বাংলা করে বললে, এই রাজ্যের শনির দশা চলছে। একের পর এক গ্রাম মফস্বল থেকে রাজনৈতিক কর্মী বা তার পরিবারের মানুষের হত্যার খবর আসছে। হত্যার বহর বাড়তে বাড়তে ঘরে আগুন দিয়ে গণহত্যার খবরও আমরা দেখতে বাধ্য হলাম, গতকাল, বীরভূমের বগটুই গ্রামে। এই হত্যাগুলি প্রসঙ্গে কয়েকটি জিনিস লক্ষণীয়- ক) যাঁদের মারা যাওয়ার খবর আলোচনায় আসছে, তাঁরা অনেকেই শাসক দলের কর্মী-সমর্থক, তাঁরা খুনও হচ্ছেন অবশ্যই শাসক দলের লোকের হাতেই। ব্যতিক্রম আনিস খান, তবে মুখ্যমন্ত্রীর ভাষায় তিনি তো শাসক দলের ফেভারিট ছিলেন! ২) এই হত্যা পর্ব বড় ভোটগুলির আগে শুরু হয় নি। বিধানসভা ভোটের পর বিজেপি কর্মীদের ওপর অত্যাচারের খবর পেয়েছি, কিন্তু সাম্প্রতিক হত্যা-লীলা শুরু হয়েছে পুর-নির্বাচনের সামান্য আগে দিয়ে। পুর-নির্বাচনের পরেও তা চলছে, পুর-ভোটে জেতা কিছু নেতাও খুন হয়েছেন। বগটুই গ্রামের প্রথম খুনটা পঞ্চায়েত উপপ্রধান হয়েছেন। বিগত পঞ্চায়েত ভোট হিংসার জন্য আমাদের স্মরণে আছে। ৩) বহুক্ষেত্রে পুলিশ জড়িত অথবা ইচ্ছাকৃত গাফিলতি দেখাচ্ছে। আনিস কাণ্ডে খুনের অভিযোগ সরাসরি পুলিশের বিরুদ্ধে, কালকের ঘটনাতেও লোকাল ওসিকে ক্লোজ করা হয়েছে। তদন্তের ব্যাপারে রাজ্য প্রশাসনও স্থানীয় পুলিশকে ভরসা করছে না, বাইরে থেকে বিশেষ তদন্ত কমিটি বসাচ্ছে।
আমরা দেখতে পাই উপরের সবকটি পয়েন্ট রাজ্যের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থার চিহ্ন বহন করছে, যাতে বিরোধীদের ব্যর্থতার পরিসর ছাপিয়ে নজর টান পাচ্ছে শাসক দলের কর্মসূচীটি। বিগত বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকে এই রাজ্যের রাজনীতিতে বিরোধী দলের ভূমিকা প্রায় শূন্য হয়ে এসেছে। বিজেপি তার বিপুল বিনিয়োগ থেকে যথাযথ লাভ না পাওয়ায় ব্যবসা সরিয়ে নেওয়ার পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। অন্যান্য দলগুলির গত কয়েক দশকের রাজনৈতিক ব্যর্থতার ধারাও অব্যাহত থেকেছে। উল্টোদিকে গত দু’বছরে করোনা লকডাউনের নামে সরকার একাধিক জন বিরোধী পদক্ষেপ নিয়েছে, কিন্তু তার বিরুদ্ধে একটিও সামাজিক প্রতিরোধ দৃশ্যমান হয় নি। গণ আন্দোলনের মঞ্চগুলি স্কুল বন্ধ, ট্রেন বন্ধ, বাজার বন্ধের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ না নিয়ে লকডাউনের রিলিফ বণ্টনে ব্যস্ত থেকেছে। এই প্রেক্ষাপটে শাসক দল নিরঙ্কুশ হয়ে ওঠার সমস্ত সুযোগ তুলে নিয়েছে। পঞ্চায়েত পুরসভা থেকে আরম্ভ করে স্কুল বোর্ড, কোঅপারেটিভ সর্বত্র বিরোধীশূন্য হয়ে জিতবার প্রবণতা বেড়ে উঠেছে। পশ্চিমবঙ্গে স্থানীয় স্তরের শাসনক্ষমতা বরাবরই খুব লোভনীয়, পঞ্চায়েত ভোটের হিংসা বহুবছর ধরেই লোকসভা বিধানসভাকে ছাপিয়ে যায়। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটের হিংসা এবং তার উল্টোদিকে অন্যদলগুলির অপারগতা রাজ্যে বিজেপির উত্থানের একটা পটভূমি দিয়েছিল। বিজেপির প্রকোপ কমে আসার ফলে সেই হিংসার একমাত্রিক ছবিটা আরও স্থায়ী হয়ে গেল। খেয়াল করা যায়, ২০২১-এ ভোটের ফলের অব্যবহিত পরেই, যখনও স্বরাষ্ট্র দপ্তরের ভার নির্বাচন কমিশনের হাত থেকে নির্বাচিত সরকারের হাতে আসে নি, নজিরবিহীন ভাবে বিরোধীদের আক্রমণ করার ঘটনা শুরু হল। শাসক দল, তার হাতে তখনও পুলিশ নেই, এই অছিলায় সেই দুষ্কর্মের দায় ঝেড়ে ফেলতে চাইল, কিন্তু, এই কথা তো আর মিথ্যে হয়ে গেল না, যে সেই দলের কর্মীরাই হাত লাল করেছেন সেই সময়ে। এর ফলে তিনটে জিনিস হল, এক, দলের কর্মীরা কেউ কেউ অনর্থক বিরোধীদের আক্রমণ করার কাজে হাত পাকিয়ে নিলেন; দুই, বিরোধীদের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকল এই হিংসার ঘটনাগুলি। অনেকে, যাঁরা সামাজিক বা আদর্শগত কারণে বিরোধী দল করতেন, তাঁরা ভয়ে চুপ হয়ে গেলেন, অনেকে, যাঁরা ক্ষমতা লাভের ইচ্ছেয় অন্যদল করলেন, তাঁরা শাসক দলে যোগ দেওয়ার সুযোগ খুঁজতে লাগলেন, কারণ তার বাইরে থাকলে রাজনীতি করাই সম্ভব হবে না; এবং খুব গুরুত্বপূর্ণ, তিন, পুলিশের সঙ্গে রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকা দুষ্কৃতীদের সম্পর্ক নিকটতর হল, কারণ পুলিশের নাকের ডগা দিয়ে অপরাধ হল এবং শাসক দলের হাতে দু’দিনে ক্ষমতা যাবে এই ধারণা থাকায় পুলিশ দুষ্কৃতীদের আটকাল না। পুলিশের সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের মাখামাখি অবশ্য বহু পুরোনো, সে ভারতী ঘোষের ঘটনাই হোক বা পুলিশ সুপারের স্ত্রী হওয়ার জন্যে এক অল্প খ্যাত সিরিয়াল অভিনেত্রীকে এম এল এ মনোনয়ন দেওয়াই হোক, আমরা বারংবার এর প্রমাণ পেয়েছি। তৃণমূল কর্মীরাও জানেন যে তাঁদের সংগঠন চালানোর পিছনে দলীয় নেতাদের পাশাপাশি পুলিশের বড় অফিসারদের ভূমিকা থাকে, হয়তো বেশিই থাকে।
এইসব মিলিয়ে যা শুরু হল, অন্য রাজনৈতিক দল, অন্য রাজনীতির প্রতি বিশ্বাস রেখে কাজকর্ম করতে না দেওয়ার অবস্থা। দলীয় কর্মী, কিছু গুন্ডা এবং পুলিশের সাহায্যে এলাকার পর এলাকা বিরোধীশূন্য করা হল, এতটাই বিরোধীশূন্য যে ভোটের সময় বুথে বিরোধীদের এজেন্ট খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না এমন কি সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রে প্রার্থী দেওয়ার মতন বিরোধী মুখই পাওয়া যাচ্ছে না। তৃণমূল কংগ্রেস উল্লাস প্রকাশ করল, যে এ তার রাজনীতির জয়, সকলে তার দল করতে আসছেন। কিন্তু, বস্তুত, এরকম কোনও বৃহৎ পরিবার, ক্লাব বা পুজো কমিটিই হতে পারে না যেখানে সকলে একরকম ভাবেন, আর একটা এলাকা যেখানে কোনও বিরোধী রাজনীতিতে বিশ্বাসী মানুষ নেই, এ পৃথিবীর কোনও তন্ত্রেই সম্ভব না! এই বিরোধীশূন্যতার পিছনে মূল কারণ থাকল, ভয়ে বিরোধীদল করা যাচ্ছে না, কিছু ক্ষেত্রে হতাশাতেও; দ্বিতীয় কারণ থাকল, রাজনীতিতে আদর্শ বাদ দিয়ে কিছু লাভ লোকসান থাকে, ক্ষমতার স্বাদ থাকে, একজনের চিন্তাভাবনা যাই হোক না কেন, সে তৃণমূলে যোগ দিয়ে সেই স্বাদ পাওয়ার সুযোগ পেল। স্থানীয় স্তরে এগুলো কীভাবে হল, তার অনেক কারণ আছে কিন্তু আমরা দেখলাম রাজনৈতিক মতবাদ বা সংগঠনের প্রতি আনুগত্যের বাইরে ক্ষমতার জন্য দলে পাল্টে ফেলার যে অভ্যেস বিজেপি চালু করেছিল তার ওস্তাদ হয়ে উঠল তৃণমূল কংগ্রেসের একদম ওপরতলার নেতৃত্ব। ফলে স্থানীয় স্তরে শুধুমাত্র রাজনৈতিক কুশলতা বা বাহুবলের জন্য কাউকে দলে ঢোকান নিয়ে ছুৎমার্গ থাকল না। অতএব, রাজনীতিতে নামতে ইচ্ছুক প্রায় সমস্ত সমাজবিরোধীরা নিজেদের তৃণমূল বলে কাজ চালাতে শুরু করলেন। এই প্রবণতা স্থানীয় স্তরে ভীষণ বাড়ার একটা বড় কারণ পুরসভা বা পঞ্চায়েতের হাত দিয়ে বিভিন্ন প্রকল্প চলা এবং তাতে বিশাল অর্থ আদানপ্রদান হতে থাকা। এর পাশাপাশি দুয়ারে বিভিন্ন ক্যাম্প করা এবং তাতে প্রশাসন ও শাসক দলের মিশে যাওয়াও একটা বড় মুনাফার জায়গা খুলে দিল। আর, বালি পাথর প্রভৃতি বিভিন্ন ব্যবসা তো থাকলই। এবং এই মুনাফার ভাগ ও রাজনৈতিক ক্ষমতার স্বাদ পেতে স্থানীয় পুলিশ আর স্থানীয় তৃণমূল এক হয়ে যেতে থাকল। গ্রামের পর গ্রাম, পুরসভার পর পুরসভা ধরে এটাই ঘটছে। সকলে তৃণমূল, সক্কলে তৃণমূল। বর্তমান পত্রিকার আজকের প্রতিবেদনে যেমন প্রকাশ- ‘সিপিএম নেতা সঞ্জীব বর্মন ও কংগ্রেসের জেলা সভাপতি মিল্টন রশিদের দাবি, ‘ওই গ্রামে সবাই তৃণমূল। ওদের নিজেদের দ্বন্দ্বের জন্যই খুন ও আগুনে পুড়িয়ে মারার ঘটনা ঘটেছে’।
কিন্তু, আমরা আগেই বলছিলাম, এই বিরোধীশূন্যতা মানবসমাজের স্বাভাবিকতা নয়। রাজনৈতিক পরিসরের তো নয়ই। কারণ, শুধু নিজের জায়গার উন্নয়নের জন্য কেউ রাজনীতি করে না। হয় রাজনীতির পিছনে এক বৃহত্তর স্বার্থ আদর্শ থাকে, অথবা রাজনৈতিক অবস্থান ব্যবহার করে নিজের আখের গুছিয়ে নেওয়ার জায়গা থাকে। তৃণমূল নেতৃত্ব যেভাবে নিরঙ্কুশ বিরোধীশূন্য হওয়ার বাসনায় বিরোধীদের সন্ত্রস্ত করে রেখেছেন এবং যে কাউকে নিজের দলে ঢুকিয়ে নিয়েছেন, তার ফল আবশ্যিকভাবে, এই দ্বিতীয় শ্রেণির, আখের গুছনো দলকে নিজের দলে সামিল করা। কিন্তু টাকাপয়সার প্রভূত হাতবদল স্বত্তেও তা তো একটা মাত্রায় সীমিত হবে। ফলে পুরসভার বা পুর ওয়ার্ডের ক্ষমতায় যে যাবে সেই মূল হিসসা পাবে। আর সেই হিসসা যার কাছে আসবে, তার লোকবল বাড়বে, সংগঠনের মধ্যে সেই শক্তিশালী হবে, ফলে তার হিসসা আরও বাড়বে- এই চক্র চলতেই থাকছে। এর ফল হচ্ছে দলের মধ্যেই এলাকা দখলের লড়াই, একের পর এক হত্যা, হত্যার উত্তরে গণহত্যা ইত্যাদি। আমরা সেইটুকুই জানছি যা মাত্রাগত বীভৎসতার জন্যে খবরে আসছে। কিন্তু, নিজের দলের মধ্যেই যদি এই হানাহানি চলে, বিরোধীদের কী অবস্থা হচ্ছে তা বোধহয় অনুমানের অপেক্ষা রাখে না।