এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  রাজনীতি

  • গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার জন্য অবাধ মতপ্রকাশের পরিসর অপরিহার্য

    ডঃ দেবর্ষি ভট্টাচার্য
    আলোচনা | রাজনীতি | ২৫ আগস্ট ২০২৪ | ৬৯৮ বার পঠিত | রেটিং ৫ (৩ জন)
  • ছবি: রমিত


    ১৪ বছর আগের একটি আলোচনা সভার মুমূর্ষু বক্তব্য ঠিক কোন কারণে আজ হঠাৎ আজ পুনরুজ্জীবিত করে তোলা হল! ২০১০ সালের ২১শে অক্টোবর। নয়াদিল্লির কোপার্নিকাস মার্গের এলটিজি অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত ‘আজাদি - দ্য ওনলি ওয়ে’ শীর্ষক একটি আলোচনা সভায়, ভারত থেকে কাশ্মীরকে বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যে প্ররোচনামূলক বক্তৃতা দেওয়ার অভিযোগ। অভিযুক্ত বক্তা বুকার পুরস্কার প্রাপ্ত ‘ওয়াকিং উইথ দ্য কমরেডস্‌’-এর লেখিকা অরুন্ধতী রায় এবং সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অফ কাশ্মীরের আন্তর্জাতিক আইনের প্রাক্তন অধ্যাপক ড. শেখ শওকত হুসেন। সেই আলোচনা সভায় উস্কানিমূলক বক্তব্য রাখার অভিযোগে যাঁদের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির (আইপিসি) ১৫৩-ক (ধর্ম, বর্ণ, জন্মস্থান, বাসস্থান, ভাষা ইত্যাদির ভিত্তিতে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে শত্রুতা বৃদ্ধি ও সম্প্রীতি বজায় রাখার ক্ষেত্রে ক্ষতিকর ক্রিয়াকলাপ), ১৫৩-খ (জাতীয় সংহতির প্রশ্নে ক্ষতিকর ও নিন্দনীয় কার্যকলাপ) ও ৫০৫ (প্রকাশ্যে প্ররোচনামূলক বিবৃতি)ধারায় ইতিমধ্যেই মামলা দায়ের করা ছিল। কিন্তু রাষ্ট্রের কাছে বোধহয় আইপিসি-র এতগুলো গুরুতর ধারা যথেষ্ট বলে মনে হয়নি! অভিযুক্তদের এখনও গারদে পুরে ফেলা যায়নি বলেই হয়তো! তাই রাষ্ট্রশক্তি তাঁর তূণে লালিত সবচেয়ে মারণ অস্ত্রটি এবার প্রয়োগ করে বসলো। ১৪ বছরের পুরনো সেই মামলায় অতি সম্প্রতি দিল্লির লেফটেন্যান্ট গভর্নর ভি কে সাক্সেনা, অরুন্ধতী রায় এবং অধ্যাপক হুসেনের বিরুদ্ধে ‘বেআইনি কার্যকলাপ (প্রতিরোধ) আইনের’ (ইউএপিএ) ধারায় বিচার প্রক্রিয়া চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। এবং খুব তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, ঘটনাটা এক যুগেরও বেশি সময়কাল আগের হলেও, ইউএপিএ-র নাগালের আওতার মধ্যে এনে ফেলা হল কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদী নেতৃত্বাধীন তৃতীয় এনডিএ সরকার শপথ নেওয়ার অব্যবহিত পরে পরেই!

