সাধারণ মানুষ ব্যাংকে টাকা পরিচিত রাখেন কিঞ্চিৎ সুদ পাবেন বলে। শুধু তাই নয়। ঘরে টাকা রাখলে চুরি যেতে পারে। পুড়ে বা ভিজে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। অথবা সরকারও কোনদিন বলে উঠতে পারেন যে আজ থেকে এই নোটগুলো বাতিল। তখন ঘরে সঞ্চিত টাকার পুরোটাই নষ্ট। এইসব ফাঁড়া-গর্দিশ থেকে বাঁচার জন্যও মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখেন।
তবুও ব্যাংকে টাকা রাখলেই কি সব সময় তা নিরাপদে থাকে? আমরা কি দেখিনি বা শুনিনি কখনো ব্যাংক ফেল করতে? আগেকার দিনে এইরকম ব্যাংক ফেল করলে সাধারণ মানুষের গচ্ছিত টাকা অনেক ক্ষেত্রে পুরোটাই জলাঞ্জলি যেত। ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেল, টাকাও ঘরে ফেরত এলো না। যদিও সচরাচর এই জাতীয় ঘটনা ঘটে না; তবুও যখন ঘটে তখন অনেক মানুষকে সর্বস্বান্ত করে দিয়ে যায়।
অর্থনীতিবিদরা এই ঘটনাগুলো নিয়ে দীর্ঘকাল চিন্তাভাবনা করে এসেছেন। যেকোনো বিপর্যয়ের ঘটনা আলোচনা করতে গিয়ে তার দুটো দিক দেখা হয়। প্রথম, এই ধরনের ঘটনা কেন ঘটতে পারে, কি পরিস্থিতিতে, সেটা বিচার করা। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হলো এই রকম কোন বিপর্যয় ঘটলে তার থেকে সাধারণ মানুষকে কি করে পরিত্রান দেওয়া যায় ।
মজার ব্যাপার হচ্ছে এই ব্যাংক ফেলের ঘটনা সাধারনত কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা হয় না। এর একটি ডমিনো এফেক্ট থাকে। মানে যখন দেখা যায় যে কোন একটি ব্যাংক মানুষের বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে, তখন অন্যান্য ব্যাংক ও একই ফাঁদে পড়ে যেতে পারে। কোন কারণে একটি ব্যাঙ্ক যখন তার গ্রাহকদের টাকা ফেরৎ দিতে পারেন না, সেই আতঙ্ক অন্য ব্যাঙ্কের গ্রাহকদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।
তখন দলে দলে সব ব্যাংকের গ্রাহকরা টাকা তোলার চেষ্টা করেন। যেহেতু কোন ব্যাংকের কাছেই নগদ টাকার পরিমাণ বেশি নয় তাই সবাইকে টাকা ফেরত দেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠেনা । তখনই শুরু হয় আতঙ্ক, ব্যাংকের ওপর চাপ ক্রমশ বাড়তে থাকে। চেষ্টা করলেও ব্যাংকের পক্ষে সব টাকা ফেরত দেয়া সম্ভব নয়। তখনই শুরু হয় বিভিন্ন অপ্রীতিকর অবস্থা। যেহেতু অনেক লোকের সর্বস্ব গচ্ছিত আছে ব্যাঙ্কগুলির কাছে, তাই সরকারকে রাস্তায় নামতে হয়। শুধু গ্রাহকদের বোঝালে হবেনা, তাদেরকে টাকা ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। খুব বড় ব্যাংক হলে সরকারের পক্ষেও সেটা যথেষ্ট চাপের। তাই শেষমেষ সবাইকে টাকা ফেরত