অনসূয়া এবার উচ্চমাধ্যমিকের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে। আর কলেজ মানেই বড় শহর, হোস্টেল।
রুমাদি ওর রুমমেট। অনসূয়ার গালের ব্রণ দেখে রুমাদিই বললো, বেটনোভেট সি লাগা, সেরে যাবে।
পার্ট-টুর পর রুমাদি চলে গেলো, এখন নতুন রুমমেট কৃষ্ণা। তার কালো রং ফর্সা করার জন্য অনসূয়া তাকে দিলো ওই বেটনোভেট সি।
আরো একবছর পর, হোস্টেল ছাড়ার সময় হয়ে এলেও বেটনোভেট সি আর ছাড়তে পারে নি অনসূয়া আর কৃষ্ণা, অথবা বেটনোভেট সি ছাড়েনি তাদের!
অনেকবার চেষ্টা করেছে, লাভ হয়নি! ছাড়লেই দানা দানা বেরিয়ে যাচ্ছে, সারা কপাল, গাল জুড়ে, অতএব আবার বেটনোভেট সি!
####
তিন্নি আর তার মা একই সঙ্গে হাজির সেদিন ডাক্তারবাবুর চেম্বারে, সমস্যাটা একই, আর বেশ বিদঘুটে! দুজনেরই গালে লোম বের হচ্ছে! তিন্নির উনিশ তার হলে হালকা হালকা লোম আর ওর মা বিয়াল্লিশ। তার তো বেশ পুরুষ্টু দাড়ি! গালের কালো দাগের জন্য একজন লাগাচ্ছেন প্যান্ডার্ম প্লাস আর অন্যজন স্কিনলাইট! ফল হাতে নাতে!
####
ব্রায়ানা ব্যানোস একজন নৃত্যশিল্পী।
ফ্লোরিডা নিবাসী।
নিজে স্টেরয়েড অপব্যবহারের স্বীকার।
নিজের চিকিৎসার সাথে সাথে গড়ে তুলছেন স্টেরয়েডের অপব্যবহার নিয়ে বিশ্বব্যপী জনসচেতনতা।
তাঁর তথ্যচিত্রের মাধ্যমে।
এই শহরে তো বটেই এশিয়ায় এই প্রথম।
এখানে কিছু রোগীর সঙ্গে কথা বলে, রেকর্ড করে উড়ে গেলেন জাপানে, সেখানে দুই চিকিৎসক ও কিছু রোগীর সাথে কথা বলতে।
####
সমস্যাটা কি? কেন হয় এই সমস্যাগুলি?
আসলে এগুলি স্বচিকিৎসার কুফল!
বলা যায় খাল কেটে কুমির আনা!
একেবারে 'এসো ভাই, বসো ভাই, খাট পেতে দিই, ভাত বেড়ে দিই, খাবে ভাই?' গোছের ব্যাপার!
আর একটু বিস্তারে বলি?
ধরুন কারো জ্বর হলো, সেটা টাইফয়েড হতে পারে, ম্যালেরিয়া হতে পারে, টিবি অথবা ব্লাড ক্যান্সার, ডেঙ্গি অথবা চিকুনগুনিয়া অনেক কিছু থেকেই হতে পারে তাই তো?
এখন সেক্ষেত্রে ডাক্তার না দেখিয়ে, জ্বরের সঠিক কারণ না জেনে কেউ যদি একটু ম্যালেরিয়ার ওষুধ, একটু টাইফয়েডের ওষুধ, একটু টিবির ওষুধ, একটু ব্লাড ক্যান্সারের ওষুধ মিশিয়ে খায় এবং খেয়ে চলে কেমন হবে? তাতে রোগ সারবে কি? না বেড়ে যাবে?
সঠিক রোগ নির্ণয় না করে ঐসব প্যান্ডার্ম, ফোর্ডার্ম মার্কা ক্রিম লাগানো ব্যাপারটা ওইরকমই!
ওষুধ মানে কিন্তু শুধু ক্যাপসুল, ট্যাবলেট ইনজেকশন নয়, স্কিনে লাগানোর ক্রিম বা অয়েন্টমেন্টেও যে শক্তিশালী রাসায়নিক থাকতে পারে সেটা বেশীর ভাগ মানুষের খেয়ালই থাকে না!
