এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • ১৯৭৮ থেকে ২০১৯র - আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যনীতির রূপান্তর, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এবং আমাদের ভারতবর্ষ - দ্বিতীয় পর্ব

    ডঃ জয়ন্ত ভট্টাচার্য লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯ | ২১২৯ বার পঠিত
  • প্রথম পর্ব | দ্বিতীয় পর্ব

    ১৯৭৮ – সকলের জন্য স্বাস্থ্য, ২০০০ সাল

    ১৯৭৮ সালে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সেসময় অব্দি সবচেয়ে বড়ো সম্মেলন হল অবিভক্ত রাশিয়ার কাজাখিস্তানে, ৬-১২ সেপ্টেম্বর। ১৩৪টি দেশের প্রতিনিধি, ৬৭টি আন্তর্জাতিক সংগঠন এবং বহুসংখ্যক অ-সরকারী সংগঠন এ সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলো। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বা WHO এবং শিশুদের আন্তর্জাতিক সংস্থা UNICEF ছিল এ সম্মেলনের যৌথ আহ্বায়ক। উল্লেখজনকভাবে, চীন এ সম্মেলনে অংশ নেয় নি। ১৯৭৮-এ বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মহাসচিব ছিলেন ডঃ হাফডান ম্যালার (Halfdan Mahler)। তাঁর দার্শনিক অবস্থানের ও চিন্তার একটি প্রতিফলিত চেহারাও বটে এ সম্মেলন। ইতিহাস বহু সময়েই নৈর্ব্যক্তিক হলেও ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে ব্যক্তির ভূমিকা বিশেষভাবে গুরত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এ ঐতিহাসিক সম্মেলনে ঘোষণা করা হল – Health for All by 2000 A.D (২০০০ সালের মধ্যে সকলের জন্য স্বাস্থ্য)। এ ঘোষণা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের অভিমুখ ও গতিবেগের জন্ম দিলো। ২০০০ সালের মধ্যে সকলের জন্য স্বাস্থ্য ভীষণভাবে অধরা থেকে গেলেও বেশ কয়েকটি দেশে সরকারী স্তরে ও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অ-সরকারীভাবে comprehensive primary health care বা সংহত প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবার ধারণা ক্রমশ বেগবান হয়ে ওঠে। ডঃ ম্যালারকে আমরা আরেকবার দেখি ২০০০ সালে, বাংলাদেশের সাভারে। First People’s Health Assembly সংগঠিত হয়েছিল সাভারে। মজার ব্যাপার হল, comprehensive primary health care বা সংহত প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবার কথা এ সম্মেলনে বলা হলেও একমাত্র ডঃ ম্যালার ছাড়া হু-এর তরফে আর কোন উচ্চপদস্থ কর্তা ব্যক্তি এ সম্মেলনে উপস্থিত হন নি। হু-এর মধ্যেকার বিভাজন সামনে আসতে শুরু করলো ২০০০ সালের মধ্যেই। এ সম্মেলনে আক্ষেপ করে বলা হল – The WHO must be an open and democratic organization that can also respond to the grass roots: listening to the people should not be difficult for Gro Harlem Brundtland, a former politician, and it is regrettable that she is not attending the People's Health Assembly. Her success as director general depends on the growth of popular health movements all over the globe which will be able to back up her call to make health central to the development process. (“The People’s Health Assembly”, British Medical Journal 321 (2000): 1361-2)

    একদিকে চীন থেকে কিউবা পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে অর্থপূর্ণ করে তোলার জন্য লাগাতার প্রয়াসের ফলিত চেহারা, হু-র তৎকালীন ডিরেক্টর জেনেরাল ডঃ ম্যালার-এর বিশেষ মতাদর্শগত অবস্থান, আবার অন্যদিকে মুক্ত বাজার অর্থনীতির বর্তমান সর্বগ্রাসী শক্তি ও উপস্থিতির তুলনায় দুর্বলতর অবস্থান এবং একমেরু বিশ্ব না থাকা – সবকিছুর সামগ্রিক যোগফলে ও ফলশ্রুতিতে জন্ম নিল ১৯৭৮-এর সনদ। মোট ১০টি অনুচ্ছেদ ও উপ-অনুচ্ছেদে বিভক্ত এই ঘোষণাপত্রে স্পষ্ট ভাষায় বলা হল – “that the attainment of the highest possible level of health is a most important world-wide social goal whose realization requires the action of many other social and economic sectors in addition to the health sector”। অর্থাৎ স্বাস্থ্য-কে অর্জন করা এবং একে রক্ষা করা আন্তর্জাতিকভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষের মধ্যে একটি এবং এ লক্ষ অর্জনের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র স্বাস্থ্যের বাইরেও আরো অনেক সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রসঙ্গ জড়িয়ে আছে। এক কথায় বলা যায় স্বাস্থ্য একটি ব্যতিক্রমহীনভাবে রাজনৈতিক বিষয়ও বটে। আরো বলা হল – The people have the right and duty to participate individually and collectively in the planning and implementation of their health care. অর্থাৎ একজন নাগরিকের (প্রজার নয়) প্রতিচ্ছবি এলো ঘোষণাতে।

