পুজো নানারকম। খবরের কাগজ আর টিভিতে পাবেন সেলিব্রিটির পুজো। সে পুজো সিনেমা রিলিজের। লাইফ স্টাইল ম্যাগাজিনে পাবেন সাজসজ্জার পুজো, খাওয়াদাওয়ার পুজো। গুরুর এবারের সিরিজ এসবের বাইরে অন্য পুজোর সন্ধান দেবে। যেখানে হয়তো আলো-টালো পৌঁছয়না। পৌঁছলেও অন্যরকম। পড়ুন পুজোর মধ্যে অন্য এক পুজোর খবর। রোজ একটি করে।
একটা ছোট কালো কাঠের দুর্গা মূর্তি আছে আমার কাছে। চালচিত্রে খোদাই করা কালো প্রতিমার মতো দেখতে আমার ঠাম্মা আমায় দিয়ে গেছিল মরণকালে। আগেই শুনেছিলাম কোনো মেয়ে ফিসফিসিয়ে দেবীর কানে নিজের মর্মান্তিক দুঃখের কথা শোনালে দেবীর গাত্রবর্ণ আরো একটু কালো হয়ে যায়।
তাহলে এই কষ্টি পাথরের মতো রঙে এই বংশের কতো মেয়ের মনের বিষ ঢালা আছে !! তবে না কালোর এমন জেল্লা !
এই পুজোতে একজনের কষ্টের কথা শুনে যেন চোখের কাজলের মতো আরো ঘোরা কৃষ্ণবর্ণা হয়ে গেলেন দেবী। তার সঙ্গে আমার আলাপ তো বেশি দিনের নয়। তার গায়ের রঙ কুমারী গাছের ছায়ার মতো, বসন্তের শুরুতে যার ঝাঁকড়া মাথা জুড়ে নতুন পাতার রঙ হয় টকটকে লাল। সে মেয়ের চোখেমুখে কষ্টের কালি। স্বামী সন্তান ঘর, সব সে খেইয়ে লিয়েছে গ্য। সে এক আস্ত ডাইন।
পিনাকী মিত্র বললো অন্য মানুষের পুজোর গল্প চাই, তাইতে আমার মনে পড়ল ফুলকুমারি মেঝেনের কথা। পুরুলিয়ার ফুলকুমারি। তার হাত ধরে গল্প করার সময় একবারও তো মনে হয়নি সে নাকি এক সব-খাওয়া ডাইন, যার নামে তার গ্রাম তো গ্রাম, আশেপাশের গ্রামগুলিও ভয়ে কাঁপে।
এই যে এই 'খাওয়া' কথাটা, মেয়েদের ক্ষেত্রে এই কথাটার প্রয়োগ খুবই অভিনব। শুধু গ্রামীণ আদিবাসী সমাজেই নয়, খোদ কলকেতায় প্রায়ই এই কথাটি বড়ো কদর্থে ব্যবহৃত হয়। কারো স্বামী সন্তান পরিজন অসুখে মারা গেলেও আমরা অবলীলায় পেছনে বলি সবাইকে খেয়ে নিয়েছে। ঝগড়া লাগলে বাঁধা বুলি, এতো খেয়েও পেট ভরল না, এবার কি আমাকে খাবি!
সেখানে ফুলকুমারির পেটে বাঁশের খোঁচা মেরে যদি পড়শিরা দেখে ভুক্ত মানুষটির দেহাবশেষ হজম হয়েই গেল কিনা তাহলে সেটি খুব অস্বাভাবিক হয় না, কারণ সে ঘোষিত ডাইনী। আশেপাশে সবাই বিশ্বাস করে সে নিজের স্বামী সন্তানকেই খেয়ে নিয়েছে, এতো তার খিদে। কিন্তু চোখে জল নিয়ে ফুল পুজোর দিনে আমায় যে গল্প শোনালো তা একেবারেই অন্যরকম।
- পুজোর দিনগুলো কীভাবে কাটাও ফুল ?
