১৫ই জুন ২০০৪ সালের এক ভোরবেলা আমেদাবাদের রাস্তায় এনকাউন্টারে খুন হায় চার যুবক যুবতী। জীশান, আহমেদ, জাভেদ আর ইশরাত জাহান। পুলিশ প্রাথমিকভাবে জানায়, তারা সন্ত্রাসবাদী। নরেন্দ্র মোদীকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে তারা আমেদাবাদে এসেছিল।
মূলত ইশরাতের মায়ের চাপে, অনেক পরে সিবিআই এই এনকাউন্টারের তদন্তভার হাতে নেয়। উঠে আসে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। আমরা একটু দেখে নিই ঘটনাগুলো।
১৫ জুন, ২০০৪এর এক ভোরবেলা জীশান, আহমেদ, জাভেদ আর ইশরাত নামে চারজনকে খুন করার দায়ে অভিযুক্ত ৮ জন গুজরাত পুলিশের কর্মচারীর বিরুদ্ধে চার্জ তৈরি করার জন্য সিবিআই ১৭৯ জন সাক্ষীর তালিকা বানিয়েছিল। এই ৮ জন পুলিশ হলেন, অতিরিক্ত ডিজিপি - পি পি পান্ডে (নিখোঁজ), ডিআইজি - ডি জি বানজারা, এসপি - জি এল সিঙ্ঘল, ডেপুটি এস পি - এন কে আমিন, ডেপুটি এসপি - টি এ বারোত, কম্যান্ডো অনুজ চৌধরি, এবং অবসরপ্রাপ্ত ডেপুটি এসপি - জে জি পারমার। এই ৮ জনের মধ্যে পান্ডে এবং বানজারা বাদে বাকি সকলেই ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন বলে স্বীকার করেছেন। গুজরাত পুলিশের ফাইল করা মূল এফআইআরে এই আটজনেরই নাম ছিল যাঁরা গুলি করে মেরেছেন ঐ ৪ "সন্ত্রাসবাদী"কে। পান্ডে আর বানজারার নামও ছিল।
এখন, প্রশ্ন উঠতেই পারে, এফআইআরে যদি নাম আছেই, তা হলে আর তাদের উপস্থিতি প্রমাণ করার জন্য সিবিআইকে ১৭৯জন সাক্ষীর ব্যবস্থা কেন করতে হল! সিবিআইয়ের বর্তমান চার্জশীটে এই এনকাউন্টারকে আইবি আর গুজরাত পুলিশের যৌথ অপারেশন বলে বিবৃত করা হয়েছে, এবং এতে রাজিন্দর কুমার সমেত চারজন আইবি অফিসারের নামও দেওয়া রয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবেই কোনও আইবি অফিসারকেই হত্যার ষড়যন্ত্র, অপহরণ ইত্যাদি সম্ভাব্য কোনও ধারাতেই অভিযুক্ত করা হয় নি। এই ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডটি ঘটাবার পেছনে এতগুলো পুলিশ অফিসার এবং আইবি অফিসারদের আসল উদ্দেশ্য, বা মোটিভ কী ছিল, এই সম্বন্ধে কোনও কথাই বলা হয় নি। এটাও ব্যাখ্যা করা হয় নি কেন এই চারজনকে তিনটে আলাদা আলাদা জায়গা থেকে তুলে আনা হল আর কেনই বা তাদের আমেদাবাদের একটা রাস্তার ধারে দাঁড় করিয়ে মেরে ফেলা হল। চার্জশীটে যা লেখা আছে, তার থেকে অনেক বেশি কিছু লেখা নেই।
এই রহস্যের জট খুলতে গেলে, ৯ই জুলাই ২০১৩তে আহমেদাবাদে গোপীনাথন পিল্লাইয়ের বক্তব্যে গুরুত্ব দিতে হবে। অসংখ্য সাংবাদিকদের সামনে গোপীনাথন ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে যা জানান, তা হল, ২০০৪এর ৯ই জুন, জাভেদ খুন হবার ঠিক ছদিন আগে, তাঁকে ফোন করে জানায়, কিছু পুলিশ অফিসারের নির্দেশে সে আহমেদাবাদ যাচ্ছে। জাভেদের সাথে তাঁর শেষ কথোপকথন অনুযায়ী তিনি জানতে পারেন যে গুজরাতের কিছু প্রভাবশালী পুলিশ অফিসারের সাথে জাভেদের আলাপ হয়েছে যাঁরা জাভেদকে তার ব্যবসার কাজে সাহায্য করবেন। এই প্রভাবশালী পুলিশ অফিসারদের সঙ্গে জাভেদের সম্পর্কের বিষয়টা জানা গেলে হয় তো অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যেত।
