এ'লেখাটি কোনও 'ম্যানিফেস্টো' নয় জানবেন। এটি একটি শোকে ভেজা ছেঁড়া তমসুক মাত্র।
প্রলাপ।
আগুন, সে আর যথেষ্ট কই ধরাবার? এখন তো প্রিয় সব শবদেহ'ই অর্ধদগ্ধ!
১.
হাংরি প্রজন্মকে যাঁরা অস্বীকার করেছেন, দল বেঁধে লোপাট ক'রে দেবার চেষ্টা করেছেন, 'পড়েন নি' ব'লে তাচ্ছিল্য করেছেন, মজার কথা হ'ল সন-তারিখ মিলিয়ে দেখুন হাংরি-কালোত্তর তাদেরও লেখা বদলে গেছে। বিশেষত গদ্যে।
কেউ কেউ সরাসরি 'কপি' করার চেষ্টা করেছেন। ভাষায়-ভঙ্গীতে-বিষয়ে। সেই 'কেউ-কেউ'এর মধ্যে আবার কেউ কেউ সফল হ'য়েছেন। আর অধিকাংশ কেউ কেউ স্বাভাবিকভাবেই হড়কেছেন। তার মধ্যে কত যে 'সাহিত্য সম্রাট'!
মজার কথা যিনি নিয়েছেন এবং পেরেছেন তিনিও স্বীকার করেন নি। যিনি হাত পেতেছেন এবং গিলতে পারেন নি তিনিও স্বীকার করেন নি। ফলত 'ক্ষুধার্ত প্রজন্ম' হ'য়ে দাঁড়িয়েছে প্রকাশ্যে এক 'নিষিদ্ধ' শব্দ। বাংলা সাহিত্যে এক বৃহত্তম 'মিসিং লিঙ্ক'। প্রতিষ্ঠান তার প্রতিশোধ সম্পূর্ণ করেছে।
তবে লেখাগুলো র'য়ে গেছে। হাংরি-কালের সব কৃষ্ণচিহ্ন নিয়ে। সেগুলোই আজ সূর্য কোনদিকে উঠেছিল তা জানায়।
আগুন তো কতজনই ধার নেয়। নিয়ে তাতে এগরোল ভেজে দোকান বসায়। তারা সমবেত প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। আগুন যে প্রথম জ্বালায়, সেই প্রমিথিউস। পৌরাণিক নায়ক।
আর এই ক্ষুধার্তের দল তো সেখানে নিজেদেরই জ্বালানি বানিয়েছিল দধীচির আত্মত্যাগে।
২.
এটাও বেশ আশ্চর্যের, যে এদের সঙ্গে আমাদের দেশীয় মার্কসবাদীদের বিচ্ছিন্নতাটা থেকেই গিয়েছিল! দেবেশ রায়, শঙ্খ ঘোষ, অমিতাভ দাশগুপ্তের মতো হাতে গোনা তিন/চারজন ছাড়া বাকি যে সাহিত্য-অভিভাবক শিবির ঐ তরফে তারা হয় নীরব ছিল অথবা তাদের একটা অংশ অতি সরব ছিল এদের ক্রুশবিদ্ধ করতে। এদের পাপ সাহিত্যে 'অশ্লীলতা'!
একটি নিখুঁত নিপুণ মধ্যযুগীয় 'উইচ-হান্টিং'এর আয়োজন!
যে সমাজ ক্ষুধার জন্ম দিচ্ছে, যে সমাজ অর্থ বৈষম্যের জন্ম দিচ্ছে সে অশ্লীল নয়,তার চেহারাকে হাড়-কঙ্কাল শুদ্ধ দেখালে তা অশ্লীল।
অথচ স্বয়ং মার্কস অবধি চেয়েছিলেন এই সমাজের অশ্লীলতাগুলির প্রতি ঘৃণা জন্মাতে। ব্রেখট চেয়েছিলেন সেই অশ্লীলতার স্বরূপকে অশ্লীলভাবে দেখাতে। গোর্কি 'নিচের মহল'কেই ভেবেছিলেন সমাজ বদলের ব্রয়লার ঘর।
ভাগ্যিস মার্কস, গোর্কি বা ব্রেখট কারোকেই এদেশের মার্কসবাদী সাংস্কৃতিক নেতাদের কাছ থেকে পরিচয়পত্র প্রত্যায়িত করতে আসতে হয় নি। হ'লে তাঁরাও যথাক্রমে অ-মার্কসীয়, অশ্লীল ও হঠকারী হিসেবে ছাপ্পা পেতেন!
