ঘটনা শুরু হয়েছিলো, সবাই জানেন, ২০১৯-এর জুন মাসের ১০ তারিখে ৮৫ বছরের এক শ্বাসকষ্টের বৃদ্ধকে মরণাপন্ন অবস্থায় নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজের ইমার্জেন্সিতে এনে ভর্তি করা দিয়ে। বাঁচানোর শেষ চেষ্টা হিসেবে ডাক্তারি নিয়ম মেনে জীবনদায়ী ইঞ্জেকশন দেবার অল্পসময় পরে রোগীটি দুর্ভাগ্যজনকভাবে মারা যান। যদিও বয়সটা খেয়াল রাখবেন – ৮৫ বছর। এরপরের ঘটনাই পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষে চিকিৎসাক্ষেত্রে আন্দোলনের অভিমুখ ঘুরিয়ে দিল। এক ঐতিহাসিক অধ্যায়ের হয়তো সূচনা হল এ রাজ্যকে কেন্দ্র করে। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, একজন চিকিৎসক হিসেবে আমিও একইরকম চিকিৎসা করতাম খুব সম্ভবত। রোগীটি আমার ‘হাতেও’ মারা যেতে পারতো।
কি সেই পরের ঘটনা? “ঘন্টাখানেক সঙ্গে সুমন” থেকে সমস্ত স্থানীয় এবং জাতীয় চ্যানেল, স্থানীয় সংবাদপত্র থেকে জাতীয়স্তরের প্রায় সব বড়ো, নামী এবং প্রচুর সার্কুলেশনের সংবাদপত্রে, বিভিন্ন পোর্টাল বাহিত হয়ে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে এ খবর। বৃদ্ধের মৃত্যুর পরে স্বাভাবিকভাবেই বেদনাহত রোগীর আত্মীয়পরিজন বর্তমান সময়ে বিরাজমান মানসিকতা নিয়ে (যা আমরা বিশেষত গত ৫-৬ বছর ধরে দেখছি) ডিউটিতে থাকা ইন্টার্নদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আক্রমণ করার আগে তারা যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়েছিলো। ট্যাংরা অঞ্চল থেকে ট্রাকে করে আঘাত করার বিভিন্ন অস্ত্রে সজ্জিত প্রায় ২০০ জন মানুষ (সংখ্যা আর কে মাথা গুনে হিসেব করতে গেছে?) ঝাঁপিয়ে পড়ে ইন্টার্নদের ওপরে সরাসরি আক্রমণ করার জন্য। এদের কি সাধারণ মানুষ বলা যাবে? সাধারণ মানুষ কি সংগঠিতভাবে এরকম আচরণ করে? আমরা এধরণের মনুষ্য সন্তানদের লুম্পেন বলেই জানি। আলোর বৃত্তের বাইরে থাকা অন্ধকারের জগতের বাসিন্দা যারা বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাজে লাগে। এ নিয়ে একটু পরে কথা বলছি।
[এ প্রসঙ্গে একটা কথা স্বীকার করতে কোন দ্বিধা থাকার কথা নয় যে, ওয়ার্ডগুলোতে ক্রমাগত মৃত্যু দেখে দেখে বেশ খানিকটা dehumanized হয়ে যাই আমরা। আমাদের মৃত্যু সম্পর্কে desensitization হয়। আমাদের কাছে রোগী হয়ে ওঠে একটি কেস নম্বর। কিন্তু রোগীর পরিজনের কাছে তা হল একজন মানুষের হারিয়ে যাওয়া, স্মৃতির মাঝে বেঁচে থাকা। মেডিসিনের সাথে সাধারণ মানুষের বোধের এই পার্থক্য ও টানাপড়েন সবসময়ই চলে। শুধু তাই নয় আমাদের সমগ্র শিক্ষাক্রমের মধ্যে সবার অলক্ষ্যে একটি লুকনো পাঠ্যসূচী (hidden curriculum) যা ক্রমাগত আমাদের সমস্ত শুভবোধ এবং রোগীর পাশে মমতা নিয়ে দাঁড়ানোর আন্তরিক আকাঙ্ক্ষার মাঝে ক্ষত তৈরি করে। New England Journal of Medicine-এ সেপ্টেম্বর ২৯, ২০০৫-এ প্রকাশিত সুসান ডি ব্লকের একটি প্রবন্ধ “Learning from the Dying”-এ মন্তব্য করা হয়েছিল – “Unfortunately, the “hidden curriculum” of contemporary medicine — especially the hurried, disease-centered, impersonal, high-throughput clinical years — still tends to undermine the best intentions of students and faculty members and the best interests of patients and families.”। পাঠ্যক্রমের এ চেহারা আমাদের কাছে সবসময় দৃশ্যমানও হয়না। আজকের সংকটের বিচারে এগুলো আমরা মাথায় রাখবো।]
