১৯৭৫-১৯৮০ সাল - কিছু ছোট ছোট স্মৃতি - মহীনের ঘোড়াগুলির গোড়ার দিকের কিছু কথা
আমি তখন পাশ্চাত্য সংগীতে ডুবে থাকা কিশোর। Delhi Symphony Orchestra - তে Dvorak এর New World Symphony তে বাজিয়ে কলকাতার ট্রেন না ধরে ভূপালে চলে গেলাম সোজা। গৌতম চট্টোপাধ্যায় (মণিদা)-এর ছোট ভাই বিশু আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ওর কাছে শুনেছিলাম মণিদার কথা যিনি তখন ভূপালে। সেখানে গিয়ে একসঙ্গে গানবাজনা করব, এরকমই মতলব ছিল আমাদের। মনে আছে ভূপাল স্টেশনে নেমে একরাত পান্থশালায় থাকতে হয়েছিল পথ হারিয়ে। ভোরে চলে গেলাম হামিদিয়া রোডে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর হঠাৎ দেখলাম ছাদ থেকে একজন মধ্যবয়স্ক যুবক ঘুম থেকে উঠে উস্কোখুস্কো চুল নিয়ে প্রাণখোলা হাসি নিয়ে তাকিয়ে চিৎকার করে বলছে, "এব্রাহাম এসে গেছিস!!" বুঝলাম আমার হাতে violin দেখে মণিদা আমায় চিনেছে। মুহুর্তের জন্যে আমি এক গভীর আন্তরিকতা অনুভব করলাম। মনে হল মণিদা আমায় যেন বহুবছর চেনে। রাস্তার ধরে বাড়ি, লাগোয়া বিশাল ছাদ যার থেকে বিশাল একটা মসজিদ দেখা যেত। উপরে উঠে ছাদের ভিতর দিয়ে সরু গলি পেরিয়ে মণিদার ঘরে ঢুকে দেখলাম এককোণে একটা mono record player. পাশে ছড়ানো ছিটানো অনেক রেকর্ড যার মধ্যে Beatles, Rolling Stone এর সঙ্গে স্থান পেয়েছে Beethoven এর বিখ্যাত violin concerto এবং Bach এর St. Matthew's Passion। আশ্চর্যভাবে সেই সময়েই আমি কলকাতার Max Mueller Bhavan ও British council-এ নিয়মিতভাবে পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সঙ্গীতের ওয়ার্কশপ এ অংশ নিচ্ছিলাম আর এইসব - virtuoso composer দের সঙ্গীত অধ্যয়ন করছিলাম বিভিন্ন German ও British অধ্যাপকদের ছত্রছায়ায়।
যাই হোক, আমাদের আলাপ পরিচিতির আগেই মণিদা অনুরোধ করল violin বাজাতে। আমি তখন Purcell এর Rondeau বাজালাম ও মণিদা একাগ্রচিত্তে শুনতে লাগলো। শেষ হতে দেখলাম মণিদার চোখে জল, পাশে পুটুদি (মিনতি) দাঁড়িয়ে, মুখে সরল স্নিগ্ধ হাসি, মণিদা বলে উঠল- “চল কলকাতায় ফেরা যাক। সবাইকে নিয়ে একটা নতুন ধারার বাংলা গানের গ্রুপ ফর্ম করব।” সেই প্রথম মহীনের ঘোড়াগুলির যাত্রা শুরু। আমরা কখনোই নিজেদের ব্যান্ড আখ্যা দিতে চাই নি। এটা ছিল একটা movement.
