আমরা তখন বসন্তের খেলায় উদ্বেল। ভ্যালেন্টাইনস ডে, ২০১৯। বুঝতেও পারি নি কখন রক্তরাঙ্গা ভালবাসার গোলাপে এসে লাগল রক্তের ছিটে। মানুষের রক্ত। চুয়াল্লিশজন তরতাজা মানুষ এক মুহুর্তে নেই হয়ে গেলেন! কি অপচয়! কষ্ট আর কষ্ট! একটা জীবন মানে একটি অমিত সম্ভাবনা – অথচ তাকে নাশ করা এত সহজে! একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে শুধু মনের মধ্যে গুমরানো কষ্ট নিয়ে বাস করা ছাড়া আর কি-ই বা করা যায়!
বিশেষত শত্রু যেখানে সন্ত্রাসবাদ! যে কিনা কোন দেশ-কাল-পাত্রের সীমানা মানে না। কেন একজন সন্ত্রাসবাদী হয় সে কথা আজ থাক – কিভাবে বিভিন্ন পুল ফ্যাক্টর আর পুশ ফ্যাক্টরের দড়ি টানাটানি চলে, আর তার মাঝখান দিয়ে দড়ির টানে সাধারণ ছেলেপুলের দল সন্ত্রাসবাদের দলে ভিড়ে যায়, সে কথা আলোচনার সময় নয় এটা। তবে সীমানার বাইরের শত্রুর মোকাবিলা করা তুলনামূলকভাবে যত সহজ, নিজের ঘরের ছেলের আত্মঘাতী সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলা করা তত সহজ নয়। কূটনৈতিক, মানবিক, রাজনৈতিক সব রকমের শুভবুদ্ধিকে সঙ্গে নিয়ে এর মুখোমুখি হওয়া দরকার।
সমস্যা হল, কাকে বলব শুভ বুদ্ধি আর কাকেই বা বলি অশুভ বুদ্ধি? পুলওয়ামা কান্ডের পরে সেটাই গুলিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।নিতান্ত ছা-পোষা গেরস্ত মধ্যবিত্ত মানুষেরা এতকাল সুখে সোস্যাল-মিডিয়ায় সেলফি-যাপন করছিল। তারাও হঠাৎ হাল্লা রাজার মতন যুদ্ধু- যুদ্ধু বলে লাফিয়ে উঠল। যারা সেই তালে তাল মেলাতে রাজী নয়, তাদের নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের ঝড় উঠল।এই অবধি হলে ঠিক ছিল। এসব চেনা ঘটনা। এ রকম দেশাত্মবোধের জোয়ার ২০১৬ সালেও দেখা গিয়েছিল। কিন্তু এবার ঘটনা গড়িয়ে চলল আরো একটু দূর। একদিকে রাজ্যপাল থেকে সেনা-নেতা, সব তাবড় লোকেরা কাশ্মিরীদের বয়কটের ডাক দিচ্ছেন – পুরো দেশটাকে একটা বাইনারীতে ভেঙ্গে ফেলার মরিয়া চেষ্টা, অন্য দিকে সামান্যতম বিরোধীমতের আভাসে সোস্যাল মিডিয়ায় ভয় দেখান, যৌন-হেনস্থা, নোংরাতম কথা বলা পেরিয়ে শুরু হল বাড়ি ধাওয়া করে হেনস্থা, ভাঙচুর। এবং চাকরী থেকে তাড়ানো। কারণ? চড়াও-হওয়া দলের মতে, অন্যপক্ষ দেশবিরোধী, তাদের দেশের সেনাবাহিনীর প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধার অভাব।
