খুব বেশি আগের কথা নয়। মেট্রো স্টেশনে যখন ট্রেনের জন্য অপেক্ষায় থাকতাম, প্ল্যাটফর্মের স্ক্রিনে মাঝেমধ্যেই প্রচারিত হত বেঁচে থাকার জন্য সচেতনতা মেশানো পনেরো কুড়ি সেকেন্ডের একটা ক্লিপিং। বলা হত, দুম করে জীবন শেষ করে দেওয়া কোনও কাজের কথা নয়। কয়েকটা নম্বর উঠে আসত ওই এলসিডি পর্দায়। সঙ্গে ছিল উপদেশ – মন খুব খারাপ লাগলে, জীবনে শুধু অন্ধকার দেখতে পেলে এই নম্বরে ফোন করুন।
প্ল্যাটফর্মের থিকথিকে ভিড়ের মধ্যে ক’জন লোক খুব মনখারাপ নিয়ে মিশে থাকেন, তা আমাদের জানার কথা নয়। তবে এমন আশা করে সুখ হয়, দূর থেকে আসা ট্রেনের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ার ইচ্ছে নিয়ে যাঁরা প্রহর গুণতেন, তাঁদের মধ্যে অন্তত একজনও হয়তো এমন বিজ্ঞাপন দেখে জীবনটাকে আবার নতুন করে সাজানোর কথা ভেবেছিলেন।
ওই ক্লিপিং আর তেমন দেখি না আজকাল। বলিউড-টলিউডের বাহারি গসিপ আর মন ভোলানো পণ্যের নানা চটকদার বিজ্ঞাপনে চাপা পড়ে গিয়েছে আত্মহত্যা রোধের জন্য ওই সরকারি প্রচার। দেরি করে হলেও রেলকর্তারা হয়তো বুঝেছেন, হেল্পলাইনের নম্বর দেখিয়ে মাসের শেষে রেভিনিউ আসে না।
একবার মেট্রো স্টেশনে পরবর্তী ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করার সময় মৃত্যু দেখেছিলাম। ডেস্কটপ থেকে যেভাবে এক ক্লিকে ফাইল পাঠাই রিসাইকল বিনে, মাঝবয়সী লোকটার জীবনও শেষ হয়েছিল একইরকমভাবে। এই আছে, এই নেই। আর যে মানুষটি চলন্ত ট্রেনের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, তাঁর হবু সহযাত্রীরা দু’ অক্ষর-চার অক্ষর যোগ করে বলেছিলেন, ‘আর মরার সময় পেল না!’ শুনেছিলাম, ‘ফালতু মালটা আজ অফিস লেট করিয়ে দিল।’ ‘যত্তসব।’ চাকার লীলায় দু’ভাগ হয়ে যাওয়া শরীরটার কানে এ কোলাহল প্রবেশ করেনি। হয়তো মনের কথাগুলো বলার জন্য তিনি লোক খুঁজেছিলেন অনেকদিন। পাননি।
আমরা তো সামাজিক জীব। তাই জানি, আলকাতরার মতো কালো যখন আমাদের মনকে, শরীরকে খেয়ে নিতে শুরু করে ক্রমশ, আলোর চেয়েও অনেক বেশি অন্ধকার নিয়ে প্রতিটা সকালের কু-উদয় হয়, তখন আমরা পাগলের মতো লোক খুঁজি। মনের কথাগুলো কাউকে বলতে পারলে হয়তো আপাত-আরাম হয়। ইংরিজিতে এরই নাম কি ভেন্টিং আউট? হবে হয়তো। খুঁজি। খুঁজতেই থাকি। পাই না।
