এদেশে আমার ছত্রিশ বছর কাটলো। প্রায় সাঁইত্রিশ বছর। ১৯৮৫'র আগস্টে এসেছিলাম কপর্দকশূন্য বিদেশী ছাত্র হয়ে। ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অ্যাসিস্ট্যান্টশিপ মাসে ৩৮০ ডলার। তার থেকে আবার ১০% ট্যাক্স। ইংরিজি বলতে গেলে হাত, পা কাঁপতো। এদেশে আসার এক সপ্তাহের মধ্যেই তিরিশ চল্লিশজন মার্কিন ছাত্রছাত্রীকে বায়োলজি প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস নিতে শুরু করলাম। এবং জেদের মাথায় চালিয়ে গেলাম।
সেই শুরু এদেশের জীবনযাত্রা।
আজ ২০২২'এর মার্চ। বহু অভিজ্ঞতা হলো। বিজ্ঞান নিয়ে পড়লাম, তারপর বিজ্ঞান থেকে চল্লিশ বছর বয়েসে চলে গেলাম একদিকে সাংবাদিকতা নিয়ে পড়াশোনা করতে, এবং অন্যদিকে এগারোই সেপ্টেম্বরের পরে ইমিগ্রেন্টদের ঘৃণামূলক আক্রমণ থেকে বাঁচাতে রাস্তায় নেমে কাজ শুরু করলাম।
সবচেয়ে বড় কথা, যা ৯০-৯৫ শতাংশ বাঙালি বা ভারতীয় অভিবাসী করেনা, বা তাদের করার সুযোগ হয়না, আমার অভিজ্ঞতা হলো আমেরিকার রাস্তায় নেমে রাজনৈতিক আন্দোলন করার। এবং সেই সূত্রে একদিকে নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান ইমিগ্রেন্টদের সঙ্গে মেলামেশা করার, আর অন্যদিকে শ্রমিক ইউনিয়নে চোদ্দ বছর পড়ানোর সূত্রে একেবারে সাধারণ আমেরিকান শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গদের ঘনিষ্ঠভাবে জানবার। তার ওপর ব্রুকলিন নামক কৃষ্ণাঙ্গ-অধ্যুষিত জায়গায় বাড়ি কিনে কুড়ি বছর বসবাস করার জন্যে বহু ব্ল্যাক আমেরিকানের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও প্রতিবেশীর সম্পর্ক ঘটলো, যা একেবারেই বোধহয় বিরল ঘটনা।
এবং পীস মুভমেন্ট, ক্লাইমেট মুভমেন্ট, শ্রমিক ইউনিয়ন, ইমিগ্রেন্ট রাইটস, ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার -- এসব জায়গায় যাঁদের সঙ্গে মিশেছি, একসঙ্গে কাজ করেছি, তাঁরা আমাদের অনেক ভালোবাসা দিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ব্যতিক্রমী মানুষও অনেক।
আমার আমেরিকাকে দেখা অন্য পাঁচজন বাঙালি বা ভারতীয়র আমেরিকাকে দেখা থেকে একেবারেই আলাদা। ব্ল্যাকদের সঙ্গে তো আমাদের দেশের মানুষ একেবারেই মেশেনা, এবং রেসিস্ট, বিদ্বেষমূলক কথাবার্তা বলতে আমাদের জুড়ি নেই। আমরা হিন্দুরা মুসলমানদের সম্পর্কে, মুসলমানরা হিন্দুদের সম্পর্কে, এবং হিন্দু ও মুসলমানরা ব্ল্যাকদের সম্পর্কে সবসময়েই বর্ণবিদ্বেষী কথাবার্তা বলে থাকি। বলতে গেলে, যে কোনো আড্ডার মতো ঘটনা ঘটলে এটাই আমাদের একটা প্রধান পাস্টটাইম। ভারতীয় বাঙালিদের মধ্যেও যেমন, বাংলাদেশী বাঙালিদের মধ্যেও কৃষ্ণাঙ্গবিদ্বেষ, এবং অন্য জাতির ইমিগ্রেন্ট-বিদ্বেষ খুব বেশি।
এ শুধু একটা দুটো লেখায় বোঝানো সম্ভব নয়। দীর্ঘ আলোচনার দরকার, যা করেওছি গত কয়েক বছর ধরে। সেসব আলোচনা কিছু কিছু বই হয়ে বেরিয়েছে, বাকী রাখা আছে আমাদের অনলাইন মিডিয়া হিউম্যানিটি কলেজে, ইউটিউবে, এবং সোশ্যাল মিডিয়ার পাতায়। কিছু প্রকাশিত হয়েছে আনন্দবাজার, এবেলা, আজকাল, একদিন, Outlook, Counter Currents, এবং বাংলাদেশের অনেক কাগজে।
কিন্তু "এ দেখাই শেষ দেখা নয় তো।" প্রতিদিনই লিখে রাখি নানা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা নানা অভিজ্ঞতার কথা।
*****
ইউক্রেন অথবা কোভিড, অথবা ... আরো অন্যান্য বিষয় -- আমেরিকার মানুষ আমেরিকা সম্পর্কে কী ভাবে?
