দ্বিতীয় পর্ব : সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা
দক্ষিণ ২৪ পরগনা চম্পাহাটির বাসিন্দা উদয় সর্দার। পেশায় রাজমিস্ত্রি। বারুইপুরের হাড়ালে একটি নির্মীয়মাণ বাড়ির তিনতলায় কাজ করার সময় নিচে পড়ে যান এবং তিনটি লোহার রডে বিদ্ধ হন। সহ শ্রমিকরা বুদ্ধি করে লোহার রড টানাটানি না করে, রডগুলি তলা থেকে কেটে ওই অবস্থাতেই উদয়বাবুকে বারুইপুর গ্রামীণ হাসপাতালে নিয়ে আসেন। ওখান থেকে তাকে পাঠানো হল পার্ক সার্কাসের চিত্তরঞ্জন (ন্যাশনাল) হাসপাতালে। তিন চিকিৎসক দু ঘণ্টার মধ্যে জটিল অস্ত্রোপচার করে উদয়বাবুর শরীর এফোঁড়-ওফোড় হয়ে যাওয়া লোহার রড তিনটি বের করে। সৌভাগ্যবশত কিডনি বা লিভারে আঘাত ছিল না। দ্রুততার সঙ্গে সাতজন বিভাগীয় প্রধানকে নিয়ে মেডিক্যাল বোর্ড তৈরি হয় উদয়বাবুর শারীরিক অবস্থা পর্যালোচনার জন্য। ওই বিশেষজ্ঞরা সকলেই খবর পেয়ে উপস্থিত হন। এই সবই ঘটে বিকেল পাঁচটার পর। ১২ বছরের একটি ছোট্ট মেয়ে (নাম স্মরণে আসছে না) গলায় অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে নীলরতন সরকার হাসপাতালে ভর্তি হয়। নাক-কান-গলা (ইএনটি) বিভাগের চারজন চিকিৎসক চার ঘণ্টা ধরে জটিল অস্ত্রোপচার করে থেকে গলা থেকে ৯টি সূঁচ বের করেন। এই পদ্ধতি ছিল অত্যন্ত জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ যে কোন সময় রক্তপাতে মেয়েটির মৃত্যু হতে পারত। কয়েকদিন আগে সংবাদপত্রে আরজিকর মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকদের আরেকটি বিরল কৃতিত্বের কথা সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায় গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে। এই সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা এক মহিলা রোগীর প্রাণ বাঁচিয়েছেন গত ছয় মাস ধরে ১২৫ বোতল রক্ত ও রক্তরস সঞ্চালন করে। রোগীর আত্মীয়দের উক্তি, “চিকিৎসকরাই আমাদের কাছে সাক্ষাৎ ভগবান”।
এই ভগবানরাই কিন্তু বহু সময় শয়তানের অনুচরে পরিণত হন। চিকিৎসকদের বিভিন্ন সংগঠন (যার অনেকগুলোই গড়ে উঠেছে লাগাতার চিকিৎসক নিগ্রহের প্রতিক্রিয়ায়) পরিসংখ্যান দিয়ে দেখিয়েছেন যে বিগত দেড় বছরে নানা সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, নার্সিংহোম বা ব্যক্তিগত চেম্বারে ভাঙচুর লাঞ্ছনা এবং নিগ্রহের ঘটনা একশো ছাড়িয়েছে। মহিলা চিকিৎসকরাও বাদ যাননি এর হাত থেকে। মেদিনীপুরের ডেবরায় এক চিকিৎসকের মুখে মানুষের বিষ্ঠা মাখিয়ে দেওয়া হয়েছে। একজন প্রবীণ চিকিৎসক অপমানের ভয়ে ও পেশার চাপ সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন। বহু সরকারি চিকিৎসক চাকরি ছাড়তে উন্মুখ, এবং অনেকে পদত্যাগপত্র দাখিল করে কাজে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন বলে চিকিৎসকদের সংগঠনের বিবৃতিতে জানা গেছে। কিন্তু সরকার তাদের পদত্যাগ করার বা স্বেচ্ছাবসরের গণতান্ত্রিক অধিকারকে অগ্রাহ্য করেছেন। চিকিৎসকদের আরও অভিযোগ যে সরকারি ডাক্তারদের নিরাপত্তা দেয়া দূরে থাক, বিভিন্ন ক্ষেত্রে শাসক দলের স্থানীয় নেতানেত্রীরা এই গণপিটুনির প্রধান পরামর্শদাতা ও চালিকা শক্তি। ফলে চিকিৎসকদের এই অংশের অভিযোগ যে তারা প্রাণ বিপন্ন করে স্ত্রী পুত্র সংসারকে অবহেলা করে রোগীর সেবা করে এবং তাদের নিরাময় করে, ক্ষেত্রবিশেষে টানা ২৪ ঘন্টা পরিষেবা দিয়ে এবং সম মেধাবী তথ্যপ্রযুক্তি ইঞ্জিনিয়ার বা অন্য পেশার বন্ধু বান্ধবদের থেকে অনেক কম রোজগার করে, দিনের শেষে দেখেন যে অসংবেদনশীল ও অত্যাচারী প্রশাসন, শাসক (এবং বিরোধী দলেরও) স্থানীয় অর্ধশিক্ষিত নেতানেত্রী, কৃতজ্ঞহীন রোগীর পরিজন এবং হিংসুক জনগণের চক্রব্যুহে তারা অভিমন্যুর মত বন্দি। | ক্রমশ হিংস্র হয়ে ওঠা অমানবিক সমাজ, যারা চোর বা পকেটমার সন্দেহে গরীব ভিখারিদের পিটিয়ে মারে, দলিত হত্যা করে, গরু পাচারের অজুহাতে গরীব মুসলমান ব্যবসায়ীদের পুড়িয়ে মারে, পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যুর বদলা নিয়ে তাণ্ডব চালায়, তাদের কাছে চিকিৎসক ও হাসপাতাল হল নরম লক্ষ্যবস্তু (soft target)।
সমাজতাত্ত্বিকরা দেখিয়েছেন যে বহু গণপিটুনির ক্ষেত্রে আক্রমণকারীরা অনেক ক্ষেত্রে জানেই না কেন বা কোন অভিযোগে আক্রান্তকে আঘাত করা হচ্ছে, রক্তাক্ত করা হচ্ছে বা হত্যা করা হচ্ছে। বহু ক্ষেত্রেই নানা সামাজিক বঞ্চনা দারিদ্র ও অপ্রাপ্তির পুঞ্জীভূত ক্ষোভ বিস্ফোরণ হিসেবে ফেটে পড়ে। এই যূথবদ্ধ সামাজিক হিংসার শিকার হন চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা। এটাও একটা সত্য। প্রিয় পরিজনদের মৃত্যু মেনে নেয়া কঠিন—বিশেষত অত্যাধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার ঢক্কানিনাদের প্রেক্ষিতে। মৃত্যুর বিরুদ্ধে অক্ষম ক্ষোভ আছড়ে পড়ে সামনে উপস্থিত লক্ষ্যবস্তুর ওপর। সরকারি হাসপাতালে যেসব মৃত্যু ঘটে এবং যেগুলি সম্পর্কে বিনা চিকিৎসা, ভুল চিকিৎসা, দেরি করে চিকিৎসা ও অবহেলার অভিযোগ ওঠে, তার মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে সত্যতা আছে। আবার বহু ক্ষেত্রে নেইও। বর্তমান রাজ্য সরকার ঘোষণা করেছেন, রাজ্যে সাড়ে নয় কোটি মানুষের জন্য চিকিৎসা নিঃশুল্ক। এ বিষয়ে তারা যে পরিসংখ্যান বিধানসভায় পেশ করেছেন তা নিম্নরূপঃ (ক) বিগত জমানায় (২০১০-১১) মোট স্বাস্থ্য বাজেট ৬৮২ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে প্রায় ৮৭৩৩ কোটি টাকা করা হয়েছে। (খ) জেলায় জেলায় ৩০টি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল চালু হয়েছে, আরও তিনটি হবে। (গ) ১১২টি ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকান চালু করা হয়েছে। (ঘ) প্রায় ৬৫০টি ঔষধ (রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার সহ) বিনা পয়সায় দেওয়া হচ্ছে সরকারি হাসপাতালে, যার মোট অর্থমূল্য ৪৫৩ কোটি টাকা। (ঙ) ৩৮টি আইসিইউ ও ২২টি এইচডিইউ-তে তখনও পর্যন্ত প্রায় দেড় লক্ষ মানুষের চিকিৎসা করা হয়েছে। (চ) ৬৫০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে, যার মধ্যে আছে অটো-অ্যানালাইজার, এক্সরে, ইইজি, ইএমজি, ডায়ালাইজার এবং আইসিইউ- এর যন্ত্রপাতি। (ছ) মেডিকেল কলেজ নয়টি থেকে বেড়ে হয়েছে সতেরোটি। আরো পাঁচটি স্থাপিত হয়েছে পুরুলিয়া, কোচবিহার, রায়গঞ্জ, ডায়মণ্ড হারবার ও রামপুরহাটে; ছাত্র সংখ্যা ১১০০ থেকে বেড়ে হয়েছে ২২০০। (জ) শয্যা বেড়েছে (৭ বছরে) ১৩,৮০০। স্বাস্থ্য দপ্তরের নতুন পদ সৃষ্টি হয়েছে ২৭৯৩২টি। চিকিৎসকের সংখ্যা বেড়েছে ৯৩৭০ জন যার মধ্যে ৭৯০ জন বিশেষজ্ঞ। নিয়োগ হয়েছে পাঁচ হাজার সেবিকা, ৬০০ ফার্মাসিস্ট, দুশো ফিজিওথেরাপিস্ট, ২১০০ টেকনিশিয়ান। আরও বিভিন্ন ধরনের ৪৫০০ পদের জন্য বিজ্ঞাপন অচিরেই বের হবে বলে সংবাদে প্রকাশ। (ঝ) বিনা পয়সায় দেওয়া হচ্ছে পেসমেকার, স্টেন্ট প্রভৃতি। (ঞ) দ্রুত নিয়োগের জন্য চালু হয়েছে ‘হেলথ রিক্রটমেন্ট বোর্ড। উপরে যে সব পরিসংখ্যান উল্লেখ করা হল তার সবই বিধানসভায় স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী লিখিত প্রতিবেদন ও স্বাস্থ্য দপ্তরের মুখপত্র Health on the March (internet version) থেকে সংগৃহীত। সরকারের পেশ করা তথ্যগুলি শাসক দলের বিরোধী চিকিৎসক সংগঠনের নেতারা বিশ্বাস করেন না। তবে সাম্প্রতিক কালে স্বাস্থ্য দপ্তরের কর্মী বাহিনী যে অনেকটাই বেড়েছে এবং বিভিন্ন পরাচিকিৎসাবিদ্যা কর্মী (প্যারামেডিকেল স্টাফ) ও সেবিকাদের চাকুরি হয়েছে তা বিরোধীরাও স্বীকার করেন। কিন্তু চিকিৎসক নিয়োগের বিষয়টি কিছুটা আলাদা। | চিকিৎসক (সাধারণ ও বিশেষজ্ঞ) নিয়োগের জন্য ঘন ঘন বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হচ্ছে, সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। যারা সরাসরি রোগীর চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত (অর্থাৎ পড়ানো বা প্রশাসন নয়) তাদের বলা হয় ক্লিনিক্যাল ডক্টর। এই ধরনের পদে কাজ করতে এবং গ্রামে/মফঃস্বলে যেতে ইচ্ছুক চিকিৎসকদের সংখ্যা হতাশাজনকভাবে কম৷ মুখ্য স্বাস্থ্য অধিকর্তাই স্বীকার করেছেন যে প্রথমত যথেষ্ট সংখ্যক চিকিৎসক আবেদন করছেন না, যারা আবেদন করছেন এবং নিয়োগপত্র পাচ্ছেন তাদের মধ্যে কাজে যোগ দিচ্ছেন গড়ে ৪৫ শতাংশ, এবং তিন মাস বাদে টিকে থাকছেন মাত্র ৩০ শতাংশ। এমনিতেই পশ্চিমবঙ্গে পাস করা অ্যালোপ্যাথ চিকিৎসকের সংখ্যা জাতীয় গড়ের থেকে কম। আগেই বলেছি পশ্চিমবঙ্গে ৯.