এক বন্ধু প্রথম ম্যাগাজিন বার করার সময়, আমাকে কবি ঠাউরে , কবিতা দিতে বলেছিলো। আমি ভারী খুশি হয়ে লিখেছিলুম,
মন, যদি, হায় , হতো আমার ঘুড়ির মতো
নীল আকাশে উড়তো স্বেচ্ছায়
কিন্তু লাটাই থাকতো আমার হাতে।.. ইত্যাদি
ঐটাই ম্যাগাজিনটির শেষ সংখ্যা ছিল। সে যাই হোক, কে যেন বেশ বলেছিলেন, you can kill the ideologist but not the ideology। ওটা মনে হয় ফিলোসফির ক্ষেত্রেও খাটে। তো, ম্যাগাজিন মরুক গে, আমার ওই ফিলোসফি যাবে কোথায়। থাকি ফরাসি দেশে, খেতে পাই মাগনার, আর সকাল বিকেল ঘুরে বেড়াই, মনটাকে আকাশে উড়িয়ে, লাটাই হাতে। আইফেল টাওয়ার চত্বরে ঢুঁ মারি ফী হফতায়। কোথাও কানে বাংলা, হিন্দি উর্দু পড়তে দেরি, চুপচাপ গিয়ে বলি, ওই গোরার ব্যাটা আপনাকে কি দেখাবে, ওর ওই উদ্ভট ফ্রেঞ্চ অ্যাকসেন্ট মেশানো ইংলিশ বুঝতে বুঝতেই তো ট্যুর শেষ হয়ে যাবে। আসুন, আমি দেখাচ্ছি আসল ফ্রান্স। (ওখানে গাইড হতে গেলে পার্মিট লাগে, যেটা আমার ছিল না, একবার পুলিশ ধরেও ছিল, নির্বিকার মুখে বলেছিলুম, দেশ থেকে আসা মেসো মাসিমাকে "তু দ্য'ফেল" ঘুরিয়ে দেখাচ্ছি, স্বাধীন ফ্রান্সে কি এটা অপরাধ?)। তাদের পয়সায় ঘুরে বেড়াতুম, মাইয়া দেখলে তারে একটু বেশিই মনোযোগ সহকারে বোঝাতুম (অর্থাৎ, ছাই উড়াইয়া রতন খুঁজিতাম আর কি, যদি কোথাও লেগে যায়) আর একটা কাজ করতুম, সেটাই বলবো বলে বসেছি।
বাঙালি মাত্র বিদেশে গেলেও দেশের খাবার খোঁজে। দিল্লী স্টেশনের বাইরে বাংলা সাইনবোর্ড যারা দেখেছেন তারা জানেন। মালিক হতে পারে রাজস্থানি, দুটো বাঙালিকে কাজে রেখে দিব্বি দু পয়সা করে খাচ্ছে। আমিও এতে দোষের কিছু দেখিনা। কথাতেই বলে, আপ রুচি খানা। যা পছন্দ হবে খাও, কে কি বলবে হ্যা ! তো, ওই গাইডগিরি করার সময়, কানে কানে ফিসফিস করে সাদেক মিয়ার হোটেলের (মানে ওই, রেস্টুরেন্ট, আমরা ওটাকেই হোটেল বলি) কথা বলে দিতুম। এই সাদেক মিয়ার কথা আগেও বলেছি, এনার মাইয়ারে আমি বাংলা পড়ানোর নাম করে গল্পগুজব করতুম হফতায় দুদিন। টুরিস্টদের বলতুম, দেশের কথা মনে পড়ে যাবে, ফেরার টিকেট দু দিন এগিয়ে আনতে হবে, এতো ভালো এর খাবার। কথাটা খুব একটা মিথ্যা ছিল না। এই যে নিয়ে যেতুম, তারা তো আর একা খাবে না। মাসিমা গোছের মহিলারা বলতেন, তুমিও বস বাবা। বাস, অকলমন্দ কো ইশারা হি কাফি হ্যায়। তার উপর, বুড়ো কাউন্টারে বসে গুনগুন করে গান গাইতো চমৎকার। পূর্ববঙ্গীয় গান। একবার বসিয়ে আমায় পল্লীগীতির মধ্যে ভাটিয়ালি কি বৈশিষ্ট্য দেখে আলাদা করতে হয় শিখিয়েছিলেন, আমি ঘোড়ার ডিম্ কিছুই না বুঝলে সে তো আর সাদেক সাহেবের দোষ নয়। সমঝদার বাঙালিরা বুড়োর গানের গলার তারিফ করতো খুব।
সে যাই হোক, এর ফলে, সাদেক মিয়া আমারে খাতির করতো বেজায়। মাঝে মাঝে কখনো নিজের পয়সায় খেলে, বিল নিতো প্রায় আদ্দেক। মানে, ওই আর কি, দেশোয়ালি রিলেসন গোছের হয়ে গিয়েছিলো। আমার তখন...ওই সাতাশ বছর গোছের, সাদেক মিয়ার বার্থ সার্টিফিকেট দেখিনি কিন্তু বেশক্ ষাটের ওপারে। মাঝে মাঝে কাজ ছাড়াই যেতুম। মাইয়ার নাম ছিল সিলভিয়া। সাদেক সাহেব বলতেন, এরা আমাদের নাম নিয়ে যা গোল পাকায়, সাহেবি নাম কি সাধে রেখেছি? সাদেকের স্ত্রীকে চাচী বলতুম, যদিও সাদেকরে সাদেক সাহেব বলতুম।
একদিন এমনই গেছি, এক বাঙালি পরিবারকে নিয়ে। গেছি বেশ দেরিতে, ওনাদের থাকার হোটেল কাছেই ছিল তাই পৌঁছে দিতে হলো না খাওয়ার পর। কাকু বেশ adventurous ভাবে বললেন, এই তো কাছেই, বেশ যেতে পারবো। আর যদি হারিয়েই যাই, ক্ষতি কি? এই সুন্দর পৃথিবীর আরেকটা রূপ না হয় আবিষ্কার করবো। বুঝলুম, ঘুরিয়ে দেখানোর সময় কাব্যি বেশি করে ফেলেছি, ইনফেকশন হয়ে গেছে। আর বললুম না, চাচা, এতো রাতে কোনো cul de sac (কানা গলি) এ ঢুকে পড়লে যে রূপ আপনি আবিষ্কার করবেন, সেটা না করলেই শান্তিতে থাকবেন।
ওনারা তো গেলেন, আমিও উঠবো উঠবো করছি সাদেক সাহেব চিল্লিয়ে বললেন, মাস্টারমশাই, তাড়া আছে? আমি এমন ভাবে তাকালুম যেন কোনো ভিখারিকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে তার ক্যাডিলাক আছে কি না। বললুম, তাড়া ? সে কি বস্তু? বললেন, বসো তবে, সিলভিয়ারে লইয়া কথা আসে। তাই হোক। খানিক বাদে সাদেক সাহাব আইলেন।
ধানাইপানাই ছাড়া বললেন, মাস্টার সাহেব (উনি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মাস্টার সাহেব আর মাস্টারমশাই এবং তুই আর তুমি বলতেন), দেশে যাবো ভাবছি। তুমি কি কও। আমি শুধু এইটুকু জানি, সাদেক সাহেবের দেশ মানে ময়মংসিংহর কাছে এক গ্রাম। সে আর যতই উন্নত হোক, প্যারিস তো নয়। জিজ্ঞাসা করলুম, কেন?
