এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • যত দোষ...

    Aniruddha Garai লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৬ এপ্রিল ২০২৫ | ৪৭ বার পঠিত
  • প্রচণ্ড গরমে অবিনাশ‌ বাবুর নাজেহাল অবস্থা। সকাল আটটা বাজতে না বাজতেই অ্যায়সা রোদ পড়ে, ঘরের ভেতরটা তপ্ত তাওয়ার মত হয়ে যায়। তার ভেতর নুন হলুদ মাখানো মাছের পিসের মত ছটফট করেন রিটায়ার্ড কেরানি অবিনাশ বাবু। প্রাইভেট ফার্ম বলে পেনসন নেই কোন। গোটা জীবনের সঞ্চয় এফডি করে, তার ইন্টারেস্টে কোনমতে জীবনধারণ করেন। আজ ব্যাংকে গেছিলেন টাকা তুলতে। আগে এটিএম থেকে তুলতেন। একবার ফোনকলে ওটিপি দিয়ে দেওয়ায় তাঁর একাউন্ট থেকে হাজার দশেক উড়ে গিয়েছিল। তারপর থেকে এটিএম থেকে শুরু করে সমস্ত ডিজিটাল মাধ্যম তিনি ত্যাগ করে এখন ব্যাংকে লাইন দিয়ে টাকা তোলেন। সেই ব্যাংকে আজ সকাল থেকে লিংক ছিল না। সবার আগে লাইন দিয়ে এই দুপুর দুটোয় তিনি ঘামে স্নান করে বাড়ি ঢুকেছেন। এই জায়গাটায় আগে প্রচুর গাছপালা ছিল। সন্ধ্যে হলেই দুদিকের জানালা গুলো খুলে দিলেই হাওয়ায় প্রাণ জুড়িয়ে যেত। তারপর এল এক লোভী প্রোমোটার। রুলিং পার্টির সাথে আঁতাত করে, একদিকের সমস্ত গাছ কেটে ফেলে কয়েকটা ফ্ল্যাট তুলে দিল। বেশিরভাগই G+3 এর প্ল্যান, কিন্তু তোলা হলো G+4, বা G+5। অবিনাশ বাবুর বাড়ির ভেতরে এয়ার সাপ্লাই টোটালি বন্ধ হয়ে গেল। ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা দয়াপরবশ হয়ে নিজেদের ঘরে এসি লাগিয়ে অবিনাশ বাবুকে হট এয়ার সাপ্লাই দিতে লাগলেন। "নো, থ্যাংক ইউ" বলে তিনি তখন একটা কুলার কিনেছিলেন। বাড়িতে ফ্যান বাদে ওই প্রথম ঘর ঠান্ডা করার একটা বাড়তি জিনিস এল। যাইহোক, ওতে বেশ কয়েকটা গ্রীষ্ম কেটে গেল। ইতিমধ্যে স্ত্রী দেহ রাখলেন। ক্যান্সার হয়েছিল। সরকারী হাসপাতালে ভরসা নেই, ভর্তি করলেন বাড়ি থেকে বেশ দূরে একখান মাল্টিস্পেশালিটিতে। ঠিক তক্ষুনি চালু হল লকডাউন। তার উপর হাসপাতালের মারকাটারি খরচ; ঠিক করে চিকিৎসাই করাতে পারলেন না অবিনাশ বাবু। যে বছর স্ত্রী গেলেন, সে বছর গরম যেন দ্বিগুণ হয়ে গেল। চোখের জল ফেলে, কপালের জল মুছে, অবিনাশ বাবু কষ্ট করে কিনলেন একটা সেকেন্ড হ্যান্ড এসি। ছেলে ব্যাঙ্গালোরে থেকে যা কামায়, তা ব্যাঙ্গালোরেই খরচ হয়ে যায়। বাপকে পাঠাতে পারে না কিছুই। তাই সেকেন্ড হ্যান্ড। ফ্যান, এসি, কুলার— এই তিনের সংযোগে ঘর ঠান্ডা রাখতে শুরু করলেন রিটায়ার্ড কেরানিবাবু। এই বছর হয়েছে গেরো। প্রতিবারই এসিটা একটু বেগড়বাঁই করে, এবছর গেছে একদম খারাপ হয়ে। ফ্যানেরও কন্ডেনসার