এমন হিংস্র সময়ের মুখোমুখি আগে হই নি। অবশ্য এ নিয়ে নতুন করে বিশেষ কিছু বলার নেই। এ দস্তুর চিরকালেরই। সেই কত বছর আগে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখে গেছেন, “দেশে মতের অনৈক্য ও ইচ্ছার বিরোধকে দণ্ড উত্তোলন করিয়া বলপূর্বক একাকার করিয়া দিতে হইবে এইরূপ দুর্মতির প্রাদুর্ভাব হইয়াছে। আমি যাহা করিব সকলকেই তাহা করিতেই হইবে, আমি যাহা বলিব সকলকেই তাহা বলিতেই হইবে এইরূপ বলপ্রয়োগে দেশের সমস্ত মত, ইচ্ছা ও আচরণ-বৈচিত্র্যের অপঘাতমৃত্যুর দ্বারা পঞ্চত্বলাভকেই আমরা জাতীয় ঐক্য বলিয়া স্থির করিয়া বসিয়াছি। মতান্তরকে আমরা সমাজে পীড়ন করিতেছি, কাগজে অতিকুৎসিত ভাবে গালি দিতেছি; এমন-কি, শারীরিক আঘাতের দ্বারাও বিরুদ্ধ মতকে শাসন করিব বলিয়া ভয় দেখাইতেছি। “ ( পথ ও পাথেয়, ১৩১৫ সাল ) দুঃখ শুধু একটাই যে পরের একশো বছরের বেশী সময়ে দেশে তথাকথিত শিক্ষিতের হার এত বাড়ল, তবু আমাদের চিন্তাভাবনার উদারতার বিশেষ একটা বদল হল না। কোথায় যে তাহলে ফাঁকি পড়ল!
দেশাত্মবোধের সংজ্ঞা নিয়ে আর নতুন করে মাথা না ঘামালেও, এত বার বার “সেনাবাহিনীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ” কথাটা শুনে শুনে কেমন যেন ধাঁধা লাগল। বিশেষত এই শ্রদ্ধাবোধের যথেষ্টতার অভাবে যখন একজন মানুষের চাকরী গেল। একটু তলিয়ে দেখতে ইচ্ছে করল। প্রথমেই দ্বারস্থ হলাম হরিচরণ বন্দোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষের। সেখানে দেখলাম, শ্রদ্ধার অর্থ বলছে ১. বিশ্বাস, প্রত্যয় ২. শাস্ত্রার্থে দৃঢ় প্রত্যয়, সম্প্রত্যয় আস্তিক্যবুদ্ধি. ৩. আদরাতিশয় ৪. স্পৃহা আকাঙ্খা ৫. গর্ভিনীর ভক্ষ্য বিশেষে ইচ্ছা ৬. বুভুক্ষা , ক্ষুধা. আমরা যে শ্রদ্ধার কথা ভাবছি, তার সঙ্গে ৪ নং বা ৫ নং বা ৬ নং অর্থের কম-ই যোগ রয়েছে। তাই ১ নং, ২ নং আর ৩ নং অর্থের দিকেই নজর ঘোরালাম । যা বুঝলাম এর মধ্যে ১ নং আর ২ নং অর্থ বেশ হাত ধরাধরি করে চলছে, কারণ দুটিই “প্রত্যয়ে” প্রোথিত। যদিও ২ নং মানেটি শাস্ত্রার্থে প্রত্যয়ের কথা বলেছে, ধরে নিচ্ছি দেশী শাস্ত্রের বাইরে বিভিন্ন মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাও এই গোত্রেই পরবে। সম্প্রত্যয় কথাটার মানে খুঁজে পাই নি, অনুমান করছি সম্প্রীতি বাড়ায় এমন, মানে মোটকথা সম্প্রত্যয় আস্তিক্যবুদ্ধিকে মোটের উপর একটা পজিটিভ ভরসার জায়গা বলে ধরা যায়.
