কাশ্মীরের কবি লাল্লেশ্বরীর জীবন - দর্শন ও 'বাখ' কবিতায় আলোকিত তিনটি বই
প্রতিদিন খুব ভোরে কাঁখে কলসি নিয়ে গাঁয়ের অন্য বউদের মতোই নদীতে জল আনতে যায় কিশোরী পদ্মাবতী। তবে বাকিদের মতো তড়িঘড়ি সে ফিরে তো আসেইনা, বরং তাঁর ফেরার সময় রোজ সূর্যদেব উঠে পড়েন মাঝ আকাশে। রোজকার দেরি দেখে শাশুড়িমা নিশ্চিত হন, ছেলের বউটি নিশ্চই অন্য কারো সাথে জড়িয়েছে সম্পর্কে, তাই তাঁর মন বুঝি নেই ঘরে ফেরায়। এছাড়াও এই বউয়ের অজস্র দোষ। সেই কবে থেকেই গুছিয়ে রান্নাবান্না- সংসার করা, খেয়ে না খেয়ে শশুড়বাড়ির সবার সেবা করা, স্বামীর প্রতি স্ত্রীধর্ম পালন করা তো দূর, সন্তানধারণ করতেও নারাজ সে, এমনকি বিয়ের পর রীতি অনুযায়ী পদ্মাবতী নামেও তাঁর অনীহা। কেউ জানতে চাইলে নিজের পরিচয় দেয় বিবাহপূর্ব লাল্লেশ্বরী বা লাল্লা নামে। এই আজব সব ধৃষ্টতার ওপর রোজকার তাঁর এই দীর্ঘ অনুপস্থিতি যেন আগুনে ঘি ঢালে। পদ্মাবতীর স্বামীকে উস্কে দেন শাশুড়ি, ঘরের অবাধ্য অলক্ষ্মী বউটিকে উচিত শাস্তি দেওয়ার জন্য...
তাই এখন বাড়ির চৌকাঠে পা দিতে না দিতেই তাই লাল্লার জন্য অপেক্ষা করে থাকে হাজারো গঞ্জনা আর মারধোর। অথচ সেসব আটকানোর কোন চেষ্টাই অবশ্য নেই বউটির। মুখ বুজে দ্রুত হাতে সে সারতে থাকে সংসারের পড়ে থাকা হাজারো কাজ। যেন দেহ আর মনের ওপর মুহুর্মুহু বরসাতে থাকা বাণগুলির কোন অস্তিত্বই নেই তাঁর কাছে, যেন কোন ব্যথাই আর ছুঁয়ে যায়না তাঁকে। ঘরের বউয়ের এই আশ্চর্য নীরবতা দামোদর আর তাঁর মায়ের কাছে অবজ্ঞার সামিল বোধ হয়, যা তাঁদের আক্রোশকে আরো হিংস্র করে তোলে। শুরু হয় অত্যাচারের নিত্য নতুন কৌশল। মেয়েটিকে অনাহারে রাখা যার অন্যতম। দামোদরের বাবা মানীগুণী পণ্ডিত মানুষ। তাই ভদ্র বাড়ির মানসম্মান রক্ষার স্বার্থে সব নিষ্ঠুরতা স্বাভাবিক ভাবেই চলতে থাকে পড়শিদের চোখের আড়ালে।
লাল্লা অবশ্য সবেতেই নিঃস্পৃহ। একলা বসে খালি সময়ে মুখে মুখে চার পঙক্তির বড় সুন্দর সব ' 'বাখ' কবিতা রোচে যায় সে। সেসব কবিতায় কালেভদ্রে অবশ্য থাকে তাঁর কষ্টের এই দিনগুলির কথা। কিছুটা ব্যঙ্গ আর অনেকটা ঔদাসীন্য মিশিয়ে সে বলে, কিভাবে থালায় একখণ্ড পাথরকে ভাতের পাতলা আস্তরণে ঢেকে তাঁকে খেতে দেন শাশুড়ি। বলে উৎসবে নধর পশুর পোড়ানো মাংস দিয়ে বাড়িতে মহাভোজ চললেও তাঁর কপালে জোটে কেবল পাথরশক্ত একখণ্ড রুটি। নিজেকেই শুধায়, "লাল্লা কেন হারিয়ে ফেলেছ নিজেকে/জীবন মরণ আর সম্পর্কের/ মিছে এই মোহজালে "....