সংক্ষেপে বলছি। ওদের কাজে যা শুনছি প্রতিদিন, তাই লিখছি। সাধারণ মার্কিনিরা অনেকেই খুবই সজ্জন, বন্ধুত্ব ও প্রীতি দেখিয়েছেন আমাকে ও আমাদের পরিবারকে। অনেকে আমাদের ফ্যামিলির মতো হয়ে গেছেন। তাঁদের অসম্মান করা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়।
ভবিষ্যতে এই বিষয় নিয়ে আরো অনেক লেখার ইচ্ছে থাকলো। এবং আমেরিকার জীবন নিয়ে স্মৃতিকথা লেখা খুব বেশি দরকার হয়ে পড়েছে।
(১) এই ভয়াবহ ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা হলে যা বেরিয়ে আসে, তা হলো এই। ইউক্রেন হলো গণতন্ত্র, এবং রাশিয়া হলো কমিউনিজম। যদিও রাশিয়া ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে কমিউনিজমের রাস্তা থেকে একেবারে উল্টোদিকে সরে এসেছে, এবং এখন একটি স্বৈরতান্ত্রিক উগ্র -দক্ষিণপন্থী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। কিন্তু যদি সাধারণ মার্কিন নাগরিকদের জিজ্ঞেস করা যায়, পুতিন কি কমিউনিস্ট? তারা বলবে, সে আমরা ঠিক জানিনা, কিন্তু রাশিয়া হলো গডলেস দেশ, আর আমেরিকা এবং ওল্ড কান্ট্রি ব্রিটেন হলো গড'স chosen (নির্বাচিত) ল্যান্ড। অর্থাৎ, ঈশ্বরের দেশ। খ্রীষ্টান দেশ। তারা বলবে, পুতিনকে সরাতেই হবে, কারণ আমরা শান্তিপ্রতিষ্ঠা করে চলেছি সারা পৃথিবীতে। আমরা যুদ্ধ করি গণতন্ত্র ও শান্তিপ্রতিষ্ঠা, এবং কমিউনিজমকে ধ্বংস করার জন্যে।
(২) এবারে যদি তাদের প্রশ্ন করেন, ইউক্রেনে নিও-নাৎজিদের সমর্থিত শাসকরা গণতান্ত্রিক বলে আপনারা মনে করেন? এবং নিউ ইয়র্ক টাইমস, সিএনএন বা অন্য জায়োনিস্ট অর্থাৎ এক বিশেষ ধরণের ইহুদিপন্থী, ইজ্রায়েলপন্থী মিডিয়া তাদের এতো বেশি সমর্থন করছে কেন? তাদের সম্ভাব্য উত্তর হবে -- নিও-নাৎজি নেই। ওসব কমিউনিস্ট প্রোপাগাণ্ডা। জেলেনস্কি গণতন্ত্র, NATO গণতন্ত্র, এবং পুতিন কমিউনিস্ট এবং টেররিস্ট। পুতিনকে সরালেই গণতন্ত্র ফিরে আসবে। গড'স রুল ফিরে আসবে। এখনই বাইডেন পোলাণ্ডে গিয়ে সরাসরি বলে এসেছেন, পুতিনকে সরাতেই হবে। অর্থাৎ, মার্কিন বিদেশনীতি বা যুদ্ধনীতি হলো, পছন্দের সরকার না হলেই তাকে "সরিয়ে দেবার" অধিকার আমার আছে। মিডিয়া এই নিয়ে ধোঁয়া ধোঁয়া খেলা খেলবে। এবং বেশিরভাগ আমেরিকান বুঝতেই পারবেনা এই সরিয়ে দেওয়ার কথা বলা আন্তর্জাতিক আইনবিরুদ্ধ। সেদিকে আলোচনা যাবেই না।
আচ্ছা, প্যালেস্টাইন? -- ওরা টেররিস্ট।
(৩) এবারে যুদ্ধ নিয়ে কথা বলা যেতে পারে তাদের সঙ্গে, যদি সেরকম বন্ধুত্বের সম্পর্ক থাকে। নাহলে কদাপি নয়। প্রশ্ন -- আমেরিকা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকে সারা পৃথিবীতে প্রতি বছর কোনো না কোনো যুদ্ধ বাধিয়েছে কেন, অথবা পরোক্ষভাবে যুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত থেকেছে কেন? তারা বলবে -- না না, এসব মিথ্যে কথা। এসব কমিউনিস্ট অপপ্রচার। আমরা কেবলমাত্র গণতন্ত্র ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যে চেষ্টা করে গেছি। এবং কমিউনিজমকে ধ্বংস করার কাজ চালিয়ে গেছি। এখনো তাই করে চলেছি। পরের প্রশ্ন, আচ্ছা...চিলি, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্স, বাংলাদেশ, গুয়াটেমালা, সালভাদোর, বলিভিয়া, ইরাক, সিরিয়া, ভিয়েতনাম -- সবকিছুই তাহলে কমিউনিজম ধ্বংস ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা? লাইক, ... আয়েন্দে'কে খুন করে পিনোশে'কে বসানো, সোয়েকর্ণ'কে সরিয়ে সুহার্তো'কে বসানো, মার্কোস'কে সমর্থন, জিয়াউল হক বা ইয়াহিয়া খান'কে সমর্থন -- সবকিছুই তাই? সাদ্দাম হুসেন, গাদ্দাফি?
