এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • প্রতিবাদে ঢাকি সর্বাঙ্গ (প্রথম অংশ)

    শর্মিষ্ঠা নাহা লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ০৫ মে ২০১৬ | ৭৫৪ বার পঠিত
  • প্রতিবাদে ঢাকি সর্বাঙ্গ
    - শর্মিষ্ঠা নাহা

    রাধামাধবের মন্দিরে বিগ্রহের পায়ে মাথা রেখে বসে আছেন রাধারাণী দেবী। মনটা বড় খারাপ। পরণের কাপড়ে, চাদরে এখনও সেই আহত মেয়েটির রক্ত লেগে আছে।ধর্মস্থানে এত বড় একটা অনাচার ঘটে গেল, কেউ এতটুকু টুঁ শব্দটি করল না।
    প্রায় সত্তর বছর হল এই চন্ডিকাপুরের বাসিন্দা তিনি। সেই ছোট্টবেলায় অভাবের তাড়নায় বাবা মা এই মন্দিরের চত্বরে ছেড়ে দিয়ে গিয়েছিল ভগবানের ভরসায়। চন্ডিকাপুর তখন গন্ডগ্রাম। মন্দিরের পুরোহিত বিজয় গোস্বামী একাকী পিতা এবং মাতার স্নেহে বড় করেছেন তাঁকে। দীক্ষা দিয়েছেন কৃষ্ণপ্রেমে। হাতে ধরে শিখিয়েছেন রাধামাধবের নিত্যসেবার কাজ। শিখিয়েছেন নামগান, কীর্তন,পদাবলী। গোঁসাইজী আজ আর নেই। কিন্তু তাঁর মানসকন্যা রাধারাণী দেববিগ্রহের সেবিকা হয়েই থেকে গেছেন।
    একদা গ্রামের জমিদার নরসিংহ দেব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এই মন্দির। তাঁর বংশধরেরা দীর্ঘকাল সুদূর প্রবাসী। বর্তমানে মন্দিরটি একটি ট্রাস্টিবোর্ডের সদস্যদের দ্বারা চালিত হয়। পদ আঁকড়ে থাকায় রাধারাণী বিশ্বাসী নন। কিন্তু অলিখিতভাবে তিনিই মন্দিরকেন্দ্রিক সমস্ত কর্মসূচীর মুখ্য ব্যক্তি।
    গত দশ বছরে চন্ডিকাপুরের অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। পাশ দিয়ে জাতীয় সড়ক চলে যাওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা হয়েছে উন্নত। কলকাতা থেকে খুব দূর না হওয়ায় রিয়েলটিওয়ালারা এসে একটা বিলাসবহুল আবাসন প্রকল্প তৈরি করে ফেলেছে। কলকাতা থেকে দলে দলে লোক এসে এখানকার বাসিন্দা হয়ে গেছে। আবাসনের ভেতরে বাচ্চাদের স্কুল, মাল্টিজিম, সুইমিংপুল সব আছে। কৃষিকাজ কিছু কমে গেলেও অনেক বিকল্প কর্মসংস্থান হয়েছে। সম্প্রতি মন্দিরের জমিতে ট্রাস্টিবোর্ডের সদস্যদের অনুমতিক্রমে গড়ে উঠেছে একটি হলিডে রিসর্ট। শহর থেকে আসা পর্যটকদের ভিড়ে সবসময় গমগম করে।
    মন্দিরের জমিতে ব্যবসা করতে দেওয়ার জন্য রিসর্টের মালিকও মন্দির কর্তৃপক্ষের উপর খুবই কৃতজ্ঞ। মাসে মাসে মোটা অঙ্কের অনুদান দেওয়া ছাড়াও মন্দিরের সংস্কার ও নাটমন্দিরের অাধুনিকীকরণ করে দিয়েছেন।
