নব্বই সালের পর বিশ্ব রাজনীতিতে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। সে পরিবর্তনের আঘাত এত দ্রুতগতি সম্পন্ন ছিল যে বিশ্বের তাবড় বড় অনেক রাষ্ট্র ঝাপটে পড়েছে। অর্থনীতি মুচড়ে গেছে। রাষ্ট্রের সীমানা আর জনগণের নাগরিকত্ব বদলের সঙ্গে সঙ্গে দেশহারা হয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। পুঁজিবাদ নিপাত যাক বলে লাল ঝাণ্ডার পাণ্ডারা আর ফান্ডা দেখাতে পারছে না। বিপ্লব হিমঘরে। নেতাদের চরিত্র পালটে সম্পূর্ণ বিপরীতে এসে ঠেকেছে। সমাজতন্ত্র ভাগাড়ে আর ধর্মনিরপেক্ষতার মরণ হয়েছে। গণতন্ত্র সেজে উঠেছে ভোগবাদী আভিজাত্যে। এর সঙ্গে ধম্মো ধম্মো বোল উঠেছে আকাশ বাতাস মাটিতে, নদীতে। আজকাল দেখি অনেকেই স্ত্রী সহবাস, স্বামী সহবাসের দোআ মুখস্থ করার পাশাপাশি হাগতে যাওয়ার দোআও মুখস্থ করে ফেলছে। মন্দিরা শঙ্খ বাজিয়ে তিন বেলা সাড়ম্বরে পূজা করছে। পাঁচ বেলা পড়ে নামাজ পড়ে কপাল ঘষে ঈমানী ছাপ বসাচ্ছে। তবে ধর্ম যত জোরে শোরে দেশে দেশে, জাতিতে জাতিতে, ঘরে ঘরে, ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে দাঁত শূলাচ্ছে তারচে বেশী জোরে নৈতিকতা পালিয়ে গেছে। মানুষ বেশি বেশি মুসলমান হয়েছে। বেশি বেশি হিন্দু হয়ে গেছে।
অধিকাংশ রাষ্ট্রের ক্ষমতা চলে গেছে কতিপয় ব্যক্তির হাতে। জনগণ এখন ওয়ান টাইম ইউজের মত পণ্য। ইউজ শেষে ছিবড়ানো চুকলা। জনগণের চাইতে সরকার যখন বড় হয়ে যায় তখন রাষ্ট্রের প্রজাতান্ত্রিক মুখে কতিপয় দ্বারা চালিত সরকারের ইচ্ছে অনিচ্ছে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। রডের বদলে বাঁশ ঢুকে পড়ে উন্নয়নের গুহ্যদ্বারে। জনগণ রক্তাক্ত হয়। সরকার শলা দেয়, জোড়াতালির বিভিন্ন ‘প্রজেক্ট ডায়াপার’ পরাতে।
বিশ্ব রাজনীতির এই পরিবর্তনের দমকে বাংলাদেশের মত ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের আগাপাশতলা দলে গেছে নির্মমভাবে। নিকটতম প্রতিবেশী বৃহৎ ভারতের শাসন ক্ষমতায় ধর্মের জয়ধ্বজা উড়িয়ে এসেছে সনাতনপন্থী ধর্মপুত্ররা। সংখ্যালঘু মুসলমান এবং দলিতদের আর্তনাদ কাঁটাতার পেরিয়েও শোনা যাচ্ছে। কোনো কো্নো রাজ্যে, ফেসবুকে তীব্র ঘৃণা নিয়ে সংখ্যালঘু মুসলিমদের উদ্দেশ্যে বলা হচ্ছে, ভাগ কাটার দল, পাকিস্তান ভাগ যা, বাংলাদেশে চলে যা। ঘর, প্রাণ, উৎসব, প্রার্থনালয়ের পবিত্র মসজিদ গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। ভবন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারছে মুসলিমদের। গুম হয়ে যাচ্ছে মুসলিম প্রতিবাদী ছাত্ররা। পবিত্র মন্দিরে ধর্ষিত হচ্ছে মুসলিম কিশোরী । শিল্প সাহিত্য চলচ্চিত্রেও উগরে উঠছে মুসলিম বিদ্বেষ। মুসলিম শ্রমিককে আগুনে পুড়িয়ে সোল্লাসে ভিডিও করছে কাকা-ভাইপো।
তবে থেমে থাকেনি ভারতের প্রগতিশীল মানুষ। জাতি ধর্ম বর্ণ মিলেমিশে সরোষে প্রতিবাদ তুলেছে। কিন্তু খুন হয়ে যাচ্ছে প্রতিবাদীরা নতুবা জেল, জুলুমের ফাঁদে আটকে দিচ্ছে প্রতিবাদীদের। বাংলাদেশ কি করছে? সাম্প্রদায়িক পশুরা সাতচল্লিশের সেই লুটেরা ধারা বজায় রেখেছে। সংখ্যালঘুর ধন, প্রাণ, ঘর, প্রার্থনালয় জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে। ধর্ষণ করছে। গালি দিচ্ছে, যা শালা মালাউন, ইন্ডিয়া চলে যা।
অর্থাৎ সাম্প্রদায়িকতার পূজারীরা সহজভাবে বলে দিচ্ছে, হিন্দুর জন্য হিন্দু রাষ্ট্র চাই, মুসলিমদের জন্যে মুসলিম রাষ্ট্র চাই।
ব্যক্তিগতভাবে আমি বিশ্বাস করি, সাম্প্রদায়িকতার পিতা এক, মাতা দু'জন। এক মায়ের সন্তান হিন্দু, অন্য মায়ের সন্তান মুসলিম। পিতৃরক্তের আশীর্বাদ আর আদর্শে দু মায়ের সন্তানেরাই ঘৃণা, হিংসা, অশান্তি, বৈরিতা, হত্যা আর সন্দেহ বিদ্বেষে পরিপূর্ণ। সাম্প্রদায়িক দুটি শক্তিরই কাজকর্ম এক এবং অভিন্ন।
কিন্তু এত সহজে কি সরল অঙ্কের উত্তর মেলে ?