ভরসা করব কাকে? দেব-দ্বিজ’র স্টান্ডার্ড লব্জটি বাদ দেওয়া যাক। আমাদের শেখান হয় গুরুজনদের শ্রদ্ধা করতে, ডাক্তার- শিক্ষক গোত্রের কিছু বিশেষ বিশেষ বৃত্তির লোকজনদের শ্রদ্ধা করতে। তার বাইরে আছে বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। বৃত্তি বিশেষের প্রতি শ্রদ্ধার উৎপত্তি হয়তো ব্রাহ্মণ্যবাদের থেকেই, তবু মোটামুটি বলা যায় যে আমাদের ধারণা সেই বৃত্তির মানুষেরা সমাজের জন্য যা করেন , তাতে সামগ্রিক ভালো হবে এই বোধের থেকে সেই বৃত্তির সকলের প্রতি শ্রদ্ধার জন্ম। তাই সমাজের চালু রীতি ছিল ডাক্তারদের শ্রদ্ধা করার কারণ তাঁরা আমাদের জীবন দেন। আমাদের শেখান হত শিক্ষককে শ্রদ্ধা করতে, তাঁরা আমাদের মানুষ বানাতে চেষ্টা করেন। সেনাবাহিনী, বি এস এফ, সি আর পি এফ, আর পি এফ কেও শ্রদ্ধা করতে শেখান হত কারণ তাঁরা আমাদের রক্ষা করেন.
তবু একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যায় আমরা যে বিশেষ কিছু বৃত্তিকে শ্রদ্ধা করতে শিখেছি, তার মধ্যেও আমাদের উন্নাসিকতা মিশে আছে। আমাদের শ্রদ্ধার সীমানায় মোটামুটি সেই সব বৃত্তি-ই আসে, যেগুলিতে অন্ততঃ আগেকার দিনে সমাজের উচ্চস্তরের লোকেরাই যেতেন। কেউ কি কখনো শিখেছে যে কৃষককে শ্রদ্ধা করো , তাদের জন্য আমরা খেতে পাই ? অথবা প্লাম্বারকে শ্রদ্ধা করো, সে না থাকলে তোমার জীবন দুর্বিষহ হত? যে রিক্সাওলা বর্ষার রাতে ভিজতে ভিজতে বাড়ি নিয়ে এল, তাকে "যত্ত শালা মালখোর" বলে গালাগালি না দিয়ে তাকে শ্রদ্ধা করতেও আমাদের শেখানো হয় না! এই তালিকাটা আরও বাড়ানো যায়, তবে মূল কথাটা বোঝা গেছে আশা করি।
গ্লোবালাইজেসন-উত্তর ভারতে অবশ্য আরো অনেক সামাজিক বদলের সঙ্গে সঙ্গে একটা বড় বদল এসেছে এই বৃত্তিগত শ্রদ্ধার ক্ষেত্রটিতেও। আগেকার দিনের সামগ্রিক বৃত্তিজীবিদের প্রতি শ্রদ্ধার জায়গাটা অনেকটাই টাল খেয়ে গেছে। আমাদের পিতৃপুরুষেরা যে ডাক্তারবাবুকে দেখলে সশ্রদ্ধ নমস্কার জানাতেন, আমরা আজ নির্দ্বিধায় তার জামার কলার চেপে ধরছি, চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগে। দরকারে নাকে দুটো ঘুষি মারতেও ছাড়ছি না। তাঁর সার্ভিসটি , অন্তত শহরাঞ্চলে, সম্পূর্ণ পণ্যায়িত। শিক্ষককুল সম্মানের উঁচু চূড়া থেকে গড়িয়ে পরেছেন আরও ঢের আগে। কবে থেকে তা একেবারে পিন-পয়েন্ট করে বলা না গেলেও, যবে থেকে শিক্ষক-কে ঠুঁটো জগন্নাথ বানিয়ে গণ-টোকাটুকি শুরু হল, তখনই শিক্ষকদের বৃত্তিগত সামাজিক সম্মান গুটি গুটি ঢলে পরা শুরু করেছে।