    সেই মন্দির প্রতিষ্ঠার দিন থেকে আজ পর্যন্ত সন্ধ্যারতির পর গ্রামবাসীরা নাটমন্দিরে জমায়েত হন। ধর্মীয় আলোচনা এবং নামগান হয়। গত পঞ্চান্ন বছর ধরে রাধারাণি এই নামগানের মুখ্য ভূমিকা স্বেচ্ছায় পালন করে চলেছেন। কেবকমাত্র কোনও কারণে তিনি অপারগ হলে তবেই অন্য কাউকে দায়িত্ব নিতে হয়।
    গত সন্ধ্যায় সন্ধ্যারতি দেখতে এসেছিল ওরা। হলিডে রিসর্টের তিন অতিথি। দুজন পুরুষ ও এক মহিলা। প্রণামির বাক্সে তিনজন তিনটে নীল নোট ও দিয়েছিল। তারপর বেশ ভক্তিভরেই ঠাকুরদালানে ধর্মগ্রন্থ পাঠ ও আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছিল। ছেলেদুটি পুরুষদের দিকে, মেয়েটি মহিলাদের দিকে।
    রিসর্টের কোনও অতিথি মন্দিরে এলে খুশিই হন মন্দির কর্তৃপক্ষ। তাঁরা ভাল প্রণামি দেন। যদিও তাঁরা বড় একটা আসেন না।
    ওরা তিনজনেই বেশ খোলামেলা পোশাক পরে এসেছিল। তবে পুরুষ দুজনেরটা তেমন চোখে লাগছিল না। ধুতি-চাদর পরা মানুষের সংখ্যা ক্রমশঃ কমছে। পাজামা পাঞ্জাবির মত পোশাক দু একসেট বিশেষ উৎসবের জন্য তোলা থাকে। লুঙ্গি- বারমুডা-হাফপ্যান্ট, ফতুয়া- গেঞ্জি- হাফশার্ট ই গ্রামের গরীব গুর্বো মানুষের পোশাক। মন্দিরপ্রাঙ্গনে পোশাকের কোনও নির্দিষ্ট বিধি যদিও নেই, তবু উরু থেকে পুরো দুটি পা, বগল থেকে পুরো হাত, পিঠ, নাভি বের করা পোশাকে ওই মেয়েটিকে দেখে রাধারাণির খুব অস্বস্তি হতে লাগল। তিনি লক্ষ্য করলেন, সমবেত জনতা ধর্মগ্রন্থপাঠ ছেড়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছে। ধর্মগ্রন্থপাঠ শেষ হলে মেয়েটির পাশে গিয়ে বসলেন রাধারাণি। খুব শান্ত, মার্জিত গলায় বললেন," মা, একটা কথা বলব, কিছু মনে করবেন না?
    - এত কিন্তু কিন্তু করছেন কেন দিদা? বলুন না কি বলবেন।
    মেয়েটির সহজ ভঙ্গীতে রাধারাণি আরও কেমন যেন ঘেঁটে যান। ভেবে পান না কোথা থেকে কথাটা শুরু করবেন। ওদিকে পুরোহিত মশাই তাঁকে নামগান শুরু করার জন্য তাড়া দিচ্ছেন।
    - ইয়ে মানে আপনারা কোলকাতা থেকে এসেছেন? এখানে ক দিন থাকবেন তো?
    - আমাকে আপনি বলবেন না, দিদা। আমরা উইক এন্ড, মানে শনি রবির ছুটি কাটাতে এখানে এসেছি।
    - ওঃ, আচ্ছা, তোমার সঙ্গে আর একটু শরীর ঢাকা
    কোনও পোশাক যদি থাকে, মানে বোঝোই তো, এটা একটা অজ পাড়াগাঁ, ওই যেটা পরে রাস্তা দিয়ে এসেছ ওটা হলেই হবে, মানে....
    রাধারাণি দেখলেন মেয়েটির চুলের ফাঁকে সিঁদুরের আভাস।
    মানে.... রিসর্টে গিয়ে কাপড় বদলে আসতে অনেক দেরি হয়ে যাবে, তো, তোমার স্বামীকে বলো এক ছুট্টে নিয়ে আসতে। পাশেই আমার ঘর। ওখানে গিয়ে পরে নিও নয়।
    - আমরা তো রাস্তা দিয়ে আসিই নি দিদা। কালো কাঁচ ঢাকা গাড়িতে নিজেরা গাড়ি চালিয়ে এসেছি। আর বড় কিছু তো....