পরিবহ কি অপরাধ করেছিলো? বয়সের বিচারে ও তো আমার সন্তানসম। আক্রান্ত হবার পরে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেছিল। পরিণতিতে ইঁট দিয়ে থেঁতলে দেওয়া হল। শুরু হল মৃত্যুর সাথে মরণপন লড়াই। শেষ অবধি আধুনিক চিকিৎসা হয়তো জয়লাভ করবে। এই আধুনিক চিকিৎসাই তো আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তাররা পৌঁছে দিতে চায় একজন আর্ত মানুষের কাছে। একজন মরণাপন্ন মানুষের কাছে? পারে কি? যেখানে জিডিপি-র হিসেবে স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় ১%-এর আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে, যেখানে মাথাভারী প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করতে হয়, যেখানে ব্লাড ব্যাংক রক্তশূণ্য অবস্থায় থাকে, যেখানে ১৩০০ রোগী পিছু ১ জন ডাক্তার সেখানে কিভাবে এই জুনিয়র ডাক্তাররা তাদের সমস্ত সদিচ্ছা সত্ত্বেও চিকিৎসার কাম্য সুবিধে পৌঁছে দেবে পিলপিল করে আঊটডোরে আসা রোগীদের কাছে? সমস্ত রোগী কলকাতার বা অন্য শহরের সরকারি মেডিক্যাল কলেজ এভাবে ভিড় করবে কেন? প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার খাঁচা পড়ে রয়েছে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে। সেখানে সংকটজনক রোগীর চিকিৎসা প্রায় নেই বললেই চলে। কিছু নিবেদিতপ্রাণ চিকিৎসক এবং চিকিৎসাকর্মীর হার-না-মানা জেদের জন্য অদ্ভুতভাবে কিছু রোগী আবার হাসিমুখে প্রাণ ফিরে পায়। কিন্তু সেটা সাধারণ চিত্র নয়। ভারতের মতো উপেক্ষিত প্রাইমারি কেয়ার বা প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পৃথিবীর কম দেশেই আছে। এমনকি শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড বা বাংলাদেশের মতো দেশেও প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা-র হাল ভারতের চেয়ে ভালো। প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙ্গেচুরে আছে বলে সমস্ত দরিদ্র মানুষের ঘটিবাটি বন্ধক রেখেও গন্তব্য মেডিক্যাল কলেজগুলি। ফল? এক অসম্ভব চাপ সামলাতে হয় ডাক্তারদের। এমনকি সরকারি হাসপাতালের চর্মরোগের অধ্যাপককেও প্রায় ৩০০ রোগীও একদিনে দেখতে হয়। একজন মানুষের পক্ষে সম্ভব? বুকে হাত রেখে নিজেকে জিজ্ঞেস করুন, সততার সাথে উত্তর দিন।
গ্রীন করিডর দিয়ে হার্ট বা কিডনি বিশেষ বিমানে বিশেষ ব্যবস্থায় নিয়ে এসে তা প্রতিস্থাপন করা চিকিৎসা বিজ্ঞানের ‘মিরাকল’ বা আউটস্ট্যান্ডিং স্টেট অব আর্ট – সাধারণ চিত্র নয়। একে কুর্ণিশ করি। সেরকমই কুর্ণিশ করি সেসব ডাক্তারদের যারা সরকারি হাসপাতালের ওয়ার্ডে এবং আউটডোরে প্রতিদিন শয়ে শয়ে ক্রনিক এবং acute রোগের মরণাপন্ন রোগীদের দেখেন এবং বেশিরভাগ রোগীকেই বাঁচিয়ে তোলেন। এই ধন্বন্তরিদের সিংহভাগ হচ্ছে আমাদের আক্রান্ত এবং আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তাররা। এরা আজ জীবন, নিরাপত্তা বাজি রেখে আন্দোলন করছে। কেন? কাজের জায়গায় নিরাপত্তা নেই। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার মতো অবস্থায় আক্রান্ত হতে পারে। পুলিশ দর্শক। প্রশাসন নির্বিকার, অ-সংবেদী, হৃদয়হীন। কেন?