শেখ মুজিবের হত্যা? ইন্দিরা গান্ধীর হত্যা? ... লম্বা লিস্ট। উত্তর আসবে, "এতো জানিনা। নিউ ইয়র্ক টাইমস, সিএনএন, এনপিআর, ফক্স সব জায়গায় যা শুনেছি, তাই জানি।"
একটু পরে শেষ সংযোজন -- "আমরা গড বিলিভার। ঈশ্বরে বিশ্বাসী। উই আর দ্য বেস্ট কান্ট্রি ইন দ্য ওয়ার্ল্ড।" আমরাই শ্রেষ্ঠ দেশ, এবং তোমার দেশের লোকেদের জিজ্ঞেস করে দেখো, তারাও বলবে আমেরিকাই শ্রেষ্ঠ দেশ। (এখানে আপনাকে ঘাড় চুলকোতেই হবে, কারণ কথাটা মিথ্যে নয়। আমাদের দেশে মার্কিনি উপাসনা আর একটা ধর্মের পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। অবশ্য, আমেরিকা সম্পর্কে ভালো করে কোনো কিছু না জেনেই।)
(৪) কোভিড-১৯ নিয়ে প্রশ্ন করা যাক -- আচ্ছা, যদি বেস্ট কান্ট্রিই হবে, তাহলে এই কোভিডে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মানুষ (আজ পর্যন্ত দশ লক্ষ অর্থাৎ ওয়ান মিলিয়ন) টেঁসে গেলো কেন? আর কোনো দেশে তো এতো মানুষ মারা যায়নি? উত্তর আসবে -- ওসব বানানো খবর। আমাদের আমেরিকা নামক শ্রেষ্ঠ দেশে এতো মৃত্যু হতেই পারেনা। তাছাড়া, ভেরি ওল্ড, ভেরি সিক এরাই সব মারা গেছে, আর হসপিটাল আর নার্সিং হোমগুলো ইনফ্লেটেড (অর্থাৎ কৃত্রিমভাবে বাড়ানো) মৃত্যুসংখ্যা দিয়ে গভর্নমেন্ট মানি তছরুপ করেছে। আমাদের প্রেসিডেন্ট রেগান এইজন্যেই বলেছিলেন, "গভর্নমেন্ট ক্যান্ট সল্ভ প্রব্লেমস। গভর্নমেন্ট ইজ দ্য প্রব্লেম।" সরকারবিরোধী রাজনীতি এই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অতিশয় তীব্র। কিন্তু সরকারের কাছ থেকে চেক নিতে কারুর কোনো আপত্তি নেই।
(৫) শেষ প্রশ্ন। আচ্ছা, ভবিষ্যতে গান ভায়োলেন্স, পৃথিবীর ২৫% কয়েদী আমেরিকার জেলে বন্দী, উন্নত দেশগুলোর মধ্যে আমেরিকার এই হতদরিদ্র অবস্থা, বর্ণবৈষম্য, পুলিশি অত্যাচার, অবিশ্বাস্য শিক্ষা ও চিকিৎসার খরচ, ওবেসিটি, স্কুলের বাচ্চাদের এনিম্যাল ফুড লাঞ্চের সময়ে, মেক্সিকান ইমিগ্রেন্টদের থেকে বাচ্চাদের কেড়ে নিয়ে খাঁচায় পুরে রাখা -- এসব বিষয় নিয়ে কিছু কিছু কথা বলার ইচ্ছে ছিল।
মার্কিনি বন্ধু ও বান্ধবীদের কাছ থেকে উত্তর আসবে, নিশ্চয়ই কথা বলা যাবে। তবে, তোমার খবরের সোর্সগুলো ফার লেফট উইং সোর্স। তুমি কমিউনিস্ট, সোশ্যালিস্ট, বা অতি বামপন্থী। আমার খবরের সোর্স মেইনস্ট্রিম, এবং তাই অনেক বেশি লেজিট, অর্থাৎ বৈধ। নিউ ইয়র্ক টাইমস হলো উচ্চবিত্ত, শিক্ষিত মার্কিনিদের সবচেয়ে প্রিয় মিডিয়া। সিএনএন সাধারণ শ্রেণীর লিবারালদের পছন্দ। ফক্স দক্ষিণপন্থী বা রক্ষণশীল মার্কিনিদের। এইজাতীয় মূলস্রোত মিডিয়া মার্কিনিদের সম্পূর্ণ মগজধোলাই করে রেখেছে।
তারা বলবে, ফাইন্ড সলিড ইনফো। তুমি আগে সঠিক তথ্য খুঁজে বের করো লেফটিস্ট বা সোশ্যালিস্ট কথাবার্তা না বলে। দেন, ওই শ্যাল টক এগেন। তারপর আবার দেখা হবে, কথা হবে।
বাই নাও।হ্যাভ এ গুড ডে, ব্রো।
###
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।