    - যদি অসুবিধে না হয়, আমার একখানা কাপড় এর ওপর জড়িয়ে নিতে পারো। আমার এই মেয়ে তোমাকে আমার ঘরে নিয়ে যাবে। ও খুব সুন্দর শাড়ি পরাতে পারে। ইশারায় জনৈক মহিলা ভক্তকে ডেকে নেন তিনি। তারপর নামগানের জন্য প্রস্তুত হন।
    - ঠিক আছে, দিদা, তাই যাচ্ছি। কিন্তু,..... যেতে যেতে থমকে দাঁড়াল মেয়েটি।
    - ওরা আমার স্বামী নয়, বন্ধু। আমরা তিনজন এক অফিসে চাকরি করি। আমার স্বামী বাচ্চাদের নিয়ে দেরাদুনে সামার ক্যাম্পে গেছেন।
    আচ্ছা, কাকিমা, চলুন।
    - দাঁড়াও। পথ আটকে দাঁড়ালেন পুরোহিত দিগ্বিজয় উপাধ্যায়।
    বুড়িমা, তোমার ঘরে যেতে হলে তো গর্ভগৃহের ভেতর দিয়ে যেতে হবে। এই মহিলা একজনের স্ত্রী হয়ে দু দু জন পর পুরুষের সঙ্গে রাত্রিবাস করতে এসেছে, অঙ্গে কি উত্তেজক পোশাক, এর স্পর্শে রাধামাধব অশুচি হয়ে যাবেন যে।
    - এ সব কথা এখন থাক না, পন্ডিতজী। অতিথি যে নারায়ণ।
    আর রাধামাধব কোনও পরপুরুষে আসক্ত নারীর স্পর্শে অশুচি হয়ে যাবেন! রাধামাধব!
    - আরে, বুড়িমা,...... গোলমালের আভাস পেয়ে এসে জুটেছে ট্রাস্টি বোর্ডের নতুন সেক্রেটারি মোনোজ পান্ডে,
    ও সব বইয়ের কথা বইতেই রাখো। জানো তো, কিসনো করলে লীলা, আর আমরা করলে.....
    আজকালকার এ সব ছেলেগুলো রাধারাণিকে খুব একটা মেনে চলে না।
    - কি হয়েছে রে মীনা, ওরা তোকে কি বলছে? এতক্ষণে আসন ছেড়ে উঠে এসেছে মেয়েটির দুই সঙ্গী।
    - না,না, কিছু না, চল, আমরা বরং এখান থেকে চলে যাই।
    - না, আমরা যাবো না। আমরা অনুষ্ঠান শেষ পর্যন্ত শুনেই যাবো।
    তীব্র প্রতিবাদ জানালো দুই সঙ্গী।
    আর, এই যে মিস্টার, কৃষ্ণের ধামকে আপনারা তো লীলাখেলার জায়গাই বানিয়ে ফেলেছেন। রিসর্টে এসে থেকে দেখছি কত বোর্ডার চড়া মেকাপ করা মহিলাদের নামের পরে নিজেদের পদবী লাগিয়ে তাদের নিয়ে হোটেলের রুমে ঢুকে যাচ্ছে। তারা মন্দিরে এলে তোমাদের ঠাকুর অশুচি হয় না, আর আমরা সত্যি কথা বলেছি বলেই আমরা অশুচি!
    - চুপ করে থাক, মাগীবাজ কোথাকার। রাগে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে খারাপ কথা বলে বসে মনোজ।
    - হ্যাঁ রে, আমরা মাগীবাজ, তা ও ভালো। তোদের ঠাকুর তো মামিবাজ। নিজের মায়ের মত মামিকেও রেহাই দেয় না।
    - এক্ষুণি বন্ধ করো এ সব। শিউরে উঠে কান চেপে ধরেন রাধারাণি। ছিঃ কি অশ্লীল!
    - আহ সুকুু, কি হচ্ছে, চুপ কর না। মেেয়টি বলে। কর্ণপাত না করেই বলে চলে ছেলেটি।
    - কোনটা অশ্লীল সেটা বিচার করার ক্ষমতা আছে আপনাদের? আপনারা কি মনে করেন, এই চন্ডিকাপুর পুরী না বেনারস? যে মানুষ এখানে তীর্থ করতে আসবে! মন্দিরের জমিতে রিসর্ট হলে সেখানে কি হবে, সেটা পারমিশন দেওয়ার সময় আপনাদের কোনও ধারণা ছিল না, না? সে সব হলে মন্দির অশুচি হতে পারে সেটা তখন ভাবেন নি কেন?
