মাঝরাতে শিশু কন্যাকে নিয়ে বেরিয়ে গিয়ে যখন একটু মাথা গোঁজার নিরাপদ আশ্রয় দরকার, যখন গার্হস্থ্য হিংসার ফলে বাড়ি ছেড়েছে প্রমাণিত হলে রাষ্ট্রের অনেক পরিষেবা পাওয়া সহজ হয়ে যায় - পাওয়া যায় উপার্জনের রাস্তা, মাথা গোঁজার জায়গা এবং পেট ভরানোর খাবার - তখনও মেয়েটি সমানে বলতে থাকে, যে সে কিন্তু গার্হস্থ্য হিংসার শিকার নয়, তার মেয়ের বাবা তাকে মারেনি, ভয়ানক গাল মন্দ করেনি, পরকীয়ায় লিপ্ত নয়। শুধু সে নেশা করে ফিরে চেঁচিয়ে ওঠে, ঘুষি মেরে দরজায় গর্ত করে দেয় আর কিছু বাসন কোসন ছুঁড়ে ফেলে ভাঙে। পরের দিন আবার ঠিক হয়ে যায়। সে আসলে মেয়েকে খুবই ভালবাসে, তাকেও বাসে।
গৃহহীন, অত্যাচারিত মানুষের থাকার জন্য যে সমাজকল্যাণমূলক পরিষেবা রয়েছে, সেখানে মেয়েটি যায় তার শিশু কন্যাকে নিয়ে। তার থাকার জায়গা দরকার। অন্তত আজ রাতটুকু। গতরাতে তারা ঘুমিয়েছে নিজের গাড়িতে, রাস্তার ধারে গাড়ি পার্ক করে। কিন্তু সাতসকালে আইনের রক্ষক এসে মনে করিয়ে দিয়েছে যে রাস্তা জনগণের সম্পত্তি হলেও সেখানে পার্কিং-এর নিয়ম নেই এবং কোনো চুলোয় যাওয়ার জায়গা না থাকলে সে সমাজকল্যাণমূলক প্রকল্পের সাহায্য নিক বরং!
অতএব সে ফর্ম ভর্তি করে। তার ডাক পড়ে এবং কোনো প্রশ্নেরই সুদুত্তর সে দিতে পারে না। সওয়াল-জবাব এগিয়ে চলে -
- তো এই হল সেই শিশুটি? তুমি ওর আইনি অভিভাবক? প্রমাণ করতে পারবে?
মেয়েটি জানায় সে স্ট্রেচমার্ক দেখাতে পারবে। কিন্তু থোড়াই সে প্রমাণ রাষ্ট্র মানবে? আর সত্যিই তো। সেটা তো অন্য বাচ্চার জন্যও হতে পারে। এই দাগ যে তার কোলে বসা এই মেয়েকে জন্ম দিতে গিয়েই হয়েছে – তার কি প্রমাণ? …
এরপর ক্রমশ -
– মেয়েটি কি গৃহহীন?
– ঠিক তা বলতে পারবে না। সে তো রাতের বেলা বেরিয়ে এসেছে মেয়েকে নিয়ে। তাই বলে তার বাড়ি নেই… কি করে বলে?
– বেশ তাহলে সে পারিবারিক হিংসার শিকার?
– না ঠিক তাও নয়। কারণ তাকে মারা হয়নি, তার মেয়েকেও মারা হয়নি।
– তার কোন কাজ আছে?
– না নেই।
– পড়াশুনো?
– শেষ করেনি। ছটা বিভিন্ন জায়গার বিভিন্ন স্কুলে সে পড়েছে! কারণ তার চিত্রশিল্পী মা তাকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে যায় এবং বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে থেকেছে তারা।
– কোন বিশেষ দক্ষতা?