দিয়ে গচ্ছিত টাকা ফেরত দিয়ে হয়তো খুশি করা সম্ভব হয় না । এভাবেই সমাজে তথা অর্থনীতিতে একটা বড় চাপ নেমে আসে যার ফলশ্রুতি শুধু ব্যাংকের গ্রাহকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনা, সম্পূর্ণ অর্থনীতিতেও তার বিরূপ প্রভাব পড়ে। ব্যাংকগুলোও গ্রহীতাদের ঋণ দিতে সংকোচ বোধ করে। তাই সমগ্র অর্থনীতির চাকা ধীর হয়ে যায়, যার ফলশ্রুতি হতে পারে একটি দীর্ঘমেয়াদী মন্দা।
আমরা জানি যে ব্যাংকে সাধারণত ক্ষুদ্র গ্রাহকেরা অল্পবিস্তর বা বেশি টাকা রাখেন সেভিংস খাতা বা স্থায়ী আমানতে। এগুলি প্রায় সব নগদের মতই কাজ করে। যখন দরকার মোটামুটি তখনই এই টাকা তোলা যায় বা তোলা যাবে বা তোলা যাবে এই আশ্বাস ব্যাংক কর্তৃপক্ষ দিয়ে রাখেন। নগদ টাকার দরকার হয় মানুষের কিছু বিশেষ অবস্থায়। যেমন মেয়ের বিয়ে দিতে হলো বা মা কি বাবার অসুখ। তখন ব্যাংকে সঞ্চিত টাকা বা স্থায়ী আমানত মানুষ ভাঙ্গার কথা ভাবেন।
মোটামুটি একটা হিসেব আছে যে প্রত্যেক মাসে কত শতাংশ মানুষের এইরকম নগদ টাকার দরকার হতে পারে। সেই অনুযায়ী ব্যাংক কিছু পরিমাণ টাকা নগদ রাখে, যেটা তারা কাউকে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ দেয় না । এমনকি সরকারের তরফে একটা মাপ করে দেওয়া আছে, যে ব্যাঙ্কগুলিকে তাদের গ্রাহকদের সঞ্চিত অর্থের একটি অংশ নগদ হিসেবে রাখতে হবে। একেই বলে এস এল আর স্ট্যাটিউটরি লিকুইডিটি রেশিও। আবার আরেকটি আছে ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও বা সি আর আর। মোটকথা এই দুটির সমপরিমাণ অংশ ব্যাংককে নগদ রাখতেই হবে। এর ওপরেও কোন ব্যাঙ্ক নগদ রাখতে পারে; যদি মনে হয় যে তার গ্রাহকেরা আরও নগদ টাকা তুলতে চাইতে পারেন।
অন্যদিকে ব্যাংক থেকে যারা ঋণ নেন সেই ঋণের অর্থের পরিমাণ অনেক বেশি এবং সেই দিনের পরিশোধের সময় বেশ লম্বা । সেই কারণে যারা ঋণ নেন, তারা অনেক বেশি সুদ গোনেন এবং যারা টাক সঞ্চিত রাখেন তারা কম সুদ পান।
আবার যারা ঋণ নেন তাদের কাছে চটকরে চাইলেই টাকা ফেরত পাওয়া যায় না কারণ সেই টাকা তারা লাগিয়ে দিয়েছেন হয় বাড়ি কিনতে নয় মোটর গাড়ি কিনতে। অথবা যদি ব্যবসায়ী হন তাহলে কোন কারখানায় বা কাঁচামাল কিনতে। অন্তত এটা তারা দাবি করেন। তাই ব্যাংক চাইলেও তাদের কাছে সেই টাকা হঠাৎ করে ফেরত পাবেন না। ব্যাংকের সাথে তাদের কড়ারই থাকে যে টাকা অল্প অল্প করে দীর্ঘদিন ধরে ফেরত দেওয়া হবে। এটা সাধারণভাবে যেকোনো ব্যাংকের কর্মপদ্ধতি।
ব্যাংক ঋণ গ্রহীতাদের থেকে সেই পরিমান টাকাই মাসে মাসে ফেরৎ নেওয়ার ব্যাবস্থা রাখে যাতে করে সাধারণ অবস্থায় প্রতিমাসে গ্রাহকদের নগদ এর চাহিদা মেটানো যায়।
