সিপিএমের তরুণ নেত্রী দীপ্সিতা ধর, আনন্দবাজার অনলাইনের একটি অনুষ্ঠানে সাক্ষাৎকার দেন গত পরশু। তার মধ্যে একটি জায়গায় উনি বলেন "বাঙালি জাতিয়তাবাদ, যেটা ২০১৯ পর্যন্ত ভীষণ রকম প্রমিনেন্ট ছিলনা, সেটা ভীষণ রকম মেনস্ট্রিম হয়ে গেল এবং মনে হল যে যেভাবেই হোক, বাংলাকে বাঁচাতে হবে, বাঙালি জাতিয়তাবাদকে বাঁচাতে হবে, এবং তার মুখ মমতা। এবং আমরা যদি মমতা ব্যানার্জির নির্বাচনী প্রচারও দেখি, বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়, সেই সেন্টিমেন্টটাকেই উনি হার্প অন করলেন, এবং সেইটার এফেক্ট যে এইরকম হতে পারে, সেটাতে হয়তো আমাদের বিশ্লেষণে একটু খানি ত্রুটি রয়ে গিয়েছিল। আমরা হয়তো এই সেন্টিমেন্টটাকে আরেকটুখানি যদি প্রায়োরিটি দিতাম, তাহলে হয়তো অন্যরকম ভাবে ভাবা যেত।" (সাক্ষাৎকারটি যাঁরা দেখবেন, তাঁরা ৭ মিনিট ৪০ সেকেন্ড থেকে দেখলে এই অংশটি শুনতে পাবেন)
দীপ্সিতা আরও অনেক কিছু বলেছেন। কিন্তু কেন তাঁরা বাঙালি জাতিয়তাবাদকে গত কিছু নির্বাচনে ছোঁনইনি, তা নিয়ে কিছু বলেননি। অথচ, সেই কথাটিই এখানে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। হঠাৎ করে একটি নির্বাচনী অবস্থানে তো কারো অগ্রাধিকার বদলে যায়না, সেটি একটি প্রক্রিয়ার ফসল। এই প্রক্রিয়াটি, অন্তত বাংলার ক্ষেত্রে, দীর্ঘদিন ধরে আঞ্চলিকতা, বা বাঙালি জাতিসত্ত্বাকে অস্বীকার করে এসেছে। অথচ এরকম হবার কথা ছিলনা। কারণ আমরা জানি, অতীত সিপিআইএর যে বামঘেঁষা অংশটি বা জন্মলগ্ন থেকে সিপিআইএম, তারা প্রাথমিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পক্ষেই জোরালো সওয়াল করে এসেছে। দীপ্সিতা জানেন কিনা জানিনা, বহু বছর আগে, ১৯৫৬ সালে বঙ্গ-বিহার সংযুক্তির একটি প্রস্তাব আনেন বিধানচন্দ্র রায়। তার বিরুদ্ধে তীব্র গণআন্দোলন গড়ে ওঠে। স্বাধীন ভারতে বাঙালির সেই প্রথম জাতিসত্ত্বার আন্দোলন (শিলচরের ১৯শে মে এর পাঁচ বছর পরে)। সেই আন্দোলনের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল তৎকালীন সিপিআই, এবং একটি উপনির্বাচনকে বস্তুত সংযুক্তিকরণের পক্ষে-বিপক্ষের গণভোটে পরিণত করা হয়। সেই উপনির্বাচনটি কংগ্রেস হারে, এবং বিধানচন্দ্র রায় পিছু হটতে বাধ্য হন। তো, জাতিসত্ত্বার পক্ষে থাকা, এবং প্রয়োজনে তাকে অগ্রাধিকার দেওয়া, এটি নতুন কিছু না। অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির আমল থেকেই পার্টির লাইনে এবং অভ্যাসে ছিল।
