অগ্রহায়ণ মাসের ঝিম ধরা ভোরে যখন সূর্য নববধূর মত কুয়াশার ঘোমটার আড়াল থেকে পৃথিবীর দিকে আলতো চেয়ে থাকে, সেইরকমই কোন এক লাজুক সকালে সম্ভবত ভাড়াটে লগ্নে আমার জন্ম। ভাড়াটে জীবন কেমন যেন স্রোতের কচুরিপানার মত, ঘাটে ঘাটে দুদিনের বসতি। বাড়ি যে তাদের নয় তারা যে ঘাটের লোক নয়, স্রোতেই তাদের আসল জায়গা তা মনে করিয়ে দেওয়ার লোকের অভাব হয় না। ভাড়াটেদের ছেলেমেয়েদের অনেক সময়েই একটা প্রছন্ন ট্রেনিং থাকে। তারা কেমন করে যেন শিখে যায় বাগানের গোলাপ আগে বাড়িওয়ালার, তারপর গাছের। সদরের চিঠিবাক্সে তাদের বাবার চিঠি আসেনা, দরজার আশেপাশে পথে-পাথরে ভাড়াটেদের চিঠিগুলো ঠিকানা খুঁজে নেয়। চোখে পড়লে সেসব খুঁজে পেতে আনতে হয়।
সে যাই হোক, লাজুক সকালে জন্মেছিলাম বলে হয়ত আমি এসব খুব সহজেই শিখে নিয়েছিলাম। ভেসে থেকেছিলাম কচুরিপানার মতই। বাবা শেষ জীবনে একটুকু বাড়ি বানালেন কিন্তু আমার ভাড়াটে জীবন শেষ হল না। কারণ আমি ততদিনে গোত্র বদলে ফেলেছি, শহরও।
কর্তা তখনও পোক্ত কর্তৃপক্ষ হয়ে ওঠেননি। তাঁর গবেষণার সামান্য সাম্মানিকেই তখন দিন গুজরান হয়। তাই মহার্ঘ রাজধানী শহরে পরের বাড়ীতেই আমি চোদ্দ বাক্স বই, একটি গদি, আর একটি উনুন নিয়ে বানাই ভালোবাসার ঘুলঘুলি। এই ঘরটুকু খুঁজতে গিয়ে কতরকম জানা পরিচয়, কত ধরণের যে স্মৃতির কোলাজ।
কখনো হয়তো বাড়ি দেখতে গিয়েছি, অথচ পুরনো ভাড়াটে তখনো বাড়িটি ছেড়ে যাননি। তাঁরা নিজগৃহে চলে যাবেন তাই তাঁদের মালপত্র গাঁঠরি করে বাঁধা। ভাড়াটে গিন্নিই বাড়িটি আমাকে দেখিয়ে দেন। মালপত্র ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে আমিও তাঁর সাথে ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকি। তিনি বহুব্যবহৃত শ্যাওলাধরা কলঘর দেখান আর মুখে বলেন " জানো ভাই,আমার নতুন বাড়ির কলঘরটিতে লাগিয়েছি ঝকঝকে জয়পুরিয়া মার্বেল"। বাসাবাড়ির তিনদিক চাপা শয়নঘরটি দেখিয়ে বর্ণনা দেন তাঁর নতুন খোলামেলা ঘরের। তাঁর মুখের আলোয় বেশ বোঝা যায় গৃহিনীর মনটি ইতিমধ্যে ভেসে গেছে নবনির্মিত বাসগৃহে। আমিও ভাড়ারবাসা দেখে ফিরি সেই গিন্নির নতুন বাড়ির সুঘ্রাণ নিয়ে। তিনদিক চাপা সেই বাসা কোন কারণে আমাদের আর ভাড়া নেওয়া হয়না।
কখনো আবার বাসা ভাড়া হবার আগেই বাসার মালিক, গৃহিণী, মালিকের ছেলে সবাই ভাড়ার টাকায় তাঁদের অধিকারের কথা জানান। ভাড়ার টাকায় নিজেদের প্রয়োজন, নিজস্ব কোন অসহায়তার কথা বলেন। একটি বাসার জন্য তিনজনকে ভাড়ার টাকা দেওয়া সম্ভব নয়, তাই সেই বাড়িটিও বাতিল হয়ে যায়। অসহায়তার কাহিনীগুলো শুধু মনের মধ্যে দীর্ঘকাল বাসা বেঁধে থাকে।
কখনও কখনও আবার বীররসেরও অভাব হয়না। মৎসভুক বাঙালীকে ঘর দিতে মারমুখী অস্বীকার করে শাকাহারী প্রতিবেশী। আজন্মের খাদ্যাভাসের কারণে তিরষ্কৃত, অস্বীকৃত হয়ে ফিরে আসি। খেতে বসে মাছের কাঁটা গলায় আটকে যায়, কষ্টে চোখে জল আসে।
কোন ঘরে আয়নার ছোট লাল টিপ হয়তো নবীন দম্পতির ঘরবসতের গল্প বলে, আবার কোন ফাঁকা ঘরে প্রতিযোগিতার পরীক্ষার ফেলে যাওয়া বই কোন ছাত্রের দিনযাপনের কাহিনী শোনায়।
পরে পরে সংগতি ও সংসার উভয়ই একটু বাড়ার ফলে মেয়ের বাবা খোঁজেন একটু বেশী স্বাচ্ছন্দ্য। ততদিনে তিনি তরুণ অধ্যাপক। নিবিষ্ট মনে তিনি পরখ করে নেন সুরক্ষিত বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা, মজবুত দরজা। আমি খুঁজি মেয়ের জন্য একটুকরো কমলারোদ, বা খানিকটা সবুজ।