    আমরা দেখবো কিভাবে নাগরিকের দায়িত্ব ও অধিকারের এ ধারণা পরবর্তী সময়ে ক্রমান্বয়ে পর্যবসিত হল consumer বা ভোক্তার ধারণায় এবং সামাজিক মানুষের পরিবর্তে একক ব্যক্তি ও অর্থনৈতিক মানুষের ধারণায়। দায়িত্ব ও অধিকারের ধারণা রূপান্তরিত হল স্বাস্থ্যের মুক্ত বাজারে ক্রেতার তথাকথিত choice-এর বোধে। স্বাস্থ্য সুরক্ষিত করার ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকাও খুব স্পষ্ট ভাষায় উচ্চারিত হয়েছিলো ১৯৭৮-এর ঘোষণাপত্রে। নয়া-অর্থনৈতিক নীতি ও ধারণায় যেমন জীবনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অনুষঙ্গের মাঝে বিভাজন রেখা টানা হয় সেরকম কোন বিভাজন রেখা এখানে অনুপস্থিত। স্বাস্থ্যকে তখনো রাষ্ট্রের পরিবর্তে খোলা বাজারের হাতে অর্পণ করা হয় নি।

    ডেভিড ওয়ার্নার যখন ১৯৬০-৭০-এর পশ্চিম মেক্সিকোতে হতদরিদ্র জনজাতির মাঝে একেবারেই স্থানীয় সম্পদ ও জনতাকে ব্যবহার করে স্বাস্থ্যের বোধ ও এর জন্য আন্দোলন গড়ে তুলছেন তখন তাঁকে সম্মিলিত ল্যান্ড ব্যাংক-ও গড়ে তুলতে হচ্ছে দারিদ্র্যের মাত্রা হ্রাস করার জন্য। সেসময়ে তাঁর স্বাস্থ্য আন্দোলনের বৃহৎ প্রতিবন্ধক হয়ে উঠছে নাফটা বা North American Free Trade Agreement। নাফটা মেক্সিকো সরকারকে চাপ দিচ্ছে যাতে এদের বীজ ও প্রযুক্তি অবাধে ব্যবহার করা যায়। এবং এ ঘটনা ঘটাতে পারলে জমি ব্যাংক উঠে যাবে, কৃষক আবার ঋণের জালে জড়াবে, প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অস্তিত্বও থাকবে না। এরকম সহজবোধ্য কারণে জীবনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অনুষঙ্গের মাঝে বিভাজন রেখা টানা নয়া অর্থনীতির প্রবক্তাদের জন্য খুব জরুরী হয়ে পড়ে। সাম্প্রতিক সময়ের একটি প্রবন্ধে মন্তব্য করা হয়েছে যে আমেরিকা ইরাকে যুদ্ধের জন্য ১০০ বিলিয়ন ডলার খরচ করতে প্রস্তুত, কিন্তু এইডস, যক্ষা এবং ম্যালেরিয়ার মোকাবিলার জন্য তৈরী Global Fund-এ মাত্র ১০০ মিলিয়ন ডলার দেয়। (John H Hall, Richard Taylor, “Health for all beyond 2000: the demise of of the Alma-Ata Declaration and primary health care in developing countries”, Medical Journal of Australia 178 (2003): 17-20)

    এ সনদে আরো বলা হল – “A genuine policy of independence, peace, détente and disarmam ent could and should release additional resources that could well be devoted to peaceful aims and in particular to the acceleration of social and economic development of which primary health care, as an essential part, should be allotted its proper share.” এ বক্তব্য থেকে নিতান্ত পরিষ্কার হয় যে যুদ্ধখাতে ব্যয়বরাদ্দ স্বাস্থ্যকে সঙ্কুচিত করে এবং প্রথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে কার্যকরী করতে হলে শান্তির জন্য প্রচেষ্টাও একটি অর্থপূর্ণ পদক্ষেপ হয়ে ওঠে। অর্থাৎ, যুদ্ধখাতে ব্যয়-বরাদ্দ কমিয়ে জনকল্যাণমূলক ক্ষেত্রে ব্যয় বাড়ানোর মতো ঘোরতর রাজনৈতিক বার্তাও ছিলো এ ঘোষণাপত্রের বিশেষ বৈশিষ্ট।

     মুশকিল হচ্ছে তেলের এবং খনিজ সম্পদের বাজারের জন্য সমগ্র পশ্চিম এশিয়া ও মিশর অশান্ত হয়ে না উঠলে যুদ্ধাস্ত্র বিক্রীর বিপুল মুনাফা হয় না। স্বাস্থ্য এখানে দুয়োরাণীর-ও অধম যে! এজন্য এরকম সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সনদপত্র মুক্ত বাজারের প্রবক্তাদের পক্ষে হজম করা অসম্ভব একটি ঘটনা। ২০১৫ সালে ফরচুন পত্রিকার সমীক্ষা অনুযায়ী সবচেয়ে লাভজনক প্রথম ১০টি লগ্নীর মধ্যে চিকিৎসা পরিষেবার অবস্থান।

    এ কারণে ১৯৭৮-এর প্রতিক্রিয়ায় এবং এ প্রবণতাকে আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিহত করার জন্য আরেকটি আন্তর্জাতিক কার্যক্রম সেসময় দিয়েই জন্ম নিতে থাকলো। অতি সংক্ষেপে সে ইতিহাস একবার দেখে নেওয়া যাক।

    তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে

    ১৯৭৭ সালে Allan Enthoven মুক্ত বাজারের উপযোগী Consumer Choice Health Plan (“এ ন্যাশনাল হেলথ ইন্সিউরেন্স প্রোপোজাল বেসড অন রেগুলেটেড কমপিটিসন ইন দ্য প্রাইভেট সেক্টর”) তৈরি করলেন। আমেরিকার কার্টার প্রশাসন এটাকে অনুমোদন করলো। নিঊ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন-এ ১৯৭৮ সালের মার্চ মাসে “Consumer Choice Health Plan” শিরোনামে দুটো কিস্তিতে প্রকাশিত হল এ লেখা। ১৯৭৯-এর ২৭শে ডিসেম্বর Wall Street Journal-এ প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ বিশ্লেষণ করে দেখালো যে হেলথ কেয়ার করপোরেশনগুলোর নীট আয় ১৯৭৯ সালে ৩০-৩৫% বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ১৯৮০ সালে আরো ২০-২৫% আয় বৃদ্ধি প্রত্যাশিত। নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন-এর প্রাক্তন প্রধান সম্পাদক তাঁর এক প্রবন্ধে জানালেন – ১৯৭৯ সালে কেবলমাত্র বিভিন্ন ধরনের ডাক্তারি পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যয়িত অর্থের পরিমাণ ১৫ বিলিয়ন ডলার এবং যৌগিক পদ্ধতিতে প্রতি বছরে শতকরা ১৫ ভাগ হারে বাড়বে। (Arnold Relman, “The New Medical-Industrial Complex,” NEJM 1980, 303(17): 963-970) এ লেখাতেই রেলম্যান জানালেন যে আমেরিকানরা ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও মালিকনায় এবং মুনাফার তাগিদকে বিশ্বাস করে।

    এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো যে মেডিক্যাল পরিষেবাকে মুক্ত বাজারের হাতে ছেড়ে দেবার এবং একটি প্রতিযোগিতামূলক ক্ষেত্র হিসেবে দেখার প্রথম প্রস্তাব আসে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ কেনেথ অ্যারো-র সুবিখ্যাত গবেষণাপত্র “Uncertainty and the Welfare Economics of Medical Care”। এ লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল The American Economic Review-এ ১৯৬৩ সালে। মজার ব্যাপার হল জনস্বাস্থ্য নিয়ে WHO-র অবস্থান সাম্রাজ্যবাদ এবং কর্পোরেট পুঁজির চাপে যখন ক্রমাগত বদলে বদলে যাচ্ছে, সংকুচিত হচ্ছে জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্র এবং সবার জন্য স্বাস্থ্যের প্রসঙ্গ তখন অর্থাৎ ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে WHO-র মুখপত্র Bulletin of the WHO-তে কেনেথ অ্যারো-র লেখাটির নির্বাচিত অংশ ছাপা হল। মূল লেখাটি ৩৩ পৃষ্ঠার, WHO ছেপেছিল ৯ পৃষ্ঠা। অ্যারো তাঁর অবস্থান প্রবন্ধের গোড়াতেই স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন – “the subject is the medical-care, not health. The causal factors in health are many, and the provisio of medical care is only one.” এরপরে তিনি “analysis of the medical-care market”-এ প্রবেশ করেন। বলেন – “in the analysis of the medical-care market is comparison between the actual market and the competitive model…” ইন্সিউরেন্সের প্রসঙ্গ আনেন অ্যারো – “It is frequently observed that widespread medical insurance increase the demand for medical care.” এক অদ্ভুত যুক্তি জালের মধ্যে আমরা প্রবেশ করলাম – একদিকে, ইন্সিউরেন্সের প্রসঙ্গ এলো স্বাস্থ্য পরিষেবার জগতে; অন্যদিকে, ইন্সিউরেন্সের বহু বিস্তৃত ব্যবহার যে স্বাস্থ্য পরিষেবার চাহিদা বাড়াবে এ প্রসঙ্গও চলে এলো। কিন্তু তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি যে পণ্য দুনিয়ার অন্যক্ষেত্রের মতো এখানে শুধু কেনাবেচার-র সম্পর্ক নয় – একজন ব্যক্তি মানুষের অন্যের স্বাস্থ্য নিয়েও চিন্তা ও ঊদ্বেগ থাকে যা পণ্য জগতের অন্যক্ষেত্রে দেখা যাবেনা। তাঁর অভিমত – “The economic manifestations of this taste are to be found in individual donations to hospitals and to medical education, as well as in the widely accepted responsibilities of government in this area.” KFC, Nike কিংবা অ্যাডিডাসের ক্ষেত্রে আমরা নিশ্চয়ই এ দৃশ্য দেখতে পাবোনা।

    প্রসঙ্গত আমরা স্মরণ করবো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে পারমাণবিক বিস্ফোরণের প্রয়োজনে নতুন নতুন প্রযুক্তির জন্ম হয়েছিলো (যেমন নিউক্লিয়ার অ্যাক্সিলেরটর, যার ফলিত চেহারা সিটি স্ক্যানার, এম আর আই ইত্যাদি) এবং এর জন্য স্বাভাবিকভাবেই বিপুল অর্থের বিনিয়োগ হয়েছিলো। যুদ্ধোত্তর সময়ে এই বিনিয়োগের পরবর্তী দীর্ঘকালীন মুনাফা ধরে রাখার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে এ সমস্ত প্রযুক্তি রফতানি নিতান্ত জরুরী হয়ে পড়লো। মেডিসিনের জগত এক্ষেত্রে সবচেয়ে সফল ও কার্যকরী অবস্থা তৈরি করতে পেরেছিল। কারণ সহজেই অনুমেয়। পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব মুহূর্ত থেকে সবসময়েই মানুষের স্বাস্থ্য ও অসুস্থতা একসাথে সহাবস্থান করে। ফলে অসুস্থ মানুষ মেডিসিনের ও চিকিৎসকের ওপরে নির্ভর করবেই এবং এর সাথে সমগ্র চিকিৎসা ব্যবস্থাকে যদি প্রযুক্তি নির্ভর করে তোলা যায় তাহলে অসুস্থতা থেকে আহরণ করা অবাধ মুনাফা নিয়ে দুশ্চিন্তা কমে যায়। এর পূর্বশর্ত দুটি – (১) চিকিৎসাকে মুক্ত বাজারের অর্থনীতির আওতায় আনতে হবে এবং সাধারণ জনসমাজকে এই অর্থনৈতিক দর্শনে বিশ্বাসী করে তুলতে হবে, (২) স্বাস্থ্য-র এবং “সংহত প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা”-র (comprehensive primary health care) ধারণাকে স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং “বেছে নেওয়া প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা”-র (selective primary health care) ধারণা দিয়ে ধীরে ধীরে প্রতিস্থাপিত করতে হবে। একই সাথে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ থেকে স্বাস্থ্য পরিষেবাকে পূর্ণত মুক্ত করে ফেলতে হবে। গবেষকেরা দেখিয়েছেন কিভাবে ১৯৭০ পরবর্তী সময়ে নয়া-উদারবাদী স্বাস্থ্যনীতি “have shifted resources from the public to the private sector, reduced benefits to recipients, and affected the lives of clients and workers alike.” (Mimi Abramovitz, Jennifer Zelnick, “Double Jeopardy: The Impact of Neoliberalism on Care Workers in the United States and South Africa”, International Journal of Health Services 2010, 40 (1): 97-117)