রাষ্ট্রের অতিরাষ্ট্রের হয়ে ওঠার চারিত্র্যলক্ষণের মধ্যে আছে ক্রমশ ঘৃণাকে সামাজিক-সাংস্কৃতিকভাবে ছড়িয়ে দেওয়া – শব্দে, চিত্রকল্পে, প্রাত্যহিক সংলাপে। হিংসাকে আকর্ষণীয় প্রদর্শনী করে তুলতে হবে (spectacularized violence)। ধীরে ধীরে এগুলোকে সহনীয় করে তোলা। নিজের নিয়মেই সহনীয় হয়েও যায়। যাকে পছন্দ করিনা তাকে ‘দানব’ বানিয়ে দাও (demonization), শিক্ষা থেকে থেকে সরিয়ে দাও প্রশ্ন করার সাহস, উৎসাহ এবং পরিসর। শিক্ষকেরা হয়ে যাক educational managers, ছাত্রের মাঝে “কেন?”-র প্রবাহ তৈরি করার কোন জ্ঞানভিক্ষু নয়। একটি সংস্কৃতির জন্ম হবে যার ভিত্তি হবে কেবল তাৎক্ষণিকতা-নির্ভর, শুধুমাত্র বর্তমানকে চিনি বুঝি যাপন করি, অন্য কিছু নয়। অতীতের এবং ইতিহাসের পুনর্নিমাণ হবে। সমাজের অন্ধকার জগৎ (যাদেরকে চালু ভাষায় লুম্পেন বলা হয়) আলোয় আসার, রাজপথের দখল নেবার, ক্ষমতার বৃত্তের সাথে সংস্থাপিত থাকার গৌরব অর্জন করবে। এর হিংসা আর শক্তি প্রদর্শনের extra-judiciary, extra-state হাতিয়ার হয়। এরা “নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে”-র সৌম্যকান্তি পাগল চরিত্রটির মতো দুর্বোধ্য “গ্যাৎচরেৎশালা” উচ্চারণ করেনা। এরা স্পষ্ট ভাষায় হিংসা-ঘৃণা-হিংস্রতা-পেশির ভাষা উচ্চারণ করে। ভাষার চিহ্ন এঁকে দেয় “অপরের” শরীরে। পার্টি এবং রাষ্ট্রের ভেদরেখা মুছে যেতে থাকে। আমাদের বোঝা রাজনীতির চেনা ছকে ঠিক এই গল্পগুলো তৈরি হচ্ছেনা। এখানে রাষ্ট্র শুধু অতিরাষ্ট্রের আচরণ করছে তাই নয়। সমস্ত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে পাশ কাটিয়ে (extra-judiciary, extra-democratic) লুম্পেনদের হাতে সেই ক্ষমতা তুলে দেওয়া হচ্ছে যেখানে রুনু গুহনিয়োগীর প্রয়োজন পড়েনা। কারণ তাকেও তো একটা নামকাওয়াস্তে বিচারের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। এখানে সেসবের বালাই নেই। পার্টি এবং এদের লালিত extra-judiciary and -democratic institutions-এর বাইরে বেঁচে থাকা লুম্পেনরাজ ঘোষিতভাবে সমাজের চলন, নীতি, নৈতিকতা, ব্যক্তি জীবনের প্রতিটি পরিসর - সবকিছু নির্ধারণ করবে। পুলিশকে কম লাঠিচার্জ করতে হবে। পুলিশের চেয়েও সফল্ভাবে এরা সেই কাজ করে দিচ্ছে। রাষ্ট্র তার ‘গণতান্ত্রিক’ চেহারা নিয়েই থাকতে পারবে। ফলে পার্টি-রাষ্ট্র যখন পরস্পরের স্থান বদল করে তখন এই অন্ধকারের জীবেরা পার্টি ও রাষ্ট্রের জন্য বিশেষ প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে।
বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপট
