তদন্তে নেমে অভূতপূর্ব সাফল্য পায় সিসিআই। এর আগে কখনও দেখা যায় নি একসঙ্গে এতজন পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে সিআরপিসির ১৬৪ ধারা অনুযায়ী একটা এনকাউন্টারের সাক্ষী নথিভূক্ত করছে, যে এনকাউন্টারে তারা নিজেরাই সামিল হয়েছিল তাদের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে। সিআরপিসির ১৬৪ ধারায় ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে দেওয়া জবানবন্দীকে, যে কোনও তদন্তে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য জবানবন্দী হিসেবে ধরা হয়। ম্যাজিস্ট্রেট এতে সার্টিফাই করেন যে এই জবানবন্দী সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় দেওয়া, এবং এই জবানবন্দীর কোনও অংশ থেকে পরে বিচ্যুত হওয়াকে অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই এই ১৬৪ ধারায় নেওয়া জবানবন্দীকে "ডকুমেন্টারি এভিডেন্স" হিসেবে মানা হয়, যার ভিত্তিতে কোনও অপরাধের দায়ে কাউকে অভিযুক্ত এবং শাস্তিপ্রদানও করা যায়।
শ্রী সতীশ ভার্মার সহায়তায় সিবিআই প্রায় অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। অসংখ্য এই ১৬৪ ধারার জবানবন্দী তারা জোগাড় করতে পেরেছে, যার মধ্যে অন্তত ৯টি সিআরপিসির ১৬৪ ধারার জবানবন্দী; এনকাউন্টার নিজের চোখে ঘটতে দেখেছে, এমন কিছু পুলিশ অফিসারের বয়ান।
তেমনি এক বয়ান এখানে তুলে ধরা হল। পুলিশ ইনস্পেক্টর আই কে চৌহানের বয়ান, ৪ঠা জুন ২০১৩তে রেকর্ড করাঃ
"এর পর আমি এক নীল রঙের ইন্ডিকা গাড়ি, নম্বর MH-02-JA-4786, দেখতে পাই রাস্তার ডিভাইডারের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ির কাছে পুলিশ কনস্টেবল মহম্মদ সফি দাঁড়িয়ে ছিলেন। জিজ্ঞেস করাতে কনস্টেবল সফি জানান, ওই ইন্ডিকা গাড়ি তিনিই চালিয়ে এনে রেখেছেন। সেই সময় শ্রী এন কে আমিন, শ্রী জে জি পারমার আর কম্যান্ডো পুলিশ কনস্টেবল শ্রী মোহন নানজি মেনত সেখানে উপস্থিত ছিলেন। শ্রী আমিনের গাড়ি ইন্ডিকা গাড়িটার পেছনে রাস্তার বাঁদিক ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল। এর পরে সাদা রঙের একটা এসইউভি গাড়ি সেখানে আসে এবং রাস্তার ধারে এসে দাঁড়ায়। তখন আমি দেখলাম যে, কনস্টেবল মোতি তালাজা দেসাই একজনকে সেই গাড়ি থেকে বের করল। এই লোকটিকেই কুড়ি দিন আগে গোটা সার্কেল থেকে ধরা হয়েছিল। তখনই আমার মনে হল কিছু একটা গড়বড় হতে চলেছে।
এর পরে এসিপি শ্রী এন কে আমিন আর আমার সিনিয়র শ্রী তরুণ বারোত ওই লোকটি আর তার পাশেই রাস্তার ডিভাইডারের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা ইন্ডিকা গাড়িটার ওপর ফায়ারিং শুরু করে। সেই সময়ে কম্যান্ডো মোহন লালা কালাসাওয়াও তার বন্দুক বের করে ওই লোকটা আর ইন্ডিকা গাড়িতে গুলি চালাতে শুরু করে। এই ঘটনা দেখে ভয় পেয়ে আমি কোতারপুর ওয়াটার ট্যাঙ্কের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা নিজামুদ্দিন মোহন নানজি আর মোতি তালাজার কাছে চলে যাই ..."
