সত্য না ইন্দ্রজাল? এ প্রশ্নের উত্তর আকাশের মেঘে।
"আজ দীপাবলি। বিশালার ঘরে ঘরে ধনদাত্রী লক্ষ্মীর আরাধনা, অলক্ষ্মীর বিদায়। সন্ধ্যায় এই বিশালা নগর - অবন্তী দেশের রাজধানী উজ্জয়িনী, কণকশৃঙ্গ মহাকালেশ্বর মন্দির, দুই নদী শিপ্রা, গন্ধবতীর বুক দীপের আলোয় আলোকিত হবে। অবন্তী দেশের প্রতিটি গৃহের দুয়ারে, বাতায়নে প্রদীপ জ্বলবে। আজ দীপোৎসব, আলোকোৎসব ,কোথাও কোন অন্ধকার থাকবে না।"
মনের গভীরে জ্বলে উঠল অপূর্ব এক আলো। মুহূর্তে পৌঁছে গেলাম ভারতবর্ষের এক প্রাচীন নগরীতে। বর্ণনার কুশলতায় বহুযুগ আগের সেই দীপাবলির রাতের আলোকময় সন্ধ্যার ছবিটি আঁকা হয়ে গেল। সাহিত্যিক অমর মিত্রের 'ধ্রুবপুত্র' উপন্যাস শুরু থেকেই পাঠক মনে সঞ্চার করে এক মুগ্ধতার বোধ। অবন্তী দেশ ও উজ্জয়িনী এ উপন্যাসে একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু পড়তে পড়তে আবিষ্কার করি প্রায় সমগ্র ভারতবর্ষই হল এ উপন্যাসের পটভূমি। শিপ্রা নদী আর তার আশেপাশের জনপদ, পশ্চিমে সৌরাষ্ট্র ও মরুদেশ, উত্তর পশ্চিমের সিন্ধু-নদ, পুরুষপুর, গান্ধার ও বাহ্লিক দেশ, হিন্দুকুশ পর্বতমালা, অক্সাস নদী, দক্ষিণের বিদিশা নগর, পুবের পাটুলিপুত্র থেকে লোহিত্যনদ -প্রায় দু’হাজার বছর আগের ভারতবর্ষ তার বর্ণময়তা আর বৈচিত্র্যে জীবন্ত হয়ে উঠেছে উপন্যাসের পাতায় পাতায়।
কাহিনীর কেন্দ্রে আছে উজ্জয়িনী নগরে প্রচলিত একটি লোককথা। কিন্তু এই উপন্যাস কাহিনীর থেকেও অনেক বেশী কিছু দেয় পাঠককে। রাজা ভর্তৃহরি ও তাঁর চারপাশের মানুষজনকে অসাধারণ দক্ষতায় চিত্রিত করেছেন লেখক। দেবদাসী, গণিকা, রাজরানী থেকে সাধারণ পরিবারের গৃহবধূ, গ্রামবালিকা, শূদ্র, নিষাদ, রাজকর্মচারী, পুরোহিত - অতীতের 'ধূসরতা থেকে জেগে উঠেছে উপন্যাসের বাস্তবতায়।' শিবনাথের অকাল প্রয়াত বয়স্য ধ্রুবর সন্তান ধ্রুবপুত্র। এক বিশেষ কারণে উজ্জয়িনী থেকে নির্বাসিত হয় সে। আর সেই থেকেই অবন্তীদেশ বৃষ্টিহীন। ভারতবর্ষ কৃষিনির্ভর দেশ। মেঘবৃষ্টি ঘিরে এই দেশে রচিত হয় শ্রী -সম্পদময় এক জগৎ। সে জগতে প্রেম, কামনা, লোভ, বীরত্ব সবই আছে। তা সত্ত্বেও বইটি পড়ার সময়ে ভাষার সৌন্দর্যে মনে হয় যেন মেঘময় এক কল্পলোকে ভেসে চলেছি। একটা আবেশ তৈরি হয় বিনা চেষ্টাতেই। "অলিন্দ প্রায় পার করে এলেন রাজা ভর্তৃহরি। একটি দীপের আলো তাঁর লক্ষ্য ছিল। দীপটি একটি নিঃসঙ্গ তারার মতো জ্বলছিল। "এই কাব্যধর্মিতা ঘোর লাগিয়ে দেয় পাঠক মনে। কাহিনীর শেষদিকে ইন্দ্রজালের মায়ার প্রসঙ্গ এসেছে। লেখক নিজেই যেন এক ঐন্দ্রজালিক। আর এই সুষমাময় আখ্যান জুড়ে সেই ইন্দ্রজালের মোহময় বিস্তার।