    অভিযোগটা যদি দেশের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বকে আঘাত করার উদ্দেশ্যে কোন ষড়যন্ত্রের পরিপ্রেক্ষিতে হয়; কিংবা দেশের বিরুদ্ধে দেশবাসীকে খেপিয়ে তোলার প্রসঙ্গে হয়, নিঃসন্দেহে তা গুরুতর এবং তদন্ত ও প্রমাণ সাপেক্ষে কঠোরভাবে দণ্ডনীয়ও বটে। সুতরাং, দেশের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার স্বার্থে রাষ্ট্র যদি কোন বিষয়কে বিচার প্রক্রিয়ার আওতায় নিয়ে আসে, তা রাষ্ট্রের মৌলিক কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। কিন্তু অনিবার্যভাবে প্রশ্ন উঠবেই, যদি দেখা যায় যে, দেশের অখণ্ডতা রক্ষার খোলসের আড়ালে রাষ্ট্র যদি দেশের নাগরিক সমাজের বাক্‌ স্বাধীনতা ও অবাধ মতপ্রকাশের অধিকারকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে খর্ব করতে উদ্যত হয়। প্রশ্ন উঠবেই, যদি দেখা যায় যে, ধরিত্রীর বুকে প্রায় বিলীন হয়ে যাওয়া বিষয়বস্তু মাটি খুঁড়ে তুলে এনে নতুন ভূষণে সাজিয়ে, বিরুদ্ধ মতাবলম্বী মানুষজনকে শায়েস্তা করার উদ্দেশ্যে কালা আইনের অহেতুক প্রয়োগে রাষ্ট্র যদি বারংবার অত্যুতসাহি হয়ে উঠছে।

    এ কথা ধ্রুব সত্য যে, ১৯৪৭ সালের ২৬শে অক্টোবর ভারত সরকার এবং তৎকালীন জম্মু-কাশ্মীর সরকারের মধ্যে সম্পাদিত ‘অন্তর্ভুক্তি সংক্রান্ত দলিল’ (Instrument of Accession) অনুযায়ী, স্বাধীন স্বশাসিত রাজ্য হিসেবে জম্মু-কাশ্মীরের ভারতে অন্তর্ভুক্তি হয়েছিল। স্বাধীন ভারত রাষ্ট্রে জম্মু-কাশ্মীরের অন্তর্ভুক্তির পদ্ধতিগত বিষয় নিয়ে বিস্তর মতভেদ থাকলেও এ কথা কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে, ভূতপূর্ব জম্মু-কাশ্মীর রাজ্য স্বাধীন ভারতের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গরাজ্য হিসেবেই পরিগণিত ও স্বীকৃত। যদিও কাশ্মীরের সুপ্রাচীন ইতিহাস কিন্তু অন্য রকম ছিল। প্রাচীনকাল থেকেই সিংহভাগ সময়কাল ধরে কাশ্মীরের স্থানীয় শাসকেরা স্বাধীনভাবে স্বতন্ত্র কাশ্মীর শাসন করতেন। তবে অবশ্য মাঝেমধ্যেই ভারতবর্ষের প্রবল পরাক্রমশালী শাসকেরা সাময়িকভাবে কাশ্মীর দখল করে নিয়েছিলেন। কিন্তু অল্প কিছুকালের মধ্যে সেই দখলদারি দুর্বল হয়ে পড়তেই কাশ্মীরের স্থানীয় শাসকেরা আবার কাশ্মীরের শাসন পুনরুদ্ধার করে নিতেন। ষোড়শ শতাব্দীর প্রায় শেষ অবধি কাশ্মীরের শাসন ব্যবস্থার ইতিহাসটা মোটামুটিভাবে এমনটিই ছিল। ১৫৮৬ খ্রিস্টাব্দে কাশ্মীরের শাসন ব্যবস্থায় বৈশিষ্ট্যপূর্ণ পরিবর্তন আসে। এই সময়ে মোগল সম্রাট আকবর দ্বারা কাশ্মীর দখলীকৃত হওয়ার দরুন কাশ্মীরে মোগল রাজের সূচনা হয় এবং স্থায়ী বিদেশী শাসনের সূত্রপাত ঘটে। তাই ইতিহাসের পাতার সাথে ঘনিষ্ঠ কাশ্মীরীরা মনে করেন যে, ১৫৮৬ সাল থেকেই কাশ্মীরীদের পরাধীনতার ইতিহাসের সূচনা। তারপরে একে একে কখনো পাঠান, কখনো শিখ, কখনো ডোগরা রাজাদের হাত ধরে কাশ্মীরে বিদেশী রাজের শাসন কায়েম হয়।

    ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে রণজিৎ সিংহের নেতৃত্বে পাঞ্জাবে শিখ রাজ কায়েম হয়। ১৮১৯ সালে রণজিৎ সিংহ কাশ্মীরের পাঠান শাসকদের পরাভূত করে কাশ্মীরকে পাঞ্জাব রাজ্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেন। পরবর্তীকালে প্রথম ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধে ইংরেজদের কাছে শিখ রাজা পরাজিত হয়ে ১৮৪৬ সালে লাহোর চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন। এই চুক্তির অন্যতম শর্ত হিসেবে ইংরেজরা যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ দেড় কোটি টাকা শিখ রাজার কাছে দাবী করে, যা শিখ রাজার পক্ষে দেওয়া কার্যত অসম্ভব ছিল। এমত অবস্থায় শিখ রাজা ইংরেজদের আশীর্বাদধন্য জম্মুর ডোগরা রাজা গুলাব সিংহের কাছে অর্থের বিনিময়ে কাশ্মীর রাজ্য বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। ১৮৪৬ সালেই ডোগরা রাজা গুলাব সিংহ এবং ব্রিটিশদের মধ্যে ‘অমৃতসর চুক্তি’ সম্পাদিত হয়। এই অমৃতসর চুক্তির বলে কাশ্মীরে চিরকালের জন্যে ডোগরা রাজা গুলাব সিংহ ও তাঁর উত্তরসূরিদের কাছে বংশানুক্রমিকভাবে কাশ্মীর শাসনের ভার ন্যস্ত করা হয় এবং ডোগরা রাজাকে ব্রিটিশরা করদ রাজ্যের শাসকের স্বীকৃতি দেয়। এরপর থেকে ব্রিটিশ শাসনকালের অন্তিম মুহূর্ত অবধি জম্মু-কাশ্মীর ডোগরা রাজার শাসনাধীন স্বাধীন করদ রাজ্য হিসেবে বিরাজমান ছিল। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ও ভারত বিভাজনের সময়কালে, জম্মু-কাশ্মীর ডোগরা রাজা হরি সিংহের শাসনাধীন স্বাধীন স্বতন্ত্র রাজ্য হিসেবেই থেকে যায়।

    সংক্ষেপে কাশ্মীরের ইতিহাসটা মোটামুটি এমন বলেই বিভিন্ন ইতিহাস বইয়ে লিপিবদ্ধ আছে। ফলে, কাশ্মীর নিয়ে সুস্থ ও তথ্যনির্ভর বিতর্ক সভা বা আলোচনা সভা দেশের গণতন্ত্রকে পুষ্ট করার উদ্দেশ্যে এবং সংবিধান প্রদত্ত অবাধ মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারকে বিকশিত করার লক্ষ্যে নিঃসন্দেহে কাঙ্ক্ষিত। সুতরাং, কাশ্মীরের ভারতভুক্তির বিষয়টি নিয়ে কেউ যদি ভিন্নমত পোষণ করেন এবং ঐতিহাসিক তথ্য ও প্রমাণ সহকারে সেই মতের সমর্থনে কোন বক্তব্য পেশ করেন, তা ‘বেআইনি কার্যকলাপ (প্রতিরোধ) আইন’ প্রয়োগের মতো কোন গুরুতর অপরাধ বলে দেগে দেওয়া কোন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কি আদৌ কাম্য? হতে পারে, সেই ব্যক্তি কাশ্মীরের ভারতভুক্তির বিষয়টি নিয়ে যে মত পোষণ করেন বা ব্যক্ত করেছেন, তা রাষ্ট্রীয় মতামতের থেকে ভিন্ন। কিংবা, সেই মত একান্তভাবেই বক্তার নিজস্ব মত, যা কিনা দেশের অধিকাংশ মানুষই অনুমোদন করেন না। তাহলেও কি কোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র সেই মতের প্রবক্তার বিরুদ্ধে কালা আইন প্রয়োগ করে ব্যক্তি মতপ্রকাশকে স্তব্ধ করতে আগ্রাসী হতে পারে? অবশ্য, যদি সেই মতপ্রকাশের মাধ্যমে জনমানসে হিংসা ছড়ানোর ঘটনা ঘটে থাকে, তাহলে রাষ্ট্র আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে বৈকি।