এই না-পাওয়া লোকদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে বলেই কি ৫০ বছরের মধ্যে এ দেশে আত্মহত্যাকারীর সংখ্যা আকাশ ছুঁয়ে ফেলল? ঊর্ধ্বগতিতে বেড়ে চলা কোনও স্টকের আদলে যেন অবিকল তৈরি হয়েছে ভারতবর্ষে আত্মহত্যার গ্রাফ। প্রতি বছরের পারফরম্যান্স তার আগের বছরের সংখ্যাকে বুড়ো আঙুল দেখায়। সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে এনসিআরবি অর্থাৎ ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর পরিসংখ্যান। অনেক কিছুর সঙ্গে এতে স্থান পেয়েছে আত্মহননের সংখ্যাও। জানা যাচ্ছে, ২০২১ সালে ভারতবর্ষে নিজের জীবনে নিজেই দাঁড়ি টেনেছেন ১৬৪০৩৩ জন। ২০২০ সালের তুলনায় এই সংখ্যাটি বৃদ্ধি পেয়েছে ৭.২ শতাংশ। ২০২০ সালে আত্মহত্যা করেছিলেন ১৫৩০৫২ জন। ওই পরিসংখ্যানই বলছে, ২০১৬ সালে দেশের প্রতি লক্ষ লোকের মধ্যে আত্মহননের পথ বেছে নিতেন ১০.৩ জন। ২০২০ সালে সেই সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১.৩। ১৪০ কোটি জনসংখ্যার দেশের জন্য এমন হার শিউরে ওঠার মতো। সমাজের ভাল-মন্দ নিয়ে যাঁরা মাথা ঘামান, তাঁদের একটা বড় অংশ মনে করছেন, আমাদের যদি সার্বিকভাবে এই মুহূর্তে টনক না নড়ে তা হলে আগামী দিনে পরিস্থিতি হতে চলেছে ভয়াবহ।
নয়া সামাজিক ব্যাকরণ আমাদের শিখিয়েছে, দরকার ছাড়া কথা বলা নিষ্প্রয়োজন। আমরা ছোটবেলা থেকেই মনের সার্কিট বোর্ডে গেঁথে নিয়েছি, পৃথিবীটা যেহেতু বড় কঠিন ঠাঁই, তাই নিজের ভালটা বুঝে নিতে হবে নিজেদেরই। জানি, তুমুল প্রতিযোগিতার বাজারে ‘পরের ছেলে পরমানন্দ, যত উচ্ছন্নে যায় তত আনন্দ।’ ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টোয় যত, এই সামাজিক রুলবুক আমরা মেনে চলতে চেষ্টা করি অক্ষরে অক্ষরে। গুরুজনদের শেখানো বুলির মতো জানি, কেউ ‘কেমন আছো’ জিজ্ঞেস করলে ঘুরিয়ে বলতে হয়, ‘আমি ভালো আছি। তুমি ভালো আছো তো?’ মাল্টিপল চয়েস দেওয়া প্রশ্নের মতো এর কয়েকটা সম্ভাব্য উত্তর রয়েছে। ‘ভালো আছো তো’-র উত্তর হতে পারে, ‘ভালো আছি’, ‘এই চলে যাচ্ছে’ কিংবা ‘চলছে মোটামুটি’। এই তিনটের মধ্যে যে কোনও একটাতে টিক মেরে দিয়ে পরের প্রসঙ্গে চলে যেতে হয়। অবশ্য, যদি দরকার মনে হয়। আমার প্রশ্নের উত্তরে যদি ও-প্রান্ত থেকে উড়ে আসে, ‘একেবারেই ভাল নেই ভাই’, তাহলে আমরা প্রমাদ গুণি। ‘সে কী, কী হল আবার’ বলার পরেই আড়চোখে ঘড়িটা দেখে নিই একবার। ভাল না থাকার বিবরণ যদি প্রলম্বিত হতে থাকে, নানা শারীরিক ভঙ্গিতে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি, এবার তোমার থেমে যাওয়াই ভাল। মনের মধ্যে অনুরণন হতে থাকে, ‘তোমার হেডেক তোমার হেডেক। তাতে আমার কী!’ কথা শেষ হয়। অন্য মানুষটিকে আশ্বাস দিই পাশে থাকার। কয়েকদিন পর তার ফোন এলে সেটা নিমেষে কেটে দিয়ে টেমপ্লেট করা বার্তা পাঠিয়ে দিই মোবাইলে। বিজি রাইট নাউ। কল মি লেটার।