বাংলাদেশ প্রসঙ্গে বলতে পারি, বর্তমান বাংলাদেশের জনগণ কলার মান্দাসের মত দুলে যাচ্ছে আকূলপ্লাবিত ধর্মীয় জোয়ারে। কোন বিরোধী দল নেই। বিরোধী নেতা শূন্য রাজনীতির মোলায়েম চর্চা চলছে। যদিও অর্থনীতির চরম স্ফুরণ ঘটেছে। উন্নয়নে জোয়ার এসেছে। ওদিকে ব্যাংক লুটে যাচ্ছে। টাকা চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। সরকারী আমলা এবং ব্যবসায়ীরা মুদ্রার এপিঠ এবং ওপিঠ। আশ্চর্য হলেও সত্যি দেশের অভ্যন্তরে এক শ্রেণীর বাংলাদেশী ছেলেমেয়েরা বেড়ে উঠছে যারা বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করছে, ভাত পাচ্ছে না। সো হোয়াট! ফুড পাণ্ডা থেকে খাবার অর্ডার দিলেও তো হয়।
মধ্যবিত্ত শ্রেণী ক্রমশ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য লাগামহীন। বাজার মন্ত্রী এসি ঘরে থেকে বাজার নিয়ন্ত্রণ পর্যবেক্ষণ করেন। এদিকে সাধারণ ঘরের ছেলেমেয়েরা পাগলের মত কাজ খুঁজছে। দুটো পয়সার জন্যে চলে যাচ্ছে বিভিন্ন দেশে। কেউ কেউ ডুবে মরছে, বরফে মরছে, হারিয়ে যাচ্ছে, জেলে পচছে, উধাও হয়ে যাচ্ছে, নারী শ্রমিকরা ধর্ষিত হচ্ছে, পুড়ে মরছে, গৃহকর্তা আরব পুরুষের অবৈধ সন্তানের মা হচ্ছে, গরম পানিতে সেদ্ধ হচ্ছে, মরেও যাচ্ছে। কি অদ্ভুত দেশ মুসলিম আরব-জাহান। যে ধর্ষিতা হচ্ছে, তাকেই চরিত্রহীনতার দোষ দিয়ে জেলে পুরছে, বেহেশতি দণ্ডের ধর্ষক অর্থদণ্ড দিয়ে দিব্য থাকছে।
বাংলাদেশে এখন শঙ্কা বাজছে, দেশটি শ্রীলঙ্কার পথে চলছে না ত দেশ! দেউলিয়া হতে আর কত দিন বাকী আছে হে বীর বাঙ্গালী! এরকম অবস্থায় সংখ্যালঘুদের উপর হামলা, লুটপাট, জ্বালাও পোড়াও ঘটে যাচ্ছে। উদ্দেশ্য কি? বাংলাদেশকে কার্যত মুসলিম রাষ্ট্র বানিয়ে ফেলা? কেমন মুসলিম রাষ্ট্র? আফগানিস্তান মডেলের? হয়ত তাই। তাই ত নরসিংদীতে বয়স্ক এক নারী একজন তরুণী মেয়ের পোশাক নিয়ে কটূক্তি করে পুরুষদের সঙ্গী করে অই তরুণী এবং তার বন্ধুদের উপর হামলা করেছে। অতি সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নারী শিক্ষক স্লিভলেস পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করায় একজন দর্শনার্থী তরুণী এবং তার ফটোগ্রাফার বন্ধুকে যাচ্ছেতাই ভাবে হেনস্থা করেছে। আমার অনেক রাজনৈতিক বন্ধু, যারা বিভিন্ন ডান বাম মধ্য বা অদৃশ্য দল ভুক্ত বা সমর্থক তারা প্রায়ই একটি কথা বলে, ছোঃ দুই দিনের বৈরাগী, ভাতরে কচ্ছিস্ অন্ন। শালারা চায়ি দ্যাখ ভারতের লাগান(মত) বিশাল রাষ্ট্রে যদি মোদীভাই ক্ষমতায় আসতি পারে তো বাংলাদেশের মোল্লারা কি দোষ করিছে! আর শুনিছিস তো? এই নে এবার ভালো করি পড়ি দ্যাখ, ২০২৩ সালে ‘হিন্দু রাষ্ট্র হচ্ছে ভারত’ এমন ঘোষণা দিয়েছে বারাণসীর শঙ্করাচার্য পরিষদ নামে একটি সংগঠন। (আনন্দবাজার অনলাইন পত্রিকা, ১৬ আগষ্ট) তালু আফগানিস্তানের সঙ্গেও ‘চিনি চিনি মধু মধু’ সম্পর্ক গজিয়ে উঠছে ভারতের। এতে কিন্তু মোল্লারা মহাখুশী।
ওদের কথা শুনে মাঝে মাঝে খচ্চাৎ করে মগজে ছুরি মারে একটি ব্যাপার। খচমচ করে ওঠে চৌদ্দ ইন্দ্রিয়, প্রতিবেশী বৃহৎ রাষ্ট্রের ক্ষমতায় আসীন সৎ বড়ভাই সুযোগ পেলেই কি তার ক্ষুদ্র সৎ ভাইটিকে উস্কে দিচ্ছে, ম্যায়নে কর দিখায়া। তু নে ক্যা কিয়া ছোটু?
(ক্রমশঃ)