    কারণ, একদিকে যেমন ভারতীয় সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৯(১) দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য অবাধ মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সমেত মোট ছয়টি মৌলিক অধিকারের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করেছে; তেমনি অন্যদিকে, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৯(২) থেকে ১৯(৬) সেই স্বাধীনতার পরিধিকে কিয়দংশে নিয়ন্ত্রণও করেছে। বিশেষত, ভারতের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতা, আদালত অবমাননা, মানহানি, অপরাধের প্ররোচনা ইত্যাদির স্বার্থে এইসকল অধিকারগুলোর স্বাধীনতার উপর যুক্তিসঙ্গত কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা আছে। এখন প্রশ্ন হল, ১৪ বছর আগের সেই আলোচনা সভার বক্তব্যসমূহ কি আদৌ সংবিধানের ১৯(২) থেকে ১৯(৬) অনুচ্ছেদে উল্লিখিত কোন শর্তকে কি উল্লঙ্ঘন করে ফেলেছে? যদি তা হয়ে থাকে, তবে বিগত ১৪ বছরে এক মুহূর্তের জন্যেও জনমানসে তার কোন প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়নি কেন? গর্হিত অপরাধ মনে করেও রাষ্ট্র এতকাল ধরে সেই ঘটনার বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারেনি কেন? তথাপি রাষ্ট্র যদি অবাধ মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে আইনের নাগপাশে বেঁধে ফেলতে চায়, তবে কি তা দেশের সংবিধান প্রদত্ত নাগরিক বাক্‌ স্বাধীনতার অধিকারকেই কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে এনে দাঁড় করাবে না? তাহলে কি রাষ্ট্র সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৯(১) প্রদত্ত বাক্‌ স্বাধীনতা ও অবাধ মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নাগরিক অধিকারকে অন্য পন্থা অবলম্বন করে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে? এইসকল মৌলিক প্রশ্নগুলোর অকপট উত্তর একমাত্র দিতে পারে সংবিধান রক্ষাকারী দেশের মহামান্য উচ্চ ও শীর্ষ ন্যায়ালয়।