আজাদির ৭৫ বছরের অমৃত মহোৎসব, খিদের সূচকে আমাদের দেশকে শেষ বেঞ্চের ছাত্র-র তকমা দিয়েছে। তবে আত্মহত্যাকারীদের সংখ্যায় আমরা জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন পেয়েছি। ‘বেটি বঁচাও বেটি পড়াও’-এর দৌলতে মুখ ঢেকেছে সরকারি বিজ্ঞাপনে, পোস্টার-ব্যানার-ফ্লেক্সে। কিন্তু সেই একই দেশের মহিলাদের মধ্যে আত্মহননের হার বাকি পৃথিবীর মহিলাদের দ্বিগুণ।
এনসিআরবি-র রিপোর্টের প্রতিটা পাতার প্রতিটা অক্ষর আমাদের কার্যত মুখ লুকোবার জন্য হাতছানি দেয়। এক পরিচিত মনোবিদকে বলতে শুনেছিলাম, ‘এক সুস্থ ব্যক্তিকে অবসাদগ্রস্ত করে তোলার জন্য এই রিপোর্টের পাতাগুলোর সঙ্গে এক ঘণ্টার সান্নিধ্যই যথেষ্ট।’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, শূন্যের দিকে তাকিয়ে এর পরে বলেছিলেন, ‘অথচ আমরা কিছুই করতে পারছি না।’
কোথায় যেন পড়েছিলাম, ‘আমাদের মন যদি এক কোম্পানি হয় তার কাস্টমার কেয়ারের নম্বর কই?’ শব্দগুলো ভাবিয়েছে বহুদিন। খবরের কাগজে বিরাট হাসপাতালের পাতাজোড়া বিজ্ঞাপন বলে, হার্ট চিনচিন করলেই ফোন করুন এ নম্বরে। হঠাৎ সেরিব্রাল অ্যাটাক? আমরা আছি কী করতে? বলে, নম্বরটা সেভ করুন এখনই। এমন বিজ্ঞাপন দিনের পর দিন দেখে আমরা বুঝে গিয়েছি গোল্ডেন আওয়ারের প্রতিটা সেকেন্ডের মহিমা। দেখেছি, হাজারো অসুস্থতার জন্য রয়েছে লক্ষাধিক ম্যাজিক দাওয়াই। ছবি দেওয়া বিজ্ঞাপন বলে, এই ডাক্তার ইতিমধ্যেই বদলে দিয়েছেন পঁচিশ হাজার হাঁটু। বেঙ্গালুরু থেকে আসছেন মাত্র এক বেলার জন্য। নাম লেখান, নাম লেখান। অবাক হয়ে দেখি, মানসিক রোগের চিকিৎসা নিয়ে কোথাও কোনও উচ্চবাচ্য নেই। যে দেশে প্রতিদিন সাড়ে চারশ’ মানুষ আত্মহননের পথে হাঁটছেন, তার লাগাম টানা নিয়ে আমরা আশ্চর্যজনকভাবে নীরব। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে কেন্দ্রীয় সরকার কিরণ নামের একটি হেল্পলাইন চালু করেছিল। তবে মানসিক অবসাদে যাঁরা ভুগছেন, তাঁদের কত শতাংশ মানুষ এই হেল্পলাইন সম্পর্কে জানেন তা নিয়ে মনে প্রশ্ন জাগে। ওয়েবসাইট ঘেঁটে নম্বর জোগাড় করে ফোন করেছিলাম এই হেল্পলাইনে। প্রথম ৪৫ সেকেন্ড এই প্রকল্পটি নিয়ে হিন্দিতে ভাষণের পরে স্থানীয় ভাষায় কথা বলার জন্য অপশন আসে। আলাদা ভাষার জন্য আলাদা নম্বর প্রেস করার কথা বলে যায় যান্ত্রিক কন্ঠস্বর। বাংলা নির্বাচন করে দেখি রেডিওর ট্রান্সমিশন চলে গেলে যেমন রোবোটিক বিচিত্র আওয়াজ হত, ঠিক তেমন ভয়ঙ্কর এক জগাখিচুড়ি বাজনা বেজে চলেছে ফোনের ও’প্রান্তে। আমি চেষ্টা করেছিলাম নিজে পরখ করার তাগিদে। কিন্তু যে মানুষটির গলায় কীটনাশক ঢেলে দেওয়ার আগে কিংবা ফ্যান থেকে ঝুলে পড়ার পূর্বমুহূর্তে একবার কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে, তাঁর কাছে এই অপেক্ষাপর্ব সইবে তো? এর উত্তর মেলে না।