গুজরাত পুলিশের বানানো প্রথম রিপোর্ট যেটা পরীক্ষিতা গুর্জর বানিয়েছিলেন, তাতে স্পষ্ট লেখা আছে যে জাভেদ আর ইশরাত ইব্রাহিমপুর গেছিল এবং সেখানে তেসরা মে থেকে সতেরোই মে-র মধ্যে তারা অন্তত দুবার সালিম ওরফে আমজাদ আলির সাথে দেখা করেছিল। সেই রিপোর্টেই এটাও লেখা আছে যে ২৪শে মে পুণেতে জাভেদের বাড়িতে আমজাদ আলিকে দেখা যায় এবং একটা গাড়ির গ্যারেজেও দেখা যায়, যেখানে আমজাদ আলি একটা নীল ইন্ডিকা গাড়ি কিনছিল। ২৫ এবং ২৭শে মে-র মধ্যে ইশরাত আর জাভেদকে আহমেদাবাদে দেখা যায়, এটাও লেখা আছে সেই রিপোর্টে। এদিকে সিবিআইয়ের বর্তমান রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, ২৬শে মে ২০০৪এ আমেদাবাদে আমজাদ আলিকে অপহরণ করা হয়। এখন, তারিখগুলো পরপর দেখলেই বোঝা যায় জাভেদ প্রথমে সালিমের সাথে পরিচিত হয় মে-র প্রথম সপ্তাহে, তারপরে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়, তারপরে সালিমকে তার পুণের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে ২৪শে মে। সম্ভবত এটা ঘটে সেই "প্রভাবশালী পুলিশ অফিসার"এর সাহায্যেই। ২৪শে মে জাভেদ গাড়ি কেনে এবং সেই গাড়িতে জাভেদ, ইশরাত এবং আমজাদ আমেদাবাদ যায়, যেখানে সেই "প্রভাবশালী পুলিশ অফিসার" আমজাদকে অপহরণ করে। অর্থাৎ, ২৬শে মে নাগাদ পুলিশের হাতে এমন দু জন এসে গেছিল, যাদের সন্ত্রাসবাদী হিসেবে সাজানো যায়, আইবি এই সন্ত্রাসবাদীর চরিত্রে সাজাবার জন্য মনোনীত করে জীশান আর আমজাদ আলিকে। জাভেদ কিছু না জেনেই আমজাদকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়, এর পরে ইশরাত আর জাভেদ য়ামেদাবাদ থেকে চলে আসে, এবং সেখান থেকে জাভেদ তার স্ত্রী ও তিন সন্তান সমেত গাড়ি করে সোজা কেরালার বাড়িতে চলে আসে।
এর পর নিউ চ্যানেলের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, জাভেদ যখন কর্ণাটকের মধ্যে দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল, তখন, ৬ই জুন ২০০৪ রাত ১১:০৮ নাগাদ তার মোবাইলে একটা ফোন আসে গান্ধীনগরের কোনও এক ফোন বুথ থেকে। আরও জানা যায়, সেই একই ফোন বুথ থেকে ১১:১৪ আর ১১:২৮ নাগাদ দুটি ফোন যায় রাজিন্দার কুমারের কাছে, যিনি ছিলেন তৎকালীন এসআইবি চিফ।
এর পরে, গোপীনাথের বক্তব্য অনুযায়ী, ৯ তারিখ সকালে তাঁর কাছে জাভেদের ফোন আসে, কোনও একজন বড়মাপের পুলিশ অফিসার তাকে আমেদাবাদে ফিরতে নির্দেশ দিয়েছেন। সন্দেহের কোনও অবকাশই থাকে না ৬ তারিখ রাতে জাভেদের কাছে ফোনে কী নির্দেশ গিয়েছিল। সেই ফোনের আগে পরে রাজিন্দার কুমারকে করা দুটি ফোন কল থেকে এটাও বোঝা যায় কার নির্দেশে জাভেদকে এই কল করা হয়েছিল এবং কল করার পর কাকে কনফার্মেশন দেওয়া হয়েছিল। ধারণা করে নেওয়া যায় ইনিই সেই বড় পুলিশ অফিসার, জাভেদ যার কথা বলেছিল।