একসময়ে কিশোর-যুবকদের স্বপ্নে ঘুরতো ‘একটি স্ফুলিংগ দাবানলের সৃষ্টি করতে পারে’। এবারের জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন খানিকটা সেরকম ব্যঞ্জনা নিয়ে এলো। গত ৫-৬ বছর খোদ কলকাতা, মুম্বই, দিল্লি, পুণা সহ সমস্ত বড়ো শহরে ডাক্তারেরা আক্রান্ত হয়েছেন। এদের মধ্যে সিনিয়র ডাক্তাররাও ছিলেন। শুধু জুনিয়র নয়। আরেকবার বলি, যেকোন চিন্তাশীল মানুষ বুঝবেন প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা বা primary care অতি দুর্বল জায়গায় এবং নড়বড়ে অবস্থায় রয়েছে বলে সামান্য জটিল পরিস্থিতিতে রোগীরা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে প্রায় ব্যতিক্রমহীনভাবে tertiary centre-এ রেফারড হয় (অবশ্য জোরালো “ক্যাচ” থাকলে পরিস্থিতি অবশ্যই অন্যরকম হয়)। এর ফলে tertiary centre-এ যেমন মুনাফা হয় (প্রাইভেট হাসপাতাল বা নার্সিং হোমের ক্ষেত্রে) তেমনি সরকারি হাসপাতালগুলোতে এক অসম্ভব চাপ তৈরী হয়। যথেষ্ট সংখ্যক ডাক্তার না থাকাও এর একটা বড়ো কারণ হয়ে ওঠে। পরিণতিতে একজন ডাক্তারের পক্ষে – সে জেনারাল ফিজিসিয়ানই হোক বা সুপার-স্পেশালিস্ট হোক – এ পরিস্থিতির মোকাবিলা করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। গড়ে রোগী পিছু দু-এক মিনিট করে সময় দেওয়াও কার্যত অসম্ভব হয়ে ওঠে। এর শিকার হয় ডাক্তার এবং রোগী উভয়েই। রোগীর মনে বাস্তবসঙ্গত কারণেই এমন ধারণা তৈরী হয়ে যে সে উপযুক্ত নজর ও গুরুত্ব পাচ্ছেনা, একটি কেস নম্বর ছাড়া এরকম স্বাস্থ্যব্যবস্থায় সে আর কিছু নয়। ডাক্তারের ভাবমূর্তি তৈরী হয় মানুষ-বিচ্যুত, রোগী সম্পর্কে উদাসীন এবং উদ্ধত (অনেক ক্ষেত্রেই সত্যিও বটে) এক না-মানুষ সত্তা। জীবন-মরণকে ঘিরে গড়ে ওঠা এক অতি সংবেদনশীল, নিতান্ত আবশ্যক, ঐতিহাসিক সম্পর্কের করুণ পরিণতির আলেখ্য রচনা হতে থাকে।
এখানে আরেকটি গূহ্যতর সত্যকে সংবেদী মানুষকে বুঝতে হবে। সমাজতত্ত্ব, রাজনৈতিক-অর্থনীতি বা পোলিটিক্যাল সায়ান্সের সামান্য পাঠও আমাদের অবহিত করে যে সামাজিক অনিশ্চয়তা, অর্থনৈতিক সুরক্ষা বা চাকরির সম্ভাবনাহীনতা যখন প্রাধান্যকারী জায়গায় থাকে তখন একদিকে জনমোহিনী রাজনীতির সামান্য অনুদানও জনসমাজ খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরতে চায়, আবার অন্যদিকে শূণ্যদিশা জনসমাজের প্রবল ক্ষোভ এবং অপূর্ণতা mob violence বা গণহিংসার চেহারা নিয়ে আছড়ে পড়ে। স্মরণ করতে পারি সত্যজিতের “জনঅরণ্য”, মৃণালের একাধিক ছবি, শ্যাম বেনেগাল বা গোবিন্দ নিহালনি-র বিভিন্ন চলচ্চিত্রের কথা। আমরা দেখেছি নিস্ফলা ক্রোধ এবং আক্রোশ কিভাবে জনসমাজে প্রতিবিম্বিত হয়। এখানে ডাক্তারকে স্থাপন করলে দেখবো সে একজন সফল, ঈর্ষণীয়ভাবে স্বচ্ছল এবং ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ। এর বিপরীতে রোগীটি আর্ত, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উপযুক্ত সম্বলহীন