    “Selective Primary Health Care” শিরোনামে প্রথম লেখা প্রকাশিত হল নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল-এ ১৯৭৯ সালের নভেম্বর মাসে। প্রাথমিকভাবে আলমা-আটা কনফারেন্স-এর প্রতিধ্বনির মতো কিন্তু ভিন্ন যুক্তিক্রম দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হল এর যাথার্থ্য। লেখার শুরুতে জানানো হল পৃথিবীর অনুন্নত বিশ্বের ৩০০ কোটি মানুষ “suffer from a plethora of infectious diseases.” আসল মজা শুরু হল তারপরে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারা-কে উদ্ধৃত করে বলা হল – যে যুগে আমরা ক্রম-হ্রাসমান সম্পদ পাচ্ছি তখন কিভাবে যারা নীচের দিকে আটকা পড়ে আছে তাদের জন্য ২০০০ সালের মধ্যে স্বাস্থ্য ও ভালো-থাকা-কে সুনিশ্চিত করতে পারি? (Julia A. Walsh and Kenneth S. Warren, “Selective Primary Health Care: An Interim Strategy for Disease Control in Developing Countries,” NEJM 1979, 301(18): 967-974)

    সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হল এ লেখায়  ২০০০ সালের উল্লেখ, “Selective Primary Health Care”–এর ধারণার আমদানি এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাংক-এর আগমন ঘটলো স্বাস্থ্য সংক্রান্ত রিপোর্টে। পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালে ডেভিড প্রাইস দেখিয়েছেন “How the World Trade Organizaton is shaping domestic policies in health care”। (Lancet 354 (1999): 1889-92)। NEJM-এ ১৯৮১ সালে প্রকাশিত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ লেখায় (“Health Care in the Developng World: Problems of Scarcity and Choice”) লেখকেরা বললেন যে গ্রামীন জনসাধারণের জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যাবস্থা-কেন্দ্রিক যে দৃষ্টিভঙ্গি “may need to be modified to address different problems arising from life styles and diets in the urban setting.” অদ্ভুত ব্যাপার হল শহর এবং গ্রামকে গুলিয়ে দেবার চেষ্টা এবং সামাজিক অসাম্যের ব্যাধিকে লাইফ স্টাইল এবং খাদ্যাভাসে সীমায়িত করে ফেলা।

    এসমস্ত কিছুই ১৯৭৮-এর সম্মেলনের বিপরীতে ও বৃহৎ ওষুধ কোম্পানী এবং আমেরিকার উপযোগী মুক্ত নয়া-উদারবাদী বাজারের অর্থনীতির স্বপক্ষে। শুরু হল বিশ্ব স্বাস্থ্যব্যবস্থার রূপান্তর। শুরু হল অসুস্থতা ফেরী করা বা “disease mongering”-এর বিশ্বব্যাপী জাল বিস্তারের সফল, সূক্ষ্ম ও বিপজ্জনক কার্যক্রম। (দ্রষ্টব্য – Ray Moynihan, Allan Cassels, Selling Sickness: How Drug Companies Are Turning Us All Into Patients, 2005)

    নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল-এর সম্পাদক আর্নল্ড রেলম্যান পরিষ্কার ভাষায় জানালেন যে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত প্রাথমিক নীতি হবে “এমন এক নীতি যা দামের বিনিময়ে নির্ধারিত মুক্ত বাজারের শক্তিকে শক্তিশালী করবে”। (Arnold Relman, “The Allocation of Medical Resources”, Journal of Medical Education 1979, 55(2): 99-104)। অস্যার্থ, যা ছিল রাষ্ট্রের হাতে তাকে তুলে দিতে হবে মুক্ত বাজারের শক্তির হাতে। স্বাস্থ্য রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব হবার বদলে (যেমন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ বা আলমা আটা-র ঘোষণায় বলা হয়েছিল) চলে যাবে বাজারের হাতে। এবং মুক্ত অর্থনীতি ও বাজার যা কেনা-বেচা করবে তা “স্বাস্থ্য পরিষেবা”, স্বাস্থ্য নয়। “স্বাস্থ্য” পর্যবসিত ও রূপান্তরিত হল “স্বাস্থ্য পরিষেবা”-তে। কৌতুকজনক অথচ অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এক্ষেত্রেও অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণে এগিয়ে এলো বা গ্রহণ করতে বাধ্য হল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