শুধু জাতিসত্ত্বা নয়, রাজ্যের হাতে অধিক ক্ষমতা, এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পক্ষে সওয়াল, এ যে বামপন্থীদের লব্জ ছিল, সে কথা আলাদা করে বলার দরকার নেই। ৬৭ এবং ৬৯ সালে দুটি যুক্তফ্রন্ট সরকার তৈরি হয় পশ্চিমবঙ্গে। সিপিআইএম সরকারের অংশ ছিল, বৃহত্তম দল হিসেবে। সরকার ভেঙে দেওয়া হয়, এবং রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা হয়। কেন, তার বিশদে এখানে ঢোকার দরকার নেই, কিন্তু রাজ্যের ব্যাপারে কেন্দ্রের এই হস্তক্ষেপের তীব্র বিরোধিতা করে সিপিএম। রাজ্যপাল পদটির রাজনৈতিক ব্যবহারের বিরুদ্ধে কথা বলে। এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পক্ষে, রাজ্যের অধিকারের পক্ষে কথা বলে।
এর ফলও ফলে ৭৭ সালে। উত্তর ভারতে জনতা পার্টি প্রবল বিক্রমে জিতলেও, পশ্চিমবঙ্গে জেতে বামপন্থীরা। এবং জেতার পর, যে স্লোগানগুলি অন্তত প্রথম পনেরো বছর তারা দিয়ে গেছে, তা হল, কেন্দ্রের বঞ্চনার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া, মাশুল সমীকরণ সহ অন্যান্য বৈষম্যমূলক নীতি রদ করার দাবী এবং অবশ্যই রাজ্যের হাতে অধিক ক্ষমতার দাবী। সবকটাই যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর সঙ্গে যুক্ত। বস্তুত দাবী তোলার ক্ষেত্রে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অতিরিক্তও হত সন্দেহ নেই। সে নিয়ে ঠাট্টা ইয়ার্কিও হত। কিন্তু মোটের উপর লোকে ব্যাপারটা বিশ্বাস করত। সেই সময়ের অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্র একবার ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণায় লিখেছিলেন, যে, দিল্লির যোজনা কমিশনের সহসচিবকে তিনি বলেছিলেন, কলকাতা থেকে দিল্লি এলে তাঁর মনে হয়, গ্রাম থেকে শহরে এলেন। অস্যার্থঃ পশ্চিমবঙ্গ থেকে সম্পদ চুষে নিয়েই দিল্লি এবং পশ্চিমাঞ্চলের রমরমা। অশোক মিত্রের বর্ণনা অনুযায়ী সে বছর যোজনা কমিশনের অবশেষে পশ্চিমবঙ্গকে তার যথাযথ ভাগ দিতে সুপারিশ করে। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী সেই সুপারিশ খারিজ করেন। এ কোনো রাজনৈতিক স্লোগান বা লাইন নয়, কিন্তু মূল ন্যারেটিভটি ছিল এইরকমই। যা লোকে বিশ্বাস করত।
অবস্থা বদলাল ১৯৯৩ সালে এসে। যখন নরসিংহ রাওয়ের নয়া উদারনৈতিক জমানার শুরু। কেন্দ্রীয় সরকার মাশুল সমীকরণ নীতি বাতিল করে দিল সে বছর। কোথাও লিপিবদ্ধ নেই, কিন্তু একটা বোঝাপড়া সিপিএমের মধ্যে তৈরি হল, যে, যাক বাবা বঞ্চনার শেষ হল। এখন মুক্ত অর্থনীতি। সবাই সমানে-সমানে লড়বে। তখন চিনও নতুন মডেল নিয়ে এসে গেছে বাজারে। গোটা দুনিয়ায় সমাজতান্ত্রিক শিবির ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়লেও তিয়েন-আন-মেন স্কোয়্যারের গ্লানি কাটিয়ে চিন তার প্রাচীরের মতই অচঞ্চল। তারা নিয়ে এসেছে নতুন এক ধারণা, যার নাম সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি। এর অস্যার্থ হল, বাজার অন্তত কিছু সময়ের জন্য ভবিতব্য। কিন্তু যেহেতু মুক্ত বাজার, তার মধ্যেও সমানে-সমানে লড়ে জেতা যায়। এটি বিশ্বজনীন ধারণা। ভারতবর্ষের মধ্যেও তার টুকরো দেখা গেল। এবার বঞ্চনার জমানা শেষ, অতএব ভারতের রাজ্যগুলির মধ্যেও এবার বাজার অর্থনীতিকে আঁকড়ে সমানে-সমানে লড়া সম্ভব, এই ধারণাটি তৈরি হল।
