পরিবেশ বিপর্যয় আজ রাষ্ট্রীয় সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্ব চরাচরে পরিব্যাপ্ত। পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বেড়ে ১.৪৪ ডিগ্রির ঘরে, কোন প্রান্তে তীব্র দাবদাহ- খরা-তাপপ্রবাহ; অন্যত্র প্রবল বৃষ্টি-বন্যা-ধস, এমনকি দুটো বিপরীত এক্সট্রিম আবহাওয়া প্রায় একই সময়ে একই স্থানে আছড়ে পড়ছে। হিমবাহের অতিদ্রুত গলন, জল বাতাস নদীর দূষণ জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে প্রবলভাবে। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে সংবিধান-গণতন্ত্র-পরিবেশের সংকট সব জড়াজড়ি করে জট পাকিয়ে তুলেছে। প্রবল মূল্যবৃদ্ধি, বেকারি, আর্থিক বৈষম্য সহ পরিবেশ সংকটের মূল কারণ দেশি-বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানির নির্বিচারে জল জঙ্গল জমি পাহাড় নদী: প্রকৃতির সব উত্তরাধিকার লুটেপুটে ধ্বংস করা। পরিবেশ বিঘ্নকারীর সংখ্যা হাতে গোনা হলেও এর প্রভাব পড়ছে নিম্নবিত্ত মানুষ, প্রান্তিক কৃষক, কৃষি শ্রমিক তথা মেহনতি মানুষ ও বনবাসী জনজাতিদের জীবনে। অথচ সমাজের একটা বড় অংশ এখনো কেমন যেন নীরব নিশ্চুপ নিষ্ক্রিয়।
এই নিবন্ধের ছোট পরিসরে অতি সংক্ষেপে একটি প্রাথমিক আলোচনা করার চেষ্টা করব ভারতীয় সাহিত্য-সংস্কৃতি ও মননে পরিবেশ ভাবনার গুরুত্বের ওপর। প্রাণ প্রকৃতি পরিবেশ নিয়ে একটি সুসংহত ও বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা প্রাচীন ভারতের দর্শনে উপস্থিত ছিল না ঠিকই। কিন্তু অজস্র মনিমুক্তো ছড়িয়ে আছে ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গির অন্তরালে। সিন্ধু সেঁচে এই মনিমুক্তো তুলে এনে আজকের স্থানকালের প্রেক্ষিতে সমাজে প্রথিত করতে পারলে মানব জমিনে নিশ্চিত করেই একটি চারা গাছ রোপণ করা যাবে, যা ডালপালা মেলে শতধারায় বিকশিত হবে।
প্রাচীন ভারতের অথর্ব-সংহিতার পৃথিবীসুক্তে ৬৩টি মন্ত্রকবিতা জুড়ে বরফ ঢাকা পাহাড়, ধূলি-পাথর সমাকীর্ণ বিস্তৃত মাঠঘাট, বনজঙ্গল, নদী-সাগর, ছয় ঋতুর সুন্দর সমাহার, নানান কীটপতঙ্গ, পাখপাখালি, ছোট বড় বন্যপ্রাণ: সবকিছু নিয়েই একটা গোটা পৃথিবী ও তার সভ্যতার পরিচয় সুপ্ত আছে। অথর্ববেদের কবির অনুভবে ঔষধি বনস্পতির লালনভূমি বিশ্বম্ভরা বসুধা। নানান জনগোষ্ঠীর বিকাশক্ষেত্রও বটে এই ধরণী। মাটির পৃথিবীর সঙ্গে জীবজগতের এই অন্তরঙ্গতার কথা উঠে এসেছে মহাভারতের কবি ভীষ্মের মুখেও।