- কী ভাবে কাটাই ! হামার স্বামীটার ক্যান্সার হঁয়েছিল। ডাক্তারবাবু বইলল উ আর বাঁচবেক নাই।
এসব তো আমি নরেন বাবুর কাছে আগেই শুনেছি। কিন্তু পিনাকী বলে দিয়েছে পুজোর দিনের ওপর ফোকাস করতে। তাই ফুলকুমারিকে ট্র্যাকে ফিরিয়ে আনতে বলি,
- এই যে তোমরা আরসা ব্লকে ঠাকুর দেখতে যাও দু/ আড়াই কিমি পায়ে হেঁটে, বাচ্চাদের নিয়ে, খুব আনন্দ হয়, না ? পাহাড়, কাশফুল, গাছপালার মধ্য দিয়ে যাও, আর কী শুদ্ধ অক্সিজেন চারদিকে !
আমার চোখ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবেশে বুজে আসে। আহা, কী আনন্দময় জীবন !
ফুলকুমারির চোখে তবু কেমন ঘোর। যেন বহুদূর থেকে সে বলতে থাকে,
- দুইটা বাচ্চার একটা গেল জ্বরে। গাঁয়ের লোক বুইলল, তুই ডাইন বটেক। মরদ, ছানা, সবাইকে খাইয়েছিস, এইবার হামরাদেরকেও খাবি। তুকে হামরা বাঁচায়ে রাইখবক নাই।
ফুলকুমারি অবশিষ্ট ছানাটিকে কোলের কাছে টানে। মায়েপোয়ে এসে উঠেছে এই অনাথ আশ্রমে। দারোগা বলেছিল যতোক্ষণ থানার মধ্যে ততোক্ষণ নিরাপদ। কিন্তু কোনো বাঁশঝাড়ের অন্ধকারে বা নির্জন নদীর চরায় কে তার লাশ ফেলবে সে কথা পুলিশ জানবে কী ক'রে ? ফুলকুমারির আধার কার্ড, এপিক কার্ড বাক্স শুদ্ধ ছিনতাই করেছে শ্বশুরবাড়ির লোকজন। জমিজমা ভাগ কত্তে হবেক নাই এই উদের শান্তি। মিছা কথা বুলছে সবাইকে যে ফুলকুমারি নিজে সব লিয়ে গেছে।
ফুলের কাঁধে ঝাঁপাঝাপি খেলা খেলে অনাথ আশ্রমের আরো তিন চার বাচ্চা, হাত ধরে টানে। এইবার তারা সপ্তমীর ঠাকুর দেখতে বেরোবে। কোনো ছানা নেতিয়ে পড়লে ফুলকুমারি বা পানমতী তাকে কোলে নেবে। জিলিপি খাবার বায়না ধরলে সুরেন মেলার মাঠে লাইন করে দাঁড় করাবে পঁচিশজন অনাথকে। তারপর সেকি ক্যালোরব্যালোর ! মেলাভর্তি লোক, এমনকি মা দুর্গার মৃণ্ময়ী মূর্তিও যেন হাসতে থাকবে বাচ্চাদের কান্ড দেখে।
শুধু মন্ডপে দাঁড়িয়ে বছর পঁয়ত্রিশের ফুলকুমারি হাত জোড় ক'রে বিড়বিড় করতে থাকবে,
- মাই, তোর মুখে হাঁসি, কিন্তু মনে দয়া নাই। নাইহলে হামদের গাঁয়ের লোক, থানা পুলুস, যারা এতো দমহে অত্যাচার কইরছে তারহাই তো অসুর বঠে। তুই তাদের বধ করছিস নাই কেনহেঃ?
ঘরে ফিরে দেখি আমার গৃহদেবীর গায়ে যেটুকু অন্য রঙের দাগ অবশিষ্ট ছিল তার প্রায় সবটাই উবে গেছে। এক ঘোরা কৃষ্ণা বিষণ্ণবদনা দেবী নিজের অপারগতায় যেন মুখ লুকোতে পারলেই বাঁচেন।