১৩২০-র কাছাকাছি কোন এক সময়। তুষার-শুভ্র হিমালয়, রঙিন চিনার পাতা আর শান্ত নদী-ঝিলের ভূস্বর্গ কাশ্মীরে সে এক পট পরিবর্তনের সময়। নিরন্তর উপজাতি আক্রমণ আর সামন্ত বিদ্রোহে অশান্ত উপত্যকাকে অধিকার করে আইনের শাসন কায়েম করেছেন খস উপজাতির ধর্মান্তরিত সুলতান শামসুদ্দিন। সেই বংশের চার নম্বর শাসক শিহাবুদ্দিনের সময় কুবরিয়া সুফি সাধক সৈয়দ আলি হামদানির হাত ধরে কাশ্মীরে প্রবেশ করে উদার সুফি মতবাদ। অবশ্য তার বহু শতকাল আগে থেকেই কাশ্মীর দেখেছে ব্রাহ্মণ্য আর বৌদ্ধ ধর্মের সখ্যতা। আট শতকে দক্ষিণের কৃষ্ণা - কাবেরীর তীরে ঈশ্বর ভক্তির যে ঢেউ উঠেছিল তার স্রোত গোদাবরী- নর্মদা- গঙ্গা- যমুনার উজান স্রোত বেয়ে কবেই পৌঁছে গেছে কাশ্মীরের ঝিলমে। 'ত্রিকা' সহ অন্য নানা পথের 'সিদ্ধ'শৈব-সাধকরা এই কাশ্মীরে গাইছেন ঈশ্বরভক্তির পথে জাতপাত আর ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার সমস্ত কাঁটাতারকে তুচ্ছ করে এগিয়ে চলার গান। যা প্রাকৃত অপভ্রংশ সেসব কথা ক্রমে 'বাখ' নামে রূপ পাচ্ছে সদ্যজাত কাশ্মীরি ভাষায়। সুফি দরবেশ, বৌদ্ধ শ্রমণ আর শৈব সাধকদের শান্তি- উদারতার বাণীতে কাশ্মীরের বাতাবরণে বইছে ধর্মীয় আর সামাজিক সহাবস্থানের খোলা হাওয়া।
শ্রীনগরের কাছে পান্দ্রেনথানে এক ব্রাহ্মণ পণ্ডিত পরিবারে জন্মেছিল লাল্লেশ্বরী। শৈশব ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই গাঁয়ের অন্য মেয়েদের মতই তার বিয়ে হয়ে গেলো কিছুদূরের পাম্পর গ্রামের আরেক পণ্ডিত পরিবারে। ভালোবাসাহীন আদ্যন্ত নির্যাতনের অন্ধকার এই বিয়েতে সংসার যত তাঁর ঘাড়ে চেপে বসছিল, ততোই তাঁর প্রাণ আকুল হয়ে উঠছিল একটু মুক্তির জন্য... সারাদিনের মাঝে তাঁর একমাত্র আনন্দের কাজটি ছিল ভোরবেলা নদীতে জল ভরতে যাওয়া। চিনারের ঝরা পাতা, আর কেশর ফুলের সুগন্ধি ক্ষেত পেরিয়ে সে চলে যেত নদীর ধারে।এরকমই এক সময়ে তাঁর সঙ্গে দেখা হয় শৈবসন্ত সিদ্ধ শ্রীকান্ত, সিদ্ধমল বা নামান্তরে সেদ বয়ুর। লাল্লাকে তিনি দেখান শৈব আধ্যাত্মিকতার পথ। এই পথকেই আঁকড়ে ধরে এগিয়ে চলে লাল্লার উদ্ভ্রান্ত মন। গুরুকে লাল্লা শুধায়, ঈশ্বরকে পাওয়া যাবে কোন পথে? উত্তরে গুরু বলেন একটাই কথা। "বাইরে কোথাও নয়, নিজের ভিতরে ফেরো, অন্তরে তাকাও; এটিই পথ, একমাত্র শিক্ষাও এটিই...।" লাল্লা এবার তাঁর আজীবনের সমস্ত মিছে বিশ্বাস ছুঁড়ে ফেলে ডুব দেয় হৃদয়ের অথৈ জলে আর একদিন সত্যিই দেখে পরম শান্তিরূপী সেই ঈশ্বর বিরাজ করছেন তাঁর সমগ্র চেতনায়।