যতক্ষণ এভাবে চলে, অর্থাৎ গ্রাহকদের নগদ এর চাহিদা ঋণগ্রহীতাদের ফেরত দেয়া টাকার সমান বা কম, ততক্ষণ অব্দি কোন সমস্যা নেই। কিন্তু হঠাৎ করে কোনো কারণে যদি বেশ কিছু গ্রাহকের নগদের দরকার হয়ে পড়ে তখনই হয় সমস্যা। ব্যাংকের কাছে থাকা নগদ প্রায় শেষ হয়ে আসে। এবার যেই নগদ শেষ হয়ে আসার খবর সাধারণ্যে প্রকাশ হয়ে পড়ে, তখন সেই ব্যাংকের গ্রাহকদের মধ্যে একটি ভীতির সঞ্চার হয়। অনেক গ্রাহক তখন সেই ব্যাংক অভিমুখে গিয়ে টাকা তোলার চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্যাংকের টাকা তো আগেই শেষ । সুতরাং কিছু গ্রাহক টাকা ফেরত পেলেন না। এবার এতক্ষণ যেটা ভয় ছিল সেটাই সত্য হয়ে পড়ল। তাসের ঘর সত্যিই ভেঙ্গে পড়লো। এই অবস্থাকেই আমরা বলি ব্যাংক ফেল করেছে।
কিন্তু যদি একটু তলিয়ে ভাবি, তাহলে দেখা যাবে যে ব্যাংকের ব্যাবসা কিন্তু সত্যিকারে ফেল পড়ে নি। খালি নগদ অর্থের জোগান কমে গেছে। ব্যাঙ্কের টাকা রয়ে গেছে ঋণগ্রহীতাদের কাছে। এবং আগেই বলেছি তারা সেই টাকাটা নগদ ধরে রাখেন নি, বরং খরচ করে ফেলেছেন বা ব্যাবসায় বিনিয়োগ করে ফেলেছেন। তাদের ধারণা ছিল যে ভবিষ্যতের আয় থেকে ধীরে ধীরে তারা সেই টাকা ব্যাংককে ফেরত দেবেন। তাই এরকম হঠাৎ করে আসা অবস্থায় তাদেরও হয়তো কিছু করার নেই।
অর্থনীতিবিদরা এই ব্যাংকে ফেলের ব্যাপারে ঠিক কী রকম মতামত রেখেছেন? ১৯৮৩ সালে প্রফেসর ডগলাস ডায়মন্ড ও ফিলিপ ডিবুইগ, যথাক্রমে শিকাগো ও ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, একটি পেপার লেখেন জার্নাল অফ পলিটিকাল ইকোনমিক্স এ। এই প্রবন্ধের, বা তাঁদের সামগ্রিক কাজের, যা এই প্রবন্ধ প্রকাশের আগে বা পড়ে ছড়িয়ে আছে, তার মূল প্রতিপাদ্য ছিল কিভাবে একটি ব্যাংক ফেলের দিকে চলে যেতে পারে; এবং তার থেকে কিভাবে ত্রান পাওয়া যায়। তাঁদের এই সামগ্রিক কাজের জন্য, এই দুই অর্থনীতিবিদ এবছর, ২০২২ সালে, নোবেল পুরস্কার (বা অর্থনীতি তে নোবেল স্মৃতি পুরস্কার) পেলেন।
এই দুজন অর্থনীতিবীদ অংক কষে দেখিয়ে গিয়েছিলেন যে কোন কোন অবস্থায় একটি ব্যাংক এরকম আতঙ্কের শিকার হতে পারে এবং তারপর ফেল করতে পারে। খুব বেশি অংকের মধ্যে না ঢুকেও বলা যায় যে কোন এক দিন বা সপ্তাহে যদি একটি নির্দিষ্ট অংশের বেশি গ্রাহক তাদের সঞ্চয় তুলে নিতে চান তাহলে কোন ব্যাংক এরকম ধসের মুখে পড়তে পারে।
অঙ্কের মধ্যে না গিয়েও আমরা বলতেই পারি যে এটা তো একটা সাধারন বুদ্ধিতে বোঝা যায় যে ব্যাংক কেন ফেল করবে। কিন্তু এর থেকে বাঁচার কি উপায়?