    এর বিপরীত স্বরও কিংবা সতর্ক বার্তা শোনা গিয়েছিল। কিন্তু এতে কান দেবার মতো মানসিক অবস্থান পৃথিবীর প্রাধান্যকারী অংশের ছিলোনা। Kingam Brewster ১৯৭৯-র অক্টোবর মাসে “জার্নাল অব দ্য রয়্যাল সোসাইটি অব মেডিসিন”-এ একটি প্রবন্ধ লেখেন “Health at any price?” শিরোনামে। এ প্রবন্ধে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ ফারাক করলেন পণ্য দুনিয়ার “economic man” এবং সাধারণ রোগীর মাঝে। আরেকটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ফারাক হল এখানে আর্ত মানুষ বিশ্বাস করার মতো একজন “trustee” খোঁজে, পণ্য দুনিয়ার “provider” নয় – The trouble is that the patient, when he thinks something is wrong with him, is not an economic man. He is a fearful, ignorant, helpless, miserable creature. He does want health, almost at any price. He is not looking for what the economists call a 'provider'. এ প্রবন্ধের পরবর্তী অংশে মন্তব্য করেন চিকিৎসার “বাজার” পড়ে যায় কারণা “the physician-patient relationship is not one of a seller and a buyer bargaining for each other”।

    আমরা বর্তমান সময়ে দেখবো পণ্য দুনিয়ার সাধারণ নিয়মের মধ্যে একজন “economic man” হিসেবে আর্ত, চিকিৎসাপ্রার্থী একজন রোগীকে গড়ে নেবার চেষ্টা চলছে। ক্রেতা-বিক্রেতার দরাদরির মধ্যে এসে পড়ছে চিকিৎসার মতো জীবন-মরণের সীমানায় দাঁড়ানো স্পর্শকাতর বিষয়টি। মেডিক্যাল কেয়ার বা স্বাস্থ্য পরিষেবা গিলে নিয়েছে স্বাভাবিক “স্বাস্থ্য”-র বোধকে। আমিও এখানে স্বাস্থ্যকে রাখলাম বন্ধনীচিহ্নের মাঝে। বাজারের কি পরিহাস বা শক্তি যাই বলুন!

    হু-র আগে UNICEF “সিলেকটিভ প্রাইমারী হেলথ কেয়ার”-এর ধারণা গ্রহণ করে এবং GOBI (Growth monitoring, Oral re-hydration Solution, brestfeeding and Immunization) প্রকল্প গ্রহণ করে। এ বিষয়ে ফ্রান বম-এর গবেষণা পত্র উল্লেখযোগ্য (Fran Baum, “Health for All Now! Reviving the spirit of Alma Ata in the twenty-first century: An Introduction to the Alma Ata Declaration,” Social Medicine 2007, 2(1): 34-41) একই সাথে হারিয়ে যেতে থাকলো সংহত প্রাথমিক স্বাস্থ্যের ধারণা।

    ২০০০ সাল থেকে আসতে শুরু করলো “universal health coverage (UHC)” বা “universal access to healthcare”-এর তত্ত্ব। WHO জানালো - The goal of universal health coverage is to ensure that all people obtain the health services they need without suffering financial hardship when paying for them. মেডিসিনের মান্য জার্নাল Lancet এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করছে – “The resolution and its UHC concept firmly and narrowly centre on health insurance packages financed through pre-payment.” Lancet-এর আরেকটি পর্যবেক্ষণ – “the clinical sector commonly tends to emphasize specialist curative over health promotion or preventive primary care.” (“Public health, universal health coverage and Sustainable Development Goals: can they coexist?”, Lancet June 30, 2015, pp. 1-3) এ লেখাতেই বলা হল ভারসাম্যহীনভাবে UHC-র অনুপ্রবেশ স্বাস্থ্য ও সামাজিক ক্ষেত্রে অসাম্য বাড়িয়ে দেয়, স্বাস্থ্য ও এ সংক্রান্ত বিনিয়োগকে সম্পদশালী গ্রুপের পক্ষে “disproportionately” লাভজনক করে তোলে।

    এছাড়াও, হেলথ সার্ভিস বা স্বাস্থ্য পরিষেবার মজা হচ্ছে যে যত পুঁজি বিনিয়োগ করতে পারবে সে বিনিয়োগকারীর সার্ভিস ততো লোভনীয় ও আকর্ষণীয় হবে। এমন কি সাধারণ মধ্যবিত্ত, মায় দরিদ্র মানুষ পর্যন্ত ঘটি-বাটি বন্ধক রেখে এই সার্ভিস পাঁচতারা ঝাঁ-চকচকে প্রাইভেট হাসপাতাল থেকে কিনবে। আর পাঁচটা পণ্যের মতো চিকিৎসা-তুল্য বিষয় হয়ে ওঠে কেনাবেচার সামগ্রী। ভারতের প্রসঙ্গে একেবারে হালে নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল-এ মন্তব্য করা হল – যত বেশি করে রাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা শুকিয়ে যেতে ও হ্রাস পেতে থাকলো তত বেশি করে প্রাইভেট সেক্টর সক্রিয় ও কার্যকরী হয়ে উঠলো (K. Srinath Reddy, “India’s Apirations for Universal Health Coverage”,  New England Journal of Medicine 2015, 371 (1): 1-5) বর্তমানে প্রাইভেট সেক্টর ইন-ডোর রোগীর ৮০% এবং আউটডোর রোগীর ৬০%-এর পরিষেবা দেয়। এর ফলশ্রুতিতে স্বাস্থ্যখাতে ৭০% ভাগ খরচ নিজেদের পকেট থেকে মেটাতে হয়, মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়ে। AIIMS-এর মতো সরকারী ভর্তুকী পুষ্ট আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করা ছাত্রদের শতকরা ৫৪ জন পাড়ি দেয় বিদেশে, এদেশে থাকে না।