    সাম্প্রতিক অতীতে এমনই একটি বিতর্কিত মতপ্রকাশের পরিপ্রেক্ষিতে সংবিধান প্রদত্ত বাক্‌ স্বাধীনতা ও অবাধ মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারকেই প্রাধান্য দিয়ে ভারতীয় দণ্ডবিধি মোতাবেক রাষ্ট্রশক্তির দায়ের করা এফআইআর দেশের মহামান্য শীর্ষ আদালত খারিজ করে দিয়েছে। গত বছরের অগাস্ট মাসে, জম্মু-কাশ্মীর থেকে অনুচ্ছেদ ৩৭০ বিলোপের বিশেষ দিন ৫ই অগাস্ট-কে “কালা দিবস” হিসেবে উল্লেখ করে এবং পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস ১৪ই অগাস্ট-কে স্বাগত জানিয়ে স্ট্যাটাস লিখে মহারাষ্ট্রে কর্মরত এক কাশ্মীরি অধ্যাপক, জাভেদ আহমেদ হাজাম, একটি হোয়াটস্‌ অ্যাপ গ্রুপ তৈরি করেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৫৩-ক ধারায় অভিযোগ এনে কোলাপুর জেলা পুলিশ অধ্যাপক হাজামের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করে। সেই এফআইআর খারিজ করার আর্জি নিয়ে অধ্যাপক হাজাম প্রথমে মুম্বাই উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হন। কিন্তু মুম্বাই উচ্চ আদালত অধ্যাপক হাজামকে পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসকে স্বাগত জানানোর অভিযোগ থেকে মুক্তি দিলেও, অনুচ্ছেদ ৩৭০ বিলোপের বিশেষ দিনটিকে “কালা দিবস” অভিহিত করার অভিযোগটি ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৫৩-ক ধারার আওতায় পড়ে বলেই রায় দেয়। মুম্বাই উচ্চ আদালতের সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে অধ্যাপক হাজাম দেশের মহামান্য শীর্ষ আদালতে মামলা দায়ের করেন। চলতি বছরের ৭ই মার্চ, শীর্ষ আদালতের দুই মাননীয় বিচারপতি, অভয় এস ওকা ও উজ্জ্বল ভুইয়ান, দ্বারা গঠিত ডিভিশন বেঞ্চ অধ্যাপক হাজামের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৫৩-ক ধারায় দায়ের করা এফআইআরকে কেবলমাত্র খারিজ করেই দেয়নি, সেইসঙ্গে অনেকগুলো তাৎপর্যপূর্ণ মৌলিক বিষয়কে স্পষ্ট করে দিয়েছে। প্রথমত, বিচারপতিদ্বয় তাঁদের রায়ে উল্লেখ করেন যে, “প্রত্যেক ব্যক্তি ও রাষ্ট্রকে অন্যের ভিন্নমতের অধিকারকে সম্মান করতে হবে”। দ্বিতীয়ত, ডিভিশন বেঞ্চের সুস্পষ্ট অভিমত, “রাষ্ট্রের ক্রিয়াকলাপের প্রতিটি সমালোচনা বা প্রতিবাদকে যদি ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৫৩-ক ধারা মোতাবেক অপরাধ হিসাবে ধরা হয়, তবে গণতন্ত্র, যা কিনা ভারতীয় সংবিধানের একটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য, টিকে থাকতে পারে না”। সেইসঙ্গে ডিভিশন বেঞ্চের সুস্পষ্ট মন্তব্য ছিল, “এখন সময় এসেছে সংবিধানের ১৯(১)(ক) অনুচ্ছেদ দ্বারা নিশ্চিত করা বাক্‌ স্বাধীনতা ও স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকারের ধারণার ওপর যুক্তিসঙ্গত সংযমের বিস্তার সম্পর্কে আমাদের পুলিশযন্ত্রকে আলোকিত ও শিক্ষিত করার; সেইসঙ্গে অবশ্যই আমাদের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সম্পর্কে তাঁদের সংবেদনশীল করে তোলা”। সর্বোপরি, এই পরিপ্রেক্ষিতে ডিভিশন বেঞ্চের সুস্পষ্ট রায় হল, “সংবিধানের ১৯(১) অনুচ্ছেদের বলে প্রত্যেক নাগরিকের অনুচ্ছেদ ৩৭০ বাতিলের পদক্ষেপের সমালোচনা করা সমেত রাষ্ট্রের প্রতিটি সিদ্ধান্তের সমালোচনা করার অধিকার রয়েছে এবং দেশের প্রত্যেকটি নাগরিকের অধিকার আছে অন্য দেশের নাগরিকদের নিজ নিজ স্বাধীনতা দিবসে শুভেচ্ছা জানানোর”।

    নিশ্চিতভাবে শীর্ষ আদালতের এই যুগান্তকারী রায় দানের ক্ষেত্রে ভারতীয় সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৯(১) প্রদত্ত বাক্‌ স্বাধীনতা ও অবাধ মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নাগরিক অধিকারের বিষয়টি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পেয়েছে। সুতরাং, দেশের সংবিধান রক্ষাকারী স্বয়ং শীর্ষ আদালত যেখানে নাগরিকদের বাক্‌ স্বাধীনতা ও স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকারকে দেশের গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারের সাথে প্রাধান্য দিয়ে আসছে, সেখানে অবাধ মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সঙ্কুচিত করার রাষ্ট্রশক্তির উদ্দেশ্যমূলক অভিসন্ধি কি আদৌ মান্যতা পাওয়ার যোগ্য? নাকি, রাষ্ট্রের এমন অসহনশীল মনোবৃত্তির প্রকাশ আদতে দেশের সংবিধানকে অগ্রাহ্য করার ধৃষ্টতারই সমতুল্য? আপামর জনসাধারণকে সংবিধান প্রদত্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখার লক্ষ্যে অভিসন্ধিমূলক কোন উদ্ধত প্রয়াস নয় তো?