এঁরা দুজন বিভিন্ন জায়গায় মূলত তিনটে উপায়ের কথা বলেছেন, যেগুলো মেনে চললে এই ব্যাংক ফেল হওয়ার থেকে; এবং তার থেকেও বড় কথা, দেশের অর্থনীতির তাসের ঘর হওয়া থেকে, মানে একটি ব্যাংক থেকে আরেকটি ব্যাংক এবং তার থেকে সমগ্র অর্থনীতি, না হোক অর্থনীতির একটা বড় অংশের অবশ্যম্ভাবী ধসের মুখে পড়ার থেকে; পরিত্রান পাওয়া যাবে।
তাদের বলা প্রথম উপায় ছিল, যে ব্যাংকের তরফ থেকে একটি নিয়ম বা নীতি তৈরি করা, যেখানে বলা থাকবে যে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যার গ্রাহকের পরে বা একটি নির্দিষ্ট অংকের টাকা তোলা হয়ে গেলে তার থেকে বেশি টাকা তুলতে দেওয়া হবে না। বা অন্য ভাবে বলা যায় যে কোন গ্রাহক তার সঞ্চিত টাকার একটা অংশের বেশি একদিনে বা একমাসে তুলতে পারবেন না। একে ব্যাংকিং পরিভাষায় বলে সাসপেনশন অফ পেমেন্টস। এই ব্যাবস্থার সবচেয়ে বড় সমস্যার দিক হল; কারো যদি সত্যিকারের বিপদ হয়; তখন সে ব্যাঙ্ক থেকে তার নিজের টাকাই তুলতে পারবে না। ব্যাঙ্কের পক্ষে কার প্রয়োজন খাঁটি আর কার নয়; তা বোঝা অসম্ভব বলা যায়।
এর কাছাকাছি আরেকটা ব্যাপার হতে পারে যে ব্যাংক বলল যে কেউ যদি টাকা তুলে নিতে চান তাহলে তিনি পুরো টাকা ফেরত পাবেন না মানে তার যদি এক লাখ টাকা গঠিত থাকে গচ্ছিত তাহলে তিনি পুরো টাকা তুলতে চাইলে আশি হাজার টাকা পাবেন, বাকিটা ব্যাংকে ফেরত দেবে না কারণ তিনি অসময়ে টাকা তুলতে চাইছেন।
এই ব্যাপারটাকে খুব গণতান্ত্রিক বলা যায় না, এমনকি মানবাধিকার লঙ্ঘনের দোরগোড়ায় বলা যায়। এছাড়াও, অনেক অনুন্নত দেশে সাধারণ মানুষ তার সমস্ত সঞ্চয় এর কোন অংশ ফেরত পাবেন না, এটাও মেনে নেওয়া যায় না। যদিও এরকম নীতির একটা সুবিধে হল, যে সত্যিই কারো যদি টাকা দরকার না থাকে, তিনি কেবলমাত্র ভয়ের শিকার হয়ে টাকা তুলতে গিয়েছিলেন, তিনি হয়তো নিজেকে স্বেছায় নিরস্ত করতে পারবেন। এবং ব্যাংকও ওই নগদ টাকা নিজের কাছে রাখতে পারবে।
দ্বিতীয় উপায় গুলি তাঁরা বলেছিলেন সরকারের এগিয়ে আসা। এক, সরকার বলতে পারে যে ব্যাংকের যত টাকা দরকার গ্রাহকদের ফেরানোর জন্য, তা কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা বড় কোন সরকারি ব্যাঙ্ক দিয়ে দেবে। অবশ্যই খানিকটা সুদ নিয়ে। সুদের হার কত হতে পারে, যাতে ব্যাংকের ব্যবসা চালু থাকে আবার সরকারেরও ক্ষতি না হয়, সেটাও অংক কষে এই দুই অর্থনীতিবীদ দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। ২০০৮/৯ সালে আমেরিকায় যে আর্থিক সংকট দেখা দিয়েছিল, তার ফলশ্রুতিতে কয়েকটি বড় ও মাঝারি ব্যাঙ্ককে বাঁচাতে সরকার এই রাস্তাই নিয়েছিলেন। যদিও এই ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় সমালোচনা হলো, যে সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের টাকায় কিছু গ্রাহকের বা কতিপয় ব্যাংকের সুবিধা করে দেওয়া হল । যখন লাভ হবে, ব্যাংক কি সেই লাভ সরকারের সাথে এইভাবে ভাগ করে নেবে?