    - এ সব কথা শোনাও পাপ।
    - হ্যাঁ ঠাকুমা, আমরা তো পাপ ই। বলে আরেকজন।কিন্তু আমাদের পাপের মূল্যেই তোমাদের ঠাকুরের এত জৌলুশ। সেটা ভুলে যাওয়ার ভান করলে চলবে?
    - বাবা, আপনারা শান্ত হোন। আমি কথাটা ঠিক এভাবে বলতে চাই নি। নিজের ভুল শোধরাবার বৃথা চেষ্টা করেন পন্ডিতজী।
    আসলে, মেয়েরাই তো সংসারের মান ইজ্জত। তাঁদের চরিত্রের শুচিতা রক্ষা করে চলাটা প্রয়োজন কি না, আপনারাই বলুন। আমি শুধু এটাই বলতে চেয়েছিলাম।
    বাঃ রে, বেশ তো। মেয়েরা বুঝি পুরোনো বইয়ের তাক, যে ঘরের কোণে পড়ে থেকে থেকেই ধুলো পড়ে নোংরা হয়ে যাবে? মেয়েদের নোংরা করে কারা? ওই যে ওইরকম মাল, যে কি না বাঁশি বাজিয়ে ঘর ঘর থেকে ফুঁসলিয়ে নিরীহ বৌগুলোকে বের করে এনে তাদের সঙ্গে ওই যে কি বলে লীলা করে। তারপর কাজ সেরে বৌগুলোকে এঁটো চায়ের ভাঁড়ের মতন ছুঁড়ে ফেলো দিয়ো রথে চড়ে অন্য জায়গায় গিয়ে সেখানকার রাজা সেজে বসে। নিজে ফ্রেশ দেখে রাজকন্যা বিয়ে করে। আর মেয়েদের ঘাটে গিয়ে মেয়েদের স্নান করা দেখে, তাদের কাপড় চুরি করে হ্যারাস করে এমন একজনকে যারা পুজো করে, তাদের মুখে আমাদের পোশাকের সমালোচনা! হা হা।
    - প্লীজ অনি কিপ কোয়ায়েট। এটা মন্দির। মেয়েটি বলার চেষ্টা করে।
    - বাবা, বাবা, আমি আর কোনও কথা বলতে চাই না। আমি যা বলেছি, তার জন্য তোমাদের কাছে হাত জোড় করে ক্ষমা চাইছি।
    - হ্যাঁ, অনেক হয়েছে। তোমরা এবার বোসো। আজ নামগান হয়ে যাক। আগামীকাল সাধারণ সভা ডাকব। ভক্তবৃন্দের ব্যবহারবিধি নিয়ে আলোচনা করে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে।
    - তুমি থামো বুড়িমা। দাবড়ে ওঠে ট্রাস্টিবোর্ডের এক সাধারণ সদস্য কালিপদ।
    তুমি সভা ডাকার কে? তুমি কি বোর্ড মেম্বার? তুমি গান টান করো, ঐ নিয়েই থাকো, বুঝলে? এ সব সিরিয়াস ব্যাপারে মাথা ঘামাতে এসো না।
    - আরে বাঃ, তোরা দেখছি তোদের ঠাকুরের ওপর দিয়ে যাস। তোদের ঠাকুর মায়ের মত মহিলাকে অসম্মান করে, তোরা ঠাকুমার মত বয়স্ক মানুষকেও বাইরের লোকের সামনে ছোটো করিস। যেমন তোদের ঠাকুর, তেমন তোরা।
    - তবে রে, যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা? মেরে তোর মুখ ফাটিয়ে দেবো।
    নামগানের জন্য ডেস্কের উপর রাখা হারমোনিয়ামের পাশে পিতলের ভারি ফুলদানিটা রাখা ছিল। রাগ সামলাতে না পেরে সেটাই তুলে মেয়েটির এক সঙ্গীকে লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারল কালিপদ। সেই মুহূর্তে সঙ্গীকে বাঁচাতে সামনে এগিয়ে আসা মেয়েটির কপালে সবেগে গিয়ে লাগল ফুলদানি। কেটে গিয়ে রক্ত পড়তে শুরু করল।