বললেন, সিলভিয়ার জন্য। লায়েক হয়ে উঠেছে, এখানে তো জানেন, কে বিয়ে করছে, কে লিভ টুগেদার করছে, কোন মাইয়া মাইয়ারে বিয়ে করছে, কে আগে বাপ্ হয়ে পরে বিয়ে করছে। আল্লাহ পাকের কাছে জবাব দিতে হবে যদি জেনেশুনে মাইয়াকে ওই রাস্তায় ঠেলে দিই।
প্রাচ্য বাপের আর্তিটুকু বোঝার এলেম কোথা থেকে পেলুম জানি না, সবটুকুই বুঝতে পারলুম। উনি বললেন, আপনি পুরুষমানুষ, আপনার এত চিন্তা নাই, তার উপর আল্লাহ পাক আপনাকে শিক্ষিত করেছেন (সেই মুহূর্তে প্রতিবাদ করিনি), কিন্তু আমি তো মাইয়ার বাপ্। তাই ভাবছি, দেশে ফিরে যাই, গিয়ে একটা লায়েক ছেলে দেখে সিলভিয়ার বিয়ে দিই।
আমি বললুম, সে ওখানে থাকতে পারবে? মানে, এখানে জন্মেছে, এখানে বড় হয়েছে।
গর্জন করলেন সাদেক সাহেব, পারবে না মানে? ওর বাপ্ পারবে। তারপর বুঝলেন কথাটা ওনারই উপর বসে। হেসে ফেললেন।
হাতটা ধরে বললেন, মাস্টারমশাই, আপনার কথা সিলভিয়া খুব মানে (সে তো মানবেই, গাঁজাখুরি যত গল্প ওকে শোনাই), আপনি ওকে একটু বুঝিয়ে বলুন, ওর মা একটু আকারে ইঙ্গিতে বুঝছিয়েছিলো, মেয়ে খেপে লাল।
কথাটা ফেলতে পারলুম না. জানি আমাকেও উড়িয়ে দেবে ও মেয়ে, কিন্তু, কপাল ঠুঁকে একবার বলে দেখবো।
পড়ানোর কথা তার দু দিন পরে। গেলুম, তার আগে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, নকল ব্যারিটোনে, হাত পা নেড়ে উত্তম রূপে প্রাকটিস করিচি, কী কী নীতিজ্ঞান শুনিয়ে ভাসিয়ে দেব মাইয়ারে। চাচী দরজা খুললেন, মুখে এক গাল হাসি। বললেন, আসেন আসেন। তখনই বুঝলুম উনি উত্তেজিত। নাহলে আমাকে তুমি বলেন উনি। আমি বললুম, কি ব্যাপার? আকাশে বাতাসে এতো খুশির হাওয়া কেন? দেখি ভিতরে সাদেক সাহেব। আমি অবাক। এখন তো ওনার থাকা উচিত রেস্টুরেন্ট এ, থুড়ি, হোটেলে।
বললেন, আল্লাহ কি থেকে কি করে দেন, তিনিই জানেন। আমি বললুম, খোলসা করেন। সোফায় বসিয়ে বললেন, মাস্টারমশাই, কাল রাতে লঙ্কা কান্ড হইসে। বললুম, কি রকম?
যা বললেন, তার মোদ্দা কথা হলো, কাল রাতে বাপ্ বেটিতে বেজায় ঝগড়া হয়েছে। মাইয়া ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম, বাপও তাতে খুশি। মা (মানে মিসেস সাদেক, চাচী) একবার একে সামলেছেন, একবার ওকে সামলেছেন।
বললুম, এতো তো ভয়ানক ব্যাপার। তারপর?
সাদেক সাহেব মাঝে চোখে হাসি মেখে বললেন, আরে শুনুন না মাস্টার সাহেব, মাইয়া বলে, বাংলাদেশিরা কি জানে প্রেম কি। একটা মহিলা পেলেই হলো, যে রান্না করবে আর সন্তান উৎপাদন করবে। তখন মাইয়ারে বললুম, বাংলাদেশির প্রেম কেমন জানিস? তবে তোর বাপের কথা শোন্। বলে, নিজের কথা প্রেম কথা বললুম। শুনে মাইয়ার মুখ হাঁ।
আমি বললুম, আমার মুখ হাঁ করে দিন। আমারও চাচির দেওয়া কেকগুলো টপাটপ মুখে ভরতে সুবিধা হবে।
অট্টহাস্য করে সাদেক সাহেব বললেন, তুই আমাকে চিনিস কদিন? আমি কি এই হোটেলের আসল মালিক নাকি?