ভাববাদী দৃষ্টিতে জারিত প্রকৃতি সত্তার অন্তরালে ঋগবেদের সরস্বতী নদী ‘পাবণী জলধারার মূর্তিমতী সুচেতনা’র দেবী হয়ে উঠেছিল। ভূলোক, ব্রহ্মাণ্ড, কিংবা গাছ পাহাড় পাথর হয়ে উঠেছিল দেবতার প্রতীক। তাকে অবলম্বন করে ছান্দোগ্য উপনিষদে সম্পদ-উপাসনার রীতি গড়ে ওঠে। আজও আমরা দেখি আদিবাসী মানুষজন পাহাড় গাছ পাথর নদীকে দেবতাজ্ঞানে (বিমূর্ত ঈশ্বর ভাবনা নয় কিন্তু) পূজা করেন। মনে রাখা দরকার, জঙ্গল পাহাড় গাছ রক্ষার জন্য আদিবাসীদের প্রকৃতিপূজা ও বন জঙ্গলের যৌথ মালিকানার সংস্কৃতি পাহাড় জঙ্গলকে ভয়ংকর ধ্বংসের হাত থেকে একটা মাত্রায় হলেও টিকিয়ে রেখেছে।
লতাগুল্ম, ঔষধি-বনস্পতি, জল বাতাসকে সম্বোধন করে তার সাহায্য চাওয়ার কথা এবং গাছগাছড়ার স্বাস্থ্যকর উপকরণের সপ্রশংস উল্লেখ অথর্ববেদে মাঝে মাঝেই উঠে এসেছে। এর মধ্যে আধ্যাত্মদৃষ্টির ভূমিকা স্পষ্ট হলেও বাস্তব উপযোগিতা নির্ধারণের হিসেবি মনোভাবের অসীম মূল্যও কিছু অবজ্ঞা করার নয়।
এবার আসি প্রাচীন ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি কালিদাসের কথায়। ‘বিক্রমোর্বশীয়’ নাটকে শোকার্ত পুরূরবা হারিয়ে যাওয়া প্রেয়সীর খোঁজে লতাপাতাকে জড়িয়ে ধরেন পরমাত্মীয়ের মতো। মেঘদূতের নির্বাসিত বিরহী যক্ষ মেঘকেই ভাই সম্বোধন করে প্রেমিকাকে দুটো কথা পৌঁছে দেওয়ার জন্য কাকুতি মিনতি করেছিলেন আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে। আর শকুন্তলা নাটকটি কবি রচনা করেছেন প্রকৃতির কথা মাথায় রেখে প্রকৃতির রূপ রস গন্ধের সাথে জৈব-অজৈব প্রাণ ও মানুষের যাপনকে জড়িয়ে নিয়ে। তাই বনবালা শকুন্তলার কাছে বনজ্যোৎস্না লতাটি আদরের ভগিনী হয়ে ওঠে। তার ফুল ফোটার দিনটিকে যৌবন সমাগমের দিন হিসেবে স্মরণীয় করে রাখার জন্য একটি আম্রবৃক্ষের সাথে বিয়ে দেন প্রিয়ংবদা-অনসূয়া সমেত শকুন্তলা। মনমরা হরিণশাবক তাঁদের পালিত সন্তান রূপেই বিবেচিত হয়। শকুন্তলা নিজে সাজসজ্জা পছন্দ করলেও কখনো গাছের জ্যান্ত ফুল ছিঁড়ে খোঁপায় দিতেন না, বরং গাছে ফুল ফুটলে উৎসবের তরঙ্গ বয়ে যেত শকুন্তলার মননে। গাছের গোড়ায় জল না দিয়ে কোনদিন জলপান করতেন না তিনি। অথচ আজ সারা দেশজুড়ে গাছ কাটার ধূম পড়ে গেছে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে। কোন কোন ব্যক্তি/সংস্থার উদ্যোগে কিছু গাছ পোঁতা হলেও তাদের যত্নআত্তির কথা যেন কারোর মাথাতেই আসেনা।
পতিগৃহে যাওয়ার দিনে বনের কাঁটাঝোপ, লতাগুল্ম শকুন্তলার কাপড় টেনে ধরে যেন বলে উঠতে চায়, যেও না সখি-আমাদের ছেড়ে যেও না। হরিণীর আর্ত চাহনি শকুন্তলার চোখ ভিজিয়ে দেয়। নিজের মতো সন্তানসম্ভবা হরিণীর নির্বিঘ্ন প্রসবের খবর না পাওয়া পর্যন্ত শকুন্তলার যেন স্বস্তি নেই। কোকিলের কুহূতান না শোনা পর্যন্ত শকুন্তলার পা সরে না। তাঁর কেবলই মনে হয়, অরণ্যদেবী বুঝি যাবার অনুমতি দেননি এখনো। কালিদাসের ভুবনমোহিনী প্রতিভা প্রকৃতির সন্তান শকুন্তলাকে প্রকৃতির সাথে অবিচ্ছেদ্য প্রীতির বাঁধনে বেঁধেছে। উপমা-রূপকের পথ ধরে কুমারসম্ভবেও ফিরে ফিরে আসে প্রকৃতির কথা, প্রাণের কথা, সহজ সরল যাপনের কথা। উপমার ছবি হয়ে ওঠে পুষ্পভর্তি লতার চলাফেরার জীবন্ত চিত্র-বর্ণন। প্রকৃতিকে নিজের অংশ হিসেবে ভাবতে পারতেন বলেই জনৈক বনবাসী রাজা দুষ্যন্তকে হরিণ মারতে নিষেধ করতে পারেন।