এবং ক্ষমতাকেন্দ্র থেকে দূরে থাকা একজন ব্যক্তি মানুষ। একদিক থেকে দেখলে এ দ্বন্দ্ব ক্ষমতা এবং ক্ষমতাহীনতার মধ্যেকার দ্বন্দ্বও বটে। কিন্তু ক্ষমতাসম্পন্ন হলেও একজন আমলা বা পুলিস বা শিল্পপতি বা রাজনৈতিক নেতার সাথে ডাক্তারের পার্থক্য হল একজন আমলা বা পুলিস বা রাজনৈতিক নেতা সরাসরি ক্ষমতাকেন্দ্রের অংশীদার, এর উপাদান। একজন শিল্পপতি বহুলাংশে এদের নিয়ন্ত্রক। কিন্তু একজন ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মী ক্ষমতাকেন্দ্রের সাথে যুক্ত নয়। এবং এ অর্থে “ক্ষমতাচ্যূত”, ফলে এরা জনরোষের ক্ষেত্রে একটি soft target যাকে সহজেই আক্রমণ করা যায়, নিজেদের প্রবল ক্ষোভকে সহজে উগড়ে দেওয়া যায় এদের ওপরে। একটি সহজ উদাহরণ হল একজন জনপ্রতিনিধি এয়ারলাইন্সের একজন অফিসারকে আক্ষরিক অর্থে পিটিয়েও দিব্যি মেজাজে ঘুরে বেড়াতে পারেন। কোন আইন নেই একে শাস্তি দেবার বা সাধারণ মানুষের সাধ্যি নেই একে ছোঁবার। কোন Parliamentary Act তৈরী হয়না একে স্পর্শ করার জন্য। বিপরীত চিত্রটি কলকাতায় ঘটে। করজোড়ে ক্ষমাপ্রার্থী বৃদ্ধ ডঃ আগরওয়ালকে গণপ্রহারে গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। দক্ষিণ বা পশ্চিম ভারতে গণপ্রহারে নবীন ডাক্তারের মৃত্যুও ঘটে।
আরেকটু তলিয়ে দেখলে চোখে পড়বে, বয়স এবং লিঙ্গ নিরপেক্ষভাবে একজন মানুষ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে এলে চিকিৎসা পাবে এটা সবার কাছে এতোই স্বাভাবিক একটি ঘটনা এবং এতোই স্বাভাবিকভাবে আমাদের আকাঙ্খা ও মর্যাদাবোধের মধ্যে পড়ে যে এর কোন ব্যত্যয় হলে আমরা আহত বোধ করি, উত্তেজিত হয়ে পড়ি। অথচ কলেজ বা স্কুলে ভর্তি হতে গিয়ে অসফল হলে এমন কোন বোধ জন্ম নেয়না। ওটাকে মেধার ঘাটতি বলে মেনে নিই। অর্থাৎ স্বাস্থ্যের অন্তর্লীন বোধের সাথে অন্য বিষয়গুলোর মূলগত পার্থক্য আছে। স্বাস্থ্য আমাদের কাছে একটি মূল্যবোধ বলে মনে হয়, এখনো জনমানসে সেভাবেই প্রতিভাত হয়। চিকিৎসক বা ডাক্তারকে গণ্য করা হয় এই মূল্যবোধের ধারক বা ব্যক্তরূপ হিসেবে। কিন্তু বিশেষ করে বিগত শতকের ৮০-র দশকের মাঝামাঝি থেকে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় ক্ষেত্রে value বা মূল্যবোধ সূক্ষ্মভাবে রূপান্তরিত হতে শুরু করলো বাজারের মূল্যমানে, যাকে বিভিন্ন স্তরের মূল্য দিয়ে ক্রয় করা যায়। এই রূপান্তরের এক সুদীর্ঘ কাহিনী রয়েছে যা এখানে আলোচনা করা সম্ভব নয়, বর্তমান পরিসরে খুব প্রয়োজনীয়ও নয়। শুধু এটুকু প্রাসঙ্গিকভাবে বলা যায় যে নোবেল প্রাইজ পাওয়া অর্থনীতিবিদ ফ্রেডেরিখ অস্টিন হায়েক ১৯৬০ সালে তাঁর The Constitution of Liberty গ্রন্থে প্রথম হেলথ সার্ভিস বা স্বাস্থ্য পরিষেবাকে মুক্ত বাজারের হাতে তুলে দেবার সুপারিশ করেন। (The Constitution of Liberty, পৃঃ ২৯৭-৩০০) এর তিনবছর পরে ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হল কেনেথ অ্যারো-র সমধিক বিখ্যাত গবেষণা প্রবন্ধ – “Uncertainty and the Welfare Economics of Medical Care”। এখানেও ভিন্ন যুক্তিতে মুক্ত বাজারের হাতে চিকিৎসাকে প্রায় পূর্ণত ছেড়ে দেবার কথা অত্যন্ত জোর দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হল – বিনা মূল্যে স্বাস্থ্য মিলবেনা, চাই ইন্সিউরেন্স। মূল্যবোধ যখন মূল্যমানে রূপান্তরিত হয় তখন রোগী হয়ে ওঠে একজন economic man তথা consumer বা ভোক্তা। হাসপাতাল বা নার্সিং হোম এর বিক্রয়কেন্দ্র আর চিকিৎসকেরা এর provider বা সরবরাহকারী।
এবিজেডিএফ-এর আন্দোলন - ১৯৮৩
আজকের আন্দোলন বোঝার জন্য একটু পেছিয়ে যাই। ১৯৮৩ সালে শুরু হয়েছিলো সম্পূর্ণত ভিন্ন চরিত্রের আন্দোলন দীর্ঘকালীন প্রস্তুতির মধ্য দিয়ে। সহজ করে বললে কয়েকটি প্রধান দাবীকে কেন্দ্র করে আবর্তিত ও বিস্তৃত হয়েছিলো এই ঐতিহাসিক আন্দোলন। সেগুলো এরকম – (১) স্বাস্থ্য আমার অধিকার, স্বাস্থ্য কোন ভিক্ষা নয়, (২) ২৪ ঘন্টা ব্লাড ব্যাংকে রক্ত সরবারহ রাখতে হবে, (৩) ২৪ ঘন্টা জরুরী এক্সরের মতো জরুরী পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে, এবং (৪) নিত্য প্রয়োজনীয় ওষুধের সরবরাহ সুনিশ্চিত করতে হবে। একটু ভেবে দেখলে বুঝবো এ দাবীগুলো মূলত রোগী-কেন্দ্রিক দাবী। এটা ঐতিহাসিক। ডাক্তারদের স্টাইপেন্ড বাড়ানোর দাবী পেছনে ছিলো।
এরও পেছনে রয়েছে আরেক ইতিহাস। ১৯৭৮-এ প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে ঐতিহাসিক আলমা-আটা কনফারেন্স শেষ হয়েছে। এর অভিঘাত বিশ্ব জুড়ে পড়েছে। ভারতও এ সিদ্ধান্তের অন্যতম স্বাক্ষরকারী ছিলো। ১৯৮৩-র আন্দোলনের নেতৃস্থানীয়রা আলমা-আটায় গৃহীত প্রস্তাবগুলো বিশেষভাবে প্রাণিত হয়েছিলেন।
১৯৭৮-এর আলমা-আটা সনদের ১০ নম্বর ধারায় বলা হয়েছিল – পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের জন্য একটি গ্রহণযোগ্য মানের স্বাস্থ্য ২০০০ সালের মধ্যে অর্জিত হতে পারে, যদি পৃথিবীর সম্পদকে পরিপূর্ণ চেহারায় আরো ভালোভাবে ব্যবহার করা যায়। এ সম্পদের এক বড়ো অংশ এখন ব্যয় করা হয় সমরসম্ভার গড়ে তুলতে এবং যুদ্ধের জন্য। আন্তরিকভাবে স্বাধীনতা, শান্তি, দ্বিপাক্ষিক বোঝাপড়া (détente) এবং নিরস্ত্রীকরণের নীতি প্রণয়ন অতিরিক্ত সম্পদ উৎপাদনের রাস্তা উন্মুক্ত করবে। এ সম্পদসম্ভারকে ব্যবহার করা সম্ভব আর করা উচিৎও শান্তির লক্ষ্যে এবং বিশেষ করে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য, যার মধ্যে একটি আবশ্যিক অংশ হিসেবে প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে এর অংশ দিতে হবে।”