ক্রমেই নশ্বর জীবন আর অর্থহীন সাংসারিক সম্পর্কগুলোর প্রতি লাল্লেশ্বরীর ভিতরে তৈরি হতে থাকে তীব্র অনাসক্তি আর বীতস্পৃহা। এপারে খালি কলস রেখে তিনি রোজ নিশ্চুপে পেরিয়ে যান ভরা নদী; যার ওপারে রয়েছে কেশব ভৈরবের প্রাচীন মন্দির। মন্দিরের ভিতরে কখনো 'শিবপূজন', কখনো আবার তাঁর একাগ্র ধ্যানে হারিয়ে যান তরুণী সাধিকা। বাড়ি ফেরার কথা খেয়াল থাকে না। নিজের ভিতর যত ডুব দেন ততই যেন খুঁজে পান এক অনন্ত নৈঃশব্দ্য আর অপার শান্তি। মনের গহনে ঈশ্বরকে খোঁজার সেই অপরূপ অনুভূতিকে লাল্লা ধরে রাখেন তাঁর চার পঙক্তির 'বাখ' গুলিতে। ক্রমে তিনি বোঝেন এই শব্দাতীত ব্যক্তিগত প্রশান্তির নামই হয়তো ঈশ্বর। একদা অন্তর্মুখী কুলবধূটি এখন বাইরে ভিতরে সদাসর্বদা মত্ত থাকেন শিবপ্রেমে, তাই ঘরে ফিরলেও কারো কোন নির্মমতা আর স্পর্শ করতে পারেনা সাধিকা লাল্লার আলোকিত মনকে।
তাঁর 'বাখ'গুলি জলের মতো সহজ সরল আবার জলেরই মত গভীর। আটপৌরে শব্দে, গ্রাম্য রূপকে- প্রতীকে সেখানে উঠে আসে বিবাহিতা নারীর নিঃশব্দ যত যাতনা, শ্রমজীবী মানুষের রোজনামচা আর সমস্ত বন্ধন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মানুষের আর্তির কথা। সেসব কথা খুব মনে ধরে যায় গ্রামের মেয়েবউ আর খেটে খাওয়া মানুষদের। লাল্লার 'বাখ' ক্রমে গ্রামের সীমানা ছাড়িয়ে লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে দূর-দূরান্তে। তাঁকে কেন্দ্র করে ছড়াতে থাকে অলৌকিক নানা গালগল্প। অনাম্নী বউটিকে একবার দর্শন করার আকাঙ্ক্ষায় বা বিপদ তারণের আশায় তাঁর কাছে রোজ ছুটে আসতে থাকেন কত শত মানুষ। কিন্তু লাল্লা এসবে বিব্রত হন খুবই। কারণ নিজেই তো তিনি বিশ্বাস করেন না কোন কুসংস্কার আর প্রচারে। তাঁকে কেন্দ্র করে জনতার এই উন্মাদনা তার একটুও ভালো লাগেনা। ঠিক যেমন আর ভালো লাগেনা চোদ্দ বছরের নিরর্থক গার্হস্থ্য জীবনের চৌহদ্দিটুকু।