এ কোথাও লিপিবদ্ধ নয়, কিন্তু ১৯৯৩ সালের পর থেকে কেন্দ্রীয় বঞ্চনার স্লোগান সেভাবে আর শোনা যায়নি। তার জায়গায় এল রাষ্ট্রীয় নিওলিবারেলিজমের বিরোধিতা। ডাঙ্কেল প্রস্তাব, পরে যা ডাব্লুটিও হবে, তার বিরোধিতা। আঞ্চলিক অস্তিত্বের স্বর আর শোনা যায়নি। অথচ রাজ্যে রাজ্যে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কি সত্যিই ছিল? পঞ্চাশ বছর ধরে যদি সম্পদ এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে সম্পদ সরানো হয়, তারপর জমি কি আর সমান থাকে? তদুপরি, তখনও, এবং এখনও, রাজ্যের কর এবং শুল্ক বাবদ আয়ের নব্বই শতাংশ নিয়ে যায় কেন্দ্রীয় সরকার। যেকোনো শিল্পের জন্য দরকার ছাড়পত্র। যেকোনো আইন পাশ করাতে গেলে চাই কেন্দ্রীয় সরকারের সম্মতি। ফলত যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো তখনও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। খাতায় কলমে সিপিএমের ভিতরেও তার গুরুত্ব কিছু কমেনি। কিন্তু কার্যত সেসব স্লোগান থেকে উবে গেল। আঞ্চলিকতার জায়গায় এল অখন্ড ভারতের ধারণা। আর এই অখন্ড ভারতের ভিতরে ভিতরে মুক্ত অর্থনীতির কল্যাণে রাজ্য সরকারের আপেক্ষিক স্বরাজ এসে গেছে এরকম একটি চিন্তাভাবনার প্রক্রিয়া শুরু হল।
২০০০ সালে বদলে গেল কর্মসূচি। রাজ্য সরকার সম্পর্কিত ধারণা, সিপিএমের ১৯৬৪র কর্মসূচিতে এরকম ছিল, যে, রাজ্য সরকাররা হল অন্তর্বর্তীকালীন কিছু সরকার, যাদের কাজ হল ঝপাঝপ কিছু রিলিফ দেওয়া। ব্যস। এই কর্মসূচি মান্ধাতার আমলের হয়ে গিয়েছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ২০০০ সালের প্লেনামে বদলে সেটি হল এরকম, যে, রাজ্য সরকাররা কিছু সরকার, যারা কিছু বর্তমান কাঠামোর মধ্যেই বিকল্প নীতি রূপায়ন করতে পারে। আগের ধারণাটি সত্যিই বদলানোর দরকার ছিল। তেইশ বছর রাজ্য শাসন করব, তারপর দাবী করব এই সরকার অন্তর্বর্তীকালীন, তা তো হয়না। কিন্তু তার সঙ্গে লক্ষ্যণীয় যেটা, সেটা হল, রাজ্য সরকারের যে একটি আপেক্ষিক স্বরাজ এসে গেছে, সেই ধারণায় এই বদলও স্ট্যাম্প দিল।
২০০৫ সালে পশ্চিমবঙ্গ থেকে রাজ্যসভায় নির্বাচিত হলেন সীতারাম ইয়েচুরি এবং বৃন্দা কারাত। তাতে সমস্যাটি কী, তা এখন আর কেউই হয়তো পড়ে বুঝতেও পারবেননা। ২০০৫ এও অর্ধেক লোক পারতেননা। কিন্তু ১৯৭৭ এ এই কান্ড ঘটালে তুলকালাম হয়ে যেত। কারণ বিষয়টি সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর সঙ্গে যুক্ত। রাজ্যসভায় রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব হয়, দলের না। রাজ্যগুলি তৈরি হয় ভাষার ভিত্তিতে। রাজ্যসভায় যেতে গেলে রাজ্যের স্থায়ী বাসিন্দা হবার কথা, অর্থাৎ ভাষাগতভাবেও রাজ্যের অন্তর্গত হবার কথা। না হলে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ব্যাপারটিই আর থাকেনা। ইতিপূর্বে কংগ্রেস একাধিকবার এই বিষয়টি লঙ্ঘন করেছে। মনমোহন সিংহকে তারা জিতিয়ে এনেছিল আসাম থেকে। সিপিএম আপত্তি করেছিল। ২০০৫ সালে দেখা গেল, তারা নিজের নীতি থেকে সরে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো আর সত্যিই তেমন গুরুত্বপূর্ণ নেই। এখন অখন্ড ভারতীয়ত্বের সময়।
তো, সমকালীন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সরকার, এই দুইটি ধারণারই প্রতিনিধিত্ব করে গেছে। ১। আঞ্চলিক নয়, সর্বভারতীয়। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো আর তেমন গুরুত্বপূর্ণ না। ২। রাজ্যের একটি আপেক্ষিক স্বরাজ এসে গেছে। যেন চিন বা সিঙ্গাপুরে পরিণত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। যার হাত ধরে "কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ" -- এই স্লোগান। বা, টাটাদের আবাহন।
এই দ্বিতীয় পয়েন্টটি নিয়ে কথা বলছিনা এখানে। ওটির জন্য ২০১১ তে সিপিএমের সরকার গেছে। কথা হচ্ছে প্রথমটি নিয়ে। ১৯৯৩ থেকে আলগোছে, আর ২০০৫ সাল থেকে সরাসরি আঞ্চলিকতা এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর গুরুত্বকে অস্বীকার করা হয়েছে। দিল্লিকে কেন্দ্র হিসেবে ভাবা হয়েছে। এটি একটি প্রক্রিয়া। সিপিএম যখন "হিন্দিভাষী এবং যারা হিন্দি বোঝে" তাদের নিয়ে কর্মশালা করে, তখন এই প্রক্রিয়ারই প্রতিনিধিত্ব করে। যখন সারা ভারতে একই হিন্দি স্লোগান দেবার চেষ্টা করা হয়, যখন জেএনইউ তে রাজনৈতিক মাধ্যম হিসেবে হিন্দি এবং ইংরিজিকে স্বীকার করে নেওয়া হয়, তখন, সেটিও এই একই প্রক্রিয়া। যখন ভূমিপুত্র বা কন্যা সংরক্ষণ নিয়ে একটিও কথা বলা হয়না, হিন্দি সিনেমা-টিভি-রেডিওর আগ্রাসনের কথাটি এড়িয়ে যাওয়া হয়, তাও সেই একই ব্যাপার। এখনও ভারতে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই। কোনোভাবেই নেই। তারপরেও সুগত মারজিত যখন রাজ্য সরকারের কেন টাকা ছাপানোর অধিকার থাকবেনা, এই প্রশ্ন তোলেন, তখন আলোচনার পরিসরে দেখা যায় অভ্রংলিহ নীরবতা। কারণ ওটি সিলেবাসের বাইরে। ও নিয়ে আলোচনাই অর্থহীন। এই মনোভঙ্গীও একটি প্রক্রিয়ারই ফসল। প্রক্রিয়াটি না বদলে, উপর-উপর বাঙালিত্বকে অগ্রাধিকার দেওয়া যায়না। প্রক্রিয়াটি বদলালে, উপলব্ধি বদলালে, তা অগ্রাধিকার এমনিই বদলাবে। মানুষ টেরও পারে। আলাদা করে "এইটাকে একটু অগ্রাধিকার দিলে ভালো হত" জাতীয় আফশোষও থাকবেনা।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।