সেবার 31st December এ মণিদার group এর একটা অনুষ্ঠান চলছিল ভূপালে। হঠাৎ show চলাকালীন Bass Guitarist অত্যাধিক ‘Coca Cola’ খেয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গেল। মণিদা আমায় তখন বলল 'আবু' তুই Bass টা ধর। আমি বেশ ঘাবড়ে গেলাম কারণ এর আগে Double Bass বাজানোর আমার অভিজ্ঞতা থাকলেও bass গিটার আমি কখনো বাজাইনি। তবে এই দুই বাদ্যযন্ত্রের formation of strings এক হওয়ার জন্য আমার অসুবিধা হয়নি সামাল দিতে। এই হল মণিদার জাদু ! কখন যে কাকে দিয়ে কী explore করবে জানা নেই। সেই দৌলতে আমার কিছুটা শিক্ষালাভও হয়ে গেল।
মণিদা ফ্রেজারগঞ্জে বন্ধুদের সাথে পিকনিকে খেলতে গিয়ে পা ভেঙে প্লাস্টার করে মাস ছয়েক বাড়িতে শোয়া। আমরা সবাই মর্মাহত হলেও একটা বিষয়ে নিশ্চিন্ত ছিলাম যে যেকোনো সময় মণিদাকে পাব গল্প শোনার জন্য। তখন আমার ১৭ বছর বয়সে গল্পই মনে হত, আর যত ওঁর কথা শুনতাম সর্বদাই নতুন কিছু শেখার আগ্রহ বেড়ে যেত। মণিদাকে আমার মাঝে মাঝে মনে হত living Encyclopedia, এক অসামান্য গুরু, যার সংস্পর্শে আসা ভাগ্যের কথা। সেই সময় আমি প্রায়ই মণিদার সঙ্গে Beethoven এর বিখ্যাত Trio for violin, viola & cello শুনতাম। একদিন শোনার পর হঠাৎ মণিদা guitar নিয়ে একটা সুর ভাঁজতে লাগল আর আমি তা শুনে manuscript এ সুরটা scoring করতে লাগলাম। সৃষ্টি হল string orchestra র পরিবেশনায় সেই অবিস্মরণীয় মহীনের ঘোড়াগুলির গান 'ভালবাসি জোৎস্নায়' এর অসামান্য prelude, মণিদার magic voice, বুলাদার হাতের ছোঁয়ায় অনবদ্য bass guitar part, তার সাথে বিশুর drumming-এর perfect sense of tempo, যা অবশ্যই আন্তর্জাতিক মানের বলে আমি বিশ্বাস করি। ইতিমধ্য “সংবিগ্ন পাখিকুল ও কলকাতা” বিষয়ক নিয়ে আমাদের struggle চলছে। লোকজন বলতে শুরু করেছে আমরা নাকি উন্মাদের দল। এরই মধ্যে নতুন গানের ভাবনা চিন্তা চলছে এবং ফাঁকে ফাঁকে দীপকদার সাথে নাকতলার বাড়িতে আড্ডা আর practice। আমি আর বিশু মাঝে মাঝে Brahms এর Hungarian Dance no. 5 নিয়ে ঘষা মাজা করছি; বুলাদার সেতারের অপূর্ব তান ও ঝংকার ভেসে আসছে কানে; মণিদা বাপিদা ও ভানুদা-কে ভোকাল হারমনি গাওয়া শেখাচ্ছে রেকর্ডিং-এর তাগিদে; আর, রাজা গিটারে ফ্লামেঙ্কো শেখার আবদার করে চলেছে মণিদার কাছে। সেই সময় রঞ্জনদা ও মণিদার মধ্যে সাহিত্য ও সঙ্গীত নিয়ে নানরকম আলোচনা চলত। ‘মোষের বিষণ্ণ ডাক শুনে আনমনা’ হতে হতে সঙ্গীতাদি ও শর্মিষ্ঠাদির ভাবনায় হয়ত ঘুরে বেড়াত সমুদ্র এবং ঘোড়া এবং সেখান থেকেই হয়ত উঠে এসেছিল সামুদ্রিক ঘোড়ার রূপকল্পনা, রঞ্জনদার ষড়যন্ত্রে। সব মিলে সে এক অদ্ভুত অনাবিল আনন্দ। নাকতলার বাড়িটা ছিল এক উচ্চমানের সংস্কৃতির পীঠস্থান, যা আজ সবই স্মৃতি। এর মধ্যে মণিদা আমকে একদিন শোনাল Beatles-এর "Elanor Rigby"। অসাধারণ ডাবল স্ট্রিং কোয়ার্টেট দিয়ে সেই গানে তৈরী হয়েছে আবহ। আর তারপরেই শুরু হল chamber orchestra নিয়ে আমাদের গানের string arrangement আর নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা। সে এক সাংঘাতিক বিস্ময়কর ও nostalgic সময়, যার মধ্য দিয়ে আমরা গেছি। এখন ফিরে তাকিয়ে রোমাঞ্চিত হই। আমি, বিশু, বুলা দা, রঞ্জন দা, রাজা, বাপিদা, ভানু দা – আমরা, মহীনের টগবগে ঘোড়ারা, মণিদার অনুপ্রেরণায় ছুটতে ছুটতে আজও যেন ভেসে চলেছি কোনও এক ‘অজানা উড়ন্ত বস্তু’র সন্ধানে।
এব্রাহাম মজুমদার, প্রিন্সিপাল - কলকাতা মিউজিক অ্যাকাডেমি।
প্রতিষ্ঠাতা সদস্য - মহীনের ঘোড়াগুলি।