আর এই অজ্ঞানতা/অবিবেচনা আর অসতর্কতার ফল হচ্ছে ভয়াবহ!
গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো এই অবৈজ্ঞানিক ককটেল ওষুধ গুলিতে আবার স্টেরয়েড থাকে!
না জেনে, দীর্ঘদিন ধরে স্টেরয়েড (বিশেষত মুখে এবং শরীরের চাপা অংশে) অপরিমিত এবং অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার করলে বিপদ হতেই পারে!
অথচ সরকারি নিয়ম মতে স্টেরয়েড কিন্তু শিডিউল এইচ পর্যায়ভুক্ত ওষুধ, মানে যেগুলি কখনোই প্রেসক্রিপশন ছাড়া বিক্রি হওয়া উচিত নয়!
ড্রাগ এবং কসমেটিক এক্টের শিডিউল জে ক্লজ ১৮ তে আছে যে ফর্সা করার দাবি জানিয়ে কোনো ওষুধ বিক্রি করা দূরের কথা বিজ্ঞাপন দেওয়াও যায় না!
অথচ, শুধু বিক্রি নয়, রীতিমত খবরের কাগজে পাতাজোড়া বিজ্ঞাপন দিয়ে রমরমিয়ে বিক্রি হচ্ছে এই সব ক্রিম, যার পুরোটাই অনৈতিক তো বটেই বেআইনিও!
২০১৬ সালের ১২ আগস্ট কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যদফতর থেকে রীতিমত গেজেট নোটিফিকেশন করে জানানো হয় যে "all salts, esters, derivatives and preparations containing steroids for topical or external use is now covered by the Schedule"।
শিডিউল মানে শিডিউল এইচ!
কিন্তু তাতে কি আর এলো গেলো!
চুরি, জোচ্চুরি, রাহাজানি, ধর্ষণ, খুন কোনোটাই আইন মেনে করা হয় কি?
####
স্টেরয়েড ক্রিমের অপব্যবহার আমাদের দেশে প্রধানত দুইভাবে হয়।
১. দাদের মলম হিসেবে - যেমন কোয়াড্রিডার্ম, ফোর্ডার্ম, প্যান্ডার্ম, টোটালডার্ম, ক্লোবেন জি, ক্যান্ডিডার্মা, ক্যান্ডিড টোট্যাল, সার্ফাজ এস যেন, বেটনোভেট জি এম, লোবেট জি এম জাতীয় দানবীয় গজকচ্ছপ গোছের ওষুধ।
এই সমস্ত ককটেল ক্রিম ভারতবর্ষ ছাড়া কোথাও মেলে না!
ত্বকের প্রতিরোধ ক্ষমতায় থাবা বসিয়ে, জীবাণুর চরিত্র বদলে গিয়ে দাদের মহামারী দেখা দিয়েছে এই গুলি মেখে!
সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে যাচ্ছে দুরারোগ্য দাদ! স্কিন ফেটে গিয়ে স্ট্রেচ মার্কের শাখা প্রশাখা ছড়াচ্ছে শরীরে!
2. ফর্সা হবার ক্রিম হিসেবে - যেমন মেলাকেয়ার, মেলালাইট এক্সএল, মেলবেস্ট, স্কিনলাইট, স্কীনশাইন, নোস্কার এগুলির মধ্যে থাকে শক্তিশালী স্টেরয়েড, হাইড্রোকুইনোন নামে একটি ব্লিচ আর ট্রেটিনয়েন নামে একটি ওষুধ।
এছাড়া প্যান্ডারম প্লাস কসভেট জি এম, লোবেট জিএম, বেটনোভেট জিএম, নুফোর্স জি এম এগুলিও অনেকে মুখে মাখেন ফর্সা হবার উদগ্র ইচ্ছায়!
এই গুলি আসলে একটি এন্টিবায়োটিক, একটি এন্টিফাঙ্গাল এবং অত্যন্ত শক্তিশালী একটি স্টেরয়েডের ভয়ঙ্কর ককটেল!
