এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক

  • সাম্প্রতিক জুনিয়র ডাক্তার আন্দোলন ও সরকারী পরিষেবা - প্রস্তাবনা

    ডা. সিদ্ধার্থ গুপ্ত লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ০২ জুলাই ২০১৯ | ১১৮৫ বার পঠিত

  • প্রস্তাবনাঃ
    সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ১০ই জুন থেকে নীল রতন সরকার হাসপাতালে জুনিয়র ডাক্তার আন্দোলন ও তার প্রেক্ষিতে সারা রাজ্যের সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়ার ঘটনায় একটা ফয়সালা আগামী দু এক দিনের মধ্যে হতে চলেছে। আজ সংবাদে দেখলাম উভয় পক্ষই নমনীয় হয়েছেন এবং জুনিয়র ডাক্তাররা পশ্চিম্বঙ্গে প্রশাসনিক সদর দপ্তর নবান্নয় যেতে রাজী হয়েছেন। কারা কারা উপস্থিত থাকবেন, সেই নিয়ে শেষ মুহূর্তে দর কষাকষি চলছে। এর মধ্যে ১৭ই জুন চিকিৎসকদের সর্ববৃহৎ পেশাদারী সংগঠন ইন্ডিয়ান মেডিকেল এসোসিয়েশন দেশব্যাপী ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। আশা করেছিলাম তার আগেই এই অচলাবস্থা কাটবে যাতে দুপাটি দাঁতের মধ্যে জিভের মত পড়ে থাকা সাধারণ রোগীদের হেনস্থা আর না বাড়ে। কিন্তু তা আর হল না। ১১ই জুন এন আর এসে ঘটে যাওয়া ঘটনার পুনরাবৃত্তির দরকার নেই, তা বহু ভিডিও ক্লিপিং সহযোগে সোশ্যাল মিডিয়ার বিশাল পরিসরে বহু টীকা টিপ্পনী সহ ডালপালা ছড়িয়ে বিরাট ভাবে উপস্থিত। মুহূর্তে মুহূর্তে ফেসবুকের কমেন্ট বক্স বোঝাই হয়ে যাচ্ছে। এমনকি বিশ্বকাপে চিরশত্রু পাকিস্তানকে দুরমুশ করার উত্তেজনাও তার পাশে ম্লান হয়ে গেছে।

    ঘটনার প্রকাশ এক বৃদ্ধ রোগীর মৃত্যু এবং তাকে কেন্দ্র করে রোগীর আত্মীয় ও কিছু জুনিয়র ডাক্তারের বচসায় ঘটনার সূত্রপাত। চিকিৎসকদের অভিযোগ, রোগীর পরিজনরা চূড়ান্ত দুর্ব্যবহার করেন, ও ধাক্কাধাক্কি করেন। তার প্রতিবাদে কর্তব্যরত জুনিয়র ডাক্তাররা রোগীর আত্মীয়দের কাছ থেকে মৌখিক বা লিখিত ক্ষমাপ্রার্থনা দাবি করেন এবং তা না হলে মৃতদেহ হস্তান্তর করা হবে না বলে জানিয়ে দেন। অগ্নিতে ঘৃতাহুতি পড়ে। অভিযোগ রাত্রি ১১টা নাগাদ প্রায় দুই গাড়ি ভর্তি ' বহিরাগত ' জুনিয়র ডাক্তারদের ওপর হামলা চালিয়ে একাধিক ডাক্তারকে আহত করে। তাদের নিক্ষিপ্ত ইঁটে ডাক্তার পরিবহ মুখোপাধ্যায়, যশ টেকওয়ানি গুরুতর আহত হন। পরিবহর খুলির হাড় ভেঙে যায়। জুনিয়র ডাক্তাররা কাজ বন্ধ করে বিক্ষোভ দেখাতে আরম্ভ করেন এবং হাসপাতালের গেটও বন্ধ করে দেওয়া হয়। ডাক্তারদের অভিযোগ এই পুরো "অলীক কুনাট্য রঙ্গের সময় উপস্থিত পুলিসবাহিনী বৈষ্ণব সুলভ ধৈর্য ও তিতিক্ষা নিয়ে দর্শকের আসন আলোকিত করেছিল। এমনকি চিকিৎসকরা কিছুদিন আগে চালু হওয়া প্যানিক বাটন বারবার টিপলেও দুটি থানার আধিকারিকদের নিদ্রাভঙ্গ হয় নি। পরদিন থেকে কায়েম হয় চূড়ান্ত নৈরাজ্য। বিক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়ে অন্য সমস্ত মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে।,বর্ধমান, উত্তরবঙ্গ ও মালদহে দফায় দফায় ডাক্তারবাবুদের সঙ্গে স্থানীয় জনগণের সংঘর্ষ হয়। আরো কিছু জুনিয়র ডাক্তার আহত হন। সিনিয়র ডাক্তাররা এই আন্দোলনকে সমর্থন জানান। ১২ই জুন সারা রাজ্যে সিনিয়র ডাক্তাররা সরকারি হাসপাতালের আউটডোর বয়কট করেন। ডাক্তারদের সংগঠনগুলি দাবী করেছেন বেসরকারি কর্পোরেট হাসপাতালগুলির অধিকাংশ বহির্বিভাগেও কাজ ছিল কিন্তু এর সমর্থনে সংবাদপত্রে কোনো প্রতিবেদন চোখে পড়ে নি।

