প্লিনি বিপদের গন্ধ পেলেন। তিনি প্রকৃতিবিদ। হাওয়ার গতি, মেঘের রঙ, আলোর তেজ তাঁকে অনেক কিছু বলে দেয়। সেদিনটা আর পাঁচটা দিনের মতই ছিল। রৌদ্রকরোজ্জ্বল। রোমের নেপলস উপসাগরের কোলে মিসেনাম অঞ্চলের নৌ সেনাপ্রধান প্লিনি। তিনি রোদ্দুর মেখে মেখে খোলা হাওয়ায় ঠাণ্ডা জলে চান করলেন। বেশ আয়েশ করে দুপুরের খাবার খেলেন। তিনি শুধু নৌ এবং সেনপ্রধান ছিলেন না। তিনি একজন পন্ডিত এবং লেখক। প্রকৃতিবিদ, ঐতিহাসিক এবং দার্শনিক । তাঁর দাদার স্ত্রী অর্থাৎ প্লিনির বৌঠান যখন তাঁকে ডেকে বললেন,
প্লিনি ঠাকুরপো, এদিকে এসো একবার, ওইদিকে দ্যাখো, ওটা কী? ওই দূরে? ছাতার মতো? দেখতে পাচ্ছো?
প্লিনি লেখাপড়া নিয়ে বসবেন, ভাবছিলেন। হাঁক ডাক শোনার পর তিনি একটা উঁচু জায়গায় উঠে দেখতে লাগলেন ওই ছাতার মতো ব্যাপারটিকে। খুব ভালো ঠাহর হচ্ছিল না। কিন্তু দেখলেন ছাতাটা ক্রমশ বড় হচ্ছে। ঠিক এই অঞ্চলের ছাতা পাইনের মাথার মত ঝাঁকড়া। শুঁড়ের মত অনেক গুলো কুণ্ডলি বেরিয়ে আসছে।
প্লিনি বিপদের গন্ধ পেলেন। তাঁর মনে হল একটা নৌকো নিয়ে কাছে গিয়ে দেখা দরকার। বেরুতে যাবেন,ঠিক সেই সময়ে তাঁর বন্ধু টাস্কাসের স্ত্রী রেকটিনা একখানা জরুরি চিঠি পাঠিয়েছেন, পাশের দ্বীপ স্টেবিয়া থেকে। রেকটিনা লিখেছেন, আমাদের বাঁচান, যে ভাবেই হোক। জাহাজ করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভেসে পড়তে হবে।
এক মুহূর্ত দেরি না করে প্লিনি জাহাজ নিয়ে রওনা দিলেন। জাহাজ যত এগুচ্ছে গরম ছাই এসে পড়ছে। কালো থকথকে ধোঁয়া, টুকরো টুকরো ঝামা পাথর। জ্বলন্ত।
খেপে উঠেছে ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরি। পাথর আর ছাই এ আটকে গেছে উপসাগরের পথ, জাহাজ এগুতে পারছে না। প্লিনি অসম্ভব দক্ষতায় কোনোমতে বন্ধুর বাড়ির পথে জাহাজ ভিড়োতে পারলেন। উদ্বিগ্ন ও ভীত বন্ধু পরিবারকে সাহস দিলেন। সঙ্গীসাথী সবাইকে বললেন, ধুর, এতো ভয় পেলে কী চলে? চাষিরা বনবাদার পুড়োচ্ছে বা কারুর বাড়িতে আগুন লেগেছে বোধহয় ।