২ কোটি মানুষের জন্য মোট অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসকের সংখ্যা ৬৯ হাজার, যার মধ্যে মাত্র ১২ হাজার চিকিৎসক রাজ্য স্বাস্থ্য মন্ত্রকের অধীনে কর্মরত।
বিভিন্ন রাজ্যে চিকিৎসকের সংখ্যা | রাজ্য মোট কত জনসংখ্যায় একজন অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসক |
মহারাষ্ট্র | ১.৫৯ লক্ষ |
তামিলনাড়ু | ১.২৮ লক্ষ / ৯৪ হাজার ৫৪০ |
কর্ণাটক | ১.০৫ লক্ষ |
পশ্চিমবঙ্গ | ৬৯ হাজার / ১৩০০ |
রাজস্থান | ৪১ হাজার / ১৯৪১ |
উত্তরপ্রদেশ | ৭৩ হাজার / ২৯৫০ ৭৮৬ |
সাম্প্রতিক কালে প্রায় ৩৪৮ জন সরকারি চিকিৎসক অনুমোদন নিয়েই প্রবেশিকা পরীক্ষা দিয়ে স্নাতকোত্তর পাঠক্রম (এমডি/এমএস/ডিপ্লোমা) র জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তর এদের মধ্যে মাত্র ১৯০ জনকে পড়াশোনার জন্য ছাড়তে প্রস্তুত। সরকারি আইনজীবী জানান যে, সমস্ত শিক্ষার্থীকে সবেতন ছুটি দিলে রাজ্যে ১০% স্বাস্থ্যকেন্দ্র চিকিৎসকহীন হয়ে পড়বে। সেই সওয়াল জবাবেই জানা গেছে যে ৩৭টি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে একজন করে এবং ২৩টি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে দুজন করে চিকিৎসক আছেন। ৩৪৯টি গ্রামীণ হাসপাতালে প্রতিটিতে পাঁচজন করে মোট ১৭৪৫ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থাকার কথা, আছেন ১১৭ জন। তার মধ্যে কতজন নিয়মিত হাজিরা দেন তা জানা নেই। সরকারি সিদ্ধান্তের বিপ্রতীপে চিকিৎসকরা প্রশ্ন তুলছেন, বীজ না বুনলে গাছ হবে কি করে? সরকারি চিকিৎসকদের যদি উচ্চ শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয় তবে ভবিষ্যতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক মিলবে কোথা থেকে? | এমডি-এমএস কোর্সে ভর্তির সময় সরকার শিক্ষার্থীদের একটা চুক্তিপত্রে সই করিয়েছিলেন যে উত্তীর্ণ হবার পর এক থেকে তিন বছর সরকারি চাকরি করতে হবে, নতুবা ১০ থেকে ৩০ লক্ষ টাকা প্রস্থান মূল্য (exit money) দিতে হবে। তাদের ডিগ্রীর কাগজপত্রও ওই সময়সীমার মধ্যে আটকে রাখা হয়েছে। কিন্তু অনেক অসরকারি শিক্ষার্থীই (অন্তত যারা সম্পন্ন) ঐ প্রস্থান মূল্য দিয়ে চুক্তি থেকে মুক্তি চেয়েছেন। অন্য রাজ্যের এক উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে টাকা দিতে চাওয়া সত্ত্বেও তার নথিপত্র না ছাড়তে চাওয়ায় তিনি উচ্চ ন্যায়ালয়ে