নীরবে নিভৃতে শিবসাধনের জন্য এবার চিরকালের মতো সংসার ছেড়ে সিদ্ধমলের কাছে সন্ন্যাস গ্রহণ করলেন লাল্লা। শুরুর কয়েক বছর তিনি গুরুর কাছে পেলেন প্রাণবায়ু, যোগসাধনা আর তন্ত্রের নানা পাঠ। সিদ্ধমল তাঁকে শেখান কেবল শৈবভক্তির পথেই চলতে। কিন্তু লাল্লা যে চিরবিদ্রোহিনী। কোন বিশ্বাসের কাঠামোয়, কোন নিয়মের শেকলে নিজেকে বাঁধতে রাজি নন তিনি। গুরুর আদেশের উত্তর তিনি দেন তাঁর বাখে বাখে। লাল্লা বলেন, শিব কেশব জিন বা কমলসম্ভূত ব্রহ্মা.. বাইরের নাম যাঁর যাই হোক, তাঁরা একই, সেই একই পরমেশ্বর। বলেন, মন্দির, মূর্তি বা শস্যপেশাইয়ের পাথর সবই সমান আসলে, কারণ পৃথিবীর সর্বত্র তো একই ঈশ্বর বিরাজমান। তবে ধর্মীয় বুজরুকী, নিয়মাচার আর কৃচ্ছসাধনের দেখনদারির বিরুদ্ধে কবি লাল্লার বাখগুলি সবচেয়ে নির্মম। কখনো তিনি গুরুকে বলেন, তাঁর সমস্ত পুঁথিপত্র খাঁচার তোতা পাখিটিকে খাইয়ে দিতে, কখনো আবার গুরুকে স্নান করতে দেখে শ্লেষ করেন; অন্দরমহল অশুচি থাকলে দেহ পরিষ্কার করে কি লাভ? আবার কখনো সারা গায়ে ছাই মেখে ঘুরে বেড়ানো সংসারত্যাগী যোগীদেরও কটাক্ষ করেন লাল্লা।
সেসময়কার কাশ্মীরের আদ্যন্ত পুরুষপ্রধান শৈব ভক্তিবাদী ঘরানার একমাত্র নারী প্রতিনিধি ছিলেন লাল্লা। তাঁর শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব আর বাখগুলির তুমুল জনপ্রিয়তা কোথাও যেন অস্বস্তিতে ফেলে দিচ্ছিল ত্রিকা পথের পুরুষ সাধকদের। ফলে গুরুশিষ্যর সম্পর্কটি দানা বেঁধে উঠলোনা আর শেষমেশ একদিন সিদ্ধমলের সঙ্গ ত্যাগ করে আত্ম-অন্বেষণের একক পথে বেরিয়ে পড়লেন যোগিনী লাল্লেশ্বরী। এবার থেকে তিনি নিজেই নিজের পথপ্রদর্শক। যে পথ নামহীন - অগতপূর্ব , সেই পথই তাঁর গন্তব্য এবার। কাশ্মীরের গ্রাম-গ্রামান্তরে, জঙ্গল- জনপদে ঘুরে ঘুরে সহজিয়া কাশ্মীরি ভাষায় নিজের ঈশ্বর উপলব্ধির কথা বলতে শুরু করলেন লাল্লা। বললেন, নিজেকে জানার মাঝ দিয়ে মুক্তি পাওয়ার পথটি বড় কঠিন; অনেকটা যেন জঙ্গলে সিংহীর সাথে কুস্তি লড়ে বেঁচে ফেরার মত অনুভূতি। তবু জ্যোৎস্না ডুবে যাওয়া আঁধার সেই গহীনে প্রবেশ করে শিবের সাথে একাত্ম হয়েছেন তিনি। বললেন, " চেতনার আগুনে পুড়ে হয়েছি নিখাদ সোনা/ মায়ার কুয়াশা গেছে কেটে/ আমার ঠিক পাশে দৃপ্ত উদিত সূর্য/...আর অসীম সেই আনন্দের মাঝে/ পাঁকে পদ্মফুলের মতো/ আমি ফুটে উঠেছি লাল্লা..."।