এগুলি প্রাথমিকভাবে দাদের মলম হিসেবেই তৈরী হয়েছিল, কিন্তু অপব্যবহার হচ্ছে ফর্সা হবার ক্রিম হিসেবে!
এগুলি বা অন্য স্টেরয়েড না জেনে মুখে বা অন্যত্র মাত্রাছাড়া ভাবে মাখলে স্কিন পাতলা হয়ে যায়, লাল হয়ে, রক্তনালী দেখা যায়, ব্রণ বেরোয়, মেয়েদের মুখে অবাঞ্ছিত লোম বের হয়!
স্টেরয়েড এডিকশন বা নেশার শিকার হয় মানুষটি!
এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলা খুব জরুরি।
স্টেরয়েড মানেই কিন্তু খারাপ নয়!
এটি অন্তত প্রয়োজনীয় একটি ওষুধ যা শুধুমাত্র চিকিৎসকের পরামর্শেই ব্যবহার করা যায়। ত্বক বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উত্থান আর উন্নতির পথে গত অর্ধশতাব্দী ধরে যে রাসায়নিকটির ভূমিকা অনস্বীকার্য তা এই স্টেরয়েডের স্থানীয় বা টপিক্যাল ব্যবহার। ক্রিম, অয়েন্টমেন্ট, জেল, লোশন, বহু ত্বক রোগের চিকিৎসায় আশীর্বাদের বার্তাবাহী এই স্টেরয়েড। সোরিয়াসিস, লাইকেন প্লেনাস, লাইকেন সিমপ্লেক্স, শ্বেতী এমন বহু অসুখে স্টেরয়েডের সুচিন্তিত ব্যবহার রোগ উপশমে অব্যর্থ ভূমিকা নেয়।
স্বচিকিৎসা কখনোই নয়!
এই স্টেরয়েড ক্রিমের অপব্যবহার আমাদের দেশের লজ্জা! পৃথিবীর কোনো উন্নত দেশে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া স্টেরয়েড ক্রিম পাওয়া যায় না! আর আমাদের দেশে? মুড়িমুড়কির মতো বিক্রি হয় ওষুধের দোকান থেকে প্রেসক্রিপশন ছাড়াই!
এমনকি বিয়ের তত্ত্বেও ঠাঁই করে নিয়েছে এই ক্রিম!
ফল হয়েছে ভয়াবহ! মহামারীর আকার ধারণ করেছে এই ব্যাধি।
আসুন সবাই সচেতন হই।
কোনভাবেই শিডিউল H তালিকায় থাকা ওষুধ প্রেসক্রিপশন ছাড়া বিক্রি করা যায় না, এবং বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করাও যায় না। বছরে দেড় হাজার কোটি টাকার (এই হিসেবেটি বছর তিনেকের পুরোনো) ওপরে ব্যবসা ষ্টেরয়েড ক্রিমের, তার প্রায় দুই তৃতীয়াংশ কোন প্রেসক্রিপশন ছাড়াই, যার প্রায় পুরোটাই অপব্যবহার, পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশে যেটা সম্ভব নয়।
এই বইয়ে পৃথিবীর বহু দেশের তুলনা মূলক পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়েছে।
http://www.springer.com/us/book/9789811046087
নতুন আইন কার্যকরী হলে, বন্ধ হবে এই অনৈতিক, অসাধু এবং অস্বাস্থ্যকর ব্যবসা।
মানুষকে সচেতন করার জন্য একটা ফেসবুক পেজ আছে: https://www.facebook.com/NoMoreSteroidAbuse/
আর কিছু নতুন খবরের কাগজের আর্টিকেল, আর সরকারি টুইটের কপি।
http://www.anandabazar.com/lifestyle/fairness-products-actually-causing-serious-harm-to-our-skin-1.781818
https://timesofindia.indiatimes.com/city/delhi/steroids-in-skin-creams-government-to-amend-rules/articleshow/63738900.cms
http://www.dailypioneer.com/nation/govt-bans-sale-of-14-steroid-products-sans-doctors-prescription.html
https://twitter.com/mohfw_india/status/982150919168102400?s=12