    আমেরিকান অর্থনৈতিক দর্শন তৈরি করে নেয় চিকিৎসা পণ্যের বাজার। সরকারী হাসপাতাল পড়ে থাকে হতদরিদ্রদের জন্য। Lancet-এ ২০১৪ সালের একটি প্রবন্ধে মন্তব্য করা হয়েছিল যে আন্তর্জাতিকভাবে স্বাস্থ্যের লক্ষ্যসীমায় পৌঁছুন হল “an achievement that has the potential totransform health systems, especially for the poorest people.” রাষ্ট্রহীন মানুষেরা যাদের মধ্যে উদ্বাস্তু বা শরণার্থী, প্রমাণপত্রহীন পরিযায়ী মানুষ অথবা যাদের জন্মের নথিভূক্তি অস্বীকার করা হয়েছে, এদেরকে রাষ্ট্রের সর্বশক্তিমান কর্তাব্যক্তিরা “without legal entitlement to any rights to health care” বলে মনে করেন। (“What does universal health coverage mean?”, Lancet January 18, 2014, pp. 277-279) মানুষ হিসেবে এরা বেঁচে আছে অথচ স্বাস্থ্যের অধিকার নেই! এ এক বিচিত্র ছলনা – কে নেবে এ সমাধানের দায়িত্ব? এখানে আরেকটি প্রবন্ধের কথা বলবো যেখানে দেখানো হয়েছে নতুন স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত প্রোগ্রামগুলো প্রাথমিকভাবে ধনীদের কাছে পৌঁছয়, এবং পরবর্তী সময়ে তা চুঁইয়ে পড়ে দরিদ্রদের মাঝে। (“Universal health coverage: friend or foe of health equity?”, Lancet June 25, 2011, pp. 2160-2161)

    উল্লেখযোগ্য, এক্ষেত্রে ইউরোপীয় এবং আমেরিকান ধারণার মাঝে পার্থক্য রয়েছে। হু-র ইউরোপীয় রিজিওনাল অফিসের তরফে মার্গারেট হোয়াইটহেড-এর রিপোর্ট ১৯৯২ সালে জানালো – Equity is restricted unnecessarily if a country’s available resources are spent almost exclusively on high technology medical services which cater for a small segment of the population. অর্থাৎ স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে ইক্যুইটির মতো বিষয়কে ইউরোপীয় রিপোর্টে সংযুক্ত করা হল রোগীর সামাজিক অবস্থার সাথে। আমেরিকান ধারণার মতো রোগী কেবলমাত্র একক ভোক্তা অর্থনৈতিক মানুষ হিসেবে থাকছে না। মেডিক্যাল টুরিজম-এর মতো “the medical poverty trap” বলে একটি নতুন শব্দবন্ধ ব্যবহৃত হতে শুরু হয়েছে মেডিসিনের জগতে। (“Equity and health sector reforms: can low-income countries escape the medical poverty trap?”, Lancet 358 (2001): 833-36)

    এবার ভারতের দিকে চোখ ফেরাই একটুখানি। ১৯৪৩ সালে স্যার জোসেফ ভোরের নেতৃত্বে যে “ভোর কমিটি” তৈরি হয়েছিল সে কমিটি রিপোর্ট জমা দেয় ১৯৪৬ সালে। সেসময়েও রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছিল যে পাশ করা “অ্যালোপ্যাথিক” ডাক্তারদের ৭৭% রয়েছে প্রাইভেট প্র্যাকটিসে, ২৩% সরকারি চাকরিতে। ১৯৮০-র দশকের শেষ থেকে নিও-লিবারাল অর্থনীতির পরিণতিতে এবং অভিঘাতে হাঙ্গর-সদৃশ কর্পোরেট সংস্থা এবং বহুজাতিক কোম্পানি প্রবেশ করতে শুরু করে। আইএমএফ, ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন এবং বিশ্ব ব্যাংকের চাপে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা হু-র অবস্থান বদলাতে থাকে। কর্পোরেট হাসপাতাল এবং ভারতজোড়া নার্সিং হোমের বাজার গজিয়ে ওঠে। আর্ত রোগী দ্রুত রূপান্তরিত হতে থাকে “economic man”-এ। ডাক্তার বা হাসপাতাল “trustee” হবার পরিবর্তে হয়ে ওঠে “provider”, যেমনটা ব্রুস্টার সতর্ক করেছিলেন। প্রাইভেট প্র্যাকটিসের সাথে (ভোর কমিটির রিপোর্ট স্মরণ করুন) জুড়ে যেতে commercialization, corporatization এবং marketization – স্বাস্থ্য পরিষেবার ক্ষেত্রে। এর সাম্প্রতিকতম উদাহরণ পাঞ্জাবে এবং গুজরাটে ১৯৬০-৭০-এর দশকে সরকারি তথা জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় যে হাসপাতালগুলো তৈরি হয়েছিল সেগুলো একের পর এক কর্পোরেট সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। জানুয়ারি ২১, ২০১৯-এর Wire.in সংবাদপত্রের খবরের শিরোনাম – “Public Healthcare Facilities to Be Handed Over to Private Sector in Gujarat, Punjab”। এই মর্মে সরকারি বিজ্ঞপ্তিও জারী হয়েছে। জানুয়ারি ৯, ২০১৯-এ একই সংবাদপত্রের খবর – “In the Wake of Ayushman Bharat Come Sops for Private Hospitals”। এ খবরে জানানো হয়েছে – “The Narendra Modi government has announced plans to make hospitals into an “industry” under the Ayushman Bharat health insurance scheme and give a range of sops to private hospitals such as land and funding.”