মজার ব্যাপার হল, ২০০৮/৯ সালে এই উপায় যিনি প্রস্তাব করেছিলেন শুধু না; প্রয়োগও করেছিলেন, ফেডারেল রিসার্ভের তৎকালীন সভাপতি, বেন বারনাঙ্কে, এবছর উপরিউক্ত দুজনের সাথে নোবেল পুরস্কার ভাগ করে নিয়েছেন।
তৃতীয় আরেকটি উপায়ের কথা এই প্রবন্ধে বলা হয়েছিল। মনে করা হয়, যে এই তৃতীয় উপায়টিই সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য। প্রায় সমস্ত উন্নত দেশেই এই উপায় ব্যাবহার করা হচ্ছে। কি সেই উপায়? কোন গ্রাহক যখন ব্যাংকে টাকা সঞ্চয় করতে যাচ্ছেন, তখনই তাকে বলে দেওয়া হল, যে সরকার এই টাকার গ্যারান্টি দিচ্ছে। মানে ব্যাংক ফেল করলেও সরকার এই টাকা গ্রাহকদের ফেরত দেবে। একে বলা হয় ডিপোজিট গ্যারান্টি স্কিম। এর জন্য খুব সামান্য ইন্সুরেন্স প্রিমিয়াম নেওয়াও হতে পারে গ্রাহকদের থেকে, আবার সরকারের আয়ের টাকা থেকে এই টাকা মিটিয়ে দেওয়া যেতে পারে, যদি দরকার হয়।
ভেবে দেখলে, এটা সরকারের তরফে একটি বিরাট টাকার গ্যারান্টি দেওয়া। এতগুলো ব্যাংক, তাদের এতজন গ্রাহক, এবং তাদের সঞ্চয়ের পরিমাণ কিন্তু প্রায় একটি মহাজাগতিক আকারের সংখ্যা। সত্যিই যদি অঘটন ঘটে, এবং কয়েকটি বড় বড় ব্যাংক একসাথে ফেল করে যায়, তাহলে এই টাকা কি সরকারের পক্ষে দেওয়া সম্ভব হবে? যদিও পৃথিবীতে এরকম ঘটনা ঘটেনি এখনও।
আসলে এই ব্যবস্থার মজাটা লুকিয়ে আছে এই সরকারি আশ্বাসের মধ্যে। যেহেতু সরকারের পক্ষ থেকে এই গ্যারান্টি দেওয়া হচ্ছে; তাই সাধারণ মানুষের মনে বা গ্রাহকদের মনে এই ভয়টা আসবে না যে আমার ব্যাংক ফেল করে গেলো আমাকে এক্ষুনি টাকা তুলে নিতে হবে। মানে ওই আতঙ্কের পরিবেশই তৈরি হবে না, বা এক্ষুনি টাকা তুলে নেওয়ার গোষ্ঠী মানসিকতাটা তৈরিই হবে না। বরং যদি কোন ব্যাঙ্ক কিছু সময়ের জন্যও নগদের জোগান হারিয়ে ফেলে; এই গ্যারান্টি থাকার দরুন সাধারণ গ্রাহকেরা তাতে খুব বিচলিত হবেন না; একথা বলাই যায়।
অর্থাৎ সরকার এই গ্যারান্টি দিয়ে এটাই মানুষকে বুঝিয়ে দিল যে ভয়ের বশে টাকা তোলা দরকারই নেই। কেবলমাত্র খাঁটি দরকারেই টাকা তুলুন।
সেইজন্য এই ব্যাবস্থাটিকেই সবচেয়ে বেশি সফল হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। সত্যিকারের কোন টাকা যোগান না দিয়েও, সাধারণ মানুষকে কেবল একটি দৃঢ় আশ্বাস দিয়েই ব্যাঙ্ক ফেল কে রোখা সম্ভবপর হবে।
