এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • অনর্গল সেই আগল খুলে আজ যা যা দেখছি (৩)

    উদয়ন ঘোষচৌধুরি লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ | ৯৩২ বার পঠিত
  • সম্পর্ক’ কি কেবল সমাজের বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ? প্রসন্ন গিরগিটিসুখ? এমনও তো সুর জাগে, যা গান হয়ে ওঠে না; এমনও তো সুরা হয়, যা দুই উলটো মেরুকে মুখোমুখি বসায়; বদলে দ্যায় চরিত্রের ঝর্ণারেখা, গনগনে রোদ্দুরের ঘাম মুছিয়ে তুলে আনে ছায়াসঙ্গীতে। পেশাদার খুনি ভালবেসে ফ্যালে চির-অদেখা এক নারীকে, সাহারা বলতে টেলিফোনে মায়াকথাজাল (হোয়াট আ ওয়ান্ডারফুল ওয়ার্ল্ড, ২০০৬, ফউজি বেনসাইদি)। জয়ী সামরিকের ছেলে নির্বান্ধব প্রান্তরে সময় কাটায় যুদ্ধবন্দী সমবয়েসির সঙ্গে; একদিন বন্ধুর সঙ্গে ঢুকে যায় বিষাক্ত গ্যাস-চেম্বারে (দ্য বয় ইন দ্য স্ট্রাইপড পায়জামাস, ২০০৮, মার্ক হার্মান)। পাবলো নেরুদার নির্বাসন-প্রবাসে প্রায়-অশিক্ষিত যে ডাক-পিওন বন্ধু হয়, আঁতলামি দূরস্থান, কবিতা-ফবিতার ছায়াও মাড়ায়নি কোনওদিন – মারা যাওয়ার আগে সে-ই লিখে যায় নেরুদাকে নিয়ে কবিতা (দ্য পোস্টম্যান, ১৯৯৪, মাইকেল র‍্যাডফোর্ড)। খিঁচমেজাজি ট্রাক-ড্রাইভার পাচার করতে যায় শহুরে বাচ্চা, ওই বাচ্চার কাছেই ফিরে পায় মায়াআকুতির ইশারা (দ্য গুড রোড, ২০১৩, জ্ঞান কড়িয়া)। আত্মহত্যার স্থিরসিদ্ধান্তে বাড়ি ছেড়ে বেরোনো দুর্বিনীত অন্ধ মানুষটা যখন জানতে পারে সঙ্গী ছেলেটার জীবন, মৃত্যু স্থগিত রাখে সে; অন্যের সমস্যা সমাধানে পেয়ে যায় আরও কিছুদিন বাঁচার উল্লাস (প্রোফিউমো দি দোনা, ১৯৭৪, দিনো রিসি; রিমেক : সেন্ট অফ আ উম্যান, ১৯৯২, মার্টিন ব্রেস্ট)। নিরক্ষরতার লজ্জা লুকিয়ে জেলে যায় প্রৌঢ়া, ৩০০ মানুষ পুড়িয়ে মারার মিথ্যে অভিযোগে; নিজেকে আড়ালে রেখে তাকে অক্ষর চেনায় অসমবয়েসি অতীত প্রেমিক; মহিলা স্বাক্ষর হয়, মুক্তির আগে আত্মহত্যায় ধরে রাখে দুজনের অবৈধ সম্মান (দ্য রিডার, ২০০৮, স্টিফেন ড্যালড্রি)। সাদামাটা বৃদ্ধা চায় মৃত্যুর আগে একটা কবিতা লিখতে, যা সে কোনওদিন পারেনি; তার বেলাগাম নাতি জড়িয়েছে ছাত্রীধর্ষণ ও খুনের ঘটনায়; অ্যালঝেইমারে আক্রান্ত বৃদ্ধা স্নানঘরে সঙ্গমে নামে প্যারালাইজড মালিকের সঙ্গে; অসমঞ্জস্য রমণে বুঝে নিতে চায় কোনওদিন-না-দ্যাখা ছাত্রীর যন্ত্রণানুভূতি – ওই মৃতা আত্মাই যেন তাকে দিয়ে লিখিয়ে নেয় অন্তিম কবিতা; আর পৃথিবীর ভিড়ে হারিয়ে যায় স্মৃতিভ্রষ্টা বৃদ্ধা (পোয়েট্রি, ২০১০, লি চ্যাং-দং)। অশান্ত শহরে তরুণ মজদুর ফেঁসে যায় মিথ্যে মামলায়; খুইয়ে ফ্যালে চাকরি, ঘর, প্রেমিকা; আরেকজন, যার স্বপ্ন রাজনৈতিক ঝামেলা মিটলে ফিরে যাবে গ্রামে – আশ্রয় দ্যায় তাকে; পুলিশের গুলিতে যখন মারা যায় সে, তরুণটি পাড়ি দ্যায় তার গ্রামে কফিন পৌঁছতে; দ্যাখে, ইরাক সীমান্তে চারিদিক খণ্ডহর; কোথায় ফেলে যাওয়া আত্মীয়গ্রাম? যুদ্ধ সেখানে মানুষ খেয়েছে, নদীখাত খেয়েছে কফিনের জমি; ‘‘কেউ নেই, কিছু নেই, সূর্য নিভে গেছে’’ (জার্নি টু দ্য সান, ১৯৯৯, ইয়েসিম উস্তাওগলু)।