মেয়েটি আর ভুল করে না। সে বুঝে যায়, এতদিন ধরে যে সে, একটি শিশুকে - যে কিনা আবার এই রাষ্ট্রেরই ভবিষ্যৎ নাগরিক … তার শৈশবকে ভরসা, ভালোবাসা আর নিরাপত্তার ওম দিয়ে তার শারিরীক, মানসিক ও বৌদ্ধিক দিকগুলোর সুস্থ, সুন্দর বিকাশের জন্য, যত্নসহকারে তার প্রতিটা মুহুর্ত উজাড় করে দিচ্ছিল, তা বিশেষ দক্ষতা এমনকি ‘কাজ’ বলেও মানতে নারাজ রাষ্ট্র এবং সমাজ। ঠিক যেভাবে তারা মানতে নারাজ, যে একটি মেয়ে যখন তার নিজের এবং শিশু সন্তানের মানসিক শান্তির জন্য এই ধরণের কোন পদক্ষেপ নেয়, আগুপিছু না ভেবে বেরিয়ে আসে সেই হিংসার পরিবেশ থেকে, তখন বারবার, তার অমতে, তাকে সেই পুরুষটির কাছেই ফেরত পাঠানো আসলে অন্যায় এবং অপরাধ।
মেয়েদের এই গল্পটা আসলে স্থান কাল পাত্র ভেদে বহুদিন ধরেই এক। সেই জন্যই এতক্ষণ মেয়েটির নাম না করলেও খুব সমস্যা হয় না মূল বিষয়টা বুঝতে। আসলেই অন্য অনেক মেয়ের প্রতিনিধিত্ব করে সে। তবে এখানে আমি একটি নির্দিষ্ট ওয়েব সিরিজ নিয়ে কথা বলছি – যা তথাকথিত উন্নত এক দেশের, একটি ছোট জায়গায় একটি মেয়ে অ্যালেক্সের তার আড়াই বছরের শিশু কন্যা ম্যাডিকে নিয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচতে চাওয়ার লড়াইয়ের কথা বলে। এই লড়াই খুব সোচ্চার নয়। নরম-সরম মিষ্টি মেয়ে অ্যালেক্সকে কেউ মুখরা, দজ্জাল বলবে না। সে এবং তার সঙ্গী শ্যন দুজনেই বিচ্ছিন্ন পরিবারের অশান্ত পরিবেশে বেড়ে ওঠা সন্তান। শ্যনের মায়ের প্রবল নেশায় আসক্তির মাশুল শ্যন দিয়েছে। দুজনেই চেয়েছিল নিজেদের সন্তানকে সুস্থ সুন্দর পরিবেশে বড় করতে। কিন্তু শ্যনের মদ্যপানে মাত্রা রাখতে না পারা এবং ফলত “নেশার ঝোঁকে” বাসন আছড়ে ভাঙ্গা, চিৎকার করা সবটাই অ্যালেক্সকে আতঙ্কিত করে তুলছিল এবং যেদিন সে এরকম গণ্ডগোলের পরে ম্যাডির চুল থেকে কাঁচের টুকরো বের করে, তখনই সিদ্ধান্ত নেয় এই আপাত সুখের কিন্তু আদতে হিংসার পরিবেশ থেকে বেরোবে। এরকম ঘটনা রোজ না হলেও, “এই বুঝি হল আজ আবার” - এই আশঙ্কা আর উদ্বেগ হৃদয়ে যে ধড়ফড়ানি ওঠায়, সেই আতঙ্কের ধাক্কায় প্রতিমুহূর্তে তিলে তিলে ক্ষয় হয়ে যাওয়া যে কি ভয়ানক, তা সে দিনের পর দিন উপলব্ধি করে। শিশুর মননে এই হিংসার ছাপ তার মানসিক বিকাশে স্থায়ী প্রভাব ফেলে যাওয়ার আগে, একটা শান্তি আর স্বস্তির, আতঙ্ক বিহীন পরিবেশের খোঁজে বেরিয়ে পরে সে মেয়েকে নিয়ে গাড়ি ছুটিয়ে। প্রাথমিক ভাবে এই হিংসার জায়গা ছাড়াই ছিল তার উদ্দেশ্য। বয়স কম। মনের জোর এবং মেয়েকে সুস্থ পরিবেশ দেওয়ার অদম্য ইচ্ছেই তাকে সাহস যোগায়। প্রথম লক্ষ্য হয় সেই রাতটুকু একটা নিরাপদ কোন জায়গায় কাটানোর।