আরও কিছু অমূল্য সাহিত্য সৃষ্টির দিকে আলোকপাত করা যাক। খেলাচ্ছলে হোক, শিকারের লোভেই হোক ব্যাধের হাতে ক্রোঞ্চবধের নির্মম কাহিনী বাল্মীকির শোকবিহ্বল কণ্ঠে শ্লোক হয়ে ফুটে ওঠে। অন্যদিকে কাদম্বরীতে বানভট্ট একদল মানুষের আত্মঘাতী অরণ্য বিনাশের নিন্দা করেছেন স্পষ্টভাবেই। শালিকলনাথের চোখে একটি গাছ হল ক্লান্ত পথিকের পরম আশ্রয়, যার নিচে বসে মায়ের আঁচলের মতো স্নেহ, স্নিগ্ধ ছায়া পায় পথিকবর। কবি ধর্মপালের মতে তৃণভোজী হরিণের কাছে তৃণভূমি হল মা। আর গাছপালা হল বন্ধু-বান্ধব, নিকট আত্মীয়। ধর্মের ভয় দেখিয়েও প্রকৃতি-মা কে রক্ষার কথা বলেছেন কেউ কেউ। লাঙল চালালে মাটির অনেক পোকামাকড় মারা যায় বলে ব্রাহ্মণের হলকর্ষণ নিষেধ করেছিলেন মনু। তাই বলে ঋষি যজ্ঞব্রত যজ্ঞসভায় পশুবলি দিতে কোনরকম কুণ্ঠা বোধ করেননি।
নিসর্গনীতি নিয়ে শাস্ত্রবাক্যের শ্লোক/উপদেশ বা সংস্কৃত সাহিত্য এইভাবে পরিবেশের সাথে মানুষকে সম্পৃক্ত ও অন্তরঙ্গ করে তুলতে চেয়েছে। মাটি আমার মা, গাছ আমার বন্ধু পরমাত্মীয়, জল আমার অন্তরঙ্গ সত্তা, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণুজীব সহ সমগ্র প্রাণীকুল আমার বেঁচে থাকার শর্ত: এই সত্তায় মানুষের মনন জারিত হলে সমস্যার সমাধান অনেকাংশে হয়ে যায়। নিজেকে প্রকৃতির অবিচ্ছেদ অংশ হিসেবে ভাবতে পারলে মুষ্টিমেয় মানুষের দ্বারা পরিবেশে ধ্বংসসাধনের বিরুদ্ধে সে প্রতিবাদের হকদারও হয়ে উঠতে পারে।
পরিবেশ ধ্বংস করে আত্মতুষ্টি ও স্বর্গলাভের তীব্র নিন্দা করা হয়েছে পঞ্চতন্ত্রের গল্পে। যেখানে প্রশ্ন তোলা হয়েছে –গাছ কেটে বা পশু হত্যা করে মাটি ভিজিয়ে যদি স্বর্গে যেতে হয়, তবে নরক যাত্রার পথ কোনটা? গাছের ডালে ডালে পাখি, কোটরে পোকামাকড়, ফুলে ফুলে মৌমাছি প্রজাপতিকে আপন করে নিয়ে এক বৃক্ষের দাঁড়িয়ে থাকার কথা সুন্দরভাবে চিত্রিত হয়েছে পঞ্চতন্ত্রের গল্পে।
পুণ্যলাভের পথ হিসেবে দিঘি জলাশয় খনন, সুসংহত বনসৃজনের কথা ধর্মকর্ম হিসেবেই পুরাণে গণ্য হলেও এই বোধটি আজকের দিনে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয়। প্রয়োজন কেবল ধর্মের নামাবলি সরিয়ে নৈসর্গনীতির বোধকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করে যুক্তিবাদী ভিতের ওপর দাঁড় করানো।