যদিও এই সমস্ত তত্ত্ব তৈরি হয়েছিল আমেরিকার কথা মাথায় রেখে, এবং প্রয়োগ ও করা হয়েছিল সে দেশে। তাই আমেরিকায় খুব বড় ব্যাংক ফেলের ঘটনা ঘটেনি, তেমন বা ঘটলেও সেখানকার সরকার সেটাকে পুরো অর্থনীতি জুড়ে ছড়িয়ে পড়তে দেয়নি।
কিন্তু আমাদের দেশের অবস্থা কি? আমার টাকা কি এদেশে আদৌ সুরক্ষিত? রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার একটি ব্যাবস্থা আছে, যার নাম ডিপোজিট ইনসিওরেন্স অ্যান্ড ক্রেডিট গ্যারান্টি কর্পোরেশন । এই ব্যবস্থার আওতায় আছে ভারতবর্ষের সমস্ত ব্যাংক, সরকারি-বেসরকারি সমবায় ব্যাঙ্ক সবাই। রিসার্ভ ব্যাঙ্ক এই ব্যাঙ্কগুলির সমস্ত গ্রাহকদের এই গ্যারান্টি দিয়ে থাকেন, যে তাদের সঞ্চিত টাকা সুরক্ষিত। যদি কখনো ব্যাংক এই টাকা ফেরত দিতে অপারগ হয়, রিজার্ভ ব্যাংক সেই টাকা দায়িত্ব নিয়ে ফেরত দেবেন।
যদিও এখানে একটি কিন্তু আছে। তা হল, এই স্কিমের আওতায় কোন একজন গ্রাহক সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা ফেরত পেতে পারেন, তার সমস্ত অ্যাকাউন্ট মিলিয়ে। এর থেকে বেশি টাকা কোন একজন গ্রাহক কে রিজার্ভ ব্যাংক দেবেনা। কেউ ভাবতেই পারেন তাহলে তো আমার সম্পূর্ণ টাকা সুরক্ষিত নয়। অবশ্যই সেটা ঠিক। কিন্তু দেশের একটি সুবৃহৎ অংশের গ্রাহকদের কাছে এই পাঁচ লাখ টাকা অনেক। বেশিরভাগ গ্রাহকই এই পাঁচ লাখ টাকার আওতার নিচে আছেন ফলে তাদের ক্ষেত্রে পুরোটাই সুরক্ষিত হয়ে গেল। আর সত্যিই যদি আপনার পাঁচ লাখ টাকার ওপরে ব্যাংকে থাকে, তাহলে তো আপনি বড়লোক। সেক্ষেত্রে আপনার পাঁচ লাখ টাকা ফেরত পাওয়াই কি যথেষ্ট নয়?
আর একটি কথা বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার। এই স্কিম সমস্ত ব্যাংকের জন্যই প্রযোজ্য; শুধু সরকারি ব্যাংক নয়। ফলে আগামীবার যখন কোন সরকারি ব্যাংকের দালাল আপনাকে বোঝাতে আসবেন যে বেসরকারি ব্যাংকে টাকা রাখলে আপনার টাকা মার যেতে পারে, ফেরত নাও পেতে পারেন তাকে এই স্কিমের তথ্যটা দিয়ে দেবেন। বলবেন যে আমাদের দেশের আইন সরকারি বা বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে কোন তফাৎ করে না, টাকা যেখানেই রাখি না কেন সমান সুরক্ষিত।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।