দরে ও দস্তুরে কখনো বা মিলেও যায়। উত্তর ভারতের শহরে হয়তো দক্ষিণী ব্রাহ্মণের বাড়িতে বাঙালী আমি, কন্যা ও ঘরকন্না নিয়ে আবার কিছু দিনের জন্য স্থিত হই।
ভিন্ন ভিন্ন বাস্তুকাঁটায় বোনা হতে থাকে আমাদের প্রবাসের নক্সাকাটা জীবন।
মাঝে মাঝে বেড়াতে যাই আবাসনের সামনের ভাঙ্গা কেল্লায়। কেল্লায় সাতশো বছরের পুরনো বাতাস জমাট বেঁধে আছে। এই দিল্লি শহরে মিথের মিহিজাল আর জীবনের সত্য একসাথে হাত ধরাধরি করে থাকে। সাতশো বছরের পুরনো কেল্লায়, ভাঙ্গা প্রাচীর দিয়ে ভিতরে রোদ পোয়াতে এসেছে আদ্যিকালের বৃদ্ধা। আজকের দরোয়ানেরা সেই হাজার বলিরেখার মালকিনকে আটকায়নি। বুড়ি তার যাবতীয় লেপকাঁথা, বিবর্ণ ঝুলে পড়া চামড়া আর ঘোলাটে চোখ নিয়ে ঢুকে পড়েছে কেল্লার পরিখা পেরিয়ে। আমি তার কাছে বসে কেল্লার মালিকের দাস্তান শুনি। বুড়ির গায়ের ছেঁড়া কাঁথায় কিসসার খোশবাই। আমি প্রাণভরে সেই খুশবু টেনে নিই। বুড়ি বলে, সেই কত শত বছর আগে এই পাথুরে জমিকে মন দিয়েছিল বাদশাহ। বাদশাহের দিল কেড়েছে যে পাথুরে জমিন তাকে সাজিয়ে গুজিয়ে সোনার বাসর বানাতে লেগে গেল সালতানতের তামাম লোকজন। কুলি,কামিন, মিস্ত্রি,মজুর, ভাস্কর, শিল্পী সব মিলে সে এক হৈ হৈ রৈ রৈ ব্যাপার। সোনার রঙের ইটপাথরে সেজে উঠল রাজধানী শহর। শাহি ইমারত, হাভেলি, মান্ডি, বাজার কি নেই সেখানে? হাজার সিপাহির মালিক তিনি, দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। তাঁর বিচারশালা, কয়েদঘর থাকবে না তাই হয়? সেসবও হল। আমআদমির জন্য সরাইখানা, বসতিও ছিল বিলকুল তৈয়ার। শুধু রাজার বিজয়মিছিলের অপেক্ষায় দিন গুনছিল কেল্লার তামাম লোক। কিন্তু সোনার কেল্লা সবার আবার সয় না যে। ঠিক এই সময়ে, দিনদুনিয়ার মালিকের এক পেয়ারা বান্দা, সুফিপীরের সঙ্গে ভারি জঙ্গ-এ জড়িয়ে গেলেন বাদশাহ। পীরবাবার এত্ত সাহস যে বাদশার ইমারত বানানোর সময়েই সে খুঁড়তে গেছে গরিবের জন্য মস্ত একখানা ইঁদারা, যাকে এখানে বলে বাওলি। উজির নাজির সব কি যেন বদবুদ্ধি দিলে। বাদশাহর মেজাজ এক্কেবারে টং। সাজা-এ-মওত এর হুকুম দিয়ে কোতোয়ালকে পাঠালেন, পীরের মাথা আনতে। কিন্তু দিনদুনিয়ার মালিকের সঙ্গে লড়াইয়ে আজতক কেই বা জিততে পেরেছে? পীরের কোতলের হুকুম তামিলের আগেই নয়া নগরের বিজয়তোরণ বাদশাহর মাথাতেই ভেঙে পড়লে, রাজার রক্তে ভেসে গেল আভিশপ্ত কেল্লার পথঘাট।
কেউ বললে পীরের সঙ্গে লড়াই এ কেউ বুঝি জেতে? কেউ বললে নেহাতই দুর্ঘটনা, কেউ বা বললে ষড়যন্ত্র না কি?
সে যাই হোক, সবার কপালে বুঝি সব ঘরে বসত করা হয়ে ওঠেনা গো, একেই কি বলে বাস্তুদোষ?
সেই থেকেই এই আজব নগরী, এই কেল্লা সব বিরান, খালি। খাঁ, খাঁ, ধু, ধু। শুধু বাদশাহর ভাঙ্গা বুকের চাপ চাপ কষ্টেরা সব ছায়া ছায়া হয়ে ঘুরে বেড়ায় টুটাফুটা হাভেলি, ইমারতের আনাচে কানাচে। কান পাতলেই নাকি তাদের আহাজারি বেশ শুনতে পাওয়া যায়। একটানা ঝিমুনির সুরে বুড়ির গল্প চলতেই থাকে।
মেয়ে এতক্ষণ বাপের সঙ্গে আশেপাশে দৌড়ে এসেছে, আমি বলি, ‘আয় তবে এই দাদি থাম্মির কাছে একটু গপ্পো শুনবি।’
ও,মা! কোথায় বুড়ি? পাশ থেকে বকবকমে কবুতর কয়েকটা উড়ে গেল ডানা ঝাপটিয়ে, আসমানপানে।
এই পাখিগুলোই বুঝি এই দুনিয়ায় সবচেয়ে সুখী। ওদের বসত ও নেই, বালাই ও নেই।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।