ঘটনা – ১
কূপওয়াড়া সদর হাসপাতাল। রাজিয়া আর বিলালের বাড়ী থেকে ১৭ কিমি দূর। আগস্টের ৫ তারিখে কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা তুলে নেওয়া হল, গোটা রাজ্যে কারফিউ জারী করা হল – যানবাহন চলাচল বন্ধ, সরকারী নির্দেশে বন্ধ টেলিফোন, মোবাইল, ইন্টারনেট যোগাযোগ, তখনও রাজিয়া-বিলালের সংসারে একটা খুশীর ছোঁয়া – পরের মাসেই আসছে তাদের প্রথম সন্তান। কিন্তু বিধি বাম! আগস্টের আট তারিখ থেকে রাজিয়ার কিছু অসুবিধা হতে থাকে, গাড়ী ঘোরা কিচ্ছু নেই, তাই আর একটু দেখা যাক বলে অপেক্ষায় কাটে বারো ঘণ্টা। তারপর আর থাকতে না পেরে হাসপাতালের দিকে রওনা দেয় দুজনে। ওই অবস্থায় ১৭ কিলোমিটার পথের প্রায় বেশিটাই রাজিয়াকে পায়ে হাঁটতে হয়। তারপর কূপওয়াড়ার হাসপাতালে পৌঁছালে তাঁরা অবস্থা ভালো না বুঝে পাঠিয়ে দেন শ্রীনগরের লা দেদ হাসপাতালে। পথেই সন্তানটি মাতৃগর্ভে মারা যায়। সদ্য সন্তান-হারা বাবা-মা শোকটুকুও করতে পারে না, মৃত-সন্তানের দেহ নিয়ে বাড়ি ফিরবে কি করে সেই দুশ্চিন্তায়!
ঘটনা – ২
আইমানের অবশ্য হাসপাতালে পৌঁছাতে কোন সমস্যা হয় নি। আগস্টের ২৬ তারিখে তার সিজারিয়ান হওয়ার কথা ছিল। আগস্টের ২৩ তারিখে তার অজাতসন্তানের হার্টবিট নিয়ে কিছু সমস্যা দেখা দেয়, কিন্তু মোবাইলের অভাবে সিনিয়র ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায় নি। তাঁকে আনার জন্য গাড়ী পাঠানো হয়, তিনি যখন এসে পৌঁছান ততক্ষণে শিশুটি মৃত।
ঘটনা - ৩
সাজিদ আলির মা’র ডায়াবেটিস – ওষুধ দরকার। নিজের এলাকার সব দোকানে খুঁজেও ওষুধ অমিল। শেষকালে তিনি আম্ব্যুলেন্সে চেপে শ্রীনগরে আসেন – কিন্তু সেখানেও ওষুধ মেলে নি। অবশেষে তিনি সোজা দিল্লির প্লেনের টিকিট কাটেন। সেখান থেকে এক মাসের ওষুধ নিয়ে এসে মা’র হাতে তুলে দেন। সাজিদ আলির মায়ের কপাল ভালো! শোপিয়ান জেলার মীমান্দারের রিজওয়ান নবিকেও মায়ের ডায়াবেটিসের ওষুধ কিনতে শ্রীনগর আসতে হয়েছে – শোপিয়ানে সে ওষুধ অমিল। ইনহেলার মিলছে না খোদ শ্রীনগরেরই অনেক জায়গায়। অনেক সময় অবশ্য ওষুধ কিনতে যাওয়ার জন্য ব্লকেড পেরোন’র অনুমতিও মিলছে না ।
লক-ডাউনের কাশ্মীর। আগস্ট ৫ থেকে। পথ শুনশান – নেই কোন যানবাহন। যে দিকে চোখ যায় শুধু কাঁটাতার আর জলপাই পোশাক। নেই মোবাইল, ল্যান্ডলাইন বা ইন্টারনেটের সংযোগ। অ্যাম্বুলেন্স চলার অনুমতি আছে, কিন্তু তাকেও থামতে হচ্ছে পদে পদে। সরকারী মতে অবশ্য জনজীবন “স্বাভাবিক”। অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ ও জীবনদায়ী ওষুধ পর্যাপ্ত। বেবিফুডেরও স্টক যথেষ্ট। সরকারী সুত্রে এও জানানো হয় যে প্রায় ২৪ কোটি টাকার ওষুধ আগস্ট ৫- ২৫ তারিখের মধ্যে দোকানগুলোতে পৌঁছেছে। বেসরকারী খবর অতটা আশাপ্রদ নয়। ওষুধের দোকান, স্টকিস্ট আর ডিপোর মধ্যে যোগাযোগ নেই কোন। ওষুধের অর্ডার দিতে পারছেন না দোকান-মালিকেরা। অর্ডার যেখানে দিতে পারছেন, সেখানেও মিলছে চাহিদার থেকে অনেক কম। যেসব জীবন-দায়ী ওষুধকে তাপমান-নিয়ন্ত্রণ করে রাখতে হয়, সেগুলো ঠিকমত কোঅর্ডিনেশনের অভাবে ওয়্যারহাউসে বিনা-রেফ্রিজারেসনে পড়ে থেকে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে গেছে – মানুষের কাজে লাগে নি। শ্রীনগরের অবস্থা যদিবা মন্দের ভালো হয়, বাইরের দিকে যে কি অবস্থা তা কল্পনাতীত। আগস্টের ৫ তারিখের পর থেকে সেখানে কোন ওষুধ যেতে পারে নি। ইনহেলার, ইনসুলিনের মত ওষুধও সেখানে অমিল – পাওয়া যাচ্ছে শুধুই অ্যান্টিবায়োটিক । সঠিক তথ্য পাওয়া এখন অসম্ভব। শুধুমাত্র ওষুধের অভাবে বেশ কিছু মৃত্যু ঘটেছে বলে শোনা যাচ্ছে। অনন্তনাগের খুরশি বেগম এই হতভাগ্যদের মধ্যে একজন। হাঁপানির কারণে, ইনহেলারের অভাবে, বেসরকারী গাড়ীতে চেপে রাস্তার প্রতি ব্লকেডে ব্লকেডে থামতে থামতে হাসপাতালে যাওয়ার পথেই তাঁর মৃত্যু হয়।
এমনকি শোনা যাচ্ছে সরকারী হাসপাতালের ভাঁড়ারেও ওষুধের টানাটানি শুরু হয়েছে। অসমর্থিত সুত্রের আরও খবর যে সরকারী হাসপাতালে নাকি ভিড় কম রাখতে বলা হয়েছে যাতে চটজলদি কোন বড়সড় গণ্ডগোল হলে সহজে সামাল দেওয়া যায়। সেজন্য হার্নিয়া, কিডনি বা গলব্লাডার স্টোনের মত অসুখে হাসপাতালের ডাক্তারেরা প্রাথমিক চিকিৎসা করে ছেড়ে দিচ্ছেন। সার্জারি বন্ধ।
যানবাহনের অভাবে চিকিৎসাকেন্দ্রে গিয়েই পৌঁছাতে পারছেন না কত রোগী। ক্যান্সারের রোগীর কেমোথেরাপি চলছে, তিনি নির্দিষ্ট দিনে এসে পৌঁছতে পারছেন না। আবার কবে দিন পাবেন সেদিন আবার আসতে হবে। ডায়ালিসিসের রোগী সপ্তাহে তিনদিন ডায়ালিসিস দরকার, তিনি হয়ত মাত্র একদিনই এসে পৌঁছতে পারলেন। ফলে চিকিৎসা দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এমনকি ইমার্জেন্সীতে রোগীতে নিয়ে আসতে গেলে চড়া মাশুলের বেসরকারী গাড়ী ভরসা। অ্যাম্বুলেন্স চলছে বটে রাস্তায় – কিন্তু ফোন বা মোবাইল ফোন কিচ্ছু নেই, লোকে অ্যাম্বুলেন্সকে খবর দেবে কিভাবে? গাড়ী ঘোড়া চলছে না বলে, এক সরকারী হাসপাতালের আউটডোরে যেখানে দিনে আটশো – নশো রোগী আসত, সেখানে এখন দুশো- তিনশো রোগী আসছে।
এমনিতেই দীর্ঘ প্রায় তিরিশ বছরের টালমাটাল দশার ফলে কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের মধ্যে মানসিক অসুস্থতার হার খুবই বেশি - প্রায় ৪১% প্রাপ্তবয়স্ক অবসাদে ভোগেন – প্রায় প্রতি পাঁচজনে একজন পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিস-অর্ডারের রোগী। গোদের উপর বিষফোঁড়া, এই লক আঊট। যখন-তখন আটক হয়ে যাওয়ার ভয়, রাতের বেলা রেইড হওয়া, বাড়ি থেকে বেরোতে না পারা, আত্মীয়-স্বজন-বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারা ইত্যাদি কারণে অনেকেরই তীব্র মানসিক উদ্বেগে দিন কাটছে, প্যানিক আট্যাক হচ্ছে। এমনকি অনেকে যারা বহুদিন আগে রোগমুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন, তাঁরাও ফের পুরোন প্রেসক্রিপশন নিয়ে ওষুধের দোকানের দিকে রওনা দিচ্ছেন। যাঁরা চিকিৎসাধীন ছিলেন, তাঁদের একটা বড় অংশের মানুষের রোগের তীব্রতা বেড়ে গেছে। দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকয়, কোনরকম বিনোদনের উপায় না থাকায় শিশু-কিশোরদের ক্ষেত্রেও সাইকো-সোশ্যাল ট্রমার সম্ভাবনা বাড়ছে।
