পুজো নানারকম। খবরের কাগজ আর টিভিতে পাবেন সেলিব্রিটির পুজো। সে পুজো সিনেমা রিলিজের। লাইফ স্টাইল ম্যাগাজিনে পাবেন সাজসজ্জার পুজো, খাওয়াদাওয়ার পুজো। গুরুর এবারের সিরিজ এসবের বাইরে অন্য পুজোর সন্ধান দেবে। যেখানে হয়তো আলো-টালো পৌঁছয়না। পৌঁছলেও অন্যরকম। পড়ুন পুজোর মধ্যে অন্য এক পুজোর খবর। রোজ একটি করে। পড়ুন আগের পর্বটি।
আমরা অষ্টমী নবমীর আগে মহা লাগাই কেন কে জানে ! আমি বাড়তি একটা 'বীর' লাগাতে চাই এই মহানবমীর সঙ্গে, কারণ মনে হচ্ছে সত্যিই যেন তীর্থংকর মহাবীরের পায়ের চিনহ ধরে পথ হাঁটার পর এই লেখা। মহাবীরনবমী।
দামোদরের বিশাল বিস্তারের মধ্যে দেখা যাচ্ছে দু/আড়াই হাজার বছরের পাথরের দেউল। পাশের সোঁতায় দাঁড়িয়ে আরেকটি। সেখানে যেতে হলেও নৌকাই ভরসা। কালো জলের ভেতর সবুজ সোনালী গুল্ম মাথা নুইয়ে নৌকাকে পথ ক'রে দেয় আর দাঁড়ের মাথায় ছিটকে ওঠে স্বচ্ছ জলে রোদের হরেক ছটা। এমন নবমী একজন্মে একবারই আসে।
আসলে আমরা যারা নতুন শাড়ি বা পাঞ্জাবি পরে মন্ডপে সেলফি তুলি আমরা জানি এই রাজ্যে এমন জায়গাও আছে যেখানে কয়েকশো কিলোমিটারের মধ্যে কোন পূজা মন্ডপ বাঁধা হয়না, আলোর রোশনাই কেবল স্বপ্নে দেখা যায়। অনেকগুলো গ্রাম মিলে একটি পুজো। সামনে মেলা। পায়ে হেঁটে দূরদূরান্ত থেকে আসছে ছেলেবুড়ো। তাদের সবার পরনে যে নতুন জামা, এমনও নয়। জিতেন যেমন পরে আছে একটি চেককাটা লুঙি আর পুরনো টি শার্ট।
পুরুলিয়ার তেলকুপি এক ঘুমন্ত গ্রাম। পুজো নেই, ঢাকের বাদ্যি নেই, তবে মেলা কাশফুল। এখানে গাড়ি থামিয়ে জানালা দিয়ে গ্রামবাসী নিজে থেকেই বলতে থাকেন, এই হলো গে প্রাচীন তৈলকম্প গ্রাম, হাজার বছর আগে শিখর রাজবংশের রাজধানী। ঐ যে দেখছেন নদীগর্ভে অর্ধপ্রোথিত দেবালয় ওই হ'লো মা মহামায়ার মন্দির। ওই যে বেনাঘাসের বনে মাথা উঁচু ক'রে আরেকটি, ওটি ভৈরবের থান।
আমি জিতেন মাঝিকে বলি, কতো নেবে দাদা নৌকো ক'রে মহামায়ার মন্দিরে যেতে ? একথা জেনেই বলি যে আসলে এইগুলি সবই জৈন দেউল। কালের প্রকোপে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের বলশালী দেবতার চাপে কখন হিন্দুমন্দিরে পরিণত হয়েছে কেউ জানে না। নৌকা যখন চড়ায় ঠেকে, মন্দিরের ভেতর ঢুকে দেখি কোন দেবতা নেই, কিন্তু স্থানীয় অর্চনার ছাপ আছে তেল সিঁদূরে। জিতেন বলে এইরকম অনেক মন্দিরে পশুবলিও দেওয়া হয়।
জৈন ধর্মগ্রন্থ আচারঙ্গ সূত্রে আছে তীর্থংকর মহাবীর রাঢ়দেশে(লাড়) ধর্ম প্রচারে এসেছিলেন। সেই মহাবীর শাস্ত্রমতে যাঁর উচ্চতা সাড়ে দশ ফুট, গাত্রবর্ণ স্বর্ণাভ, লাঞ্চনচিনহ সিংহ। কিন্তু রাঢ়দেশীয় মানুষ তাকে বহু কষ্ট ( উবসগগা) দিয়েছিল। কুকুর লেলিয়ে দিয়েছিল এই দীর্ঘদেহীর পেছনে। তবু তাঁর চেষ্টায় জৈন ধর্ম ছড়িয়ে পড়ে অধুনা পুরুলিয়া বাঁকুড়া বীরভূমের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। প্রতিষ্ঠিত হয় মহা প্রতাপশালী শিখর সাম্রাজ্য।
জিতেন এতো কথা জানে না। নবমীর দিন বিশাল মন্দিরের শূন্য গর্ভগৃহে দাঁড়িয়ে সে উদবাহু হয়ে জগজ্জননীকে ডাকতে থাকে। বাপ পিতেমো'র কাছ থেকে শোনা গল্প বলতে থাকে অনর্গল,
- এই যে এতো বড় মন্দির, কোথাও সিমেন্ট দেখলেন? তাইলে জোড় দিলো কিদ্দিয়ে? শুনেন তাইলে, বিশ্বকর্মা স্বয়ং বুলেছিলেন কি যে রাইতের মদ্দে এই মন্দির তিনি শেষ কইরে দিবেন। কিন্তু ভোরের আগেই অসুর মোরগার ডাক ডাইকে দিল, মন্দিরও আর শেষ হলো নাই।
লোকমুখে আরেক মহিষাসুরমর্দিনীর আখ্যান ভেসে আসছে যুগযুগান্ত পার হয়ে। আমি উৎকর্ণ হয়ে শুনি। দামোদরের ঢেউয়ের কলোচ্ছ্বাস, বেনাবনের ঠান্ডা বাতাস, জিতেনের ভাঙা স্বর নবমীকে এক আশ্চর্য মাত্রা দেয়, যা কখনো শহুরে কোন প্যান্ডেল কখনো পারবে না। এই নবমীকে মহাবীর নবমী না ব'লে জিতেন নবমীও বলা যায়। সেলফি, চড়া গান, নতুন জামা, ভোগভোজন থেকে অনেক দূরে এ এক লোকনবমী, লোকায়ত নবমী।