খারাপ হয়ে এমন মিনমিন করে ঘুরছে, যেন গরমে ওটার হিট স্ট্রোক হয়েছে। ইলেকট্রিশিয়ান বাবলু গেছে শালার বিয়েতে শিলিগুড়ি। ফিরবে এক মাস পরে। অগত্যা ফ্যান এখন এভাবেই ঘুরবে। পাসবই, টাকা, ছাতা সব টেবিলে রেখে, গায়ের ফতুয়াটা খুলে, কুলারটা চালিয়ে সামনে দাঁড়ালেন অবিনাশ বাবু। রাজুকে ফোন করলেন। প্রতিবছর রাজুই সারিয়ে দিয়ে যায় এসি। ফোনে শুরু হল ফ্রডিউলেন্ট ফোনকল নিয়ে সরকারের সাবধানবাণী। অবিনাশ বাবুর মাথাটা হালকা গরম হয়ে গেল। তারপর শুরু হল কলার টিউন। বিদঘুটে একটা গান। তাতে মাথাটা আরেকটু গরম হল। পুরো গানটা শুনিয়ে ফোনটা ধরলো রাজু।
    "হ্যালো?!?"
    "হ্যালো রাজু, আমি দাদু বলছি।"
    "কে দাদু?"
    "অবিনাশ দাদু। পোদ্দার পাড়া।"
    রাজুকে এরকম লোকজন একটা কাজেই ফোন করে, সেটা হল এসি সারানো। পিরিত করার জন্য নয়। রাজু তাই "কেমন আছেন" গোছের ভদ্রতামূলক ভণিতার আশ্রয় ত্যাগ করে সরাসরি ঝাঁঝিয়ে উঠলো —
    "শোনো দাদু, তোমার ঐ এসি সারানোর আমার ক্ষমতা নেই। হয় নতুন এসি কেনো নয়ত নতুন লোক দ্যাখো বাঁ—!"
    অবিনাশ বাবুর পায়ের বুড়ো আঙুলের ডগা থেকে মাথার চুলের আগা অব্দি গনগনে আগুনের স্রোত বয়ে গেল। কী পেলেন তিনি জীবনে? যে কোম্পানির জন্য মুখে রক্ত তুলে খাটলেন, তারা শেষ সময়ে পুরো টাকাটাও দিল না। বউয়ের সাথে খিটিমিটি লেগে থাকলেও, বউই ছিল তার সর্বক্ষণের সঙ্গী। সে অমন দুম করে চলে গেল। দুমদাম যে পারে কথা শুনিয়ে দেয়, সে ব্যাংকের লোক হোক বা এসি মেকানিক। একজন সত্তর ছুঁই ছুঁই বিপত্নীক লোকের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় কেউ জানে না। দু বেলা এত এত ওষুধ। গরমে এরকম ভাজা ভাজা হয়ে যাওয়ার মত দশা। সুস্থ ভাবে, সসম্মানে বাঁচার অধিকার কি তাঁর নেই? গোটা রাগটা গিয়ে যেন সঞ্চারিত হল তাঁর পায়ে। প্রবল আক্রোশে তিনি একটা লাথি মারলেন কুলারটার বুকে। এতদিন ধরে নিরবিচ্ছিন্নভাবে সার্ভিস দিয়ে যাওয়া কুলারটা ঘড় ঘড় শব্দ করে ছটফট করতে করতে একসময় বন্ধ হয়ে গেল। 
     
    ভেবে দেখুন। পয়সা দিলো না কে? কোম্পানি। গাছ কেটে ফ্ল্যাট তুললো কে? প্রোমোটার। তাকে মদত দিল কে? রুলিং পার্টি। ওটিপি দিলেন তিনি নিজে, সেটা নিয়ে টাকা লুঠলো কে? ফ্রডস্টার। লাইনে দাঁড় করালো কে? ব্যাংক। লকডাউন করলো কে? সরকার। আবার টাকা লুঠলো কে? হাসপাতাল। টাকা পাঠায় না কে? ছেলে। বিয়ে করলো কে? বাবলুর শালা। অভদ্রতা করলো কে? এসি মেকানিক রাজু। অথচ যত দোষ সে কুলারের। এটা অন্যায় নয়?

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আদরবাসামূলক প্রতিক্রিয়া দিন