নিজামুদ্দিন সৈয়দ, তৎকালীন এএসআই, ৫ই জুন জবানবন্দী দিয়েছেনঃ
"এর পর আমিন ওই চোখ বাঁধা লোকটিকে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করায় রোড ডিভাইডারের পাশে দাঁড় করানো ইন্ডিকা গাড়িটার পেছনে ... এর পর আচমকা আমিন সাহেবের মারুতি জিপসির থেকে ইন্ডিকা গাড়ির ওপর ফায়ারিং করার আওয়াজ এল ... এর পরে শ্রী এন কে আমিনের নির্দেশমতো আমরা ইন্ডিকা গাড়ির কাছে আসি। এসে দেখি খোদিয়ার ফার্মে রাখা সেই জোয়ান ছেলেটি আর মেয়েটি ইন্ডিকা গাড়ির ড্রাইভারের সীটে আর তার পাশের সীটে মরে পড়ে আছে। আর ইন্ডিকা গাড়ির পেছনে মোতি তালজা সেই চোখ বাঁধা লোকটিকেও মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন ..."
শ্রী মোহন নানজিভাই মেনত, পুলিশ আর্মড হেড কনস্টেবল, তাঁর জবানবন্দী নথিবদ্ধ করেছেন ৬ই জুন ২০১৩তেঃ
"এর পর আচমকা টাটা ইন্ডিকা গাড়ি আর তার পাশে চোখ বাঁধা লোকটির ওপরে, কাছে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ অফিসারেরা ফায়ারিং করতে শুরু করে ..."
হেড কনস্টেবল মোতি কালজা দেসাইয়ের সাক্ষ্যঃ
"আমরা এবং ডিসিবি আহমেদাবাদের অফিসারেরা সত্যি সত্যিই ফার্ম হাউসে একজনকে আটক করেছিলাম, পাকিস্তানি সন্দেহে। লোকটিকে চোখ বাঁধা অবস্থায় এনকাউন্টারের জায়গায় আনা হয়, এবং রাস্তার ডিভাইডারের ওপর দাঁড় করানো হয়। তথাকথিত জঙ্গীদের ব্যবহৃত ইন্ডিকা গাড়িটিও সেইখানেই রাখা ছিল, এবং পুলিশ গাড়ি আর ওই লোকটির ওপর ফায়ারিং শুরু করে, লোকটি ঘটনাস্থলেই মারা যায়।"
শুধু এই চারটে জবানবন্দীই নয়। পিআই সি জে গোস্বামী, পিআই বি এ চাভদা, পিআই কে এস দেসাই, ডেপুটি এসপি ডি এইচ গোস্বামী, এবং পিআই আর আই প্যাটেল; প্রত্যেকেই তাঁদের বিবরণ দিয়েছেন তাঁদের জবানবন্দীতে, ১৫ই জুন, ভোর সাড়ে চারটে থেকে পাঁচটার মধ্যে ঘটা এক নৃশংস ঠান্ডা মাথার পরিকল্পিত হত্যার, যাতে শেষ হয়ে যায় চারটি প্রাণ। উর্দিধারী পুলিশদের স্বেচ্ছায় দেওয়া এই জবানবন্দী, যাতে তাঁরা তাঁদের উর্ধ্বতন অফিসারদের হাতে এই চারজনের খুন হবার ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন, পড়লে মনে হয় যেন হিটলারের জমানায় গেস্টাপোদের করা হত্যালীলার বর্ণনা।
এই সব সাক্ষ্যের সাথেই নিচের ছবিটি দেওয়া গেল। রক্তমাখা গাড়ির ভেতরে তথাকথিত জঙ্গীদের ব্যবহার করা এ কে ৫৬ ম্যাগাজিনের অংশ দেখা যাচ্ছে। দাবি করা হয়, গাড়ির যাত্রীদের কাছেই এই সব ম্যাগাজিনগুলো পাওয়া গেছে। ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, গাড়ির নিচটা রক্তে পুরো মাখামাখি, কিন্তু ম্যাগাজিনগুলো একদম চকচক করছে।
তারা অস্ত্র রেখে ছবি তুলেছিল, কিন্তু ছবি তোলবার আগে অস্ত্রে রক্ত মাখাতে ভুলে গেছিল।
ইশরাতকে, সম্ভবত আলাদাভাবে হত্যা করা হয়েছিল। নিচের সাক্ষ্যগুলি সেই দিকেই ইঙ্গিত করছেঃ
