আন্দোলন অব্যাহত। আন্দোলন চলছে দেশের প্রায় প্রতিটি শহরে এবং বিদেশেও। উত্তরপ্রদেশে মৃত্যু বেড়ে ১৬। সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ভিডিওয় দেখা যাচ্ছে, পুলিশ নিরস্ত্র সাধারণ মানুষকে ধরে-ধরে মারছে। মারা গেছে একটি ফুটফুটে শিশু। তার রক্তমাখা ছবিও ঘুরছে ইন্টারনেটে। গ্রিসের সমুদ্রতটে পড়ে থাকা আইলানের মতই মর্মান্তিক সে ছবি। কিন্তু ছবির সত্যতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিঃসংশয় না হতে পারায়, ছবিটি এখানে দেওয়া হলনা।
এরই মধ্যে বিজেপি নেতাদের গরম বিবৃতি চলছে। দিল্লির নেতা কপিল শর্মা বলেছেন বিক্ষোভকারীদের "মারো গোলি"। সংবাদমাধ্যম সূত্রানুসারে বাংলার নেতা দিলীপ ঘোষ বলেছেন "আসামে গুলি করে মেরেছি, পশ্চিমবঙ্গেও মারব"। অন্যদিকে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর আবেগজড়িত পুরোনো একটি টুইট আজ ভেসে উঠেছে, "আমি না হয় চায়ের দোকান খুলতে চলে যাব, কিন্তু দেশ আর কষ্ট সহ্য করতে পারছেনা"। আবেগ না হুমকি অবশ্য বলা মুশকিল, কিন্তু নেট দুনিয়ায় এ নিয়ে প্রবল ঠাট্টা তামাশা। কেউ বলছেন, "দয়া করে চায়ের দোকানই খুলুন, দেশ সত্যিই এ কষ্ট আর নিতে পারছেনা"। কেউ বলেছেন, "দয়া করে চায়ের দোকান খুলবেন না, সেটাও আপনি চালাতে পারবেন না"।
India needs a strong Government. Modi does not matter. I can go back & open a tea stall. But, the nation can't suffer anymore.
— Narendra Modi (@narendramodi) April 29, 2014
কলকাতায় এর মধ্যেই হয়েছে ছাত্রযুবদের বিরাট মিছিল। সে খবর সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল। কিন্তু উল্লেখ্য যেটা, একই দিন কলকাতায় একটি "হিন্দু" সংগঠনও মিছিলের ডাক দিয়েছিল, বিশেষ সূত্রে খবর, তাতে ঠিক গুণে ২৫ টি লোক হয়েছিল। এ নিয়ে সংগঠকরা যারপরনাই ক্ষোভ প্রকাশও করেছেন। নেট দুইনিয়ায় ঠাট্টা, যে, বাঙালি নেতাদের ডাকে বিজেপির মিছিলে লোক হবেনা। কারণ বাঙালি বিজেপি নেতারা হলেন দ্বিতীয় শ্রেণীর নেতা। আসল চাবিকাঠি হিন্দি বলয়ের হাতে।
বিজেপির মধ্যে এবং বাইরে বাঙালিবিদ্বেষ অবশ্য নতুন খবর নয়। এন-আর-সির বিশেষ লক্ষ্যবস্তু বাঙালিরা এ অভিযোগ দীর্ঘদিনের। আসামে বিশেষ করে বাঙালিরাই বাদ গেছেন এন-আর-সি তালিকা থেকে। বেঙ্গালুরু থেকে বিতাড়িত হয়েছেন বাঙালিরাই। গুরগাঁওয়ে বাঙালি বস্তিই ভাঙচুর হয়েছে। উত্তরপ্রদেশের পুলিশের ডিজি 'বাঙালি' ও 'বহিরাগত' প্রায় সমার্থক শব্দের মতো ব্যবহার করেছেন। এই বিরাট তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন হিসেবে একটি ভিডিও ভাইরাল হয় কাল, যেখানে জনৈক হিন্দিভাষী বিজেপি কর্মী দাবী করেছেন পশ্চিমবঙ্গের ৭০ শতাংশ লোকই বাংলাদেশী। তাদের তাড়ানো উচিত।