জাগতিক লাজ-শরম-বাসনা চোরাবালি, বিত্ত-মান-লোভ আর ক্ষমতা অস্থায়ী, জীবন-মৃত্যু নিছক গুরুত্বহীন এখন মধ্যবয়সী এই শিব-যোগিনীর কাছে। ঈশ্বর প্রেমের মত্ততায় লাল্লা এখন দিগম্বরী হয়ে নাচেন সমবেত জনতার বাজারে। গৃহী মানুষকে বলেন, "যেমন আছ, দিব্যি তেমনিই থাকো/ হৃদয়ে কেবল তাঁকে রাখো/ সেটুকুই যথেষ্ট.."। তাঁকে কেউ নিন্দায় বিদ্ধ করে, কারা আবার খুব ভালোবেসে ডাকে লালদেদ( লাল দিদিমা/ঠাকুমা) আর লালমাইজ( লাল মা) নামে। কেউ পাথর ছোঁড়ে, কারা দিয়ে যায় অন্নবস্ত্র। তবে তাঁর যে যায় আসেনা কোন কিছুতেই। উদাসী বাখে কবি বলে ওঠেন, " ওদের অভিশাপের কটূকথা/ ওদের ভক্তি ফুলের পাপড়ি/কোনটাকেই আমল দিইনা আমি/ লাল্লা যে পরমজ্ঞানের সন্ধানী..."।
লাল্লা সেকালের সমস্ত ধর্মীয় আর সামাজিক বোধের বাইরে নিজেকে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন সফল ভাবে। তিনি সকলের কাছে যেমন লাল্লা। জীবনের শেষ দিকে তাঁর মোলাকাত হয় পারসিক সুফি সন্ত সৈয়দ আলী হামদানির সাথে। তাঁর হাত ধরে সুফিবাদের নিগূঢ় তত্ত্বেও ঢুকে পড়েন তিনি। সুফি খানকায় আল্লাহর নাচে গানে 'সমা'য় মত্ত লাল্লেশ্বরী কখন যেন কাশ্মীরের গরিব মুসলমানের কাছে লাল আরিফা হয়ে ওঠেন। জাতধর্মের ফারাক একেবারে মুছে যায় আর লাল্লা বলেন ; " কারো দেওয়া অন্ন অচ্ছুৎ হতে পারে কখনো?...জানোনা, লাল্লার খিদে হস্তিনীর মতন...''।
তবে কোনদিনই গুরুশিষ্য পরম্পরা, মন্দির -আশ্রম- দরগার স্থাপনা, অথবা লিখিত উপদেশের ওজনে অমরত্ব লাভ, কিছুতেই বিশ্বাসী ছিলেননা তিনি।বাখে তাঁর এই নিঃস্পৃহতারই প্রতিধ্বনি..''সহজ ভাবে এসেছি/ সহজে চলে যাব".. অথবা " কারো জন্য শোক করিনি আমি/ কেউ তা করোনা আমার জন্যেও.."। পদ্মপাতায় জলের মতো অস্থির জীবনে সচেতন ভাবেই হয়ত নিজের কোন চিহ্ন আগামীর কাছে রেখে যেতে চাননি বিবাগিনী যোগিনী। তাই ১৩৭২- এ লাল্লার প্রয়াণ নিয়ে এখনো যেমন কোন সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক তথ্য নেই, তেমনি আজও বিজবেহেরার কাছে লাল্লার কথিত সমাধিটির সত্যতা নিয়েও হয়নি কোন ঐক্যমত।
কাশ্মীরে সেই কলহনের রাজতরঙ্গিনীর আমল থেকেই সংস্কৃত আর ফারসি দুই ভাষাতেই প্রচলিত ছিল বাস্তব নিষ্ঠ ইতিহাস রচনার এক মহান ঐতিহ্য। কিন্তু লাল্লার সমসাময়িক ঐতিহাসিক জোনারাজ, শ্রীভর, প্রজ্ঞা-ভট্ট, হায়দার মালিক চাদুরা বা হাসান বিন আলীর মতো খ্যাতনামা ঐতিহাসিকদের লেখায় লাল্লা একেবারেই অনুপস্থিত। হয়ত লাল্লা কোন নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করেননি বলে, হয়ত বা স্পষ্টবাক ব্যতিক্রমী নারী বলে তাঁকে ব্রাত্য রেখেছে কাশ্মীরের দরবারী ইতিহাস।