বিচারপ্রার্থী হন। সরকারকে তীব্র ভৎর্সনা করে মহামান্য আদালত অবিলম্বে ঐ চিকিৎসককে মুক্তি দিতে বলেছেন। এই তরজা থেকে অন্তত তিনটি সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে - (১) বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাবে, জেলা বা মহকুমায় যতই ঝাঁ চকচকে সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল হোক, রোগীদের অন্তহীন স্রোত কলকাতার মেডিকেল কলেজগুলোতে আছড়ে পড়বে। (২) স্নাতকোত্তর ডিগ্রীধারী সদ্য উত্তীর্ণ চিকিৎসকরা ৩০ লক্ষ টাকা গুণাগার দেওয়াকে তিন বছর গ্রাম বা মফঃস্বলে কাজ করার চেয়ে শ্রেয় মনে করেন। (৩) গ্রামে যেতে তীব্র অনীহা, রাজ্য সরকারের স্বল্প বেতন (কেন্দ্র বাদ দিলেও এমনকি পার্শ্ববর্তী অনেক রাজ্যের প্রায় অর্ধেক), সুযোগ-সুবিধার অভাব, বা সাম্প্রতিককালে চিকিৎসকদের ওপর হামলা—এই সবই এর পশ্চাৎপট তৈরি করেছে। তবে আরেকটা দিক হল যে, এই সদ্য উত্তীর্ণ চিকিৎসকরাও বোধ হয় নিশ্চিত যে তিন বছরে তিন লক্ষ টাকার ক্ষতিপূরণ তারা অধীত বিদ্যা বে-সরকারি কর্পোরেট হাসপাতালে বিক্রয় করে বা স্বাধীন ব্যবসা করে অনায়াসেই সঞ্চয় করতে পারবেন। আমরা যখন জুনিয়র ডাক্তার, আশির দশকেও বছরের পর বছর সরকারি চিকিৎসকদের নিয়োগের জন্য পাবলিক সার্ভিস কমিশনের অপেক্ষায় চিকিৎসকরা বসে থাকতেন। এমবিবিএস পাশ করেও ছাত্রদের হোস্টেলগুলিতে মাথা গুঁজে থেকে (কারণ এদের অনেকেই গ্রামের ছেলে মেয়ে, শহরে থাকার জায়গা ছিল না) ছোটখাটো নার্সিংহোমে উঞ্ছবৃত্তি করে, প্রাণপণে পড়াশোনা করতেন স্নাতকোত্তরে সুযোগ পাবার জন্য। মনে পড়ে, পাঁচ বছর পর পিএসসি হলে ৩০০টি খালি পদের জন্য দু হাজারের বেশি পরীক্ষার্থী ছিলেন এবং চাকরিতে যোগ দেবার হার ছিল ৯০ শতাংশের বেশি। | চিত্রটা পাল্টে গেল '৯০-এর দশকের উদার অর্থনীতি এবং চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ঢালাও বেসরকারিকরণের সময় থেকে। দুই দশকে গড়ে উঠল কোটি কোটি টাকা লগ্নিতে বহু কর্পোরেট হাসপাতাল। বিগত জমানায় প্রায় বিনে পয়সায় দুর্মূল্য জমি ও নানা উৎসাহবর্ধক অনুদান দিয়ে চিকিৎসা ব্যবস্থার পালে নয়া অর্থনীতি বা LPG (Liberalisation, Privatisation, Globalisation অর্থাৎ উদারীকরণ, বেসরকারিকরণ ও বিশ্বায়ন)-এর বাতাস লাগানো হল। এতে উপকৃত হলেন চিকিৎসককুল। নিরাময় হল ‘আমরি’, ‘কে সি রায় যক্ষা হাসপাতাল’ হল বেসরকারি কেপিসি মেডিক্যাল কলেজ’, যার দরজা দিয়ে ঢুকতে হলে ছাত্রদের কোটি টাকা লাগে। সরকারি হাসপাতালের অধোগতি আর বেসরকারিদের রমরমা চলল সমান হারে। চিকিৎসকদের একটা অংশ লক্ষ্মী লাভ করলেন। কর্পোরেটদের আঙুল ফুলে কলাগাছ হল। কিন্তু অসহায় রোগীকুল? এদের কী সংবাদ?