    একেবারে হালে এসে নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল-এ সার্বিকভাবে এরকম আর্ত অবস্থার প্রতিফলন ঘটছে – “Primary Care – Will It Survive?” শিরোনামের প্রবন্ধে। বলা হচ্ছে – “primary care, the backbone of the nation’s health system, is at grave risk of collapse”।

    এবার আমরা প্রবেশ করবো ক্লিনিক্যাল হেলথ তথা ব্যক্তি রোগীর চিকিৎসার ধরন ও পাবলিক হেলথ বা জনসমষ্টির চিকিৎসার ধরনের মধ্যেকার মৌলিক পার্থক্য মেডিক্যাল পাঠক্রমের আধুনিক চরিত্র বোঝার দুনিয়ায়। Lancet-এ প্রকাশিত পূর্বোক্ত প্রবন্ধের পর্যবেক্ষণ ছিল ক্লিনিক্যাল সেক্টর সাধারণভাবে জোর দেয় “specialist curative over health promotion or preventive primary care”-এ। এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত নিউ ইংল্যান্ড জার্নালে প্রকাশিত আরেকটি প্রবন্ধ – আমরা কি মেডিক্যাল শিক্ষার জগতে বুদ্বুদের বাজারে বাস করছি? (Scott F. Dowell, Jordan W. Taperro and Thomas R. Frieden, “Are We Living in a Medical Education Bubble Market?,” 2011, 364(4): 300-301)

    এ প্রবন্ধের লেখকেরা বলছেন যে আমরা বর্তমানে বাজার অর্থনীতির সাধারণ নিয়মের মতো মেডিক্যাল শিক্ষার জগতেও আমরা একটি বুদ্বুদের বাজারে অবস্থান করছি। এর পরিণতিতে একটি সময় সমাগত যখন সে বুদ্বুদ ফেটে যাবে এবং “At the extreme, we will march down the debt-to-income-ratio ladder, through psychiatrists to cardiologists to orthopedists . . . until no one is left but the MBAs.”

    মেডিক্যাল শিক্ষার এ চেহারা তো আমরা এ দেশেও প্রত্যক্ষ করছি। কেন ঘটছে এরকম ঘটনা? কেন গভীরভাবে বদলে যাচ্ছে মেডিক্যাল শিক্ষার ধরন-ধারণ? কেন পরিহার্য কিন্তু অবধারিত “অ-মানবিকীকরণ” ঘটছে বারংবার? সুজান ব্লক এবং অ্যান্ড্রু বিলিং কয়েক বছর আগে একই জার্নালে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন “মৃত্যু থেকে শিক্ষা” শিরোনামে। (Susan Block nd Andrew Billing, “Learning from Dying,” New England Journal of Medicine 2005, 353(13): 1313-1315) এ প্রবন্ধে তাঁরা হাসপাতালের ওয়ার্ডের একের পর এক উদাহরণ তুলে ধরে দেখিয়েছিলেন যে বাস্তবে শেখানো শিক্ষাক্রমের বাইরে থাকে লুকিয়ে থাকা তথা “informal or hidden curriculum”। দুর্ভাগ্যজনকভাবে  বর্তমান সময়ের মেডিক্যাল শিক্ষার এই “hidden curriculum” এবং “especially the disease-centered, impersonal, high-throughput clinical years…still tends to undermine the best intentions of students and faculty members and the best interests of patients and families.” মেধাবী, আর্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর স্বপ্ন চোখে নিয়ে যে ছাত্র সমাজ মেডিক্যাল শিক্ষার জগতে প্রবেশ করে তারা ক্রমাগত এই অ-মানবিক শিক্ষাক্রম আর বাজারী হিংস্র অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার বুদ্বুদের বাজারের মধ্য দিয়ে সুদীর্ঘ যাত্রা করে একজন পরিশীলিত ব্যবসায়িক চিকিৎসা-পরিষেবা বিক্রেতা হয়ে ওঠে। এ ট্র্যাজেডি কার? ছাত্রদের? সমাজের? চিকিৎসকের? রাষ্ট্রের? নাকি সম্মিলিতভাবে সবার?

    এখানে আধুনিক মেডিসিনের জ্ঞানতত্ত্ব (epistemology) এবং ontology-র সাথে মেডিসিনের ছাত্র-ছাত্রীদের এক অসম যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হবে। শ্রদ্ধেয় চিকিৎসক জেরোম গ্রুপম্যান তাঁর পরিণত জীবনের উপলব্ধির কথা জানাচ্ছেন (যার কোন ভালো বাংলা করা যায় না) - I still find myself unable, except in retrospect, to retrieve the language of my youth and speak about “a great case.” It is as if medicine at this stage of my life has split into two streams — a current of marvelous biology and an undertow that pulls at the soul. From the bank where I stand, it is hard to imagine that these two streams can ever again flow as one. (“A Great Case”, New England Journal of Medicine, November 11, 2004 (351): 2043-2045)

    আরেক বিখ্যাত লেখিকা জানান মৃত্যু ও বার্ধক্য-কে যদি নার্সিং হোম বা হাসপাতালে নির্বাসিত করতে হয় তাহলে – ways must be found to de-medicalize the final weeks or days, to nurture the dying and those who love them, an by this means to nurture ourselves. The real truth of healing lies in the nurture. (Sherwin B. Nuland, How We Die, New York, Vintage Bokks, 1993)

    এ পথে আলো জ্বেলে

    অথচ পাবলিক হেলথ-এর জগতে ডেভিড ওয়ার্নার বা এদেশের বিনায়ক সেন বা আরো অনেক ব্যক্তি বা সংগঠিত চিকিৎসকদের মতো নিবেদিত প্রাণ চিকিৎসকেরা আছেন। এদের কাছে জনস্বাস্থ্য একটি অস্তিত্ত্বগত দার্শনিক অবস্থান। হু-র ২০০৫-এর “Make every mother and child count” রিপোর্টের মতাদর্শ ও তার পরিব্যাপ্ত রূপ বহুলাংশে মনে প্রাণে গ্রহণ করেন এঁরা।