সামাজিক মাধ্যমে আঙুল বুলিয়ে এক পোস্ট থেকে অন্য পোস্টে যাওয়ার আগে, ইউটিউবে পছন্দের ভিডিও চালু হওয়ার আগে – হঠাৎ ভেসে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার বিজ্ঞাপন। কোনও দুঃস্থ মা দু’হাত জোড় করে তাঁর মুমূর্ষু শিশুর প্রাণভিক্ষা করছেন। কোনও সত্তরোর্ধ্বা শোনাচ্ছেন তাঁর সংসার ভেসে যাওয়ার কাহিনী। তারপরে আসে অর্থসাহায্যের আবেদন। ক্রাউডফান্ডিং। শারীরিক চিকিৎসার জন্য যেভাবে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো এগিয়ে আসছে, মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য এর সিকিভাগ প্রয়াসও চোখে পড়ে না। রক্তদানের জন্য যেভাবে শিবির করা হয় পাড়ায় পাড়ায়, যেমন করে স্থানীয় কাউন্সিলরের অনুপ্রেরণায় আয়োজিত হয় বিনাপয়সার হেলথ ক্যাম্প, তার কিছুটাও যদি মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য করা যেত, তাহলে হয়তো আখেরে মঙ্গল হত আমাদেরই। ডাক্তারবাবু প্রেশারটা মেপে দেওয়ার পরে তাঁর পাশে বসে থাকা মনোবিদ যদি বলে উঠতেন, ‘কী মশাই। প্রেশার তো হল। এবারে বলুন, মন মেজাজ ভাল আছে তো?’ আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এগুলো অলীক কল্পনার মতো লাগে। অথচ আমরা চাইলেই কিন্তু এগুলো করতে পারি সহজে। ইচ্ছে থাকা চাই।
ফেসবুক লাইভে আত্মহত্যা করার কথা আগাম জানিয়ে প্রশাসনিক তৎপরতায় প্রাণে বেঁচে গিয়েছেন এমন উদাহরণ রয়েছে প্রচুর। কিন্তু কত মানুষ সরকারি-বেসরকারি হেল্পলাইনে ফোন করে আরও একবার বাঁচার কথা নতুন করে ভেবেছেন, তা নিয়ে কোনও পরিসংখ্যান মেলে না। জীবনকে ফের ফিরে পাওয়া কোনও মানুষ যদি পরে এই হেল্পলাইন নিয়ে তাঁর মুগ্ধতার কথা জানাতেন, শেষ থেকে ফের শুরু করার কথা বলতেন, তা হতো এমন পরিষেবার সেরা প্রচার। এ নিয়ে আমাদের ভাবার সময় কই?
চিকিৎসকরা বলেন, মানসিক অবসাদ কর্কটরোগের থেকেও বেশি বলে বলীয়ান। কোনও আত্মহত্যাই অবসাদ ছাড়া হয় না। যে লোকেরা বেঁচে থেকেও প্রতিদিন মনের মধ্যে ব্লেড দিয়ে আঁচড় কেটে চলেছেন, প্রকৃত অর্থে তাঁদের বন্ধু হয়ে ওঠা ভীষণ ভাবে জরুরি।
অমুক ডে, তমুক ডে-র মতো আত্মহত্যা প্রতিরোধেরও একটা দিন আছে অবশ্য। ১০ সেপ্টেম্বর আমরা ফেলে এলাম বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস।
প্রতিরোধ শব্দটা যেন ইউক্যালিপটাস গাছের মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শেখে।