এই আবহেই সামাজিক মাধ্যমে বাংলা-হিন্দি বিতর্ক জোরদার হয়েছে। বিগত কয়েকদিন ধরেই দেখা গেছে, জেলার প্রতিবাদগুলিতে যেখানে জয় বাংলা স্লোগান মুরুর্মুহু শোনা গেছে, সেখানে শহুরে সমাবেশগুলিতে হিন্দির আধিক্য। মিছিলের চেয়েও হিন্দি স্লোগানের আধিক্য নেটে ছড়ানো হওয়া ভিডিও ক্লিপগুলিতে। শহুরে 'দীক্ষিত' ছাত্রযুবদের স্লোগান আমজনতার ভাবকে কতটা ধরতে পারছে এই নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে কয়েকদিন ধরেই। মিছিলগামীরাই কেউ মৃদুস্বরে অনুযোগ করেছেন, "তানাশাহী নেহি চলেগার বাংলা কি মামদোবাজি চলবে না" হতে পারে না? কেউ আন্দোলনকে সমর্থন করেও বলেছেন, "প্রথমে ৩৮ লক্ষ তারপর ১৭ লক্ষ বাঙালি যখন সরাসরি বেনাগরিক ঘোষিত হল তখন জামিয়া মিলিয়া বা আলিগড় উত্তাল হয়নি কেন? বাঙালির উপর সরাসরি জাতিগত গণহত্যা নেমে এলে জাতিবাদ সে আজাদি স্লোগান কোথায় থাকে? ১৯৮৩ এর নেলি হত্যাকাণ্ড জালিয়ানওয়ালার চেয়ে কম ভয়াবহ কি?" কেউ আরও তীব্রস্বরে জানিয়েছেন, টানা হিন্দি স্লোগান "হিন্দির দাসত্ব, উর্দুর দাসত্ব, দিল্লির দাসত্ব।"
অন্য এক সমালোচক জানিয়েছেন, এই প্রতিক্রিয়া অস্বাভাবিক নয়। মুসলমানরা জাতীয় পতাকা নিয়ে মিছিল করতে বলা যায় বাধ্যই হচ্ছেন, কারণ তাঁদের উপরে প্রমাণ করার দায় চাপানো হয়েছে যে তাঁরা ভারতীয়। একই ভাবে বাঙালিদেরও প্রমাণ করতে হচ্ছে, তাঁরা মূলধারার ভারতীয়, বাংলাদেশী নন। সমষ্টিগত অবচেতনে হয়তো ব্যাপারটা কাজ করছে। কিন্তু সমস্যা হল, আলাদা করে কাউকে কিছু প্রমাণ করতে যাতে না হয়, সেজন্যই তো এ আন্দোলন। ভারতীয় হতে গেলেই যে এক ভাষায় কথা বলতে হয়না, বিভিন্ন আঞ্চলিকতা, বিভিন্ন ধর্ম, বিভিন্ন ভাষার যোগফলই ভারতবর্ষ, এই স্পিরিটটা এই একই স্লোগানে থাকছেনা। একরকম করে অখণ্ড হিন্দুস্তানের প্রচারই চলছে যেন। ঐক্যবদ্ধ প্রমাণ করার জন্য আন্দোলনকারীরা আপ্রাণ হিন্দি বা উর্দু স্লোগান মুখস্থ করছেন। তামিল তেলুগু বাংলা নানা স্লোগান মুখস্থ করে তো দিচ্ছেন না। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য নয়, এ যেন যান্ত্রিক ঐক্য।