    'হা গোবিন্দ ' বলে দুহাতে বুক চেপে বসে পড়লেন দিগ্বিজয়। কয়েকজন তাঁকে ধরাধরি করে সরিয়ে নিয়ে গেল।উপস্থিত ভক্তবৃন্দ ভয় পেয়ে যে যার বাড়ির দিকে পালাতে লাগল।
    অত রক্ত দেখে মাথাটা কেমন ঘুরে গেল রাধারাণির।পেডেস্টালের সামনাসামনি এসে পড়ায় গা থেকে চাদরটা উড়ে গেল। বিস্রস্ত হয়ে গেল ব্লাউজহীন শাড়ির আঁচল।
    পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির এক সঙ্গী ভাগ্যিস তাঁকে ধরে বসিয়ে দিয়েছিল, নয়তো সটান পড়েই যেতেন তিনি। পাশেই বসে থাকা আহত মেয়েটি নিজের কপাল ছেড়ে ওই রক্তমাখা হাতেই তাঁর বুকের আঁচল ও চাদর ঠিক করে দিল।
    কতক্ষণ যে এভাবে বসেছিলেন খেয়াল নেই রাধারাণির। হুঁশ ফিরল গাড়ির শব্দে। রিসর্টের বিলপত্র মিটিয়ে ছুটি না কাটিয়েই ফিরে গেল ওরা তিনজন।
    রাধারাণির সারারাত কাটল ঠাকুরের পায়ে মাথা রেখে কেঁদে। প্রতি মুহূর্তে নিজের মৃত্যুকামনা করলেন তিনি। ঠাকুর অবশ্য তাঁর কথা শুনলেন না।
    ভোরবেলা পুকুর থেকে স্নান সেরে ফিরছেন, দুটি মেয়ে তাঁর পথ রোধ করল।
    - আচ্ছা, আপনিই বুড়িমা?
    - হ্যাঁ। কেন বল তো মা?
    - আমি প্রত্যয়ী, এ আমার বন্ধু জয়স্মিতা। আমরা স্বপ্নলোকে থাকি। আপনাদের ব্যাপারটা ফেসবুকে দেখলাম।
    - ফেসবুক কি মা?
    - আপনি বুঝবেন কি না, জানি না। গতকাল মন্দিরে যে মেয়েটা ভিক্টিমাইজ হয়েছিল, সে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছে।মানে লিখেছে। দেখবেন?
    - কোথায় ফেসবুক?
    - এই তো আমার ফোনে।
    - ফোনে তো কথা বলা হয়। লেখাও যায়?
    - দেখবেন?
    - ইংরাজি আমি পড়তে পারি ন।
    - না না, বাংলায়। এই দেখুন।
    মীনাক্ষি হালদার। সব কথা স্পষ্টভাবে লিখেছে। ওই ঘটনার পর স্থানীয় থানায় গেলে ডায়েরি তো নেওয়া হয় নি ই, মেয়েটির চরিত্র নিয়েও অশ্লীল ইঙ্গিত করেছেন কর্তব্যরত পুলিশ অফিসার। এটাও জানিয়েছে। রাধারাণি বুঝলেন সকলের হাতে হাতে ফোনে ফোনে অনেক দূর ছড়িয়ে পড়েছে খবর।
    - বুড়িমা, সত্যি বলুন তো, গতকাল আপনার নাতিরা যা করেছে সেটা আপনি অন্যায় বলে মনে করেন?
    - অন্যায় তো বটেই। তবে ওই ছেলেগুলোর ভাষাও ভালো না।
    - ওরা যেমনই হোক, ওরা কিন্তু প্রথমে মন্দিরে ঠিকভাবেই ছিল। পরিস্থিতি ওদের বাধ্য করেছে। বলুন বুড়িমা, আপনি কি মন থেকে ওই অন্যায়ের প্রতিবাদ চান না?
    - চাই, মা।সর্ব অন্তঃকরণে চাই। কিন্তু আমার কথা কেউ শুনলে তো। বুড়ো হয়ে বাতিলের খাতায় চলে গেছি যে।
    - একার প্রতিবাদ কারুর কানে যায় না, বুড়িমা। চাই সম্মিলিত প্রতিবাদ। ফেসবুকে একটা ইভেন্ট ক্রিয়েট হয়েছে। আমরা এতে জয়েন করেছি। আমরা চাই আপনি আমাদের পাশে থাকুন।
    - ইভেন্ট মানে প্রতিবাদের কর্মসূচি?