রাতে থাকার জায়গা নেই, পকেটে হাতে গোনা কয়েকটা ডলার, খাবার নেই, কাজ নেই- মাঝে মাঝেই ফিরে ফিরে আসা ভালো আর আক্রমণাত্মক ব্যবহারের বিপরীত স্মৃতির দ্বন্দ্বের ধাক্কায় বিপর্যস্ত হয়েও তার চেষ্টা থাকে মেয়েকে আগলে রাখার। গাড়িতে উঠলেই, মেয়ের যে প্রিয় গান সেটা বাজাতে হয় থাকে। মেয়ের সর্বক্ষণের সঙ্গী পুতুলটি জানলা দিয়ে রাস্তায় পড়ে গেলে, মাঝরাস্তায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে সে খুঁজতে নামে সেই সিম্রাইয়েল নামের পুতুলটিকে। অন্য গাড়ি এসে ধাক্কা মারে একলা বসে থাকা ম্যাডি সমেত গাড়িকে। খুব ক্ষতি কিছু না হলেও পুলিশ আসে। বাধ্য হয়ে নিজের বাবাকে ফোন করতে হয় তাকে। যেতে হয় তার সঙ্গে…
… এই মুহুর্তে প্রতিটা ডলার দামী তার কাছে। তবু যাওয়ার পথে সে হুবহু একরকম আরেকটা পুতুল কিনে নেয় ম্যাডির জন্য। সব হারিয়ে সেই শিশুটিই বা থাকবে কি ভাবে? তাই সেই মুহূর্তে তাকে সেই সঙ্গী ফিরিয়ে দেওয়াটা অ্যালেক্সের কাছে অন্যান্য প্রয়োজনের থেকে গুরুত্বপূর্ন মনে হয়। বাস্তব বুদ্ধি সম্পন্ন কোন মানুষের কাছে এই মুহূর্তে তা অপচয় মনে হতেই পারে কিন্তু যে মা শিশুর ভালো চেয়ে বাড়ি ছাড়তে পারে, সে জানে এই মুহুর্তে এর থেকে বেশী প্রয়োজনীয় আর কিছুই নেই!
সরকারি অনুদান পেতে গেলে, থাকার জায়গা পেতে গেলে দেখাতে হবে অন্তত দুটি মাসের আয়ের প্রমাণ। কিন্তু শিশুকে ডে-কেয়ারে না রাখলে সে কাজ পাবে না আর ডে-কেয়ারে রাখতে গেলে তাকে কাজের প্রমাণ দেখাতে হবে! এই গোল চক্করে ফেঁসে গিয়ে বাধ্য হয়ে ঘণ্টা পিছু অনেক কম আয়ে, বাথরুম এবং বাড়িঘর পরিষ্কার করার– এককথায় একটি বেসরকারি সংস্থায় সাফাইকর্মীর কাজ নেয় সে। এবং এই কাজের জন্যই সে বাধ্য হয় ম্যাডিকে তার আপাত উদাসীন, আত্মকেন্দ্রিক মায়ের কাছে রেখে কাজে যেতে। কিন্তু ফেরি পার হয়ে ফিরতে দেরি হয়ে যায় এবং তার দেরী দেখে, মায়ের নতুন বয়ফ্রেন্ড, শ্যনকেই বলে মেয়েকে নিয়ে যেতে! বাধ্য হয়ে বাড়ি ফিরে যায় সে। কিন্তু আপাত শান্তির আড়ালে মূল কারণ পরিবির্তিত হয়েছে বলে তার মনে হয় না! ঠিক যেমন, দরজায় একটা ছবি ঝুলিয়ে দিলেই তো আর দরজার গর্ত এবং সেটা হওয়ার কারণ “নেই” হয়ে যায় না। একটা আপাত প্রলেপ দেওয়া মাত্র। যেন কিছুই হয়নি-এরকম একটা ভান! কিন্তু আদ্যন্ত সৎ অ্যালেক্স এই ভান আর মানতে পারে না। সে বেরিয়ে যায় আবার!
শেষমেশ অ্যালেক্স বাধ্য হয় পারিবারিক হিংসার শিকার মেয়েদের জন্য বিশেষ সরকারি আবাসনে আশ্রয় নিতে। সে নিজেও বুঝতে পারে যে, তার সঙ্গে হওয়া মানসিক অত্যাচারও আসলেই পারিবারিক হিংসার তালিকাতেই পড়ে এবং সেও এই আবাসনে আশ্রয় নিতে পারে- পুলিশে রিপোর্ট করার শর্ত সাপেক্ষে। কিন্তু অ্যালেক্স বুঝলেও, বাকিদের কি সে বোঝাতে পারে?