এই আলোচনায় কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার। অর্থশাস্ত্রের সূনাধ্যক্ষ প্রকরণে হাতি ঘোড়া, কিছু জলচল প্রাণী ও নদী-পুকুর-খাল-সরোবরে জন্মানো মাছ, কোঁচ, জলকাক, হাঁস সহ ময়ূর ময়না ইত্যাদি পাখি সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। বনে পশুপাখি ধরা পড়লে তাদের জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়ার রাজাদেশও স্থান পেয়েছে অর্থশাস্ত্রে। বেশকিছু মঙ্গলসূচক পশু-পাখি সংরক্ষণের কথাও বলা হয়েছে এখানে। রাজাদেশ লঙ্ঘন করলে শাস্তির বিধান আছে অর্থশাস্ত্রে। যেমন বনে আগুন লাগানোর শাস্তি হিসেবে পুড়িয়ে মারর সুপারিশ করেছেন স্বয়ং কৌটিল্য। জীবন্ত পুড়িয়ে মারার বিধানকে বিরোধিতা করেও বলা চলে, প্রকৃতিসংহার অবশ্যই শাস্তিযোগ্য। এবং এক্ষেত্রে শাস্তির খাঁড়া সুতীক্ষ্ণ করতে হবে পরিবেশ সংহারের মূলহোতা হাঙ্গর কর্পোরেট বাহিনী ও তাদের সেবাদাস নানান কিসিমের সরকার প্রশাসনের দিকেই। অঙ্গুলি হেলন করতে হবে লুটেপুটে খাওয়ার জন্য পরিবেশ আইনগুলোকে পরিবর্তন করার নীল নকশার দিকেও।
আসলে পাপপুণ্যের ভয় দেখিয়ে বা নরকবাসের আশঙ্কা জাগিয়ে, কিংবা আচার বিচার ও আত্মশুদ্ধির দোহাই দিয়ে, শাস্তির ব্যবস্থা করে প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতি বা দর্শন পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে মানুষের ভূমিকা সুনির্দিষ্ট করতে চেয়েছিল। এই বিষয়গুলোই আজকের সমাজ মননে প্রথিত করতে হবে যুক্তিবাদ ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির উপর দাঁড়িয়ে।
সেকালের প্রাচীন সাহিত্য: বেদ উপনিষদ এবং প্রাচীন কাব্য ও নাটক, বিশেষ করে সেকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনীষী কালিদাসের সাহিত্য সৃষ্টি একালের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওপর ভীষণভাবে রেখাপাত করে। কবিগুরুর পরিবেশ ও নৈতিকতা সম্পর্কিত চিন্তাভাবনা সহ তাঁর সমগ্র সৃষ্টির ক্ষেত্রে একটা কেন্দ্রীভূত মূল সুর রয়েছে। এক অখণ্ড জীবন দর্শনের ওপর ভিত্তি করেই ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ বা সমগ্র বিশ্ব একটি পরিবারভুক্ত, এই বিশ্বমানবতার বোধ গড়ে উঠেছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শনে। তিনি মনে করতেন, প্রকৃতি ও মানুষ এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। ‘অরণ্য দেবতা’ প্রবন্ধে কবি বলছেন –মানুষ অমিতাচারী। যত দিন সে অরণ্যবাসী ছিল ততদিন অরণ্যের সঙ্গে তার আদান-প্রদান ছিল। ক্রমে মানুষ যখন নগরবাসী হল, তখন অরণ্যের প্রতি মমত্ববোধও সে হারাল। মানুষ তার প্রথম সুহৃদ তরুলতাকে নির্মমভাবে নির্বিচারে ধ্বংস করে ইটকাঠ আর কংক্রিটের শহর গড়ে তুলতে মনপ্রাণ এক করল। রবীন্দ্রনাথ আরও লিখছেন –অরণ্য ধ্বংস ও বৃক্ষছেদনের ফলস্বরূপ ভারতবর্ষের উত্তর-অংশে