দু'শতক পর ১৫৮৭ তে মুল্লা আলী রায়নার লিখিত 'তাধকিরাৎ-উল-আরিফিন' নামক কাশ্মীরি সাধকদের নিয়ে লেখা এক স্মৃতিনামায় একমাত্র মহিলা প্রতিনিধি হিসেবে প্রথমবার সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখিত হন লাল্লা। মহান সুফি সন্ত ও কাশ্মীরি ঋষি সিলসিলার জনক শেখ নুরউদ্দিন বা নন্দ ঋষির আধ্যাত্মিকতা প্রায় সম্পূর্ণই প্রভাবিত ছিল লাল দেদের জীবনবোধের দ্বারা। তাঁর জীবনী 'নূরনামায়' তাই শুরুতেই লালদেদ সম্মানিতা হয়েছেন অবতার রূপে। এরপর ১৬৫৪-তে বাবা দাউদ মিশকাটির 'অসরার-উল- আকবার'-এ জানা যায় সন্ত লাল্লা যাত্রীদের মাঝেমধ্যেই দেখা দিয়ে যেতেন ঘন জঙ্গলের পথে। ১৭৩৭ সালে পারসিক সন্তকবি খাজা আজম দিদামারীর 'তারিখ-ই- আজমী' আর 'ওয়াকিয়াত-ই- কাশ্মির' বই দুটিতে লাল্লার জীবনের বিস্তৃত বৃত্তান্ত লেখা হয়। আর মাত্র বছর শতেক আগে লোকায়ত লাল্লা ব্রিটিশ লোক ভাষাবিদ জর্জ আব্রাহাম গ্রীয়ারসন এর অনুবাদে আর সম্পাদনায় 'Lalla-Vakyani Or The Wise Sayings of Lal Ded; A Mystic Poetess Of Ancient Kashmir ' গ্রন্থের মধ্য দিয়ে পৌঁছে যান আন্তর্জাতিক পাঠকের দরবারে। এই অত্যাশ্চর্য দার্শনিক কবি সাধিকার জীবন ও লেখন নিয়ে দেশ আর দুনিয়া জুড়ে শুরু হয় অন্তহীন উন্মাদনা।
ওপরের অনুচ্ছেদগুলিতে আমার লেখা প্রতিটি তথ্য উঠে এসেছে লাল দেদ সম্পর্কে লিখিত তিনটি অনবদ্য বইয়ের পাতায়- ছত্রে- পঙক্তিতে।
২০২০-র করোনাকালে নিজের এক কঠিন সময়ে আমি কবি লাল্লার কথা পড়তে শুরু করি। প্রথমে ঐতিহাসিক সোনালিকা কল সম্পাদিত 'Looking Within -Life Lessons from Lal Ded - এ লিখিত তাঁর 'বাখ'গুলি পড়ে এত গভীরভাবে প্রভাবিত হই যে, তাঁকে আরো বেশি করে জানার - বোঝার জন্য পরপর কিনে ফেলি সহজলভ্য আরো দুটি বই। জয়লাল কলের 'Lal Ded' এবং জওয়াহর লাল ভাটের 'Lal Ded Revisited' ।