ম্যাডির কাস্টডির জন্য মরিয়া অ্যালেক্স, তার সঙ্গে ঘটা মানসিক অত্যাচারের নীরব প্রতক্ষ্যদর্শী হিসেবে যখন নিজের বাবাকে সাক্ষী হতে বলে, তখন বাবা বুঝতেই পারে না যে অত্য্যাচার কোথায়? তার সামনে তো এক দম্পতির নিজস্ব সমস্যা, কথা কাটাকাটি হয়েছিল - যা সবার মধ্যেই হয়! আসল সমস্যাটা এখানেই। যে হিংসা চোখে দেখা যায় যেমন মারধোর, আঘাতের চিহ্ন, খেতে না দেওয়া প্রভৃতি - সেগুলো সহজেই অপরাধ আর হিংসা বলে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া যায় কিন্তু, যেগুলো আপাত দৃষ্টিতে অপরাধ বলে মনেই হয় না, এমনকি যার ওপর অপরাধ ঘটছে, তার নিজেরও, সেখানেই এবং সেটা যদি হয় তথাকথিত সুবিধেপ্রাপ্ত শ্রেণীর মেয়েদের ওপর, তাহলে বিষয়টা আরো জটিল হয়ে যায়। যেমন সরকারি অনুদানের দায়িত্ব প্রাপ্ত মহিলা-যে তাকে অনেক প্রশ্ন করে? সে প্রথমেই যাচ্ছেতাই করে শুনিয়ে দেয় যে, অ্যালেক্স আসলে সাদা চামড়ার একজন বেকার মহিলা, যে সরকারী সুবিধে মুফতে লোটার তালে এসেছে!
চেনা গণ্ডীর মধ্যে যেখানেই একটু আশ্রয় নিতে যায় সে অথবা মেয়েকে রেখে কাজে যেতে যায়…সবাই বারবার শ্যনকে খবর দেয় বা তার কাছে ফিরে যেতে বলে। সবাই বলে যে, শ্যন তো সবসময় নিজের দোষ স্বীকার করে নেয়। সে চেষ্টা করছে নিজেকে শোধরানোর এবং সে ম্যাডিকে খুব ভালোবাসে। সে অ্যালেক্সকেও ভালোবাসে। এমনিতে দায়িত্ববান, মিষ্টভাষী, পরিশ্রমী ছেলে শ্যন। অ্যালেক্সকে সে মারধোরও তো করে না! হ্যাঁ, তাকে নিজের সমকক্ষও মনে করে না। পরে ঝামেলার সময়ে শ্যন মনে করিয়ে দেয় যে, সে অ্যালেক্সকে থাকতে দিয়েছে, খেতে দিয়েছে, সব খরচ চালিয়েছে অথচ অ্যালেক্স এত অকৃতজ্ঞ যে সেসব কিছুই মনে না রেখে শুধু তার অপারগতার কথাই মনে রাখছে আর দুনিয়াকে জানাচ্ছে! মেয়েকে দেখার জন্যই যে অ্যালেক্সের বাড়িতে থাকা, সেটা সে বেমালুম ভুলে যায়! তা রাগের মাথায়, পুরুষ মানুষ তো এমনটা করেই থাকে! ঠিক কিনা?