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ২৫ আগস্ট ২০২৪ | ৬৯৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • NRO | 165.124.***.*** | ২৫ আগস্ট ২০২৪ ২২:৫৭536843
  • আম্বেদকর (committee) ভারতীয় সংবিধানে American-style First Amendment Fundamental Freedoms enshrine করেন নি, সেটাই আমাদের অবাধ মতপ্রকাশের fundamental difficulty । যতদূর শুনেছি, আমাদের সংবিধান মোটামুটি English unwritten & American written Constitution এর একটা amalgamation যার বেশিটাই English আর যাতে যেহেতু আম্বেদকর US এ পড়াশোনা করেছিলেন এবং American Constitution সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন তাই তার খানিকটা incorporate করেছিলেন। I am not sure but US First Amendment এর পাঁচটার মধ্যে দুটো, Freedom of Religion আর Petition বোধহয় incorporated but Freedom of speech, Press, Assembly probably not.

    আর একটা problem হচ্ছে ভারতীয় ​​​​​​​মননে 'Concept of Rule of law not Rule of man and Constitution is the Fountain of all Law and Power' - এটা কোনোদিনই ঠিক ​​​​​​​ভাবে establish করে ​​​​​​​নি।
  • Ranjan Roy | ২৬ আগস্ট ২০২৪ ০১:০৪536851
  • সহমত।
    আমরা  হরদম আদালত এবং পুলিশের ভুমিকা গুলিয়ে ফেলি। ভুলে যাই-- পুলিশের কাজ শাস্তি দেয়া নয়, অপরাধ হবার আগে আটকানো এবং ঘটিত হলে অপরাধীকে খুঁজে ধরে আদালতের সামনে পেশ করা।
    শাস্তি আদালতের এক্তিয়ার। 
     
  • মোহাম্মদ কাজী মামুন | ৩০ আগস্ট ২০২৪ ২০:৪৫537018
  • "সুতরাং, কাশ্মীরের ভারতভুক্তির বিষয়টি নিয়ে কেউ যদি ভিন্নমত পোষণ করেন এবং ঐতিহাসিক তথ্য ও প্রমাণ সহকারে সেই মতের সমর্থনে কোন বক্তব্য পেশ করেন, তা ‘বেআইনি কার্যকলাপ (প্রতিরোধ) আইন’ প্রয়োগের মতো কোন গুরুতর অপরাধ বলে দেগে দেওয়া কোন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কি আদৌ কাম্য?""
    এই নিবন্ধে এমন আরো প্রশ্ন রয়েছে,যা আইন বিচার ও গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মানুষ যুগে যুগে দেশে দেশে করে এসেছেন। কিন্তু বুদ্ধি মুক্ত না হওয়ায় পৃথিবীর জাতি রাষ্ট্রগুলি এক একটি প্রিজন হিসেবেই রয়ে গেছে। 
     
    "শীর্ষ আদালতের দুই মাননীয় বিচারপতি, অভয় এস ওকা ও উজ্জ্বল ভুইয়ান"
    আমার কুর্নিশ এই দুই বিচারপতিকে। তারা শুধু কেইসটির জন্যই নয়,বা তাদের দেশের জন্যই নয় পুরো পৃথিবীর স্বাধীনতাকামী মানুষের জন্য একটি রেফারেন্স হাজির করেছেন। সস্তির নিঃশ্বাস এনে দিয়েছেন। 
     
    "‘অন্তর্ভুক্তি সংক্রান্ত দলিল’ (Instrument of Accession) অনুযায়ী" 
    আচ্ছা এই দলিল কি সর্বত্র সমানভাবে অনুসৃত হয়েছিল? 
     
     
     
     
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লড়াকু মতামত দিন