আমাদের এখানে মার্কসবাদী ব'লে পরিচিত সাহিত্যপত্র সমূহে সেসময় যেসব লেখা ছাপা হ'য়ে চলেছে সেগুলি সুখী সুখী বাণিজ্যিক পত্রেরই অনুরূপ। প্রাতিষ্ঠানিক ও স্থিতাবস্থায় ভরা পারিবারিক আবেগবহুল আখ্যান! কারণহীন আশাবাদের সুস্বাস্থ্যে ভরপুর!শুধু শাঁখা-সিঁদুরটুকুই যা নেই। 'শুধু কেরানি'র গল্প।
দ্বন্দ্ব বা আগুন কোনটাই সেখানে নেই। 'বিপ্লব' পাশের বাড়ির ছেলেটির ডাকনাম মাত্র।
ফলে অনতি-আগের মানিক-জীবনানন্দের ছেড়ে যাওয়া প্রকৃত প্রজ্বলন্ত শলাকাটি যে 'ব্যাটন' হিসেবে 'ক্ষুধার্ত' যুবকদের হাতে ছিল, তা জানতেই দেওয়া হয় নি!
অথচ এদের লেখায় বারবার এসেছে মার্কসবাদের কথা, বস্তুবাদী জিজ্ঞাসা। এদের অধিকাংশই সক্রিয়ভাবে এমনকী ছিলেন মার্কসীয় নানা খোপের দলভুক্ত। সক্রিয় কর্মী। চিহ্নিত 'রেড কার্ড হোল্ডার'। তবু এদের রাজনৈতিক জীবন আর সাহিত্য জীবনের মধ্যের 'বাইপাস'টি প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই লোপাট করা ছিল।
মানে, খেলা শুরুর আগেই এদের 'লাল কার্ড' দেখিয়ে দেওয়া হ'য়েছিল এ'দেশের প্রতিক্রিয়া ও প্রগতি উভয় শিবিরের তরফ থেকেই।
আজ যে হা-হুতাশ দেখছেন নানা দিকে, আজ যে স্মৃতিচারণের বন্যা, তা এটা জেনেই যে আপাতত শমীবৃক্ষের চারপাশে সামাজিক রাষ্ট্রীয় পাহারা। সেইসব অস্ত্রেরা আজ কঙ্কালসার হ'য়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে ঝুলন্ত।
আপাতত অনেক সাধনাকাল আবার পার না হ'লে তারা জাগবে না। ফলে আগ্নেয়গিরিতে শোকসভার পিকনিক চলতেই পারে...।
৩.
সে যাক, বরং এরপর নিরাপদ একটা মোদ্দা কথা পাড়ি।
সেই কথাটা হ'ল, হাংরি লেখকদের আগের আর পরের বাংলা সাহিত্য ভাষা এক নয়।
সম্ভবও নয়।
একটা সাহিত্য আন্দোলনের ভেতর যদি একটু আগে-পরে বাসুদেব দাশগুপ্ত, মলয় রায়চৌধুরী, ফাল্গুনী রায় আর অরুণেশ ঘোষের মতো চারটি গদ্য-বিস্ফোরণ ঘটে, তবে কৃষ্ণগহ্বরে নতুন মহাবিশ্ব জন্মাবেই।
সুবিমল মিশ্র জনপ্রিয় হন নি। হতে চান নি ব'লে।
সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় এবং নবারুণ ভট্টাচার্য পাঠকপ্রিয় হয়েছিলেন। তাদের গায়ে হাংরি-পুরুষদের পোড়া ছাই লেগে ছিল ব'লে।
কেউ রেগে যাবেন না, বঙ্কিমচন্দ্রের পরে এমন দীর্ঘ তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব বাংলা গদ্যে না, আর নাই।
একথা স্বীকারের সময় এসেছে।
আজও যদি এক হাংরি-পুরুষের শবের সামনে দাঁড়িয়ে এসব কথা না লিখি, তো কবে লিখব?
আদিউ বহ্নি-মলয়...।
কাল সকাল থেকেই তো কান ভ'রে উঠবে নানাবিধ দরবারী কানাড়ায়...।
ভরা ভোজসভায় কনসার্টের এখন নাম হবে 'ক্ষুধার্তদের জন্য গান'!