে অ্যাটম বোমার মতোই ছোট। তাকে তাই সেই নামেই উল্লেখে করেন কথক। সে জাপানে যায়, তারপর ফেরত আসে একটি শিশুর বা বালকের কফিন আর তার সঙ্গে কিছু ফটোগ্রাফ যেখানে অ্যাটমের পাশে দেখা যায় এক দাঁত বড় জাপানি মহিলা কবিকে। সেখান থেকেই কথক নিয়ে যায় জাপানে আবার। এখন এই মহিলা কবি গতবছর লিখেছিল নিজের যৌনাঙ্গকে ছাপিয়ে গিয়ে একটা জায়গায় পৌঁছনোর প্রচেষ্টামূলক কবিতা যেটা আসলে কি তা কেউই বোঝেনি, প্রয়োজনও পড়েনি। এবছর ইনি লিখছেন মা কিভাবে বিভিন্ন উপায়ে শিশুকে খুন করতে পারে তার বর্ণনামূলক কবিতা। এই মহিলা কতগুলো বিয়ে করেছে নিজেই গুলিয়ে ফেলেছে। এরা দুজনে জমে যায় একে অন্যের সঙ্গে। অম্লান বদনে হেসে অ্যাটম বোমাকে জানায় যে গত রাতের সাকে দিয়ে অক্টোপাসের দারুণ ডিনারের পর অ্যাটম বোমা সান্তোরি (জাপানি হুইস্কি) দিয়ে তাকে খেয়েছে এবং এই অ্যাটমের দল চলে গেলে সে কি করবে সেই ভেবে কাতর হয়ে পড়ে। সে বর্তমানে তিনমাস জাপানে রয়েছে এবং লস এঞ্জেলিসে তার দুই ধাড়ি মেয়েকে সামলাচ্ছে সেই বুড়ো যে কিনা ডিভোর্স হয়নি বলে এখনো তার বর! ইয়ামাগাতা এবং টোকিওতে জাপানি-ভারতীয় সাহিত্য সেমিনারে ‘ভাটানোর র্যান্ডাম চান্স’ পেয়ে যায় অ্যাটম বোমা এবং ইয়ামাগাতায় সে পড়ে শোনায় তার অতি রদ্দি একটি উপন্যাস থেকে দুই পাতা যা কিনা সে লিখেছে সাবেকি রেন্ডিবাড়ি নিয়ে। এবং সেখানে সে জানায় যে ‘যৌনকর্মী’ বলে ‘ডাক-নাম কিনতে চাওয়া’ রেন্ডিদের কথাবার্তা সে হুবহু তুলে দিয়েছে তার উপন্যাসে। তাতে আরেক মহিলা কবি ‘প্রতিবাদ’ করে ‘প্যাঁক প্যাঁক’ করে কারণ অন্যের ভাষা ঝেড়ে দেওয়াটা অনুচিত। এভাবে নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবাই বিস্তর বাজে বকে সন্ধ্যেবেলা পার্টি করতে যায় আর দাঁত বড় মহিলা প্ল্যান অনুযায়ী সব ব্যবস্থা করে ফেলে। সেই খবর অ্যাটম বোমার কাছে পৌঁছে যায় আর সে আনন্দে ফাঁকা হাতেই গ্লাস ধরার ভঙ্গি করে ‘চিয়ার্স’ বলার সঙ্গে সঙ্গেই একটা মিনি ভূমিকম্প হয় যেমনটা জাপানে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই হয়ে থাকে আর কি। তারপর পার্টি থেকে ফিরে হোটেলের ঘরের লাগোয়া বাথরুমে স্নান করতে গিয়ে বাথটাবে ডুবে যায় অ্যাটম বোমা। তার বা কোনো শিশু বা বালকের কফিন ফিরে আসে। বউ বিধবা হয়। আর ওদিকে দেখা যায় যে ‘অ্যাটম বোমা এখন বারমুডা ও চকড়া-বকড়া হাওয়াই শার্ট পরে দাঁত বড় কবির সঙ্গে ওকিনাওয়া-র সমুদ্রতীরে দাঁড়িয়ে… প্লাস্টিক সার্জারি করে সে তার মুখটাকে জাপানি আদল দেবে।’ এবং শেষ লাইনে জানা যায় যে ‘ওকিনাওয়াতে মার্কিন সেনাদের একটি ঘাঁটি রয়েছে।’ অ্যাটম বোমা, মার্কিন সেনা ঘাঁটি এবং জাপানের যোগসূত্র ও তার সঙ্গে ভারতীয় রদ্দি খচড়া ‘নিকৃষ্ট প্রজাতির ধান্দাবাজ লেখক’ এর সম্পর্ক এভাবে উপস্থাপিত করতে নবারুণই পারেন বোধ হয়! এখানে উল্লিখিত মহিলা কবির ক্ষেত্রে দেখি যে সাধারণত মহিলাদের যে দিকগুলি বিচার করে তাদের ‘ভালো-মন্দ’ আখ্যা দেওয়া হয় পিতৃতান্ত্রিক সমাজে (‘পিতৃতান্ত্রিক’ শব্দটাও অনেকের কাছে হ্যাজানো লাগছে কি? কিন্তু বড়জোর ‘পেট্রিয়ার্কি’ বলতে পারি। তাছাড়া কোনো অল্টারনেটিভ পাই নি এখনো), সেই দিকগুলিই এর জীবনে ভয়ানক! একে অনেক বিয়ে, দ্বিতীয়ত নিজের যৌনাঙ্গ ছাপিয়ে এক জায়গায় যাওয়ার চেষ্টা! কবিতা অতি রদ্দি হলেও বিষয়টাও তো মারাত্মক! তারপরে মাতৃত্বের অবমাননা! মা কিভাবে শিশুকে খুন করবে তার নানারকম নিয়ে কবিতা! নিজের মেয়েদের ‘ধাড়ি ধাড়ি’ মেয়ে বলে আখ্যা এবং সাহিত্য সেমিনারে যোগ দিতে অন্য দেশ থেকে আসা প্রতিনিধির সঙ্গে রাতে ‘সান্তোরি’ সহযোগে নিজেকে ‘খেতে’ দেওয়া! সবটাই যাকে বলে ‘মারাত্মক’! এই মহিলা কবির থুড়ি দাঁত বড় মহিলা কবির ব্যক্তিগত জীবন যেভাবে এই আখ্যানে আসে তা এই সংকলনের অন্যান্য আখ্যানের মধ্যবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত বা বুদ্ধিজীবি নারী চরিত্র থেকে খুব আলাদা হতে পারে না। এরা হয় ‘অতি হারামি’ নয় একটু হালকা গোছের ‘জেন্ডারবায়াস’ নিয়ে বুলি কপচানো ফেমিনিস্ট যে কিনা আবার অনুষ্ঠান বাড়িতে শাড়ি না পরে সালওয়ার কামিজ পরে যায় অথবা ফিল্মস্টার বা অভিনেত্রী হলে বহু ইন্টুপিন্টুর ঘনঘটায় আসলে ‘খানকি মাগী’ না হলে স্প্যাস্টিক ছেলের মা এবং পরকীয়া প্রেম আর সুখী গৃহবধূর দল যারা আদুরে গলায় বরের কাছে আইসক্রীম খেতে চায় অথবা ছেলেকে ভুলে বাস থেকে নেমে গেলে খান খান হয়ে যায় অমার্জনীয় অপরাধবোধে।