মূল কথা, পৃথিবীর দূরতম প্রান্তের স্বাস্থ্যের সুযোগহীন মানুষটির জন্যও প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা সুরক্ষিত করতে হবে এবং এজন্য স্বাধীনতা, শান্তি, দ্বিপাক্ষিক আলাপ-আলোচনা এবং নিরস্ত্রীকরণের নীতি গ্রহণ করতে হবে যার মধ্য দিয়ে একটি দেশের সুষম বিকাশের জন্য আরো বেশি মানবসম্পদ সৃষ্টি হতে পারে। এবার বর্তমান যুদ্ধোন্মত্ততার পরিস্থিতিতে কিভাবে তৈরি হবে মানব সম্পদ? কিভাবে নির্মিত হবে স্থানীয় সম্পদ, পারস্পরিক বিশ্বাস, যূথ চেতনার উপর ভিত্তি করে জনস্বাস্থ্যের চেহারা? জনস্বাস্থ্যের চেহারা তো কোন প্রাতিষ্ঠানিক কিছু নয়, বড়ো বড়ো বিল্ডিং-ও নয়, নয় হোমরা চোমরা কেউকেটা আমলা এবং কর্তাদের দল। এখানে প্রয়োজন একেবারে প্রান্তিক স্তরে জনতার অংশগ্রহণ এবং পারস্পরিক সম্প্রীতি ও বোঝাপড়ার ভিত্তিতে স্বাস্থ্যের বনিয়াদ তৈরি করা। আলমা-আটা সনদের ৪ নম্বর ধারায় বলা হয়েছিল – “প্রতিটি ব্যক্তির অধিকার এবং দায়িত্ব রয়েছে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে নিজেদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা বা পরিষেবার (health care) পরিকল্পনা তৈরিতে এবং একে কার্যকরী করার ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করার।” এখানে জোর পড়লো সমাজের একেবারে তলার দিকে থাকা মানুষগুলোর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের ওপরে – কেবলমাত্র দর্শক হয়ে থাকা নয়। আমাদের এখানে স্বাস্থ্যের যে ধারণা এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থা বিরাজমান তা প্রধানত ভার্টিকাল – পিরামিডের গঠনের মতো। ওপরে সব মাথাভারী প্রশাসনিক কর্তারা বসে রয়েছে, তাদের ভার বহন করছে নীচের তলার সম্পদহীন, অধিকারহীন (entitlement), সম্বলহীন প্রায় ৯০ কোটি বা তার বেশি ভারতবাসী।
১৯৫০-৭০-র দশক জুড়ে বিশ্বরাজনীতিতে দ্বিমেরু বিশ্বের জীবন্ত উপস্থিতি ছিল। প্রবল পরাক্রান্ত, আগ্রাসী ও মুক্ত পুঁজি এবং সাম্রাজ্যবাদের মুখোমুখি দাঁড়ানোর মতো ভিন্ন একটি আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার অস্তিত্ব – সমাজতান্ত্রিক বলে যার উপস্থিতি ছিল জনমানসে। দ্বিমেরু বিশ্বের উপস্থিতির জন্য রাজনৈতিক এবং সামাজিক একটি পরিসর তৈরি হয়েছিল যাকে বলতে পারি “তৃতীয় পরিসর”। বিশ্বের মানুষের স্বাভাবিক আশা-আকাঞ্খা এবং দাবী নিয়ে দর কষাকষির ক্ষমতা বেশি ছিল। পরবর্তীতে একমেরু বিশ্বের উদ্ভব এসবকিছুকে পরিপূর্ণভাবে বিনষ্ট করে দেয় – আজকের ভারত এর একটি প্রোজ্জ্বলন্ত উদাহরণ। এ সময়েই পৃথিবী জুড়ে শ্লোগান উঠেছিল – স্বাস্থ্য আমার অধিকার।