কিন্তু মনের মধ্যে আশঙ্কা চেপে রেখে সবাইকে সাহস জুগিয়ে চলা শেষ পর্যন্ত আর সম্ভব হলনা তাঁর। দিন রাতের ফারাক বোঝা যায়না। গলগলে ধোঁয়ায় কালো আকাশ ! ছাইয়ের পুরু আস্তরণ। ভিসুভিয়াস ফুঁসছে এলোপাথাড়ি। সেই সঙ্গে ফুঁসছে সমুদ্রের জল, ঝড় ঝঞ্ঝা। বাতাসে তীব্র সালফারের গন্ধ ! দম আটকে আসছে। দম আটকে আসছে । দম আটকে আসছে।
ঠিক দুদিন পরে ২৬ শে অগাস্ট প্লিনির দেহ পাওয়া গেল। অক্ষত। অবিকৃত। যেন ঘুমিয়ে আছেন।
আর চারিদিক থেকে ভেসে আসছে চিৎকার আর চিৎকার । মেয়েদের কান্নার রোল। শিশুদের কান্না। চোখের জল, ভয় আর আতঙ্ক। নরক, যেন নরকের ছবি একটা।
২
ওপরের এই বর্ণনা এক প্রত্যক্ষদর্শীর। তাঁর নামও প্লিনি, তিনি জ্যেষ্ঠ প্লিনির ভাইপো। ৭৯ খ্রিস্টাব্দে আগ্নেয়গিরির লাভা আর ছাইয়ের তলায় চাপা পড়ে গেল ভিসুভিয়াসের পাদদেশে ঝলমলে বন্দর শহর পম্পেই। এবং হারিয়েও গেল। কনিষ্ঠ প্লিনির এই প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ অসামান্য এক দলিল হয়ে রয়ে গেল উত্তরসূরিদের কাছে।
পম্পেই সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত হল।প্রায় ১৬০০ বছর পম্পেই এর কোনো অস্তিত্ব ছিল না। এরপর একের পর এক প্রত্নতাত্ত্বিক খোদাই বের করে নিয়ে আসে সেই চাপা পড়ে থাকা শহরকে। সেই ভয়ানক লাভা, ছাই আর কাদা ঠাণ্ডা হয়ে জমে গিয়ে একটা পুরু আস্তরণের মধ্যে এই শহরের সব কিছুকে সময়ের হাত থেকে রক্ষা করে গেছে অদ্ভুত ভাবে। অনুমান প্রায় কুড়ি হাজার লোক চাপা পড়ে গেছিল।
পম্পেই এর তিনদিন ধরে এই রুদ্ধশ্বাস প্রলয়, লিটনের কলমে উপন্যাস হয়ে বেরুল লাস্ট ডেজ অফ পম্পেই। উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র সেই অন্ধ ফুলওয়ালিও অসম্ভব জীবন্ত হয়ে রয়ে গেলো সারা দুনিয়ার কাছে।
পম্পেই সমেত আরো দুটি শহরের এই ভয়ানক পরিণতির পরের বছর রোমে তুমুল উত্তেজনার মধ্যে খোলা হল কলোসিয়াম। যুব সমাজকে তাতিয়ে খেপিয়ে দিল দামাল ষাঁড়ের লড়াই। রোমান সম্রাট টাইতাস কলোসিয়ামের প্রবেশ দ্বার অবাধ করে দিলেন। সঙ্গে দিলেন খাওয়া ফ্রি ! জনপ্রিয়তা চাই তাঁর। আর ওদিকে নিশ্চিহ্ন হতে থাকল বাণিজ্যের প্রাণ কেন্দ্র ক’টি বন্দর ! কেউ চেয়েও দেখল না !
৩
দেখো পাইন গাছের কেমন ঝাঁকড়া মাথা।
এমন পাইন গাছ তো আগে কখনো দেখিনি !