    - ঠিক বলেছেন। মীনাক্ষি হালদার, অনিন্দ্য সেনগুপ্ত আর সুকুমার রায়চৌধুরী এটা ক্রিয়েট করেছেন। ওই ছেলেমেয়েগুলো। এই দেখুন।
    - একি! এ যে ঠাকুরদালানে অনি আমাকে ধরে বসে আছে। আর মীনা আমার কাপড় ঠিক করছে ওর রক্তমাখা হাত দিয়ে। এ ছবি কে তুলল? সুকু? কি দিয়ে তুলল?
    - ফোন দিয়ে।
    - ফোনে ছবি তোলাও যায়! আর ছবির নীচে বড় বড় করে কি লেখা? ইভেন্টের নাম?
    - হ্যাঁ, বুড়িমা।
    রাধারাণি বানান করে পড়লেন, ' প্রতিবাদে ঢাকি সর্বাঙ্গ
    - এ কথার মানে কি, মা?
    - দেখুন, সবাই বলছে কালকের ওই অশান্তির জন্য একমাত্র দায়ী ওদের খোলামেলা পোশাক।বিশেষ করে মীনাক্ষির। উপযুক্ত পোশাক যখন সঙ্গে ছিলই না, তখন ওদের মন্দিরে আসার কি দরকার ছিল?
    - আমার খারাপ লাগছে, জানো, প্রসঙ্গটা আমিই তুলেছিলাম।
    - আপনি না তুললে অন্য কেউ তুলত। আপনি মার্জিত ভাষায় বলেছিলেন, অন্য কেউ অন্য ভাষা কিংবা আচরণে বুঝিয়ে দিত।
    - দোষটা তো আমাদের ই মা। এতদিনেও আমরা ভক্তবৃন্দের জন্য নির্দিষ্ট পোশাকবিধি চালু করতে পারি নি। বাইরের চারপাশ এত বদলে যাওয়া সত্ত্বেও।
    - সেটা বড় কিছু নয়। ওরা তিনজন প্রাপ্তবয়স্ক। বাইরের জগৎ সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান আছে। ওরাই বা ওরকম পোশাকে মন্দিরে আসবে কেন?
    - আর দেখো মা, মেয়েরা খোলামেলা পোশাক পরলে সেটা পুরুষের কামনাকে তো উসকে দেয়ই।
    - দেখুন বুড়িমা, নারীর প্রতি পুরুষের আকর্ষণ চিরন্তন বিষয়। এ তো ভগবানের সৃষ্টি। যাতে পুরুষ নারীর সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হতে উৎ সাহ বোধ করে। এর মাধ্যমে বংশধারা এগিয়ে চলে। জন্তুদের মধ্যে এমনই দস্তুর। কিন্তু মানুষের সমাজ নানারকম অনুশাসনে সকলকে বেঁধে রেখেছে সকলের মঙ্গলের জন্য। কামনা জাগ্রত হলেই যে কোনও পুরুষ যে কোনও নারীতে উপগত হতে পারে না। তা বললে কি হয়। কামনা তো কামনার মতই জাগে। যে কোনও পোশাক পরা নারীকে দেখলেই জাগতে পারে। আর পোশাকের শালীনতার সংজ্ঞা দেশভেদে, কালভেদে ভিন্ন। কেবলমাত্র পোশাকের দৈর্ঘ্য প্রস্থের ওপর কিছুই নির্ভর করে না।
    - তো, তোমরা কি করতে চাও?
    - এই কথাটাই আমরা সবাইকে বুঝিয়ে দিতে চাই। মীনাক্ষি, সুকুমার, অনিন্দ্য আজ আবার মন্দিরে আসবে। ওই রকম পোশাকেই। সঙ্গে প্রায় চল্লিশজন ছেলেমেয়ে।আমরাও থাকব। সংক্ষিপ্ত পোশাকে সান্ধ্য অনুষ্ঠানে শান্তিপূর্ণভাবে যোগ দিয়ে আমরা বুঝিয়ে দেবো যে এই পোশাকের সঙ্গে ভক্তিপূর্ণ আরাধনার কোনও বিরোধ নেই। প্রতিবাদই হবে আমাদের সর্বাঙ্গ আচ্ছাদনকারী পোশাক।
    - বুঝলাম। কিন্তু এ কথা আমাকে বলছ কেন?