গ্রীষ্মের উৎপাত মাত্রাছাড়া হয়েছে। সবুজ বৃক্ষ ও জঙ্গল বিনাশ করে মানুষ যেন দেশে মরুভূমি ফিরিয়ে আনবার উদ্যোগ নিয়েছে। কি অসম্ভব দূরদৃষ্টি। একশত বছর আগে রবীন্দ্রনাথের লেখনীতে উঠে এসেছে আজকের দিনের ভয়ানক পরিবেশ বিপর্যয়ের স্পষ্ট চালচিত্র। বিপন্ন হিমালয় পৃথিবীর মানচিত্র থেকে উধাও হয়ে গেলে ভারত সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো রুখাশুখা মরুভূমি বই অন্য কিছু নয়।
এই প্রবন্ধেই তিনি লিখছেন –“সেই বিপদ থেকে রক্ষা পেতে হলে আমাদের আহ্বান করতে হবে বরদাত্রী বনলক্ষ্মীকে –আবার তিনি রক্ষা করুন এই ভূমিকে। দিন তাঁর ফল, দিন তাঁর ছায়া।” কবির উপলব্ধি –আধুনিক মানুষ বিলাসবহুল ও প্রদর্শনমূলক জীবনযাপনে নিদারুণভাবে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। বিশ্বমানবতার পূজারী রবীন্দ্রনাথের অন্তর্দৃষ্টি দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বলোকে পরিব্যাপ্ত। তাই তিনি স্পষ্ট করে বলতে পারেন –“এই সমস্যা আজ শুধু এখানে নয়। মানুষের সর্বগ্রাসী লোভের হাত থেকে অরণ্যসম্পদকে রক্ষা করা সর্বত্রই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমেরিকাতে বড়ো বড়ো বন ধ্বংস করার ফলে এখন বালু উড়িয়ে আসছে ঝড়, কৃষিশস্যকে নষ্ট করছে, চাপা দিচ্ছে। ….. লোভী মানুষ অরণ্যকে ধ্বংস করে নিজেরই ক্ষতি ডেকে এনেছে। বায়ুকে নির্মল করার ভার যে গাছপালার উপর, যার পত্র ঝরে গিয়ে ভূমিকে উর্বরতা দেয়, তাকেই সে নির্মূল করেছে” (অরণ্য দেবতা)।
‘শান্তিনিকেতন’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখছেন – “যে বিরাট প্রকৃতির দ্বারা মানুষ পরিবেষ্টিত, যার আলোক এসে তার চক্ষুকে সার্থক করেছে, যার উত্তাপ তার প্রাণকে স্পন্দিত করে তুলেছে, যার জল তার অভিষেক, যার অন্নে তার জীবন, …. ভারতবর্ষ সেই প্রকৃতির মধ্যে আপনার ভক্তিবৃত্তিকে সর্বত্র ওতপ্রোত করে প্রসারিত করে রেখে দিয়েছে।” তিনি বলছেন, এই বিশ্বপ্রকৃতির সাথে পবিত্র যোগেই ভারতবর্ষ নিজেকে বৃহৎ করে জেনেছে। আহা, প্রকৃতির সাথে মানবসত্তার কী অপূর্ব আত্মিক যোগ।
পাশ্চাত্যের সাথে প্রাচ্য তথা ভারতের প্রকৃতিবোধ ও জীবনদর্শনের স্পষ্ট ফারাক তুলে ধরেছেন তিনি — “শেকসপীয়রের As You Like নাটক একটা বনবাস কাহিনী, টেম্পেস্টও তাই, Midsummer Night's Dream-ও অরণ্যের কাব্য। কিন্তু সে-সকল কাব্যে মানুষের প্রভুত্ব ও প্রবৃত্তির লীলাই একেবারে একান্ত –অরণ্যের সঙ্গে সৌহার্দ্য দেখতে পাইনে। অরণ্যবাসের সঙ্গে মানুষের চিত্তের সামঞ্জস্য সাধন ঘটেনি।”