ইশরাতের মা শামীমা কওসরের বয়ান অনুযায়ী, ইশরাত ১১ তারিখ ভোরবেলায় তাদের মুম্ভরার বাড়ি থেকে চলে যায় এবং নাসিক থেকে ফোন করে। শাজিদা, জাভেদের স্ত্রীও জানান যে ১১ তারিখ সকাল ১০টা নাগাদ জাভেদ খুব তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যায় এবং নাসিকে ইশরাতের সঙ্গে দেখা করে। নাসিক আমেদাবাদ যাবার রাস্তাতেই পড়ে। রিপোর্ট থেকে বোঝা যায় নাসিক থেকেই তারা নজরবন্দী হয়ে গেছিল। চার্জশীটে লেখা আছে যে তরুণ বারোট, এন কে আমিন এবং অন্যান্য আইবি অফিসাররা আনন্দের কাছে ভাসাড নামক জায়গা থেকে তাদের তুলে নিয়ে গিয়ে আমেদাবাদের খোদিয়ার ফার্মে নিয়ে গিয়ে রাখে।
পুলিশ কেন জাভেদ আর ইশরাতকে আবার নিয়ে এল, তাদের যখন ছেড়েই দিয়েছিল ২৭শে মে-তে? জানা যায় যে মে-র প্রথম সপ্তাহেই জীশান আর আমজাদকে এনকাউন্টার করে মেরে ফেলার প্ল্যান ছকে ফেলা হয়েছিল। আমজাদ ২৬শে মে পুলিশের হাতে আসে, জীশান এপ্রিলের শেষ থেকেই পুলিশের কাছে ছিল। এর পর তা হলে প্রশ্ন আসে, জাভেদ আর ইশরাতকে নিয়ে কী করা হবে, যারা নিজেদের অজ্ঞাতসারেই আমজাদকে পুলিশের হাতে মরবার জন্য তুলে দিয়েছিল? তারা তো সাক্ষী থেকে গেল! অতএব, তাদেরও মেরে ফেলা দরকার। অতএব, গান্ধীনগরের ফোন বুথ থেকে তাদের ফোন করে আবার আমেদাবাদে ডেকে আনার একটা সূত্র পাওয়া যায়।
ইশরাত জাহান এনকাউন্টার কেসে গুজরাত পুলিশের করা এফআইআরের বয়ান অনুযায়ী, জঙ্গীরা যে ইন্ডিকা গাড়িতে করে যাচ্ছিল, তাতে বিস্ফোরক পাওয়া গেছে, যা নাকি তারা নরেন্দ্র মোদীর ওপর আত্মঘাতী হামলা করার জন্য নিয়ে যাচ্ছিল। এই "বিস্ফোরক" পরে ফরেনসিক টিম পরীক্ষা করে দেখে এবং এতে কোনও ক্ষতিকর রাসায়নিক পাওয়া যায় নি।
গুজরাত হাইকোর্টে পেশ করা এসআইটির এফআইআরের অংশ নিচে তুলে দেওয়া গেলঃ (নম্বর DCB PS I CR No. 8 of 2004)
প্যারা 8.5: গাড়ি থেকে একটা ১৭ কেজি ওজনের হলুদ পাউডার সমেত বন্দুকের ব্যাগ পাওয়া গেছে। গান্ধীনগরের ডিরেক্টরেট ফরেনসিক সায়েন্স এবং ভদোদরার ডেপুটি চিফ কন্ট্রোলার অফ এক্সপ্লোসিভস সেটির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেন এবং জানান যে হলুদ রঙের সেই কেমিকাল মিশ্রণটি কোনওমতেই বিস্ফোরক ছিল না।
গুজরাত পুলিশ, এমনকি, সঠিক বিস্ফোরকও রাখতে পারে নি ফেক এনকাউন্টারের জায়গায়। মজার ব্যাপার হল, তিরিশখানা শুকনো নারকোলও পাওয়া যায় গাড়ির ছাদ থেকে যেগুলোকে বোমা বলে চালানোর চেষ্টা করে পুলিশ। পরে জানা যায় নারকোলগুলি জাভেদের বাবা তাঁর কেরালার বাড়ি থেকে পাঠিয়েছিলেন, নাতিকে উপহার দেবার জন্য।
সম্পাদনা ও অনুবাদ - শমীক মুখোপাধ্যায়
(আগামী পর্বে সমাপ্য)