লৌকিক গল্প, পুরাণ আর কিংবদন্তীর অপূর্ব সমন্বয়ে সৃষ্টি হয়েছে 'ধ্রুবপুত্র' উপন্যাসের প্রেক্ষাপট। এক্ষেত্রে কাহিনীকার তারাশঙ্কর, দেবেশ রায়, সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ ও শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের সার্থক উত্তরসূরি বললে অত্যুক্তি হয় না। কাহিনীর আঙ্গিক ও নির্মাণ মৌলিক ও অভিনব। পুরাণ, লোককথা ও কিংবদন্তীতে আধারিত হলেও 'ধ্রুবপুত্র' বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্করহিত নয়। বৃষ্টির সঙ্গে ফসল আর ঐশ্বর্যের চিরাচরিত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ভারতবর্ষে। উপন্যাসের মূলসূত্রটির ভিত্তি সেই সত্যটি। ধ্রুবপুত্র যখন বর্ণনা করছে কী ভাবে একটি সোনার দেশ রোদে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে, সবুজ পাতারা লাল হয়ে যাচ্ছে, নদী সরোবর শুকিয়ে যাচ্ছে, মানুষ নিষ্ঠুর হয়ে উঠছে তখন আজকের পৃথিবীতে পরিবেশ ঘিরে যে উদ্বেগ তা আরও একবার স্মরণ করেন পাঠক। যে বিচিত্র আঁধারে দশদিক ঘিরে ধরার কথা বলছে ধ্রুবপুত্র সেই আঁধারের দেখা তো আমরা পেলাম অতিমারী আক্রান্ত পৃথিবীতে। প্রকৃতির যে প্রতিশোধ জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দিয়েছিল উজ্জয়িনীকে সেই প্রতিশোধ বারেবারেই নেমে আসতে পারে পৃথিবীর বুকে। এ উপন্যাস যেন এক অমোঘ সতর্কবার্তা। রাজা যখন বলছেন, "রাজ্যশাসনের রীতি হয়ত তাই, যত ক্ষমতা তত অজ্ঞানতা, ক্ষমতাই অজ্ঞানতার জন্ম দেয়। "তখন স্থানকালের ব্যবধান ছাড়িয়ে এই কাহিনী সর্বকালের সর্বসমাজের হয়ে ওঠে। শুধু সতর্কবার্তাই উপন্যাসের শেষকথা নয়। এ গল্প শেষ পর্যন্ত অন্ধকার থেকে আলোতে উত্তরণের। নির্বাসন থেকে প্রত্যাবর্তনের।
বিগত দুই দশকেরও বেশী সময় ধরে আমি বাংলার বাইরে। কিন্তু যে ভাষায় পৃথিবী রূপরসবর্ণগন্ধময় হয়ে ধরা দিয়েছে শিশু আমির চেতনায় সেই ভাষাটির প্রতি আজও অবোধ টান। সে ভাষায় ভাল লেখা পেলে মন ভাললাগায় ভরে যায়। শ্রী অমর মিত্র তাঁর 'ধ্রুবপুত্র' উপন্যাসের জন্যে ২০০৬ সালে আকাদেমি পুরস্কার পান। আমার আক্ষেপ এই উপন্যাসটি আমি এতদিন পরে হাতে পেলাম। বাংলার বাইরে বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে আমার অনুরোধ রইল বইটি পড়ার। প্রকৃতির নির্দয়তার বিপক্ষে কবিই একমাত্র দাঁড়াতে পারেন। উজ্জয়িনীর অনাবৃষ্টির অভিশাপ মোচন হয় কবির লেখা বৃষ্টির শ্লোকে। পুঞ্জীভূত হতে থাকে মেঘ রেবা নদীর তীর থেকে বেত্রবতীর কূলে, অলকাপুরীর পথে, রামগিরির কোলে.... আর কবির সম্বল ভাষা।
সম্প্রতি একটি ইংরাজি প্রবন্ধে পড়েছি পর্যাপ্ত যোগান তার নিজস্ব চাহিদা তৈরি করে। আশা করি 'ধ্রুবপুত্রে'র মতো একটি বহু-স্তরীয় উপন্যাস ভবিষ্যতে পাঠকদের অনুপ্রাণিত করবে নিবিড় পাঠাভ্যাসে। আর ভাবীকালের লেখকরাও উদ্বুদ্ধ হবেন পাঠকদের হৃদয়ে সেই পাঠ অভিজ্ঞতার স্বাদ এনে দিতে।