নীরস পণ্ডিতি ঢঙে নয়, বরং তিনটি বইতেই বেশ সহজ ভাবে আলোচিত হয়েছে ওপরে যা কিছু লিখেছি তার সবটুকুই। বিবৃতি হয়েছে লাল্লার সমকালীন কাশ্মীরের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট, কাশ্মীরের নিখাদ একেশ্বরবাদী 'প্রত্যভিজ্ঞা' বা 'ত্রিকা' ( যা শিব, শক্তি ও নর - এই ত্রিমুখী শক্তির সমন্বয় বোধের ভিতে সৃষ্ট হয়েছিল) শৈব দর্শনের নানা দিক, কাশ্মীরের লোকসংস্কৃতিতে লাল্লার প্রভাবের গভীরতা, আঞ্চলিক কাশ্মীরি ভাষার বিকাশের ক্ষেত্রে বাখগুলির গুরুত্ব আর সর্বোপরি কবি লাল্লেশ্বরীর বাখগুলির সাবলীল ইংরেজি অনুবাদ।
Looking Within বইটিতে, 'বাখ'গুলিকে সম্পাদিকা ভাগ করেছেন, 'life of illusions', 'the search', 'the realization', 'the way' নামক চারটি ধাপে। যেখানে কবিতার ভাষ্যে আমরা দেখি এক মুক্তি আকুল গৃহবধূ থেকে আত্মদীপা সাধিকা লাল্লেশ্বরী হয়ে ওঠার সফর বৃত্তকে। সেই সফরে বিবর্তিত হয়, তাঁর বাখের বিষয়, ভাব, ভাষা, উপলব্ধি ও চেতনা। প্রথম বাখের লাল্লা অনুসন্ধানী, " আমি কোথা থেকে কিভাবে এলাম জানিনা/ জানিনা সামনে যাব কোথায় / জানিনা সফরে পাবো কিনা ধন কিছু?/ দামি জীবনটাকেই কি ভরসা করা যায়?..''
আর শেষ বাখে তিনি ক্রান্তদর্শী, " তন্ত্র রূপ নেয় মন্ত্রে/ জ্ঞান ডুবে যায় চেতনায়/ চেতনা মেশে শূন্যে/ অপার শূন্যতা শুধু ডুবে যায় আরো শূন্যতায়…"
লাল দেদ গ্রামীণ কাশ্মীরে আজও পর্যন্ত প্রায় একইরকম জনপ্রিয়। তাঁর মরমিয়া বাখগুলি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মনে ধরে রেখেছেন কাশ্মীরের গ্রাম্য গৃহবধূ, গরিব ফলচাষি, কার্পেটের কারিগর, মোট বওয়া মজুর, শিকারার মাঝিরা। কথ্য প্রবাদ-প্রবচনে, জনশ্রুতি আর লোকগানে রোজ নানাভাবে ফিরে ফিরে আসেন তিনি। শত চেষ্টা সত্ত্বেও কাশ্মীরের দীর্ঘ রাজনৈতিক হানাহানিতে লাল্লাকে কোন নির্দিষ্ট ধর্মের লোক বলে দেগে দিয়ে তাঁকে মুছে ফেলতে পারেনি কেউ আজও। তিনি প্রবলভাবে আগেও বেঁচে ছিলেন, এখনো আছেন আর আগামীতেও থাকবেন।
লাল্লা থাকবেন তাঁর বাখে ধরে রাখা
অশান্তিদীর্ন ভূস্বর্গের অনিবার প্রকৃতি আর ঝিলামের ঢেউগুলির মতো সহজ মানুষের জীবন যুদ্ধে, তাঁদের বুকের ভিতর।
আলোচ্য বইত্রয়ীতে উঠে আসা লাল দেদ কিন্তু কেবল কাশ্মীরের নয় তিনি আমাদেরও, বা বলা ভাল এই দুনিয়ার সবার কবি, যিনি আবহমান কাল ধরে ভিতরে বাইরে ধ্বস্ত পৃথিবীর মানুষকে শোনাতে থাকেন সমস্ত অন্ধকারের ভিতর নিজের আলোয় নিজেকে খুঁজে পাওয়ার গান। সহজলভ্য বই তিনটি অথবা নিদেন পক্ষে নেট মাধ্যমে প্রাপ্ত লাল্লার বাখগুলি পাঠ করার আন্তরিক অনুরোধ রাখলাম সকল পাঠকের কাছে।