তবু এমন তো নয় যে আমরা শিক্ষক মাত্রেই হ্যাটা দিই বা ডাক্তার দেখলেই অসম্মান করি। তা নয়। ব্যক্তিগতস্তরে আমরা অনেকেই নিজের পরিচিত মহলের অনেক শিক্ষকের প্রতি অসীম শ্রদ্ধাশীল। তাঁরা তাঁদের পেশাগত দায়বদ্ধতা, বৃত্তিগত কৃতিত্ব আর মানবিকতার জোরে সেই শ্রদ্ধা আদায় করে নিয়েছেন। অতএব দেখা যাচ্ছে যে শিক্ষকদের আর শুধু শিক্ষক বলেই শ্রদ্ধার বদলে শ্রদ্ধার অভিমুখ বদলে যাচ্ছে ব্যক্তির প্রতি। গোটা ডাক্তার সমাজকে যাঁরা আজও শ্রদ্ধা করতে পারেন, তাঁরা মহানুভব। অনেক সাধারণ মানুষই পারেন না। যে ডাক্তার নোটবাতিলের দুদিন পরে ক্যাশ না দিলে রোগী দেখতে অস্বীকার করেন, পেটিম ব্যাংক ট্রান্সফার কিছুতেই রাজী হন না, তাকে আর যাই হোক অনেকেই শ্রদ্ধেয় বলে ভাবতে চাইবেন না। আবার উল্টো দিকে, প্যাথলজি সেন্টারে করতে দেওয়া কিছু রক্তপরীক্ষার রিপোর্ট দেখে সেখানকার কর্ণধার , শুধুমাত্র যাতে ঠিকঠাক অসুখ ধরা যায়, সেজন্য একটি বহুমূল্য রক্তপরীক্ষা নিজ দায়িত্বে বিনামুল্যে করিয়ে দেন, তখন তাঁকে শ্রদ্ধা না করে পারা যায় না। এঁদের অনেকেই যে শ্রদ্ধা করেন তা তাঁদের কর্ম ও মানসিকতার দৌলতে। বৃত্তির কারণে এঁদের সঙ্গে পরিচয় ঘটলেও, ব্যক্তিকৃতিত্বে এঁরা নেহাতই আদরের হয়ে উঠেছেন। বঙ্গীয় শব্দকোষে শ্রদ্ধার যে ৩নং মানেটা ছিল, ‘আদরাতিশয়’ এখানেই বোধহয় তার প্রয়োগ। .
এর আরেকটা আঙ্গিক হল, একজনের যার প্রতি শ্রদ্ধার উন্মেষ হল, অন্যজনের তাকে নিজস্ব বিচারবুদ্ধিতে ততটা শ্রদ্ধেয় মনে নাও হতে পারে। আসলে বিচারবোধও তো আর আকাশ থেকে পরে না । একজন মানুষের নিজস্ব জ্ঞান, তার মানসিক গঠন , শেখা-বোঝার ধরণ ইত্যাদি আর সবার উপরে তার সামাজিক অবস্থান সেই বিশ্লেষণী শক্তিতে প্রভাবিত করে। আর যেহেতু এর অনেকগুলো প্যারামিটারই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায়, তাই বিচারবোধও পাল্টায়। আর সেই সঙ্গে বদলে যায় তার মনোজগতের অশ্রদ্ধা থেকে অপার শ্রদ্ধার যে নিরবচ্ছিন্ন দাগটি রয়েছে, তার উপরে ব্যক্তিবিশেষের অবস্থান-বিন্দু - ছোটবেলার শ্রদ্ধেয় একজন বড়বেলায় নেমে যান শ্রদ্ধার আসন থেকে। আবার যাকে নিয়ে আগে বিশেষ ভাবার অবকাশ হয় নি, তিনি হয়ত এসে বসেন সেই ফাঁকা আসনে।