    আমাদের নির্ভুলভাবে বোঝা প্রয়োজন, জনস্বাস্থ্যের দর্শন একটি মূলগতভাবে ভিন্ন অবস্থান। এটা কোন মেডিক্যাল শিক্ষার বুদবুদের বাজার নয় বা এখানে কোন লুকনো শিক্ষাক্রম নেই। এখানে সবকিছুই অবারিত খোলা এবং পরস্পরের প্রতি দায়বদ্ধ। নিজের নিজের সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্মীয় বিশ্বাস, দৈনন্দিন জীবন-চর্যা এবং সর্বোপরি পড়শি-চেতনা ধরে আছে ভারতের মতো আরো বহু দেশের অসমসত্ত্ব বিপুল জনসমষ্টিকে। এই বিশেষ অবস্থান বুঝতে না পারলে মেডিক্যাল কলেজের প্রশিক্ষণ শেষ করা মাত্র জনস্বাস্থ্যের জন্য উপযোগী চিকিৎসক হয়ে ওঠা যায় না। মুক্ত বাজারের অর্থনৈতিক ও সামাজিক দর্শন, বিশেষ করে এর উপজাত social psyche, এ দুয়ের প্রভেদ মুছে দিতে বদ্ধ পরিকর। কিন্তু খোদ আমেরিকার বুকেই চিকিৎসকদের একাংশও ভিন্নতর উপলব্ধিতে পৌঁছন - We find it terribly and tragically inhumane that Mr. Davis and tens of thousands of other citizens of this wealthy country will die this year for lack of insurance. (“Dead Man Walking”, New England Journal of Medicine 369 (2013): 1880-81)

    জনস্বাস্থ্যের দর্শন একটি ভিন্ন অবস্থান। এটা কোন মেডিক্যাল শিক্ষার বুদবুদের বাজার নয় বা এখানে কোন লুকনো শিক্ষাক্রম নেই। এখানে সবকিছুই অবারিত খোলা এবং পরস্পরের প্রতি দায়বদ্ধ। নিজের নিজের সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্মীয় বিশ্বাস, দৈনন্দিন জীবন-চর্যা এবং সর্বোপরি পড়শি-চেতনা ধরে আছে ভারতের মতো আরো বহু দেশের অসমসত্ত্ব বিপুল জনসমস্টিকে। এই বিশেষ অবস্থান বুঝতে না পারলে মেডিক্যাল কলেজের প্রশিক্ষণ শেষ করা মাত্র জনস্বাস্থ্যের জন্য উপযোগী চিকিৎসক হয়ে ওঠা যায় না। মুক্ত বাজারের অর্থনৈতিক ও সামাজিক দর্শন, বিশেষ করে এর উপজাত social psyche, এ দুয়ের প্রভেদ মুছে দিতে বদ্ধ পরিকর।

    ঠিক এ ঘটনাটিই আজ ঘটছে। আমরা এর অনিবার্য শিকার হয়ে পড়ছি অধিকাংশ সময়ে। এর মুখোমুখি জ্ঞানতাত্ত্বিক সংগ্রাম আমরা গড়ে তুলতে পারবো কিনা বা কতোটুকু সাফল্য অর্জন করবো তা ভবিষ্যৎ বলবে। কিন্তু আশু কাজ হল সমস্যাটিকে নিবিড়ভাবে বোঝা।

    দানবীয় বহুজাতিক কোম্পানী এবং হিংস্রতম, আগ্রাসী কর্পোরেট পুঁজির কাছে মানুষ শব্দটির ততক্ষণই মূল্য আছে যতক্ষণ সে মুনাফা দিতে পারে। এজন্য ব্যক্তির ব্যক্তিসত্তা, দেহ ও মন থেকে অসুস্থতাকে বিযুক্ত করে দেখে কেবলমাত্র অসুখের জন্য সমস্ত ওষুধ ও প্রযুক্তি তৈরি হয়ে চলছে সর্বোচ্চ মুনাফার জন্য, মেডিক্যাল শিক্ষাক্রমও বিপুল্ভাবে প্রভাবিত হয়। ৩০ লক্ষ ইয়েমেনী কিংবা ইয়েমেনের একটি প্রজন্ম নিঃশেষ হয়ে যাওয়া এ দানবদের কাছে কোন বিবেচ্য বিষয়ই নয়।

    এরপরেও বলার থাকে। আমেরিকায় গ্রামীণ চিকিৎসকের ঘাটতি নিয়ে হাহাকার উঠেছে। ২০১৯-এর জুলাই মাসে NEJM-এ প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে “Implications of an Aging Rural Physician Workforce” বলা হচ্ছে গ্রামাঞ্চলে (আমেরিকার) “Limited access to physicians can reduce access to preventive care and exacerbate unmet health needs, leading to costly hospitalizations and poor health status.” বলা হচ্ছে প্রাথমিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে ৬৬% ঘাটতি রয়েছে চিকিৎসকের। বলা হচ্ছে – “In 2030, residents of rural areas will have access to one third as many physicians per capita as their suburban and urban counterparts will.”

     আমেরিকান মডেলে অসাম্য এবং নিরুপয়তার কথা বারে বারে ধরা পড়ছে। অর্থনীতির জোরে ওরা এখনো অব্দি খানিকটা সামাল দিতে পারছে। আমরা নির্ভুল্ভাবে সেদিকেই যাত্রা করছি। জনতার স্বাস্থ্যের জন্য সর্বস্তরের মানুষকে সাধ্যমতো আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে হবে।

     অর্থনীতির মতোই আমাদের স্বাস্থ্যের ভবিষ্যৎও অসুরক্ষিত, অনিশ্চিত।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
    প্রথম পর্ব | দ্বিতীয় পর্ব
  • আলোচনা | ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯ | ২১২৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে মতামত দিন