আমি বললুম, তবে? বললেন শোন্, আমি রাঁধুনি ছিলুম বটে, তবে দেশে বিয়েশাদীতে রাঁধতুম। আর কেউ কোথাও ঘুরতে গেলে বাবুর্চি হিসাবে নিয়ে যেত। সে করার জন্য অবশ্য পকেটে রেস্ত থাকতে হয়।
আমি বললুম, mais oui (অফ কোর্স )।
বলে চললেন, আমি তখন ওই কাজ করি, এমন সময়, তোর চাচীরা ফ্রান্স থেকে দেশে বেড়াতে গেলো। সে আজ থেকে ধরে নে চল্লিশ বছর আগের কথা। ওর বাপের এই হোটেল। তোর চাচী এক মেয়ে। দেশে ফিরে ঘুরতে গেলো কক্সবাজার, আমারে নিয়ে গেলো। বুড়োর ব্যাটা বলে, ফ্রান্সে রাঁধি বলে কি দেশেও রাঁধবো নাকি। ছুটি কাটাতে এয়েচি, ছুটিই কাটাবো। তাই আমারে বেঁধে নিয়ে গেলো।
ওরা ঘুরে বেড়ায়, আমি পাকাই আর সমুদ্রের ধরে বসে থাকি, একটা গুন্ ছিল, ভাটিয়ালি গাইতুম চমৎকার। অনেকগুলো গীত জানতুমও বটে। একদিন একা বসে ভাটিয়ালি গাইসি, তোর চাচী শুনে ফেললো। আমারে কয়, বেশ গান আপনি। সে তখন তোর চাচির বাংলা শুনলে তুই হেসে কুটোপাটি করতিস। যাই হোক, অনুরোধ করলে যখন, অনেকগুলো গান শুনালুম। মাইয়ার আমারে মনে ধরে গেলো। যাবার সময় বলে গেলো, চিঠি লিখবো। তখন তো আর ইন্টারনেট ছিল না, আর ওই চিঠির মূল্য ইন্টারনেট এর চ্যাট এ পাবিও না। আর আমার ফোনও ছিল না। তোর চাচির বাসায় ছিল বটে, তবে ওই কল করার দম আমার ছিল না।
চিঠি লেখা, দেখেই বুঝতে পারি, অনেক কষ্টে বাংলায় লিখেছে মাইয়া। যেগুলো একদম বুঝতে পারি না, সেগুলো উত্তর লেখার সময় জিগাতুম। আমারে একটু একটু ফ্রেঞ্চ শিখাতো। এমন করে করে, একদিন আর থাকতে পারলুম না, লিখলুম, বিয়ে করতে চাই। বেশ জানতুম, এটাই শেষ চিঠি আর কোনো উত্তর আসবে না। নিজেকে ডুবিয়ে রাখতুম কাজের মধ্যে, কিন্তু মনে বার বার ভেসে উঠতো কক্সবাজারে, সমুদ্রের ধারে বসে, পিছনে তাকিয়ে দেখা সেই মাইয়ার মুখ। বুক হু হু করে কাঁদতো, ভাটিয়ালিতে নিজেকে ভোলাতুম।
কিন্তু এসেছিলো রে এসেছিলো। মাইয়া লিখেছিলো , বাংলাদেশে তো আমারে আব্বা যেতে দেবে না, তুমি এখানে এস। আমি অপেক্ষা করবো।
ফ্রান্স বানান জানতুম না তখন, তোর মতো তো এলেমদার নয়, আদার ব্যাপারী। ফ্রান্সের খবর জেনে কি করবো? ঢাকায় গেলুম। খোঁজখবর নিলুম। হালার পোলারা কয়, আরব যাও, দুবাই যাও, এক্ষুনি কাজে লাগিয়ে দিচ্ছি। মাইনে দেবে, থাকা খাওযা দেবে। কিন্তু আমার এক জেদ, যাবো তো ফ্রান্স, নইলে নয়।
আমি বললুম, তারপর?
বললেন, ঢাকার একটা কাপড়ের ফ্যাক্টরিতে কাজে লাগলুম, তোর চাচীরে চিঠি লিখে বললুম, যেতে দেরি হবে, অপেক্ষা করো। আর নতুন ঠিকানা জানালুম। হর শুক্রবার ছুটি, নামাজ পরে আল্লাহর কাছে চাইতুম, আর এজেন্টগুলোর কাছে গিয়ে বলতুম, কিছু খবর এলো?