‘কালকেউটের ছোবল’ নাটকে (‘রিভলভার/পরচুলো/মার্ডার/সুইসাইড’) মহলা চলার সময় ‘মিস (?) পায়েলের হুমা আঁখমিচোলি ও অর্থপূর্ণ ভাঁজ মারার টেকনিকে ডঃ ডি কে লোধ-এর ছোট ছোট পোস্টারের মতোই মনে মনে সেঁটে গিয়েছিল ফ্যাটম্যান। বাংলায় বললে হেভি গর্মে গিয়েছিল। মিস(?) পায়েল যে এইভাবে নানা অফিসের বহু ফ্যাটম্যানকেই ক্যাপচার করে থাকেন সেটা কোনো সিক্রেট নয়।’ এবং অফিস ক্লাবের অভিনয়ের নামডাকের সুনামের থেকেও ‘অন্য’ কারণে নামজাদা হওয়াকে বড় করে দেখানো, এই প্রশ্নবোধক ‘মিস’কে নিয়ে ফ্যাটম্যান নামকরা রেঁস্তোরায় খেতে যায় এবং সেখানে টেবিলের তলায় পায়ে পায়ে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলে আবার ‘খ্যাঁচামারা’ ডিরেক্টরের সঙ্গে একেই ট্যাক্সি করে ‘ভ্যানিশ’ হয়ে যেতে দেখে মুষড়েও পরে। পরিচালকের পুরোনো প্রেম এই ‘মিস(?)’। তো সেই পুরোন প্রেমে ‘র্যাঁদা’ খাওয়ার প্রতিশোধ নিতে পরিচালক লোক লাগিয়ে ব্রিফকেস বদলে নকলের বদলে আসল রিভলভার রেখে দেয় যা ফ্যাটম্যান ছোঁড়ে আর পড়ে যায় ‘ডেড ফিমেল লাশ’ - সত্যি সত্যি! অন্য দিকে ফ্যাটম্যান আত্মহত্যা করতে গিয়েও ব্যর্থ হয়! আরে বাবা এই নারীর কারণেই আত্মহত্যা করে পরিচালক ঠিক তার আগের স্টেশনে - একই ভাবে এবং মেট্রোর কারেন্ট অফ করে দেওয়া হয় সঙ্গে সঙ্গে এই কাণ্ড ঘটার পরেই। কিন্তু এই দুটোই ছিল সম্ভাবনা! আর সম্ভাবনাতে মৃত্যুর জন্য দায়ী ছিল ঐ ‘মিস(?)’ পায়েল! বাস্তবে একটা ফাটাফাটি শো করে বাড়ি ফিরে ‘মেঘা অ্যাপার্টমেন্টের এফ১/১-এ ফিরে ফ্যাটম্যান ও ডার্লিং ঘুমিয়ে পড়ে।’ ডার্লিং বিষয়ে এটুকুই জানা যায় যে সোৎসাহে বাড়িতে মহলা দেওয়ার সময় পিৎজাওয়ালা যখন হোম ডেলিভারি দিতে আসে তখন ফ্যাটম্যানের ‘ডার্লিং’ ডাকে সাড়া দিয়ে এসে সে ‘ফোর হান্ড্রেড ফিফটি পে’ করে দেয়। ডার্লিং কে নিয়ে আর কিছু জানার দরকারও পড়ে না। এরকমটাই তো ঘটে থাকে বাস্তবেও! মার্ডার বা সুইসাইড কোনটাই হয় না, হয় ‘নিবারণ ভট্টাচার্য প্রনীত নাটক’ ‘কালকেউটের ছোবল’ এর ফাটাফাটি শো! কিন্তু অনেক কিছুই তো ঘটে যায় আবার, যা সাধারণত ঘটে না! এই মেঘা অ্যাপার্টমেন্টের দারোয়ানই তো নিশুতি রাতে মন দিয়ে চটি বই বের করে পড়ে চলে ‘জবর খবর’ যেখানে রয়েছে ‘সবচেয়ে বড় নখ কার?’ ‘খুদে লেখক আখ্যা কে পান?’ এই সব প্রশ্নের উত্তর! তাহলে? কথক চাইলে অন্যরকম বয়ান ও তৈরি হতে পারে ‘এমনটাই তো ঘটে’ এই ধাঁচার বাইরেও!