মোদ্দা কথা যেটা দাঁড়াল, তা হল এই যে বৃত্তিভিত্তিক শ্রদ্ধার জায়গা থেকে আমরা এসে পড়লাম এমন এক সময়ে, যখন শ্রদ্ধা মুলতঃ ব্যক্তিকেন্দ্রিক। চারপাশে তাকালে সেই পুরোন ধাঁচের বৃত্তিগত শ্রদ্ধার আর বিশেষ অবশেষ আছে বলে দেখি না। অবশ্য এখানে আমি মনকে-চোখ-ঠারা, শুধু কথার-কথা মার্কা শ্রদ্ধার কথা বলছি না। মানে ঐ একদল অভিভাবক হন না, যারা দুঃখের সুরে বলেন "ছি ছি আজকালকার বাচ্চারা কি যে হচ্ছে! স্কুলের টীচারদেরও শ্রদ্ধা করে না ! " আর তার পরের মূহুর্তেই বলেন "আরে টাকা দেব, প্রাইভেট টিউটর পাবো না মানে , ভাত ছড়ালে কাকের অভাব ? " - এই ধরণের লিপ-সার্ভিস আমি ধর্তব্যের মধ্যে আনছি না।
আবার বাবা-মা সহ যে কোন গুরুজনকেই যে শুধু গুরুজন বলে শ্রদ্ধা করা যায় না, সেটাও অনেকেই বুঝবেন আশা করি। ইমোশনের পরত ছাড়িয়ে বিচারবোধ প্রয়োগ করলে অনেক তথাকথিত গুরুজনই আর শ্রদ্ধেয় থাকেন না। দিনের পর দিন মাকে কটু কথা বলে বলে যে ঠাকুর্দা-ঠাকুমা-বাবা মায়ের আত্মবিশ্বাসটুকু ধুয়ে মুছে সাফ করে দিয়েছেন, সেই ঠাকুর্দা-ঠাকুমা-বাবাকে অনেক সন্তান-ই আর বড় হলে আর শ্রদ্ধা করতে পারেন না । সে যতই ছোটবেলা থেকে পিতাহি পরমন্তপঃ শেখান হোক না কেন। এছাড়া আছে "বড়রা যা বলেন তোমার ভালোর জন্যেই বলেন " - এই বলে বলে বিটারলি মিসগাইড করা হয়েছে এমন সব বাচ্চার দল। এদেরও একটা বড় অংশ পরে সেই সব গুরুজনকে হয়ত বা ভালবাসলেও ঠিক ততটা ভরসা করে উঠতে পারেন না। আবার অনেকেরই জীবনে বাবা-মা আলোর ঝলক আনেন। তাঁরা সারা জীবন ধরে বাবা-মার প্রতি জীবনদানের জন্য কৃতজ্ঞতা ছাড়াও অসীম শ্রদ্ধায় নত হয়ে থাকেন।
আসলে মানুষের প্রতি মানুষের একটা প্রাথমিক ভদ্রতার বোধ থাকা নিশ্চয় দরকার। মানুষের সঙ্গে ভদ্র, নম্র ব্যবহার করা, তাদের কাজের সমাদর করা, মানুষের প্রতি এম্প্যাথেটিক হওয়া, একজন মানুষ যে আরেকজনের থেকে আলাদা হবেন সেটা খুশী মনে মেনে নেওয়া এগুলো সবই ঐ প্রাথমিক ভদ্রতার বোধের মধ্যে পরে। তবে কিনা বোধ ব্যাপারটাই ভারী আপেক্ষিক , আর ঠিক মাপাও যায় না । আমি বলতেই পারি বাজারের সব্জি-ওলাকে তুই-তোকারি করা বা এমনকি তুমি বলাটাও খুবই খারাপ, আবার একজন গ্রামের মহিলা নির্দ্বিধায় আরেক অপরিচিতাকে তুমি বলতেই পারেন, একটুও অসম্মান না করেই, কারণ তিনি হয়ত কাউকেই আপনি বলে অভ্যস্ত নন। আপেক্ষিকতার বিবিধ প্যারামিটারের মধ্যে এটা একটা উদাহরণ মাত্র। তবে এখানে একটা কথা আবার করে বলার প্রয়োজন বোধ করছি, পরমতসহিষ্ণুতা নামক চারিত্রিক গুণটি এই প্রাথমিক ভদ্রতাবোধের মধ্যেই পরে।
