এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • ছাতা

    Soumya Kanti Pramanik লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ০২ নভেম্বর ২০১৮ | ২৪৬৫ বার পঠিত
  • "এখনও সেই গাভীগুলি..গোচরণে ছড়ায় ধূলি...সখার সনে কোলাকুলি...রাখাল রাজেরে.."

    "আমি জানি, আমার এই চিঠি তোমার কাছে পৌঁছবে না... তুমি এখন অনেক দূরে থাকো, হয়তো বিয়ে করে নিয়েছো...বছরখানেক আগে তোমার খবর পেয়েছিলাম, পেনসিলভানিয়া তে বিশ্ববঙ্গ সম্মেলনে তোমায় সম্মানিত করার হচ্ছে ! নিখিলেশ, আমি বলে বোঝাতে পারবো না, আমার ঠিক কি অনুভুতি হচ্ছিল তখন !!...

    আমায় কি তোমার মনে থাকবে, নিখিলেশ ? অবশ্যই মনে না রাখার কথা...এতো গুলো বছর কেটে গেছে ! তুমি তখন ফিজিক্সে honours, প্রেসিডেন্সির দাপুটে ছাত্র নেতা...অবশ্য আমার মতো মেয়েকে মনে রাখার ও কারণ আছে কি ? তবুও, একবার মনে করে দেখতে পারো !

    সেদিন আমার কলেজে প্রথম দিন... আমার কুশাবেরিয়া গ্রাম থেকে বাঁকুড়া শহরের দূরত্বই যেন দুটি মহাদেশের অন্তর্বতী ব্যবধান ! সেখানে কোলকাতা তো গ্রহান্তর.. কোলকাতায় প্রথম পা দেওয়া সেদিন ...কিন্তু ট্রাম-বাস-অটো পেরিয়ে কলেজ স্ট্রিট পৌঁছতে পৌঁছতে প্রথম ক্লাস টা মিস হয়ে গেল... এক শহরে এতো লোক আমি আগে দেখিনি... সেদিন বেলা হতেই প্রচন্ড বৃষ্টি নেমে এলো, চারিদিক প্রায় অন্ধকার, আমি ছাতা আনিনি এদিকে... প্রায় চারটে বেজে গেলো, আস্তে আস্তে কলেজ ফাঁকা হয়ে এলো... কমনরুমের কাছে দাঁড়িয়ে ভাবছি, এবার কি উপায়... পেছন থেকে একজনের জলদগম্ভীর স্বর ভেসে এলো, 'আপনি কোথায় যাবেন ? ছাতা আনেননি তো, ভিজে যাবেন... চলুন, আপনাকে এগিয়ে দিচ্ছি, আমার ছাতা আছে'...

    নিখিলেশ, জীবনে প্রথম বার কোন পুরুষকন্ঠ আমায় মাথায় ছাতা ধরার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল.. কমবয়সে বাপ হারানো এক মেয়ের কাছে এ যে কতবড় পাওয়া, আমি তোমায় কি করে বোঝায় !তোমার ওই ভাসা ভাসা চোখে আমায় জরিপ করে নিচ্ছিলে সেদিন...বৃষ্টি পড়েছিল আমার রিক্ত দেহ তটে... শান্ত সম্মোহনের এক নিগূঢ় জলপ্রপাত...

    এরপরের ঘটনা তোমার জানা নেই, জানবার কথাও নয়... প্রেসিডেন্সির পাঠ আমার এক বছরেই চুকে গেছিল... বাড়িতে একা মা, দুই ভাই, কে টানবে সংসার, কে জোগাবে আমার কোলকাতা থাকার খরচ, পড়াশোনা করার এতো ইচ্ছে ! ভর্তিহলাম বাঁকুড়া কলেজে,কোন রকমে বি এ পাস... একটা প্রাইমারি স্কুলে চাকরি পেলাম বরাত জোরে...সংসারে তখন দুটো টাকা আসছে, ভাইদুটো কে স্কুলে ভর্তি করাতে পেরেছি, মা কে পুজোতে নতুন শাড়ি কিনে দিয়েছিলাম সে বছর...