ইতালি সমেত অনেক মেডিতেরানিয়ান অঞ্চলের পাইন এমনই দেখতে হয়। যেন মাথার ওপর জমাট সবুজ ধোঁয়া। সেই সবুজ ধোঁয়ার মত এক মাথা দুঃখ নিয়ে গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে এক কালের বিলাসী শহরের পাঁচিলের ঠিক বাইরে। নেপলস থেকে আসছি। চকচকে নীল আকাশ। ঝকঝকে সূর্য। খসখসে ঠাণ্ডা। ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া পাইন। এবং অসম্ভব উদাস ভিসুভিয়াস। ভিসুভিয়াসের নীচে সানুদেশে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে স্তব্ধ শহর পম্পেই। এই অসামান্য ছবির দিকে তাকিয়েই সারাদিন কাটিয়ে দেওয়া যায়।
কিন্তু নেপলস উপসাগরের ধারে পম্পেই যে তার গল্প শোনাতে চায় ভিনদেশিদের। সেই ডাক শুনেই ভেতরে ঢুকলাম।
হেরিটেজ জায়গায় এলে আমার সঙ্গে নানান অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে। সম্প্রতি লখনউ ভুলভুলাইয়া তে একটা ছোট্ট দলের গাইড বলে উঠল, দেখুন এটা কিন্তু গোলমেলে জায়গা। কাজেই আমি একটা কোড নাম ডাকতে থাকব আর আপনারা ওই ডাক শুনে আমাকে অনুসরণ করবেন। সেই কোড নামটা হল সুপর্ণা দিদি ইইইই। যতক্ষণ আমরা ভুলভুলাইয়াতে ছিলাম সারাক্ষণই ওই কোড নাম এবং উচ্চারণের ফিসফিসানি রোমাঞ্চ উস্কে উস্কে দিচ্ছিল অন্ধকার সিঁড়ির অলগলির মধ্যে । কিন্তু চূড়ান্ত ব্যাপারটা ঘটলো এয়ারপোর্টে। পেছন থেকে কে চেঁচিয়ে উঠল সুপর্ণা দিদিইইইই। দেখি একটা পুঁচকে মেয়ে। আমাদের দলে ছিল সেদিন !
একটি বেশ বৃদ্ধ গাইড পম্পেই তে আমাদের সঙ্গে ছিলেন। তার নাম নিকোলাস। আমাদের কাউকে নয়, তিনি কেবল আমাকে পাকড়াও করে বললেন, আমি তোমাকে মারিয়া বলে ডাকবো, কেমন?
কাম, মারিয়া, দিস ওয়ে।
ফোরাম। ছড়ানো চাতাল। প্রশস্ত ফোরাম হচ্ছে মিটিং পয়েন্ট। বড় বড় নেতারা এখানে বক্তৃতা করতেন। এখানেই সবাই আলাপ আলোচনা করতেন। ঝগড়া তর্ক করতেন। সাধারণ মানুষ, বণিক সম্প্রদায়, সক্কলে। শহরের সবচেয়ে প্রাণবন্ত জায়গা। পম্পেই ছিল সমৃদ্ধ বন্দর আর বাণিজ্য কেন্দ্র। কাজেই কী পরিমাণ চিৎকার চেঁচামেচি এই জায়গায় হতো, তাই মনে মনে ভাবছিলাম। ভাবতে ভাবতেই মনে হল, এই যাহ্, আমাকে তো এখন বেকারি থেকে রুটি নিয়ে ফোরামের পাশে খোলা বাজারে আসতে হবে ! আজ যে খোলা বাজারের দিন ! জুপিটারের মন্দিরে ঘণ্টা বেজে গেলো।
আমি নিকোলাসকে বললাম, বেকারিতে নিয়ে চলুন তাড়াতাড়ি । আর কত ক্ষণ ফোরামে দাঁড়িয়ে থাকব? এদিকে দেরি হয়ে যাচ্ছে। পেট্রাস রেগে বোম হয়ে যাবে, যদি ঠিক সময়ে দোকানে রুটি না আনতে পারি !