ভারতের মতো দেশে এরকম বিপুলভাবে বিষম এক আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক আবহে যেখানে মুক্ত বাজারের হাতে সমর্পিত হচ্ছে স্বাস্থ্য এবং স্বাস্থ্য পরিষেবার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যখন এমন নতুন সিলেবাস তৈরির প্রস্তাব আসছে খোদ মেডিক্যাল কাউন্সিলের তরফে যেখানে ফ্যামিলি মেডিসিন, সাধারণ (বিশেষজ্ঞ নয়) প্র্যাক্টিশনার কিংবা ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান বা পারিবারিক চিকিৎসক ইত্যাদি শব্দের নামোচ্চারণও করা হয়না, যেখানে রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার পরিবর্তে ইন্সিউরেন্সের হাঙ্গর সদৃশ বহুজাতিক কোম্পানিগুলো প্রবেশ করে, সেখানে Comprehensive Primary Health Care (CPHC) কার্যকরী হবে কিভাবে? ভারতবর্ষের প্রায় ১৩০ কোটি মানুষের কাছে আজ এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আর আমাদের মতো শিক্ষিত বা ভয়ঙ্করী অল্পবিদ্যার আকরদের কাছে নৈতিক এবং দার্শনিকভাবে ভেবে দেখার মতো ঐতিহাসিক মুহূর্ত।
এবারের (২০১৯) আন্দোলন
এবারের আন্দোলন ১৯৮৩-র আন্দোলনের অনুসারী নয়। যারা আজকের আন্দোলন করছে তাদের জন্মই হয়তো হয়নি সেসময়ে। সেসময়ের আন্দোলনের বার্তাও এদের কাছে সেভাবে নেই ধরে নেওয়া যেতে পারে। এর মাঝে ১৯৮০-র দশকের শেষ থেকে মুক্ত বাজারের অর্থনীতি, কর্পোরতন্ত্র, রাজনৈতিক লুম্পেনিকরণ এমন একটা আগ্রাসী সামাজিক মানসিকতার জন্ম দিয়েছে যে সামাজিকভাবে হিংসা বপন করা হচ্ছে। এর প্রতিঘাত পড়ছে ডাক্তারদের ওপরে – একেতো সফট টার্গেট, তায় এমন একটা পেশায় আছে যেখানে আর্ত রোগীর জীবন-মৃত্যু একটি অদৃশ্য সূতোর উপরে ঝুলছে। ফলে খুব সহজে পরিবাহদের ‘ঘাতক’ বানিয়ে দেওয়া যায়।
কিন্তু ইতিহাস এখানে শেষ হয়না। ব্যপ্তিতে স্ফুলিংগ দাবানল হবার মতো এদের আন্দোলন ভারতের সর্বত্র ছড়িয়েছে, পশ্চিমাবাংলার প্রতিটি কোণে পৌঁছে গেছে, শিক্ষকরা কর্মবিরতি শুধু পালন করেননি সংহতি জানাতে mass resignation দিয়েছেন। ১০,০০০-এর বেশি চিকিৎসক এবং সমাজের প্রায় সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে অভূতপূর্ব মিছিল হয়েছে। এরকম ঘটনা বাংলার ইতিহাসে এর আগে কখনো ঘটেনি। ঘাঁটি আগলে পড়ে থেকেছে এনআরএস-এর জুনিয়র ডাক্তাররা। সমস্ত ভয়, শাসানি, প্রলোভনকে উপেক্ষা করে। স্বীকৃতি আর সমর্থন অর্জন করেছে বিদেশের চিকিৎসকদের কাছ থেকে – ইংল্যান্ড থেকে আমেরিকা, পাকিস্তান থেকে জাপান সর্বত্র প্রসারিত হয়েছে সংহতির বার্তা।
জুনিয়র ডাক্তাররা শ্লোগান তুলেছে – ‘বাঁচতে চাই, বাঁচাতে চাই’। আমরা এই বীরদের পাশে। পাশে সাধারণ মানুষও। মাথা উঁচু করে বাঁচার আরেক চিহ্ন জুনিয়র ডাক্তার আন্দোলন ২০১৯!!
আমাদের গলায় যতটুকু আওয়াজ জন্ম নিতে পারে সেটুকু দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে, রাষ্ট্রকে বলার সময় সমাগত –