    - আমরা চাই আপনার আশীর্বাদ আমাদের সঙ্গে থাকুক। যারা দুদিন ক্ষমতা হাতে পেয়ে আস্ফালন করে, তাদের দর্পচূর্ণ হোক।
    - তাই যেন হয়, মা। আমিও রাধামাধবের কাছে সেই প্রার্থনাই করি। তা, কখন আসবে তোমরা?
    -বিকেলের রোদ পড়লেই চলে আসব।
    - এসো। তোমাদের কল্যাণ হোক।
    হৃষ্টচিত্তে মন্দিরে ফেরেন রাধারাণি। রাধামাধবের জাগরণের প্রস্তুতি শুরু করেন।
    পুরোহিত দিগ্বিজয় উপাধ্যায় কলকাতার হাসপাতালে। গত সন্ধ্যার উত্তেজনার কারণে আশঙ্কাজনক অবস্থা। তাঁর ভ্রাতা মৃত্যুঞ্জয় তাঁর স্থলাভিষিক্ত হবেন।
    - বুড়িমা, ও বুড়িমা
    হাঁকডাক শুনে বাইরে আসেন রাধারাণি। কয়েকজন বোর্ড মেম্বার তাদের ষন্ডাগুন্ডা কজন স্যাঙাৎ নিয়ে হাজির।
    - কি ব্যাপার বুড়িমা? তুমি না কি আমাদের বিরুদ্ধে পৃথিবীশুদ্ধু লোককে খেপিয়ে তুলছো?
    - কে বলল?
    - এই তো ওই শয়তানগুলোর সঙ্গে তোমার ছবি।
    - ওঃ ফেসবুকের ওই ইভেন্টের কথা তোমরাও জেনেছ? ওখানে যা লেখা আছে মিথ্যে সেগুলো? মন্দিরের মধ্যে অতিথি ভক্তের রক্তপাত ঘটাও নি তোমরা? তাদের কটু কথায় আঘাত করো নি?
    - হ্যাঁ, সব দোষ আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে এখন তো নিজে ভালো সাজবেই। তুমি আর পন্ডিতজীই তো শুরু করেছিলে।
    - আমি তো তেমন কিছু বলিই নি। আর পন্ডিতজী নিজের কৃতকর্মেরর জন্য অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চেয়েছিলেন।
    - আর অতিথি বলে ওদের সাতখুন মাপ, তাই না?কত নোংরা নোংরা কথা বলে গেল। শুধু আমাদের না, রাধামাধবকেও।
    - ওদের সমাজের লোকেরাই সেই নিয়ে ওদের নিন্দেমন্দ করেছে। ফেসবুকে লিখে।
    ঠাকুরের অপমান করা খুব খারাপ। কিন্তু অতিথির রক্তপাত ঘটানো, সে ও তো ভয়ানক ঘটনা। যাক গে, কাল উত্তেজনার মাথায় করে ফেলেছ, যদি মনে করে থাকো ভুল করেছো, আমাকে বলো, আমি গিয়ে ওদের বলছি। ওরা ফেসবুকে ইভেন্টটা বাতিল করার জন্য লিখবে।
    - কোন দুঃখে তোমাকে বলতে যাবো? তুমি কে হরিদাস পাল! আমরা বোর্ড মেম্বার, বুঝলে? তোমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে আমাদের ঠিক দু মিনিট লাগবে। আমাদের না কি ওই শহুরে জানোয়ারগুলোর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে! যাও, ওদের গিয়ে বলে এসো, ওরা যদি ভুলেও এ মুখো হয়, ওদের লাশ এই চাতালের মার্বেলের নীচে পুঁতে রাখা হবে। হুঃ, ক্ষমা চাইবে!
    বিশাল আস্ফালন করে হুঙ্কার ছেড়ে ফিরে যায় গুন্ডাবাহিনী।
    ভাঙা মন নিয়ে নতুন পন্ডিতজীকে পুজোর কাজে সাহায্য করতে থাকলেন রাধারাণি।নানান আশঙ্কার ছায়া তাঁর চিন্তাকে আচ্ছন্ন করে তুলতে লাগল।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ০৫ মে ২০১৬ | ৭৫৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে প্রতিক্রিয়া দিন