ইশরাতের ঘটনা নিয়ে তো কম লেখালেখি হল না; কিন্তু এবার একটু দূরদেশের দিকে তাকান তো। মণিপুর – গুজরাতের একেবারে উল্টোদিকে, তা হোক, এনকাউন্টারের ব্যাপারে মিল অনেক দুই রাজ্যেই।
তা প্রায় তিরিশ বছর হয়ে গেল, নিয়মিত মণিপুরে তরুণ তরুণীদের এনকাউন্টারে মেরে ফেলাটা মণিপুর রাইফেলস বা মণিপুর পুলিশের কম্যান্ডোদের কাছে একটা জলভাত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত দশ বছরে গড়ে প্রতি সপ্তাহেই দুটি করে অমন তাজা প্রাণ “এনকাউন্টারে” প্রাণ হারিয়েছে। অভিযোগটা খুবই রুটিন। কোনো না কোনো মিলিট্যান্ট গ্রুপের কেউ সিকিউরিটি ফোর্সের দিকে গুলি ছোঁড়ে, আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি চালালে এক বা একাধিক সন্ত্রাসবাদী প্রাণ হারায়। এনকাউন্টারের পরে জমা দেওয়া FIRগুলোও মোটামুটিভাবে একই গতের।
এই রাজ্যটি মোটামুটি ভাবে কংগ্রেসের শাসনেই চলছে গত এক দশক ধরে। কিন্তু রাজ্যে উন্নতির কোনো চিহ্নই নেই, কেন্দ্রীয় সরকারের বিশাল মাপের অনুদানের কোনো খামতি নেই। কিন্তু এইসব গ্রান্টের বেশির ভাগটাই শাসক দল আর তার সাঙ্গোপাঙ্গদের পকেটে ঢোকে। নেহাতই যেসব সরকারি টাকা যায় রাস্তাঘাটের উন্নতির জন্যে, সেগুলির বরাতও পায় চেনা লোকেরাই। মোটা নজরানার পয়সা দিতে হয় শাসক দলকে। আর এইসব কন্ট্রাক্টরদের সোজা রাখতেই দরকার পড়ে এইসব “মিলিট্যান্ট”দের। আর মিলিট্যান্টরা যখন পাওনাগন্ডায় গরমিল ঘটায় তঝনই তাদের কপালে জোটে এনকাউন্টারে মৃত্যু। মণিপুর রাইফেলস আর মণিপুর পুলিশের কম্যান্ডো বাহিনীর উপর থাকে এইসব এনকাউন্টার ঘটানোর দায়িত্ব। AFSPA সহায় থাকলে আইনি ব্যবস্থার নজরদারি সম্ভব হয় না।
হাজারের উপর তরুণ মণিপুরী গত দশকে এইভাবে মৃত্যুবরণ করেছে। মরিয়া হয়ে মণিপুরী স্বামীহারা তরুণীরা একটা সংগঠন গড়ে তুলে পৌঁছয় সুপ্রিম কোর্টের দোরগড়ায়, তাঁদের সাহায্য করেন Human rights law network (HRLN)। সুপ্রিম কোর্ট এই হত্যালীলার ব্যাপকতা দেখে সত্যি যেন হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে আর অবিলম্বে একটি দুই সদস্যের কমিশন গঠন করে। এই সদস্যদের একজন প্রাক্তন নির্বাচনী কমিশনার শ্রী লিংডো আর অন্যজন কর্ণাটকের প্রাক্তন ডিজিপি।
কমিশনের কাছে পেশ করা হয় এরকম ছটি এনকাউন্টারের ঘটনা যাতে প্রাণ হারিয়েছেন সাতজন তরুণ। এঁদের নামগুলি যথাক্রমে একইজ্যাম প্রিয়প্রত, নোবো, গোবিন্দ, কিরনজিৎ, ওরোনজিৎ, উমাকান্ত আর মহম্মদ আজাদ খান। আজাদ খান, মাত্র ১২ বছয় বয়সি, একটি স্কুলের পড়ুয়া ক্লাস এইটের ছাত্র। এই বাচ্চাটিকে গুলি করে মারে কুড়িজন সশস্ত্র কম্যান্ডো, ছেলেটির বাড়ির পিছনের মাঠেই। এই ছটা এনকাউন্টার ঘটেছিল এপ্রিল ২০০৯ থেকে মার্চ ২০১০এর মধ্যে। এ তো খুবই সামান্য নমুনা। সুপ্রিম কোর্ট চেয়েছিল এই নমুনাগুলো তদন্ত করে, তারপর যে প্রায় ১৫০০ জন প্রাণ হারিয়েছেন গত দশ বছরে, সেই ব্যাপারে অগ্রসর হতে।
আমার সৌভাগ্য যে স্বামীহারাদের সংগঠন আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল সুপ্রিম কোর্টে তাদের সাহায্য করতে। এর ফলে আমি, মণিপুর রাইফেলস ও পুলিশের লোককে জেরা করবার সুযোগ পেয়েছিলাম, দিল্লি আর ইম্ফল, দুই জায়গাতেই। আমি যখন ইম্ফল যাই ২০১৩র মার্চ মাসে, তখন সাক্ষাত হয়েছিলো বাবলু লয়টংবাম নামে এক আইনজীবির সাথে। উনি কয়েকজন জেদী আইনজীবির একটি ছোটো গ্রুপকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন এই এনকাউন্টারের শিকার হওয় মানুষগুলির স্বজনদের আইনি সাহায্য দিতে। শয়ে শয়ে স্বামীহারা মহিলারা এই কমিশনের শুনানি চলাকালীন হাজিরা দিতেন। কমিশনের মাথায় ছিলেন বিচারপতি হেগড়ে। আমি,আমার অভিজ্ঞতায়, এই প্রথম একটা কমিশনে হাজির ছিলাম যেখানে কমিশন একেবারে হৃদয় দিয়ে তদন্তে নেমেছিলেন। আমরা ইম্ফলে ছিলাম ছয়দিন আর নয়াদিল্লিতে চারদিন। আর মার্চের শেষেই কমিশন তার রিপোর্ট পেশ করেন।
সুপ্রিম কোর্টের কাছে পেশ করা এই রিপোর্টে সর্বসম্মত মতামতে জানানো হয়েছে যে তদন্তের জন্য আনা ছয়টি এনকাউন্টারই সাজানো ঘটনা। স্বামীহারাদের সংগঠনের আইনজীবি শ্রী কলিন গঞ্জালভেস এখন সুপ্রিম কোর্টের কাছে দাবি করেছেন যে কোর্ট যেন SITর মাধ্যমে অন্যান্য এনকাউন্টারেরও তদন্ত করে ও দোষীদের উপযুক্ত শাস্তি হয়।
গুজরাত আর মণিপুর, এই দুই রাজ্যেই এনকাউন্টার মৃত্যুর মাঝে কয়েকটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তবে দুটোর মধ্যে মোটিভের আকাশ পাতাল ফারাক। গুজরাতে যেরকম মুল লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক ফায়দা তোলা, মণিপুরে কিন্তু মূল উদ্দেশ্য ছিল সরকারি গ্রান্টের পয়সা পকেটে ভরানো। মিলটা এইখানেই যে নিরীহ মানুষেরা প্রাণ হারাচ্ছে, সে বিজেপি বা কংগ্রেস, যে সরকারই হোক না কেন।
নোটঃ কমিশনের রিপোর্ট কিছুদিন পরেই প্রকাশ করা হবে আর আমরা তখনই সেই রিপোর্ট জনসমক্ষে আনব।
অনুবাদঃ দীপ্তেন