অতএব, শস্তায় ভর্তুকি দেওয়া ফ্ল্যাটে থেকে, মেয়েকে ভর্তুকি দেওয়া ডে-কেয়ারে রেখে অ্যালেক্স কাজে যায়। কিন্তু ভয়ানক ড্যাম্প ধরা ঘরে এদিকে মেয়ের জ্বর এসে যায়, সর্দি বসে যায় এবং দেখা যায় ঘরের দেওয়ালে পুরো ভেজা ভেজা সংক্রমণ হয়ে রয়েছে! আবার অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে নিজের বাবার কাছে যায় সে। এবং অবশেষে মগ্নচৈতন্যে থাকা কুঠুরির দমবন্ধ অন্ধকার তার চেতন আলোকিত করে। তার মনে পড়ে যায় যে, সে ছোটবেলায় রান্নাঘরের দেওয়াল আলমারির পাল্লা খুলে লুকিয়ে থাকত- যখন এই বাবা, এই বাড়িতেই
চেঁচামেচি, বাসন ছোঁড়া, এবং মাকে মারধোর করত। হ্যাঁ, তার মাও আসলে পারিবারিক হিংসার শিকার। বরের হাতে মার খেয়েও, তার শিশু মনে ছাপ যাতে না পড়ে -তাই মুখে আঘাত আর রক্ত ঝরা নাক নিয়েই বেচারি মা, ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়ে রান্নাঘরের আলমারিতে লুকিয়ে থাকা শিশু অ্যালেক্সকে প্রবোধ দিয়ে শান্ত করে বাড়ি ছেড়ে ছিল তাকে নিয়েই।
অ্যালেক্স তার লড়াইয়ে পথে নেমে নিজের মাকেও আবিষ্কার করে। বুঝতে পারে যে কিভাবে মা একা তাকে বড় করেছে। আপাত উদাসীন, বেপরোয়া শিল্পী সত্ত্বার আড়ালে মায়ের প্রকৃত অসহায়তা উপলব্ধি করতে পারে। প্রখর আত্মসম্মান বোধ নিয়েও বারবার ভালবাসতে চেয়ে পুরুষের কাছে আত্মসমর্পন করে প্রতারিত হওয়া, তবু কিছুতেই হেরে যেতে না চাওয়া মায়ের ওপর, বড্ড মায়া হয় তার।
“মেইড” দেখতে দেখতে দর্শকেরও কোথাও একটা আলগা মায়ার রেশ তৈরি হয় অ্যালেক্সের ওপর, ম্যাডির ওপর, আর সেই প্রতিটি মেয়ের ওপর যারা বার বার ফিরে ফিরে যায় পরিবারে আর আবার ফিরে আসে বিপর্যস্ত হয়ে ‘শেল্টার হোম” এ। অ্যালেক্স অবাক হয়ে যায় শুনে যে, প্রথমে এই হোম বা আবাসনে ঢুকেই যে মেয়েটি তাকে শেখায় যে নিজের পাওনা হকের টাকা ছাড়তে নেই, আর যার জন্য তার মনের জোর অনেকটাই ফিরে আসে, সেই মেয়েটি- যার সন্তানকে দেখতেই দিচ্ছে না তার বর…সে আবার তার সেই বদমেজাজি বরের কাছেই ফিরে গেছে! তখন, আবাসনের ভারপ্রাপ্ত মহিলা বুঝিয়ে বলে যে, একেবারে বেরিয়ে আসা কি এতই সহজ? কেউ কেউ সাত বার, কেউ নয় বার, কেউ পাঁচ বার, কেউবা আবার তেরোবারের বার হয়তো পুরোপুরি বেরোতে পারে – কখনো একা, কখনো সন্তান নিয়ে! তার নিজেরও বেশ কয়েকবার লেগেছে পাকাপাকি ভাবে বেরিয়ে আসতে!
সত্যিই তো! “কেন পড়ে আছ এই সংসারে? আত্মসম্মান থাকলে বেরিয়ে যাও”- এমন কথা তো বলি আমরা অনেকেই অনেককে। কিন্তু আসলেই, এমনকি বহু উপার্জনক্ষম নারীর পক্ষেও এক কথায় বেরিয়ে যাওয়া এত সহজ নয়…তা একটা ক্রম পদ্ধতির ভেতর দিয়েই অর্জন করতে হয়। আশৈশব লালিত, নীড় বাঁধার যে ইচ্ছে বাস্তবায়িত হয় একদিন, তা বাধ্য হয়ে ছেড়ে আসার রক্তক্ষরণও ততটাই বাস্তব! বহু মেয়েরই- তথাকথিত স্বাবলম্বী মেয়েদেরও, নিজের ভালোবাসার সঙ্গী, নিজের সন্তান, নিজের সংসারের মায়ার বাঁধন ছিঁড়ে পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে যে নয়- দশ - তেরোবারের এমনকি তারও বেশি কষ্টসাধ্য চেষ্টা লাগতে পারে –এই সত্যিটুকু উপলব্ধি করা যায় “মেইড” দেখলে।