নিকোলাস কী বুঝলো কে জানে। রুটি রুটি রুটি। পম্পেই শহরের সবচেয়ে বড় বেকারির সামনে এসে পড়লাম। বিশাল আভেন। পম্পেই ধ্বংসাবশেষের মধ্যে মাঝে মাঝেই চোখে পড়বে ছোট বড় আভেন। দানাশস্য রাখার বড়বড় পাত্র, শস্য পেষাই এর জাঁতা, বিশাল বিশাল জাঁতা। আর অবশ্যই চোখে পড়বে অজস্র অগুন্তি অ্যাম্ফোরা। এইসব মাটির পাত্রে থরে থরে রাখা থাকত জলপাই তেল, আঙুর থেকে বানানো মদ এমনকি দানাশস্যও।
আমি কিন্তু রোমান ছিলাম না। গ্রিক ছিলাম। আমি না ছিলাম প্যাট্রিসিয়ান, না ছিলাম প্লেবিয়ান। রুটির বেকারিতে কাজ করা এক গ্রিক দাসী মাত্র। প্যাট্রিসিয়ানরা দেশ চালাত, এদের নীচে প্লেবিয়ান। আর সবচেয়ে নীচে আমরা, ক্রীতদাস। গাধা বলদের পাশাপাশি একটা শ্রেণী, ক্রীতদাস। বেকারিতে প্রচুর খাটতে হত, দিন রাত এক করে। না করলেই মনিব পেট্রাসের মার !
বড়বড় ধনীদের তো কথাই নেই। আয়েশে আমোদে দিন কাটত। গ্রানাইট পাথরে বাঁধানো রাস্তা। রাস্তার মধ্যে রথের চাকা যাবার জন্য সমান্তরাল ভাবে ও সমান দূরত্বে উঁচু করে দেওয়া আছে। ফুটপাথ ও জলের লেড পাইপ। আর রোমান বাথ। রোমানরা কী নাইতে ভালোবাসে ! পাবলিক বাথ। ঠান্ডা জল, গরম জল। গরম বাষ্প। সবচেয়ে ভালোভাবে বোঝা যাবে স্টাবিয়ান বাথে। মাঝে মাঝে সারনো নদীর জল উঠে আসতো শহরে। ওই জলে একবার পা পিছলে গ্রানাইট পাথরের পথে পিছলে গেছিলাম। রুটির বাস্কেট হাত থেকে পড়ে গেছিল। আমার মনিবের কাছে কী মারটাই খেয়েছিলাম, মনে আছে।
আভেন থেকে গরম রুটি আর মাছের আচার গারুম, খুব লোভনীয়। গরম গরম রুটি, তাজা ফল রোমানদের চাইই চাই। বন্দর আর সমুদ্র এই শহরকে কত বৈচিত্র্য দিয়েছে। কত রকম লোক দেখতে পেতাম। ফোরামের বাজার ভরে থাকতো রাশি রাশি জিনিশে। মন্দ ব্যাপারও কম ছিল না। আমার বরাত ভালো রুটির বেকারিতে কাজ করতাম। মারধোর খেতাম।সেটাও ভালো ছিল কারণ বেশীর ভাগ ক্রিতদাসীরা ভিনদেশি বণিক আর রোমানদের সঙ্গিনী হত। সেই সব ঘরের ধ্বংসাবশেষ পম্পেই তে আছে । ভাল্লাগে না দেখতে ! যে দেশে এতো ধনী আর এতো ব্যাবসায়ী ছিল, মেয়েরা তো সেখানে প্রমোদের উপকরণ মাত্র।
বেকারির তাজা রুটি আমরা বড়লোকদের বাড়িতেও পৌঁছে দিতাম, জানেন। এভাবেই দেখে নিয়েছিলাম এখানকার বড়লোকদের বাড়ি।
গাইড নিকোলাস গলা তোলে, এই বাড়িটা দেখুন। পড়তে পারছেন কী লেখা আছে? লেখা আছে স্বাগতম।
মোজেইক।
বড়লোকদের ভিলা। যান ভেতরে ঘুরে ঘুরে দেখুন। মারিয়া, যাও যাও। ঘুরে এস।