অথচ কালিদাসের শকুন্তলা নাটকের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন তিনি। প্রকৃতিপ্রেমিক রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘শকুন্তলা’ প্রবন্ধে বলছেন – কালিদাস তাঁর অপরূপ কৌশল ও প্রতিভায় শকুন্তলাকে লীলা ও ধর্মের, স্বভাব ও নিয়মের, নদী ও সমুদ্রের ঠিক মোহনার উপর স্থাপিত করেছেন। তপোবনের প্রকৃতি বর্ণন সম্পর্কে তিনি উচ্ছ্বসিত। তাঁর মতে –তপোবনে স্বভাব এবং তপস্যা, সৌন্দর্য এবং সংযম সব মিলেমিশে একাকার। সেখানে সমাজের কৃত্রিম বিধান না থাকলেও ধর্মের কঠোর নিয়ম বিদ্যমান। শকুন্তলার সহজ সরল সুন্দর অথচ গভীর পবিত্রতা সম্পর্কে তিনি লিখছেন –“শকুন্তলাকেও ধূলা লাগিয়াছিল, কিন্তু তাহা সে নিজেও জানিতে পারে নাই। …. সে অরণ্যের চঞ্চলা মৃগীর মতো, নির্ঝরের জলধারার মতো, মলিনতার সংসর্গেও অনায়াসেই নির্মল।” এখানেই রবীন্দ্রনাথের মহত্ত্ব। তাঁর প্রকৃতিপ্রেম ভীষণ প্রগাঢ় ছিল বলেই ‘ধুলোলাগা মলিন শকুন্তলা’কে তিনি অনাবিল জলধারার সাথে, অরণ্যের সরলা হরিণীর সাথে তুলনা করতে পারেন।
নদীর বুকে বড় বাঁধের অযৌক্তিকতা ও বিপদ সম্পর্কে বিজ্ঞানী ও নদী বিশেষজ্ঞরা অনেকদিন ধরেই সরব। ২০২৩ সালে সিকিমে গ্ল্যাসিয়ার লেক আউটবার্স্টের কারণে তিস্তার উপর বড় জলাধার জলের তোড়ে উড়ে যাওয়া এবং কয়েকশ নাগরিকের মৃত্যু নদী বাঁধের বিপদ সম্পর্কে চিন্তাভাবনাকে নতুন করে উস্কে দিয়েছে। এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ‘মুক্তধারা’ নাটকের কথা আমাদের উল্লেখ করতেই হয়। তিনি প্রকৃতির স্বাভাবিক গতি বা প্রবহমানতা রুদ্ধ করার বিপক্ষে মত ব্যক্ত করেছেন। প্রাকৃতিক জলধারার ওপর আমাদের সকলের সমান অধিকার, তাই এই জলধারার স্রোত বা গতিপথ পরিবর্তন করা অমার্জনীয় অপরাধ। তাই ‘মুক্তধারা’য় শেষ পর্যন্ত এই অপ্রয়োজনীয় বাঁধকে মুক্ত করে স্রোতকে তার নিজস্ব গতিতে বইতে দেওয়ার বন্দোবস্ত করা হয়েছে।
এই নিবন্ধটিকে নির্দিষ্ট অক্ষরসীমার মধ্যে বাঁধতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি ভাবনার আরও নানান পরিচয়: একগুচ্ছ প্রবন্ধ, এমনকি ছোট গল্প বা কবিতার কথা অনুল্লিখিত থাকল। বুঝে নেওয়ার প্রয়োজন পড়েছে যে, আধুনিক ভারতে রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে প্রকৃতি ভাবনা, জীবনদর্শন এক উন্নত মাত্রা লাভ করেছে। এই ভাবনা গুলোকে সম্যকভাবে বুঝে নিয়ে আজকের স্থানকালের প্রেক্ষিতে প্রয়োগ করার মধ্য দিয়ে বিশ্বজোড়া প্রকৃতি বিপর্যয়ের সমাধানের তল পাওয়া সম্ভব বলেই মনে করি।