“মেইড” সিরিজটি দেখতে দেখতে আরো মনে আসে রাষ্ট্রীয় পরিষেবার বিষয়টি । ভাবা যায় এখানে, এই উপমহাদেশে, পারিবারিক হিংসার ফলে শারীরিক-মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত, মনোবল
আর আত্মবিশ্বাস তলানিতে গিয়ে ঠেকা মেয়েদের জন্য, এমন কোন নিরাপদ থাকার জায়গার কথা! যেখানে থাকা যায় সন্তান সহ! যেখানে পরিষ্কার আলো বাতাস রয়েছে! আলাদা ফ্ল্যাটের মত ব্যবস্থা এবং দোরগোড়ায় খাবার! সঙ্গে প্রয়োজনমত চিকিৎসা, আইনি পরামর্শ আর মনোবিদের সাহায্য? এমনকি সেখানে দোকানও (ছদ্ম) রয়েছে জামাকাপড়ের! আসলে দোকান নয়, অনেকের দান করা পোশাক অথবা অর্থ সাহায্যে কেনা বিভিন্ন মাপের পোশাক সেখানে সাজানো আছে দোকানের মত, কারণ অধিকাংশ মেয়েই এক বস্ত্রে চলে আসে। নকল দোকানের নকল কাউন্টারে নকল টাকা দিয়ে কেনা জামা, সুন্দর করে ব্যাগে গুছিয়ে দেয় কর্মরতা মেয়েটি। মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়া মেয়েদের দয়ার দান নিতে যেন আত্মসম্মানে আরও আঘাত না লাগে, তাই একটু ভালো বোধ করানোর উদ্দেশ্যেই এই নকল দোকানদারি। কিন্তু কাজ হয়। সত্যি সত্যিই ওদের মধ্যে একটা ভালোলাগা কাজ করে। দেখতে দেখতে আমারও ভালোলাগে আর খালি মনে পড়ে, আমার দেশের হতভাগ্য সেইসব অগুন্তি অজস্র মেয়েদের কথা, মায়েদের কথা -যারা শুধু মাত্র একটা নিরাপদ মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের অভাবে, প্রতিনিয়ত তিলে তিলে
মরে যায় মার খেতে খেতে, ভয় পেতে পেতে…সন্তান, পরিবার, সমাজ সবার ‘সম্মান’ রক্ষার দায় নিতে গিয়ে, নিজে অসম্মানের পাঁকে ডুবে গিয়ে দম বন্ধ হয়ে মরেই যায়। শিশু সন্তান নিয়ে আবার কলেজে পড়ার কথা ভাবা তো দূরস্ত! তবু, এই তথাকথিত সুবিধেপ্রাপ্ত শ্রেনীর পরিবারে, নিরুচ্চারে হয়ে চলা পারিবারিক হিংসার সম্মুখীন হতে হয় যে সব মেয়েদের প্রতিনিয়ত, তারা হয়ত দেশ কাল ভেদে এই দিকটাতে অনেকটাই একাত্মবোধ করতে পারবে অ্যালেক্সের সঙ্গে।
সিরিজের শেষে, শ্যন স্বীকার করে যে, সে তৈরি নয় এখনো ম্যাডির দায়িত্ব নেওয়ার জন্য। নিজের উগ্র আক্রমণাত্মক ব্যবহারে নিজের মায়ের ছায়া দেখতে পায় সে এবং প্রস্তুতি নেয় নেশার আসক্তি থেকে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠার! অ্যালেক্স আন্তরিক ভাবেই স্বীকার করে যে শ্যন খুব ভালো বাবা এবং সে সুস্থ হয়ে যখন চাইবে, তখনই ম্যাডির সঙ্গে দেখা করতে যেতে পারে। দুজনের চোখেই জল এবং দুজনেই বাস্তব পরিস্থিতি বুঝতে পারে।