এই করে করে আমার কেটেছে, তা প্রায় ছয় মাস হবে। একদিন এক এজেন্ট বললো, একটা খবর আছে কিন্তু ট্যাহা লাগবে অনেক। তখন ওরা দুবাই পাঠায় দুই হাজার টাকায়, আমার কাছে চাইলো দশ হাজার টাকা। আমার মাইনে শুনবি? ছশো টাকা। বললো, দু মাস সময় আছে, তার মধ্যে যা করার করতে হবে।
তোকে লম্বা গল্প শুনিয়ে বিরক্ত করবো না, মোটের উপর, আমার বাপের ক্ষমতা ছিল না ওই টাকা দেওয়ার। আবার গেলুম এজেন্ট এর কাছে। বললুম, এত টাকা দিতে পারবো না। শুনে চুপ করে রইলো। খানিক ভেবে বললো, শোন্, ইঞ্জিন রুম এ কাজ করতে পারবি? আমি জানতুমই না, ইঞ্জিন রুম কি জিনিস। বললুম বেশ পারবো। বললো, সাদেক, আচ্ছা আচ্ছা ভীমসেন সেই রুম এ অজ্ঞান হয়ে যায়। আমি বললুম, পারবো বলেছি তো পারবো, এক বাপের ব্যাটা সাদেক মিঞা।
বললো, আচ্ছা, আমাকে তুই চার হাজার টাকা দে। চাটগাঁ থেকে মালবাহী জাহাজ যাবে, তাতে তোকে লাগিয়ে দিচ্ছি। মাইনে তেমন না, কিন্তু হাড়ভাঙা খাটুনি। আমি বললুম, সে ঠিক আছে, কিন্তু ফ্রান্স এ গিয়ে করবো কি? বললো, সে শিখিয়ে দোব। তোর চাচীকে চিঠি লিখলুম, আসছি আমি। জবাব এলো, শুনেছেন আল্লাহ এই পাপীর দোয়া।
যে যাত্রা, মনে হলো আল্লাহ আমার গোনাহের জন্য দুনিয়াতেই আমাকে জাহান্নামে ফেলেছেন। একটা একটা দিন শেষ হতো, শরীর টেনে নিয়ে যেতে পারতুম না থাকার রুমটায়। তার ওপর জাহাজে চাপিনি কোনো দিন, গা গুলাতো সর্বক্ষণ, বমি করতুম প্রথম প্রথম. তারপর, অভ্যাস হয়ে গেলো। তোর চাচির পুরানো চিঠি গুলো পড়তুম, আর একটা ফটো পাঠিয়েছিল একবার, সেইটা দেখতুম। জাহাজে তো আর চিঠি আসে না।
তোর চাচী চেয়েছিলো রিসিভ করতে। এজেন্ট এর কথা মতো, পাসপোর্ট ছিড়ে ফেলে দিয়েছিলুম ওই সমুদ্রের পানিতেই। দেশের শেষ চিহ্ন বলতে থেকে গিয়েছিলো শুধু এই বুকের মাঝে বাংলা ভাষা। তাইতো তোরে বলি, সিলভিয়ারে শেখা বাংলা ভালো করে, ঐটা মা রে।
যাই হোক, তোর চাচী নিয়ে গেলো বাপের কাছে কিন্তু বিয়ে করবো বলে নয়। গল্প ফেঁদে বাপকে বললো আমাকে কাজে নিতে। বুড়ো তো আমাকে দেখে অবাক। বললুম, দেশে কাজ নাই, খেতে পাই না, তাই এসেছি। বাকিটা সত্যি বললুম, খালি ওই চিঠির কথাগুলো বাদে। ওসমান সাহেব, মানে তোর চাচির বাপ, আমার হাতের খানা খেয়ে খুব তারিফ করেছিলেন। ওইগুলো বললুম, আর পায়ে পড়লুম। রেখেছিলো বুড়ো কাজে।
আমি বললুম, তারপর?
সাদেক সাহেব বললেন, তারপর আর কি.. সে তুই আন্দাজ করেই নিতে পারবি। পড়িস তো অনেক কিছু শুনিচি।
আমি ছাড়ার পাত্র নয়. বললুম, পাসপোর্ট তো ছিড়ে ফেললেন, ওটার কি হলো?
হেসে বললেন, সাদা চামড়া ঘুষ খায় না বলছিস? যা, চাচী পায়েস করেছে, খেয়ে নে।
উঠে ভিতরে গেলুম, ডাইনিং রুম আর ড্রয়িং রুম একই। চাচী সেখানেই ছিলেন। মুখের হালকা হাসি আর নিচু চোখ দেখে বুঝলুম সবই শুনেছেন বুড়ি। আমায় বললেন, ওই যত্ত সব আজেবাজে গল্প শুনে মাইয়া ঠান্ডা হয়েছে। দেশে যাবে বলেছে, আর বলেছে, ভেবে দেখবে। একবার যাক, নিশ্চই ওর আব্বা ওকে রাজি করতে পারবে।
আমি বললুম, সিলভিয়া কই ? বললেন, সে আজ বেরিয়েছে , বন্ধুদের সাথে। বারণ করিনি। ঘুরে নিক, এই তো বয়স। একবার গেলে আবার কবে আসবে, ঠিক নেই। আমি বললুম, আমিন, সুম্মা আমিন।
অনেক পরে, দেশে ফিরে এক বার খোঁজ নিয়েছিলুম, বাংলাদেশে সুখে আছে সিলভিয়া। একটি মেয়ে হয়েছে, নাম রেখেছে, শ্রাবন্তী।