বর্তমান যুগের সাহিত্যে, দর্শনে তথা জনমানসে পরিবেশ সংক্রান্ত যে আধুনিক রূপটি ফুটে উঠেছে, তা উল্লেখ করতে হলে সামনে আনতে হবে বর্তমান কালের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন ও তার রূপকারদের। শুধুমাত্র উদাহরণস্বরূপ আমরা উল্লেখ করব চিপকো আন্দোলনের কথা। শ্রদ্ধেয় পরিবেশবিদ সুন্দরলাল বহুগুণা, যিনি হিমালয়কে হাতের তালুর মতো চিনতেন, প্রকৃতিকে ভালোবাসতেন হৃদয় দিয়ে, যাঁর নেতৃত্বে উন্নয়নের অজুহাতে কয়েকশত গাছ কাটার বিরুদ্ধে উত্তরাখণ্ডের আদিবাসী জনগণের বুক দিয়ে গাছ আগলে রাখার আন্দোলন ৫০ বছর ছাড়িয়ে গেল। অথচ উন্নয়নের নামে, নগরায়ণের নামে সবুজ বনানী সহ হেক্টরের পর হেক্টর অরণ্য নিধন হয়েই চলেছে মহা সমারোহে। আজকের দিনের আরেকটি আন্দোলনের কথা সোচ্চারে বলতেই হয়। অবিরল নির্মল গঙ্গার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন জি ডি আগরওয়াল সহ একাধিক সাধুসন্ত। হরিদ্বারের কংখলে মাতৃসদন আশ্রমের সন্ন্যাসীরা জীবনপণ করে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন হিমালয় ও গঙ্গাকে রক্ষা করার স্বার্থে, বিগত দশ বছর ধরে ‘নমোমী গঙ্গা’ প্রকল্পের কোটি কোটি টাকা গঙ্গার জলে তলিয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে, গঙ্গার ভয়ানক দূষণের বিরুদ্ধে। হিমালয়ের কথা এসে পড়লে লাদাখের আদিবাসীদের আন্দোলনের মুখ সোনম ওয়াংচুর কথা স্মরণ করতেই হয়। লাদাখ-কাশ্মীর সংলগ্ন হিমালয় সহ ভারতের বড় বড় নদী, সিন্ধু গঙ্গা অলকানন্দা ধৌলি ইত্যাদি বাঁচানোর লড়াইয়ে আজ প্রচুর মানুষ/সংগঠন এগিয়ে আসছে। এই আন্দোলন গুলিতে প্রাণ সঞ্চার করতে ভারতীয় সাহিত্য, সংস্কৃতি তথা জীবনদর্শনকে সামনে আনতে হবে অনেক বেশি করে, অবশ্যই যুক্তিনিষ্ঠ সত্যের উপর ভিত্তি করেই।
ভোগ-সর্বস্বতা সম্পর্কে ‘বিলাসের ফাঁস’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ একটি প্রণিধানযোগ্য বক্তব্য রেখেছেন – “এখনকার দিনে ব্যক্তিগত ভোগের আদর্শ বাড়িয়া উঠিয়াছে। এখন আহার পরিচ্ছদ, বাড়ি গাড়ি জুড়ি, আসবাবপত্র দ্বারা লোকে আপন মহত্ত্ব ঘোষণা করিতেছে। ধনীতে ধনীতে এখন এই লোভের প্রতিযোগিতা। আমাদের দেশে ইহাতে যে কতদূর পর্যন্ত দুঃখ সৃষ্টি করিতেছে, তাহা আলোচনা করিলেই বুঝা যাইবে।”
‘আত্মপরিচয়’ গ্রন্থে নবীন রবীন্দ্রনাথের কলমে উঠে এসেছে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের কথা। আত্মপরিচয় এর ভাষা বেশ কাব্যিক মনে হলেও ‘সুদূর বিস্তৃত শ্যামল অঙ্গ’, ‘আমার বৃহৎ সর্বাঙ্গে’, প্রকাণ্ড বৃহৎভাবে এই শব্দগুচ্ছ গুলোর মধ্য দিয়ে তিনি স্পষ্ট করেছেন বিপুলা বিশাল নৈসর্গিক প্রকৃতি তার সমস্ত রূপ -রস-গন্ধ নিয়ে মানুষের বৃহৎ প্রকাণ্ড শরীরকে (এক্সটেন্ডেড বডি) তৈরি করেছে। রক্তমাংসের ক্ষুদ্র শরীরের আরামের মোহে আমরা যতই অন্ধভাবে ছুটি না কেন, সেইটি নেহাতেই আত্মসর্বস্ব এক ক্ষুদ্র ভাবনা। তাই আমাদের আজ ভাবতে হবে অনেক বৃহৎ পরিসরে অনেক বড় পরিধিতে মননকে জারিত করে। ‘আপনা হতে বাইরে দাঁড়া’লে ‘বুকের মাঝে বিশ্বলোকের’ সাড়া মিলতে অসুবিধে কোথায়?