এই সাদা, কালো, ধূসর, রঙিন সবের মিশেলে তৈরি “মেইড”। অ্যালেক্সকে দেখে মনে হয় পাশের বাড়ির মেয়েটি। একা, অসহায় অবস্থাতে তার চোখ ভরে আসলেও সে মেয়েকে “অদৃশ্য -মেপল সিরাপ” বলে হাত ঘুরিয়ে প্যান কেকে সিরাপ দেওয়ার ভঙ্গী করে, মেয়েটিও খুশি হয়ে খেয়ে নেয়! স্নেহ, মমতা, মায়া কিছুই কম নেই তার। শ্যনের জন্যও তার কষ্ট হয়। আর এখানেই এই সিরিজের সার্থকতা। যে জটিল মানসিক দ্বিধা মেয়েদের বাধ্য করে পরিবার আঁকড়ে থাকতে, যে শান্ত, নরম মনের মেয়েটি আসলেই তার শিশু আর সঙ্গীকে নিয়ে ভালোবাসার বন্ধনের এক দুনিয়া নিজের করে পেতে চায়, তার প্রতি অনাবিল মায়ায় নিজেকে বুঝ দেয় –‘সব ঠিক হয়ে যাবে’ অথবা ‘আরেকবার শেষ চেষ্টা করে দেখি’ বলে … আর ভাগ হয়ে যায় দুটি সত্ত্বায়…তাদের এই অন্তর্দ্বন্দ আর টানাপোড়েন সোচ্চারে নয়, এসেছে সহমর্মীর দৃষ্টিভঙ্গী থেকে নীরবে। অ্যালেক্স ক্রমে বুঝতে পারে যে, তার সামনে ঘটা উগ্র আক্রমনাত্মক ব্যবহারের প্রভাবে যখন সে মানসিক নিরাপত্তার অভাব বোধ করছে- তার শিশুটির জন্য সুস্থ পরিবেশ দিতে পারছেনা … এবং তার স্নায়বিক সমস্যা হচ্ছে – তখন সেগুলোও পারিবারিক হিংসার আওতায় পড়ে।
এই যে ক্রমশ বুঝে উঠতে পারা নিজেকে, নিজের চাওয়া পাওয়া এবং নিজের জীবনের ঘটনাপরম্পরা সম্পর্কে ধারণাগুলো পরিষ্কার হয়ে ওঠা- এই সব মিলিয়েই “মেইড”। “মেইড” বা কাজের মহিলা বা সাফাই কর্মী হয়ে বিভিন্ন বাড়িতে প্রবেশ এবং তাদের আবর্জনা সাফাই করতে করতে বাস্তবকে আরও ভালো ভাবে চিনতে পারে অ্যালেক্স। আর সেই অভিজ্ঞতা লিখে রাখে তার ডায়েরিতে। এই কাজ করতে করতেই নিজের জট পাকিয়ে যাওয়া জীবনের অনেক বাড়তি আবর্জনাও সে সাফ করে ফেলতে পারে। আবাসনের আশ্রয়ে তাকে যখন মনোবিদের কাছে যেতে হয়, তখন সে শেখে কিভাবে হঠাত উদ্বেগজনিত আতঙ্ক বা ‘প্যানিক অ্যাটাক’ হলে সবথেকে ইতিবাচক, আনন্দের স্মৃতি মনে করে সেই আতঙ্ক থেকে মুক্তি পেতে হবে। জীবনের জট ছাড়াতে ছাড়াতেই শেষে অ্যালেক্স এগিয়ে চলে ম্যাডিকে নিয়ে তার ইতিবাচক আনন্দের রোদ্দুর ঝলমল গন্তব্যের দিকে।
“মেইড” এর মূল বার্তা দুটি - প্রথমত নিজেকেই বুঝতে হবে প্রচ্ছন্ন হিংসা এবং মানসিক অত্যাচারও পারিবারিক হিংসার আওতায় গণ্য হয় এবং দ্বিতীয়ত, একা লড়াই করতে শুরু করে দিলে, ক্রমে মনোবল টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করার মত অনেক নারীকেই পাশে পাওয়া যেতে পারে। প্রকৃতই সহমর্মী তারা, কারণ একইরকম তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়ে জীবনের হাল ধরতে পেরেছে। অদৃশ্য, অস্বীকৃত পারিবারিক হিংসার বিষয়টি একইরকম সূক্ষ্ণ, কিন্তু সুতীব্রভাবে অতি যত্নে, সহমর্মিতায় মানবিক ভাবেই তুলে ধরা হয়েছে এই সিরিজে। ভুল ত্রুটি বা সমালোচনার জায়গা নেই বললে ভুল হবে কিন্তু সিরিজ শেষে দেখি সহমর্মিতার রেশটুকুই মন ছুঁয়ে থেকে গেছে।