    বেসরকারি কর্পোরেট হাসপাতাল থেকে কোনো রোগী প্রত্যাগত হয়েছেন এমন কোনো সংবাদ দেখিনি। বেশ কিছু প্রাইভেট প্র‍্যাক্টিশনার তাদের চেম্বার বন্ধ রেখেছিলেন। চিকিৎসায় প্রত্যাগত হওয়া সত্ত্বেও সাধারণভাবে জনমত জুনিয়র ডাক্তারদের পক্ষেই ছিল এবং বহু রোগীর আত্মীয় পরিজনদের এই আন্দোলন সমর্থন করতে দেখা যায়।

    এরমধ্যে মুখ্যমন্ত্রী জুনিয়র ডাক্তারদের দাবী বা অনুরোধ মত অকুস্থল নীল রতন সরকার হাসপাতালে উপস্থিত না হয়ে এস এস কে এম হাসপাতালে উপস্থিত হলেন। জুনিয়র ডাক্তারদের দ্বারা তাকে অপমান করার অভিযোগ তুললেন। চিকিৎসকদের ৪ ঘন্টার মধ্যে কাজে ফেরার হুমকি দিলেন, বহিরাগত আখ্যা দিলেন। এস্মা জারি করার ভয় দেখালেন এবং সর্বোপরি এই অভিযোগ তুললেন চিকিৎসকরা পদবী দেখে ( পড়ুন ধর্মীয়ে ভেদাভেদ করে) রোগী দেখেন। এই অবিমৃষ্যকারী মনোভাব প্র‍য়াত নবারুন ভট্টাচার্যের কবিতা অনুসারে জলের পরিবর্তে কেরোসিন ঢেলে আগুন নেভানোর অপচেষ্টা।

    বহু প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানে ঘটনার ধারা বিবরণী আপনারা ইতিমধ্যেই বহুবার পড়েছেন। সেই নিয়ে চর্বিতচর্বণ করার পরিবর্তে এই ঘটনার উৎস সন্ধানের চেষ্টা বোধ করি বর্তমান অবস্থায় এবং ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে বেশী প্রয়োজনীয়। সিনিয়র এবং জুনিয়র ডাক্তারদের বিভিন্ন সংগঠন জনিয়েছেন, চিকিৎসকদের উপর লাগাতার হামলা বিশেষত গত আড়াই বছর ২৩০ টি এই ধরণের ঘটনা বহুবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও সরকার কার্যত ডাক্তারদের কোনো নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন নি এবং অপরাধীরা কোনো শাস্তিও পান নি। সরকারি ডাক্তারদের সঙ্গে সরকারের আচরণ চূড়ান্ত অমানবিক। এমনকি দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত চিকিৎসককেও স্বেচ্ছাবসরের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। এদিকে কর্তৃপক্ষের হুমকি, অন্যদিকে বিভিন্ন পার্টি আশ্রিত কুকৃতিদের হামলায় ডাক্তাররা চূড়ান্ত নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। ফলে তাদের পক্ষে এন আর এসের এই ঘটনা 'উটের পিঠে শেষ কুটো'র মত ভয়াবহ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারি হাসপাতালের পরিষেবার ৮০ শতাংশ শিক্ষানবিশ বলে চিন্হিত জুনিয়র ডাক্তারদের ঘাড় দিয়ে চলে। কিন্তু তারাও ধারাবাহিক লান্ছনার শিকার। যে কোনো রোগীর মৃত্যু হলেই অবহেলা এবং হামলার অভিযোগ ওঠে। অপর পক্ষে কান পাতলেই চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ওঠে যার মধ্যে অনেকটাই সত্য। যেমন রোগী ও বাড়ির লোকের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, ঔষধ কমদামী এবং রোগ নির্ণয় কেন্দ্র থেকে কমিশন নেওয়া, রোগীকে অবহেলা করা, সরকারি হাসপাতালে সময় না দিয়ে প্রাইভেট চেম্বারে রোগী দেখা, ঔষধ কম্পানির আনুকুল্যে বিদেশ ভ্রমণ, বেসরকারি হাসপাতালগুলিতে রোগী শোষণ ইত্যাদি। বোঝা যাচ্ছে, উভয় পক্ষ থেকেই চূড়ান্ত অবিশ্বাস, ঘৃণা এবং অভিযোগ - প্রত্যাভিযোগ আজকে এই পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে। আসুন যুক্তিপূর্ণভাবে এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা যাক।



    অনীক পত্রিকায় চারটি পর্বে এই প্রবন্ধটি, প্রথম প্রকাশিত হয়।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ০২ জুলাই ২০১৯ | ১১৮৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল মতামত দিন