তবু ওই ভদ্রতার সীমার বাইরে শ্রদ্ধা ব্যাপারটা খুবই ব্যক্তি কেন্দ্রিক। পুরোপুরি নিজের জোরে আদায় করে নিতে হয়। শুধুমাত্র পজিশন বা সম্পর্ক বা বৃত্তির জোরে সেটা দাবী না করতে যাওয়াই ভাল। ব্যক্তির সীমা ছাড়িয়ে গোষ্ঠী বা বৃত্তিগতভাবে কোন দলকে সামাজিক শ্রদ্ধা করতে শেখান’র একটা সমস্যাও আছে। তখন মজুতদারদের ল্যাম্পপোস্টে ঝোলাতে গেলে সব ব্যবসায়ীরাই শ্রদ্ধার আসন থেকে নেমে যান, তাতে সমস্যায় পড়েন পাড়ার নেহাত সৎ ব্যবসায়ীটিও। সেনাবাহিনীকে ব্ল্যাঙ্কেট শ্রদ্ধা করতে গেলে শ্রদ্ধার পাত্র হন আদর্শ হাউজিং সোসাইটির স্ক্যামের হোমরা-চোমরাও। তুলনায় বরং ব্যক্তি-শ্রদ্ধার সুবিধা হল যে সেনা-অফিসাররা কাশ্মিরী যুবকের দেহ জিপে বেঁধে ঘুরিয়েছিলেন তাদের তুমুল অপছন্দ করার পরেও যিনি প্রাণ হাতে করে ঐ পুলওয়ামাতেই বন্যাত্রাণ করেছেন তার প্রতি শ্রদ্ধায় নত হওয়ার জায়গা মেলে। যাচাই করে একজনকে শ্রদ্ধা করতে পারলে সে শ্রদ্ধার আসন অনেকখানি গভীরে যায়, তোতাপাখির মত মুখস্থ করে "এঁদের শ্রদ্ধা করা উচিত কারণ তাহাই শেখান হইয়াছে " বলে অন্ধ শ্রদ্ধা করলে যাকে শ্রদ্ধা করা হচ্ছে তারও কেমন অপমান করা হয় বলে মনে হয়. আর তার ফলে শ্রদ্ধা কথাটাই কেমন জোলো হয়ে যায়.
শ্রদ্ধা ছাড়াও একজন মানুষের ভান্ডারে অপর মানুষ বা অপর গোষ্ঠীর জন্য আরো অনেক অনুভূতি থাকতে পারে, কিছু পজিটিভ, কিছু হয়তো নেগেটিভ। গা-জোয়ারি করে সব পরিস্থিতিতে শ্রদ্ধা দাবী না করে, বরং পরিস্থিতির হিসেবে কষ্ট, দুঃখ, অসহায়তার বোধ, ক্ষোভ , ভবিষ্যতের ভয় এই সব অন্য অন্য অনুভূতিগুলোকে সামনে আনা হোক। এইগুলোও কিন্তু শ্রদ্ধার মতই জোরদার অনুভূতি। নিজস্ব অনুভব আর অনুভূতির প্রকাশকে একমাত্রিক করতে না চেয়ে আমরা বরং অনুভবের সততাকে বেশী সম্মান দেখাতে শিখি। সেনাবাহিনীর প্রতি যারা এমনিতেই শ্রদ্ধাবান, তাদের দেশপ্রেম তো এমনিতেই সব প্রশ্নের উর্দ্ধে। যারা ততটা জোর গলায় শ্রদ্ধা কথাটা বলে উঠতে পারলেন না, কিন্তু সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে নিজেদের অসহায়তার দুঃখটা যাদের মধ্যে চারিয়ে গেল, কয়েকটা প্রাণ অকালে ঝরে যাওয়ার দুঃখ যাদের কাতর করল, তাদের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলার আগে বরং দুবার ভাবা যাক। দেশ স্বাধীন হয়েছে বহু বছর - “মেরে পাস মা হ্যায়” বলাটাই শুধু মাতৃভক্তি দেখানোর একমাত্র উপায় নয় এটা বোঝার মত পরিণত-বয়স্ক আমরা আর কবে হব?