খানকি, ফেমিনিস্ট, গৃহবধূ ও ডার্লিং ছাড়া আর যাদের দেখা যায় ‘প্রেম ও পাগল’ বইটিতে তাদের মধ্যে অবশ্যই রয়েছে এক ‘ঘর’ বুঝতে না পারা ‘মারাত্মক’ মেয়ে যার প্রেমে পাগল হয় সুমিতেশের মল্লিকাকা। সেই গল্পের নামেই সংকলনটির নাম। গল্পের নামকরণেই যেন আভাস পাওয়া যায় যে প্রেমে পড়ে পাগল হবে এক পুরুষ আর তার দায় বর্তাবে এক নারীর ওপরেই! ছকটা ভাঙে না এক্ষেত্রে। এই মেয়েদের জন্য নির্দিষ্ট ছক গুলিতে কথক এক আপাত নির্লিপ্ত উদাসীন নবারুনীয় নৈপুন্যে রেখে দেন এই শ্রেণীর নারী চরিত্রগুলিকে। ব্যক্তি জীবনে সব থেকে কাছের অথচ সবথেকে দূরের নারীর সঙ্গে জটিল সম্পর্ক এবং সেই ছক ভাঙা নারীর প্রতিবাদী, বলিষ্ঠ স্বর এবং তাঁর সৃষ্ট ছক ভাঙ্গতে চাওয়া নারী চরিত্রগুলিকে সচেতন বা অবচেতনে এড়িয়ে যাওয়ার ইচ্ছে হয়ত বা এর ব্যখ্যা হতে পারে। কিন্তু তাঁর জীবনে অপর যিনি সব থেকে কাছের ছিলেন তিনিও তো ছক ভাঙা বলিষ্ঠ এক নারী যিনি ছিলেন আমরণ তাঁর পাশে! অথচ ‘প্রেম ও পাগল’ এ মধ্যবিত্ত বা উচ্চমধ্যবিত্ত পুরুষ চরিত্র গুলির স্বরের রকমফের রয়েছে। অ্যাটম বোমার সঙ্গে সঙ্গে আছে রজতও। কিন্তু যাঁর লেখনীতে প্রান্তিক মানুষের এক অদ্ভূত প্রতিবাদী ঘুরে দাঁড়ানো, প্রতিশোধ নেওয়ার জোর এবং স্বর শুনতে পাওয়া যায়, তাঁর আখ্যানগুলিতে কোনও মধ্যবিত্ত বা উচ্চমধ্যবিত্ত লড়াকু, ইতিবাচক কেন্দ্রীয় নারী চরিত্র দেখতে না পেয়ে একটু হতাশ লাগে বইকি! অথচ নবারুণকে ঠিক সেই দলভুক্ত করা যায় কি যাঁদের বিশ্বাস ছিল বা আছে যে শ্রেণীসংগ্রাম শেষ হোক আগে তারপর না হয় নারীমুক্তির কথা ভাবা যাবে! ও এমনিই হয়ে যাবে! মানে আগে তো বুর্জোয়া শ্রেণীর আধিপত্য শেষ হোক তারপর না হয় মেয়েদের অবস্থান নিয়ে লড়াই হবে! যতদিন তা না হচ্ছে ততদিন মেয়েরা হয় বেশ্যা নয় গৃহবধূ নয় ‘ফেমিনিস্ট’! নারী পুরুষ একই শ্রেণীর হলেও যে সেখানে নারীরা প্রান্তিক সেই দিকটি এঁদের কাছে অদৃশ্যপ্রায়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ‘এক যুগলের গল্প’-এর পুরোনো কোট পরা, ‘ওকে আমি লাথি মেরেছি’ বলা বৃদ্ধর সঙ্গী সেই জীর্ণ হাতে শাঁখা পরা, জট পড়া চুলের বৃদ্ধাও কিন্তু রয়েছে এখানেই! দুজনেই একই শ্রেণীর, একই ‘ঘরের’ কিন্তু বৃদ্ধার কোনও কথা শুনতে পাই না। অথচ সেই নিরুচ্চার উপস্থিতিই যেন সোচ্চার হয়ে মনে পড়িয়ে দিয়ে যায় কথককে বার বার যে এরা আছে এবং কলকাতাতে থাকবেও! এই মহিলারও আদত ঘরের পরিচয় পাওয়া যায় না কিন্তু। যদিও কথক তাদের রাস্তাতেই দেখতে পান! তাহলে এক্ষেত্রে কি নিরুচ্চার উপস্থিতিই হয়ে যায় এই শ্রেণীর নারীর অবস্থানকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার এক অন্য কৌশল!