    নিখিলেশ, এর পরের ঘটনাগুলো তোমাদের জগৎথেকে অনেকটাই সমান্তরাল... তোমার দেখা আধুনিক জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন, আপাতদৃষ্টিতে... কারণ, আমার সেই কুশবেরিয়া গ্রাম থেকে তোমাদের গ্রহান্তর যে বহু আলোকবর্ষ দূরে !

    আমি তখন এক বছরের কম সময় চাকরিতে ঢুকেছি... স্কুল থেকে মেঠো পথ ধরে বাড়ির রাস্তা প্রায় মাইল দেড়েক... সেদিন সন্ধ্যে নেমেছিল, মাথায় গামছা বাঁধা জনা চারেক মাঝ বয়সী লোক আমার রাস্তা আটকালো, বলল ওদের সাথে যেতে হবে ...আমি ছোটথেকে এদের কথা শুনেছি... নিখিলেশ, তোমাদের মতো শহুরে লোকেদের জন্য রাজনীতি হলেও, কখনো সেসবের গল্প আমি চোখে দেখিনি... ততদিন নিজের ভোট টা কখনও নিজে দিতে পারিনি, সেটা নাকি আমার হয়ে প্রতিবছর কেউ দিয়ে দিয়েছে... গণতন্ত্র মানে এই ভোট দেওয়া -এর বাইরে যে কোন দেশ আছে, আমি যে আদৌ সে দেশের নাগরিক, প্রাপ্য অধিকার না পেলে যে তাকে ছিনিয়ে নিতে হয়, সেসবের কোন ধারণা ততদিন ছিল না...

    সেদিন ওরা ঠিকই করে ছিল ...নাইন এম এম পিস্তল দেখিয়ে আমায় টেনে নিয়ে আমায় দাঁড় করিয়েছিল আমার নিজের সামনে! ...কীট পতঙ্গের মতো যে জীবনে বেঁচে ছিলাম, সে জীবনের যে কোন উদ্দেশ্য থাকতে পারে, আদর্শ থাকতে পারে , এভাবে আগে তো বুঝিনি!....

    নিখিলেশ, তোমাদের সরকার পানি বিজলি সড়কের নাম করে দিনের পর দিন আমার মতো কোটি কোটি মানুষ কে ধোঁকা দিয়েছে, তোমরা সেই সরকারের দল গুলোর তাঁবেদারি করেছো দিনের পর দিন... আমার ভাই বোনেরা পিঁপড়ের ডিম খেয়ে থেকেছে, আর আমাদেরই জঙ্গল কেটে তোমাদের প্রধানমন্ত্রী বিদেশের কোম্পানির হাতে জমি তুলে দিয়েছে... না, এসবের কোন প্রতিবাদ তোমরা করোনি... তোমাদের শহরের কারখানায় আমার গাঁয়ের গরীব শ্রমিক মারা গেলে, তোমরা বস্তা বন্দী করে পাঠিয়ে দিয়েছো...আচ্ছা, নিখিলেশ বলতে পারো, তুমি আর আমি কি এতদিন এক দেশেই বাস করেছি ?

    পার্টি তাই আমাদের শিখিয়েছে, কিভাবে লড়াই করতে হয়, কিভাবে নিজের অধিকার আদায় করতে হয়... আমরা চেষ্টা করেছি... ছুটে বেড়িয়েছি দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত... তোমরা ভেবে দেখোনি, যে চাষা আজ বিষ খেলো, তার ছেলে কাল কি খাবে ? বর্ডার সিকিউরিটির নাম করে অন্যদেশের সেনাদের বন্দুকের নলের সামনে যে ছেলে টিকে তোমাদের সরকার এগিয়ে দিয়েছে, তার কফিন বাড়িতে এনে তার মা কে তোমরা কি সান্ত্বনা দেবে ? আমরা তাদের কথা ভেবেছি, পাশে থেকেছি, লড়াই করেছি...