ওষুধের, সার্জিকাল ইমপ্ল্যান্টের অভাব, যোগাযোগের অভাবে ক্রিটিক্যাল কেয়ারের দেরী, রোগীদের চিকিৎসাকেন্দ্রে পৌঁছানর অসুবিধা, বিভিন্ন চিকিৎসাকেন্দ্রের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব নিয়ে মুখ খুলছেন ডাক্তাররাও। স্বাস্থ্যসংস্থাগুলির ল্যান্ডলাইন আর ইন্টারনেট যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করার দাবীতে গত ২৬ শে আগস্ট ইউরোলজিস্ট ডঃ ওমর সালিম আখতার শ্রীনগরের মুস্তাক প্রেস এনক্লেভে শান্তিপূর্ণ ধর্ণায় বসেন। তিনি সাংবাদিকদের জানান, গরীব মানুষেরা টাকার অভাবে ওষুধ কিনতে পারছেন না। সরকারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আয়ুস্মান ভারত প্রকল্পের সবটাই কাগজ-হীন আর সমস্ত কাজ ইন্টারনেটের মাধ্যমে হয় – ইন্টারনেট চালু না থাকার দরুণ দরিদ্র রোগীদের জন্যও কোন ফ্রি চিকিৎসা করা যাচ্ছে না! কথা বলার সময় তাঁকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে অবশ্য তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
এসব শুধুই নীরস তথ্য। আমরা কাগজে পড়ছি, নিজের ভাবনা-চিন্তার গতি অনুযায়ী কখনো উত্তেজিত হচ্ছি, কখনো বা “বাঃ কেমন টাইট দেওয়া গেল” ভেবে খুশী হচ্ছি। আমাদের বিপর্যয়ের স্মৃতি আসলে খুব পলকা। যেটুকু খুচরো কারফিউ আমরা দেখেছি তাকে আমরা “যাক বাবা, আজ আর অফিসে যেতে হবে না” বলেই ভেবে নিতে পেরেছি। অথবা তার থেকে খুচরো হিরোইজমের ডিভিডেন্ড তুলেছি ঘরে। প্রায় এক মাস ধরে সম্পুর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে ঘরে আটকে থাকতে কেমন লাগতে পারে সে গাঙ্গেয় সমতলের বাঙ্গালিদের জানা নেই। “দিন আনি, দিন খাই” মানুষের কি ভাবে চলছে তাও কি জানি ছাই! তবু দিন কয়েক আগেই ফোন করে এক বৃদ্ধ আত্মীয়ের কুশলসংবাদ নিতে গিয়ে হঠাৎ গলাটা কেঁপে উঠল। এই ফোন-সংযোগ, বিপদে-আপদে বয়স্ক পরিজনের থেকে আর্ত-আহ্বান এ যদি কোনদিন এক আঁচড়ে মিছে হয়ে যায়! আজকের মত দু কিলোমিটার দূরের হাসপাতালে একছুটে চলে যাওয়াটা যদি আর ঠিক ততটা সহজ না থাকে? যদি অসুস্থ সন্তানকে কোলে নিয়ে ওষুধের অভাবে বিনা চিকিৎসায় রাত কাটাতে হয়? ভারতীয় সংবিধানের উপর, জীবনের অধিকার, স্বাস্থ্যের অধিকার এই সব কথাগুলোর উপর তখনও ভরসা রাখতে পারব তো? নিজের বিপদে সামান্য সহানুভূতির বদলে যার রক্তচক্ষু দেখব, তাকে তারপরেও স্বদেশবাসী বলে ভালবেসে বুকে জড়িয়ে ধরতে পারব? আমার উত্তরটা আমি জানি, আপনার উত্তরটা?
তবু বাঃ জীবন বলতেই হয়। আগস্টের ন তারিখে ভোরে ইনশার জল ভাঙ্গতে শুরু করে। লা দেদ হাসপাতাল থেকে সাত কিলোমিটার মত দূরে তাদের বাড়ী। একটি অটো করে তাঁরা হাসপাতালে রওনা হলেও সেনা তাদের অটো আটকায় – তারা কোন বাহন যেতে দেবে না। অগত্যা ইনশা হাসপাতালের উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করেন। ছ’কিলোমিটার হাঁটার পরে তাঁর তীব্র বেদনা ওঠে, লা দেদ অবধি আর পৌঁছান হয় না, পথের পাশে একটি বেসরকারী হাসপাতালে তাঁর সন্তানের জন্ম হয়! সুস্থ। কন্যাসন্তান। কারফিউবালা – অস্থির সময়ের জাতিকা।
Pura bachpan jung mein pala hai
Dehshat ka samma joh geebat se bara hai
Harna, mere khoon mein kahan hai
Junoon ye gawah hai, maine maut se lada hai!
আহমের জাভেদ, কাশ্মিরী র্যাপ-গায়ক