আন্দোলনকারী নানা পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে এ নিয়ে নানা প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। কেউই বিষয়টা উড়িয়ে দেননি। মহামিছিলের অন্যতম সংগঠক বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চের সামিরুল ইসলাম বলেন, "আসলে আজাদি স্লোগানটা যুবকরা বলতে চাইছে। আমাদের কিছু বাংলা স্লোগান বানাতে হবে"। ওই সংগঠনেরই তন্ময় ঘোষ বলেন, "মিছিলে বিভিন্ন ভাষাভাষি মানুষ ছিলেন। মূলত কলকাতা বা বাংলার বুকে আন্দোলনে বাংলা ভাষার মানুষজনই আন্দোলনে সামিল হতেন। কিন্তু এই আন্দোলন সমস্ত মানুষকে এক ছাতার তলায় নিয়ে এসেছে। তার মধ্যে উর্দুভাষি মুসলিমরা আছেন। কিছু অবাঙালি সাধারণ মানুষও স্বতর্স্ফুর্তভাবে অংশ নেন। তবে বাঙালি স্লোগানেও মুখরিত ছিল মিছিল, যেটা বাঙালি জাতিসত্ত্বার প্রমাণ।"
মিছিলে ছিলেন বাংলা পক্ষের সংগঠক কৌশিক মাইতি। তাঁর প্রতিক্রিয়া তীব্রতর। "ক্যাব আসার আগে থেকেই এন আর সি তে বাঙালি নিধন চলছে। এন আর সি বাঙালিকে ধ্বংস করার জন্যই-এই সহজ সত্য অনেকে বোঝে না৷ কলকাতায় এন আর সি ও ক্যাব বিরোধী মিছিলে পরপর হিন্দি স্লোগান উঠছে৷ এটা জেএনইউ কে অন্ধ অনুকরণ, এটাও দাসত্ব, এটাও হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের ফসল। কলকাতায় হিন্দিতে 'আজাদি' স্লোগান দিয়ে এন আর সি বিরোধী মিছিল হচ্ছে, বাংলায় স্লোগান দিলে কি মিছিলের জৌলুস কমে যায়? না ঠিক বিপ্লবের অনুভূতি আসে না? যদিও সামান্য ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, বাংলাই বিপ্লবের আঁতুড়ঘর৷ বিপ্লবীরা বাংলাতে স্লোগান দিতেন বলেই জানি৷ ভারতের রাষ্ট্রগান বাঙালির লেখা, 'বন্দেমাতরম' বাংলা মায়ের গান, এমনকি ভারতমাতার ছবিটাও আসলে 'বঙ্গমাতা'র ছবি। তাহলে এখন কলকাতার স্বঘোষিত 'বিপ্লবী' সমাজের নিজের মাতৃভাষা নিয়ে এত হীনমন্যতা কেন? আশা রাখব আগামীতে শুধুমাত্র বাংলা স্লোগান শুনতে পাব। দিল্লিতে হিন্দিতে স্লোগান হয়, বাংলায় না- এটা মাথায় রাখা জরুরী।"
বামপন্থীদের ডাকা মিছিলে ছিলেন বামপন্থী সংগঠক সুমন সেনগুপ্ত। তিনি বলেন, "হিন্দিভাষী মুসলমানদের একটি অংশ আমাকে বলছিল বাংলায় শ্লোগান দিতে। আমি তাই দিয়েছি। মহিলারাও তার সঙ্গে গলা মিলিয়েছেন। কিন্তু ওই আজাদী শ্লোগান কিন্তু এখন ভাষার সীমানা অতিক্রম করেছে এটাও মনে হয়েছে আমার।"
এই বিতর্কের মধ্যেই সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের "ক্যা ক্যা ছি ছি / ছি ছি ছি ছি" স্লোগান। অনেকেই এই স্লোগান নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করেছেন, অনেকেই আবার একেই কার্যকরী সহজ স্লোগান বলেছেন। কিন্তু মমতার বাকি সমস্ত কিছুর মতই, একেও কেউ অবজ্ঞা করতে পারেননি। এবং এই স্লোগানের বাঙালিয়ানা নিয়েও কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।