    একদিন ধরা পরে গেলাম...দলের নির্দেশ ছিল বিষ খেয়ে নিতে... সেটা হয়ে ওঠেনি...
    তারপর থেকে আমি এখানে...

    নিখিলেশ, কারো প্রতি আর কোন ক্ষোভ নেই...আমি জানি, এসব যা করেছি, তাতে তোমাদের কিছু যায় আসে না....তুমি পি এইচ ডি করতে যেমন এদেশ ছেড়েছ, আমিও তেমন এ রাষ্ট্রের চোখে দেশদ্রোহী হয়েছি... কি পেরেছি, কি পারিনি, সেসব তো সময় বলবে....তবে ১২৩ কোটির ঘুম ভাঙ্গানো যে এক দিনে সম্ভব নয়, সেটা নেহাতই এতদিনে বুঝেছি....তাই আর আক্ষেপ করি না.....

    শুধু তোমাকে ভুলতে পারিনি, এই আক্ষেপটা রয়ে গেল...

    ইন্টারোগেশন রুমের হলুদ বাল্বের আলোয় যখন আমার উলঙ্গ দেহের ওপর কারেন্টের শক দেওয়া হতো, তখন চোখ বুজে তোমার ওই স্নিগ্ধ চাহনির কথা ভাবতাম...আঃ, কি শান্তি....

    আমার যোনি, স্তন আর কিছু অক্ষত নেই...ধীরে ধীরে দৃষ্টি শক্তি ও ক্ষীন হয়ে আসছে ....আজকাল কারোর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে না....দিন না রাত, এসবের হিসেবও চলে গেছে...আসলে বেঁচে আছি, না মরে গেছি, বুঝতে পারিনা....

    হয়তো, মরেই যেতাম...যদি না, তোমার দেওয়া ওই ছাতা টা এতদিন আমার সাথে থাকতো...

    নিখিলেশ, ওটা তোমায় ফেরত দেবো, তাই একবার দেখা করতে হবে তোমার সাথে....সে আজ না হয় কাল...হয়তো, কোন অন্য ভোরে, যেদিন পুব দিকে এক লাল সূর্য উঠবে....আর আমি, তোমায় নিয়ে সেই রোদ্দুরে স্নান করে নেব !

    আচ্ছা, আমায় সেদিন তুমি এই রাষ্ট্রের মতো ভুল বুঝবে না তো ?"

    "কয়েদি নাম্বার ২৩৩...
    কি লিখছো এখন !
    শালা, ঢেমনি মাগী!বুড়ি হতে চললি, এখনও লেখার শখ গেল না...সাতকুলে তো কেউ টুকি মারতে আসে না...তার চিঠি লেখার ওস্তাদি গেল না এতদিনেও...
    পাগল মাগী , চলো, ডাক্তার হাসান ইনজেকশন নিয়ে অপেক্ষা করছে...
    চলো, চলো, তাড়াতাড়ি চলো"

    ....
    পেন টা এখন নীচে পরে আছে, সাদা কাগজে টা চৌকির এক কোনায়, আর সব টুকরো কাগজের ভিড়ে এখন মিশে গেছে...
    অন্ধকার ঘর...
    শুধু একফালি জানলার ফাঁক দিয়ে আলো ঠিকরে এসে পড়েছে ঘরের একমাত্র আসবাব, জলের কুঁজোর পাশে রাখা একটা কালো রঙের ছাতার ওপরে....

    "এখনও সেই বৃন্দাবনে বাঁশি বাজে রে......"
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ০২ নভেম্বর ২০১৮ | ২৪৬৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • ... | ***:*** | ০৬ নভেম্বর ২০১৮ ০৭:২৪62910
  • নিখিলেশরা সব বিলেতে বসে এখন শখের বিপ্লবের জাবর কাটতে ব্যস্ত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খারাপ-ভাল প্রতিক্রিয়া দিন