মারিয়া ডাক শুনে আবার চমকে উঠালাম। রুটি বাস্কেট নিয়ে এই বাড়িতে বার কয়েক এসেছি। ভেতরে কোনো দিন ঢুকিনি। আজ ঢুকলাম। কী বৈভব, কী প্রাচুর্য ! দেওয়াল জোড়া ফ্রেস্কো।ম্যুরাল। বড় বড় টানা বারান্দা। শ্বেত পাথরের বসার জায়গা, শ্বেত পাথরের ফোয়ারা। ইতালির এই দিকে গরম বেশি। তাই আঙুর লতার মাচানের নীচে সকালবেলায় ওই শ্বেতপাথরের চেয়ারে বসে আমারই হাতে বানানো রুটি,মধু,গারুম আর মাখন দিয়ে খেত হয়তো ওরা। দাস দাসীদের মুখে শুনেছি হামেশাই বড় বড় জমকালো পার্টি হত। কত আমোদ প্রমোদ। ঢলাঢলি। প্রমোদে ঢালিয়া দিনু মন। একদমই তাই। কত যে মদের দোকান ছিল এখানে। ছিল বার, ট্যাভারন, সরাইখানা এবং ক্যাফে।
জুপিটার, আইসিস আর আপোলোর মন্দির যেমন ছিল সেরকমই সুরার দেবতা ব্যাক্কাসকেও পুজো দিত এরা।
নিকোলাস আমাদের মোজেইক দেখাচ্ছে। ৭৯ খ্রিস্টাব্দের মোজেইক। অনেক কাজ নষ্ট হয়ে গেছে। দুষ্প্রাপ্য কিছু কাজ রাখা আছে মিউজিয়ামে। ব্রিটিশ মিউজিয়ামে। অনেক মোজেইকের ওপরে ফাইবারের ঢাকনা দেওয়া। পায়ে হাঁটতে মানা। বড্ড সুন্দর। নীল আর লাল রঙ গুলো চোখ টানছে খুব। বড় সুন্দর পোশাক, বড় সুন্দর গয়না। স্তম্ভ গুলোতে করিন্থিয়ান আর্ট। খুব খুব সুন্দর। ঘরের ভেতরে হোমারের ইলিয়াডের ছবি আঁকা। ধনী গৃহের অপরূপ মর্মর কারুকাজ। কোন বাড়ির ঢোকার মুখে স্বাগতম লেখা, কোনো বাড়ির ঢোকার মুখে চেইন বাঁধা কুকুর, কুকুর হইতে সাবধান, লেখা আছে।
সেখান থেকে অ্যাম্ফিথিয়েটার। প্রায় পুরো পম্পেই এর লোকজন ধরে যাবে এতো বিশাল ! জিমনাশিয়ামে গ্লাডিওটার ঘাম ঝরিয়ে ব্যায়াম করে অ্যা ম্ফিথিয়েটারে রক্ত ঝরানোর জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।
ব্যাসিলিকা, তার বিশাল বিশাল থাম, বিপুলায়তন অট্টালিকার কথা মনে করায়। এটাই ছিল শহরের প্রশাসন দপ্তর।
দেবতার সঙ্গে সম্রাটকেও পুজো করত রোমানরা। আবার পম্পেই এর সেই দেওয়াল লেখা বা গ্রাফিত্তিতে সম্রাট কে গালাগালিও দিত। হাবিজাবি, অশ্লীল, রসিক, গম্ভীর কত মন্তব্যই যে দেয়ালের গায়ে লিখে রেখে গেছে ! এবং সেগুলোর থেকে একটা বিষয় খুব প্রকট। কী চূড়ান্ত অকপট ছিল এরা !
একটা দেওয়ালে লেখা আছে, ওহে দেওয়াল, তোমার গায়ে এতো আজেবাজে কথা লিখে রাখা আছে।আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি তুমি এখনো ভেঙে পড়ছো না কেন?
পম্পেই এর পাথর বাঁধানো রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়,এ পথে তো হেঁটে গেছি। শুনেছি দেখেছি জমকালো শহরের কত খণ্ডচিত্র। আজ সিনেমার রিলের মত যেন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছি। গাইড নিকোলাসের দেখানো পথের প্রত্যেক কোণে কোণে, ধ্বংস স্তূপের মধ্যে সেই হারিয়ে যাওয়া সময় ফিরে এলো যেন।
নেপলসের লোকজনেরা বলে খোদ নেপলস শহরের নিচেও নাকি আরেকটা শহর চাপা পড়ে আছে। পম্পেইতেও তাই।
খনন কাজ এখনও চলছে। জমে যাওয়া ছাই কাদার আস্তরণ সরিয়ে আবিষ্কার হচ্ছে বিস্ময়কর সব ফ্রেস্কো। কাদার জমাট তাল থেকে বেরিয়ে আসছে হাঁসকে জড়িয়ে থাকা সুন্দরী।
৪
তারপর একদিন ফাঁসির দড়ির নীচে ছিল উৎসবের রাত। কখন যে এসেছে ঘাতক, কেউ জানতে পারেনি।
বড় বড় জাহাজে করে কেউ কেউ পালিয়েছিল কিন্তু ভিসুভিয়াসের সঙ্গে সমুদ্রও রাগে গরগর করছিল সেদিন ।
সবাই যে যার কাজ করছিল। কেউ কেউ হল্লা করছিল। গুলতানি করছিল। মা, বাচ্চাকে খাওয়াচ্ছিল। কেউ কূটকচালি করছিল, কেউ বা হিসেবনিকেশ। হয়তো গান গাইছিল কেউ ট্যাম্বুরিন, বাঁশি, লায়ার আর কর্তাল (Cylas)বাজিয়ে।
কেউ ভালোবাসছিল, কেউ ঝগড়া করছিল। আমি রুটি বেক করছিলাম। আচমকা ছাই, জ্বলন্ত পিউমিস পাথর,গরম কাদা, লাভা আর সালফার ঢেকে দিল আমাদের। প্রাণভয়ে পালানোর আতঙ্কটুকুও নষ্ট হয়নি। সময় সবটুকু ধরে রেখেছে। যন্ত্রণা ক্লিষ্ট মুখের রেখাও।
না, পম্পেই কে মৃত শহর বলতে মন চায় না। সেই মৃত্যু বড় বাঙময়। পম্পেই এর ভাঙা পথে জীবনের প্যাশন টা বড় বেশি চোখে পড়ে।
একটা ছোট্ট বাড়িতে খোদাই করা আছে, প্রেমিকরা সব মৌমাছির মত,তারা চায় জীবন হোক মধুময় ।
পথের পাশে চোখে পড়বে থারমোপোলিয়াম, সোজা কথায় ফাস্ট ফুড জয়েন্ট। থারমো শব্দ থেকেই বোঝা যায় এখানে গরম গরম খাবার মিলত। বড়বড় মাটির গামলায় খাবার রাখা থাকত। সামনে একটা ডেস্কের মত জায়গা। পথ চলতি মানুষ টুক করে কিনে খেত এইসব দোকান থেকে। বেশির ভাগই সাধারণ গরিব মানুষ। অভিজাত রোমানরা খাবার দাবারে খুব বিলাসী। দোকান থেকে কিনে বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেতে হত। খেতে খেতে গল্পগাছা। মাছ আর চিজের পুর দেওয়া রুটি। মিষ্টি চাইলে ঘন মধু। আর ঝাঁঝালো মদ। এরকম একটা দোকানে সব রাখা আছে,যেমন টি ছিল, জল খাবার পাত্র, কেটলি, বাতিদান আর কাউন্টারে শেষ খদ্দেরের রেখে যাওয়া পয়সা।
রুমির একটা লাইন মনে পড়ে যায়,
বসন্তে বাগানে এসো বন্ধু,
আলো আর আনন্দ সাজিয়ে রেখেছি ।
তুমি যদি না আসো, তাহলে কিছু যায় আসে না
আর যদি এসেই পড়ো, তাহলেও কিছু যায় আসে না।