- বেশির ভাগ বুলেটই ফায়ার করা হয়েছিল গাড়ির বাঁদিক থেকে। ছবিতে গাড়ির বাঁদিকে বুলেট ঢোকার ছিদ্র আর ডানদিক দিয়ে বুলেট বেরোবার ছিদ্র দেখা যাচ্ছে। জাভেদ, যে গাড়িটা চালাচ্ছিল, তার শরীরে ১৪টা বুলেট লাগে, সেগুলোও তার শরীরে বাঁদিক থেকে ঢুকে ডানদিক দিয়ে বেরোয়। ইশরাতের শরীরে ছিল মাত্র ৪টি বুলেটের দাগ, তার মধ্যে দুটি তার ঘাড়ের ডানদিকে।
- জাভেদের শরীর রক্তে মাখামাখি ছিল, ইশরাতের শরীর তা ছিল না। ইশরাত নাকি জাভেদের পাশেই বসে ছিল। যদি তাই হয়, তা হলে এ রকম কখনওই হতে পারে না, যদি পুলিশ সত্যিই গাড়ির বাইরে বাঁদিক থেকে পরপর গুলি চালায়। মৃতদেহের ছবিগুলো দেখলেই বোঝা যাবে।
সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে এটা পরিষ্কার যে, ইশরাতকে গাড়ির ভেতরে বসে থাকা অবস্থায় মারা হয় নি; অন্য কোথাও মেরে তার দেহকে জাভেদের পাশে বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
সতীশ ভার্মার এফিডেভিটে আরও লেখা ছিল, 9mm ক্যালিবার বুলেট যা মৃত ইশরাতের শরীর থেকে বের করা হয়েছে, তা ওই সময়ে ব্যবহৃত কোনও পুলিশ ওয়েপনের সঙ্গে ম্যাচ করছে না।
এইভাবে চারজন হতভাগ্য দেশের চার প্রান্ত থেকে আমেদাবাদের কোতারপুরে আসে, এবং মারা যায়। তাদের মরতে হয় কারণ কিছু উচ্চাকাঙ্খী পুলিশ অফিসারকে নিজেদের "মুসলিম জেহাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই করা সাহসী হিন্দু যোদ্ধা" হিসেবে দেখানো দরকার হয়ে পড়েছিল। যার ফলে শুধু এই চারজন প্রাণ হারিয়েছে তা-ই নয়, আরও অনেকে স্রেফ ভ্যানিশ হয়ে গেছে। ওয়াইস এবং আজাদ, যারা সম্ভবত জাভেদের মতই রাজিন্দার কুমারকে সাহায্য করেছিল জীশানকে ধরতে, তাদের আর খোঁজ পাওয়া যায় নি। এমনকি মেহরাজ, ইব্রাহিমপুরে জাভেদের বন্ধু, তারও আর খোঁজ পাওয়া যায় নি। এ আমজাদের সঙ্গে জাভেদের আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। জাভেদ নিজে মারা গেল এনকাউন্টারে, একজন "বন্ধু" পুলিশ অফিসারকে "সন্ত্রাসবাদী" খুঁজতে সাহায্য করতে গিয়ে।
ইশরাত মারা গেল উনিশ বছর বয়েসে, তার কদিন পরেই তার বি এ সেকেন্ড ইয়ারে ওঠার কথা ছিল। জাভেদ তার ফি জমা করে দিয়েছিল কলেজে। তার বক্তব্য তার নিজের বয়ানে আর কোনও দিনও শোনা যাবে না।
এখনও পর্যন্ত এই চক্রান্তের যতটা জানা গেছে, তা সিবিআই, আমেদাবাদের স্পেশাল সিবিআই কোর্টকে জানিয়েছে এই চার্জশীটে। তদন্ত এখনও চলছে এবং মাসখানেকের মধ্যেই সিবিআই একটি সাপ্লিমেন্টারি চার্জশীট জমা দেবে বলে জানিয়েছে।
কিছু দক্ষিণপন্থী বুদ্ধিজীবি অবশ্য এখনও এই ধরণের হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন করে চলেছেন এবং মনে করেন গণতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক মনে হলে কাউকে এই ধরণের নৃশংশভাবেই মারা উচিত। যদিও আইন আইনের পথে চললে এই হত্যাকাণ্ডের সমস্ত ষড়যন্ত্রকারীদেরই কঠিনতম শাস্তি হওয়া উচিত।
আমরা এখন সিবিআইয়ের সাপ্লিমেন্টারি চার্জশীট দাখিলের অপেক্ষায়।
সম্পাদনা ও অনুবাদ - শমীক মুখোপাধ্যায়