পিতৃতান্ত্রিক সমাজে মধ্যবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের বহু মেয়েরাই যে প্রান্তিক অবস্থানেই রয়ে যায় তাদের মূল চরিত্র হিসেবে সবাইকে ভাবতেই হবে অবশ্যই এমন কোনো মাথার দিব্যি নেই তবু মনে হয় যে যদি নবারুণের কলমে এদের কেউ কেউ ঘুরে দাঁড়াতো বা স্বর পেত তাহলে নিশ্চয়ই অন্যরকম হতো সেই স্বর! সেই চরিত্রটি! কিন্তু ‘প্রেম ও পাগল’ সংকলনের কথক এই দিকটি এড়িয়েই গেছেন। এই সব ক্ষেত্রে জানা যায় না, জেনে কি হবে? কি করে জানব? বা জানার প্রয়োজন নেই - গোছের আভাস দিয়েই বাকিটা সম্ভবত পাঠকের অনুমানের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। অ্যাটম বোমার ছবি দেখে জাপানে চলে যাওয়া যায় পাঠককে নিয়ে কিন্তু মল্লিকাকা পাগল হয়ে যাওয়ার পরে সেই মারাত্মক মেয়েটির খবর জানা যায় না। ‘কারণ’ রূপে এই মেয়েরা গল্পে আসে কিন্তু একমাত্র জাপানি দাঁত বড় মহিলা কবি ছাড়া আর কাউকে তারপরে কাজ করতে বিশেষত ইতিবাচক কিছু করতে আর দেখা যায় না! এই দাঁত বড় নারীও খুব ইতিবাচক কিছু করে না! বরং তার যৌনতা, তার কবিতার বিষয়, তার মেয়েদের প্রতি অবহেলা, এবং চাতুর্য সব কিছুই বর্ণিত হয় ব্যঙ্গের সুরেই। অ্যাটম বোমার যথার্থ দোসর হিসেবেই আসে এই ধান্দাবাজ নারীও। আর এদিকে সেই যে ‘বাদুড় উৎসব’ এর মেয়েটি বোকার মতো প্রশ্ন করে চাকরি খোয়াল, সেই মেয়েটিও মূল গল্পের ভূমিকা রূপে এসেই মিলিয়ে যায়! চাকরি খুইয়ে কাঁদলেও বা কি হবে? এরকমতো হয়েই থাকে! এবং সেই অসাধারণ নবারুনীয় ছাঁদে অনবদ্য ভাবে এই মেয়েটির অসহায়তা বিশেষ কিছু না বলেও আঁকা হয়েছে এক আপাত নির্লিপ্তির আড়ালে। কিন্তু এ তো মেয়েটির গল্প নয় কাজেই তার ভূমিকা এখানেই শেষ। কারণ ‘মেয়েটি স্যাকড্ হয়ে কী করবে সেটা আমাদের পক্ষে আঁচ করা সম্ভব নয়। হয়তো ট্রেকিং করতে চলে গেল। আমরা এইটুকুই অ্যাডভাইস করতে পারি, ট্রেকিং করা খুবই ভালো তবে কোনো কোনো এরিয়া অ্যাভয়েড করাই বোধ হয় বুদ্ধিমতীর কাজ।’