    ‘সম্পর্ক’ কি শুধু জীবিতের সঙ্গে? মৃতের সঙ্গে নয়? অথবা, প্রায়-মৃত? না, প্রিয়মানুষের মৃত্যুর স্মৃতিচারণ নয় – সত্যিই যদি সম্পর্ক হয় একটি মৃতদেহের সঙ্গে, যার গালভারি নাম ‘নেক্রোফিলিয়া’ বা ‘থানাটোফিলিয়া’? মেয়েটি ডুবে যায় কোমায়, নার্সের কাজ নিয়ে প্রেমিক আসে তার কেবিনে; সেবাযত্নের ফাঁকে কথা বুনে যায় সে অঢেল, ঢেলে চলে প্রেম-স্বপ্ন-বিষাদ-উল্লাসের স্রোত, ওই অচেতন শরীরের সঙ্গে; একদিন জানা যায়, মেয়েটির গর্ভসঞ্চার হয়েছে; হাসপাতাল দায়ী করে প্রেমিককেই, যেহেতু অন্য কোনও পুরুষ আসেনি মেয়েটির কাছে; ছেলেটি চুপচাপ জেলে যায়, যায় মৃত্যুর পথে; মেয়েটি বেরিয়ে আসে বাঁচার আলোয় (টক টু হার, ২০০২, পেদ্রো আলমোদোভর)। হাকুচ নোংরা ডোম নিঃসংকোচে পোড়ায় বেওয়ারিশ লাশ; দ্যাখে এলোমেলো ঘুরে বেড়ানো এক কুহকী যুবতী, যার প্রশ্ন নেই কোনও, উচ্ছ্বাস নেই, মাদকতা নেই, কোনও কান্না নেই; এক বৃষ্টিরাতে পুড়তে আসে মেয়েটির শরীর; আর ডোম তার আঙুলে আঙুল জড়িয়ে শান্ত শুয়ে থাকে (মেহফুজ, শর্টস-এর চতুর্থ, ২০১৩, রোহিত পাণ্ডে)। ঠুনকো বাঁচা-মরা পেরিয়ে সম্পর্ক উঠে যায় অধ্যাত্মদর্শনের অনেক ওপরে।

    ‘সম্পর্ক’ শুধু কি মানুষের সঙ্গে? গাছের সঙ্গে নয়? একটা কাঁচপোকা, একটা পাহাড়ি ঝোরা, বা একটা সাইকেলের সঙ্গে? রাষ্ট্রশক্তি যখন খুন করতে চায় সম্বলহীন বিধবার লেবুবাগান – আদালত থেকে আদালতে ঘুরে ঘুরে মহিলা বোঝায়, আমার-আপনার মতো ওই গাছগুলোও প্রাণলোভী, ওদেরও আত্মা আছে, আছে ভালবাসা রাখার জায়গা; বন্দুকের সামনে বেঁটে হয় বাগান, বেঁটে হয় স্বামীত্বের অহমিকা; গড়ে ওঠে দুই বিপরীতমুখী নারীর নিরুচ্চার সম্পর্ক (লেমন ট্রি, ২০০৮, এরান রিকলিস)। প্রিয় পালিত-পশুর মৃত্যুশোকে মানুষটা নিজেকেই পশু ভেবে নেয়, ঘাড় গুঁজে খড় খেয়ে চলে (দ্য কাউ, ১৯৬৯, দারিউশ মেহরজুই)। বাস্কেটবলের ওপর নিজের রক্তে চোখমুখ এঁকে ‘বন্ধু’ তৈরি করে লোকটা, তার সঙ্গেই ঝগড়া-গপ্পো করে চার বছর কাটায় নির্জনদ্বীপে (কাস্ট অ্যাওয়ে, ২০০০, রবার্ট জেমেকিশ)। বেওয়ারিশ বেড়াল লড়াই করে শিশুর দুঃস্বপ্নে আসা দানোর সঙ্গে; দানো মারা যায়, বেড়াল পায় যত্নশীল ঘর (ক্যাট’স আই, ১৯৮৫, লিউস টিগ)। মা-মরা ভালুকশিশু ধরা পড়ে শিকারিদের ফাঁদে; মরণভয়ে শিকারিরা তাকে ফেলে পালায়, শিকারিদের পিছুপিছু দৌড়ে যায় সে, ডাকে, ফিরে আসতে বলে; সে জানে, ওই ব্যপ্ত পাহাড়-জঙ্গল রহস্যে সে বড় অসহায়; এক বয়স্ক ভালুক যখন তাকে বাঁচায় নিশ্চিত মৃত্যু থেকে, দুজনে দুজনের ক্ষতয় জিভ বুলিয়ে দ্যায়; যখন তীব্র তুষারপাতে দুজন দুজনকে জড়িয়ে শুয়ে থাকে – আমাদের দ্যাখনবাজ ‘মনুষ্যত্ব’ মুখ ঢাকতে চায় (দ্য বিয়ার, ১৯৮৮, জঁ জাক আনাউদ)। কুকুর একা অপেক্ষা করে রেলস্টেশনের বাইরে, মৃত মালিকের ফিরে আসার; কোথাও যায় না সে, পরিচিত কাউকে দেখে উৎসাহ পায় না; এভাবেই কাটিয়ে দ্যায় দশ বছর, নিজের মৃত্যু পর্যন্ত (হ্যাচিকো মোনোগাতারি, ১৯৮৭, সেইজিরো কোয়ামা; রিমেক : হ্যাচি – আ ডগ’স টেল, ২০০৯, লাসে হ্যালসট্রম)। হ্যাচিকো সত্যিই ছিল (১৯২৩-১৯৩৫), জাপানের শিবুয়া স্টেশনের বাইরে, যেখানে সে অপেক্ষা করত, সেখানে ওর ব্রোঞ্জ-মূর্তি আছে।

    (ক্রমশ)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ | ৯৩২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • b | ***:*** | ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৩:৫৫58054
  • এই সিরিজটা দারুণ হচ্ছে।
  • Tim | ***:*** | ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৬:৫৪58055
  • হ্যাঁ ভালো লাগছে
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে প্রতিক্রিয়া দিন