মেয়েটার বাড়ি মফস্বলে। তার জীবনে আশির দশকের কলেজ-গান-বই-সিনেমা, "শহরের পিঠ তোলপাড় করা অহংকারের দ্রুত পদপাত।" পুরোনো বইয়ের জন্যে কলেজ স্ট্রিট আর নিপারের সন্ধানে ওয়েলিংটন ফুটপাথে নিয়মিত হানা দেয়। নিপার খুব পরিচিত, প্রিয় মুখ। নাম দিয়ে হয়তো চেনা শক্ত, কিন্তু একটু ধরতাই দিলেই বুঝবেন। সেই যে ছোট্ট একটি টেরিয়ার কুকুর গ্রামোফোনের চোঙের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে, শুনছে তার প্রভুর গলা। প্রভু আর বেঁচে নেই। তার গলার আওয়াজ গ্রামোফোন রেকর্ডে ধরা আছে। সে রেকর্ড বাজলেই নিপার বসে পড়ে তার সামনে। ‘হিজ মাস্টার্স ভয়েস।’ নিপারের ছবি দেওয়া লং প্লেয়িং রেকর্ড পাওয়া যায় ওয়েলিংটন স্কোয়ারে। বাড়িতে কালো রঙের টার্নটেবিল গ্রামোফোনে ছড়ায় সুরের সম্মোহন। কখনো সুচিত্রা মিত্রের ভরাট গলায় কৃষ্ণকলি, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের রানার আর গাঁয়ের বধূ, কখনো বা বড়ে গোলাম আলির অপার্থিব কণ্ঠের শরক্ষেপণ – ‘ইয়াদ পিয়া কি আয়ে’ - একেবারে অব্যর্থ লক্ষ্যে মর্মে গিয়ে বিঁধবে।
এমনই একদিন অঘ্রানের মন কেমন করা উদাস বিকেলে কলেজ ফেরত মেয়েটা বাড়ি ঢুকতে ঢুকতে শুনল মিহি গলার চিকন সুরে কথার বুনট, "জাগে হো কহিঁ রয়না।" ভৈরবী ঠুমরী। নিমেষে কান খাড়া। সুর যেন গলে গলে পড়ছে। এ কার গলা? বড়ে গোলাম আলির পাতিয়ালা স্টাইল তো নয়? পাক্কা বেনারসি আদত, যেন গিরিজা দেবীর গুরুভাই!
ঘরে ঢুকে দেখে কাকা মুদিত নয়নে গ্রামোফোনের সামনে, রসাস্বাদনে মগ্ন। মেয়েটা পাশে বসে পড়ে। ভৈরবীর কোমল গান্ধারে ফুটে উঠছে রাতজাগা দুটি চোখ। ষড়জ-ঋষভ-গান্ধারে আলোর ফুলকির মত ছোট্ট ছোট্ট সুরের কাজ, সঙ্গে অল্প একটু মধ্যম। মেয়েটার মন হারাচ্ছে। 'নিশি ভোর হল জাগিয়া, পরাণ প্রিয়া' নজরুলের সুর কোথায় যেন উঁকিঝুঁকি মারে।
'আলসানে নয়না রসনারে' - এবার কোমল ধৈবত ছুঁয়ে ছুঁয়ে আসছেন, সঙ্গে কোমল ঋষভের মায়া জড়িয়ে দিচ্ছেন অপূর্ব কৌশলে। 'চাল লটপটি আয়ে হো তো' - এবার পঞ্চমে এসে স্থিত হলেন। কথা আর সুরে নিটোল একটি মালা গাঁথা হল। জড়োয়া কাজের মিনাকারী তার সর্বাঙ্গে। কি অবলীলায় ছোট ছোট মুড়কি লাগাচ্ছেন, সূক্ষ্ম, একটুও বাহুল্য নেই!
আস্থায়ী গেয়ে ভৈরবী নিয়ে খেলছেন। কোমল ধৈবতের সঙ্গে পাশাপাশি শুদ্ধ ধৈবত, তারার ষড়জকে যেন আলতো আদর মাখিয়ে দিচ্ছে। সঙ্গে ঝিরিঝিরি মুড়কির বৃষ্টি। অন্তরায় যাবেন এবার। মেয়েটা নিজের অজান্তেই সে যাত্রায় সামিল। ধৈবত দু-হাত বাড়িয়ে ষড়জের প্রতীক্ষায় রয়েছে। যেন বলছে, "এস, পূর্ণ কর, ভরে দাও আমায়।"
ছ’মিনিটের ঠুমরী শেষ। প্রথামত আস্থায়ী, বিস্তার, অন্তরা, লগ্গি - বাদ যায়নি কিছুই। মেয়েটা নিস্তব্ধ। অনুভবের নদী কূল ছাপিয়ে গেছে, রাতজাগা আরক্তিম দুটি চোখের নির্বাক চাহনি ছেয়ে আছে মনে। এমন করে সুরে সুরে ছবি আঁকা যায়?
চোখ গেছে পাশে রাখা রেকর্ডের চওড়া মোড়কে। অতি পরিচিত এক নৃত্যরত গন্ধর্ব। পায়ে চওড়া ঘুঙুর। অপূর্ব বিভঙ্গে নমনীয় দেহে ঢেউ তুলছেন। কথক নাচের সম্রাট, বিরজু মহারাজ।
কাকা হাসলেন। "অবাক হলি, তাই না?"
"মহারাজজি গেয়েছেন?" বিস্ময়ের শেষ সীমায় সে।
উল্টেপাল্টে দেখছে, এইচ এম ভি থেকে সদ্য বার হয়েছে এল পি রেকর্ড। শুধু মহারাজজির গাওয়া গান নিয়ে। লঘু শাস্ত্রীয় সংগীত। পাঁচটি পাঁচটি করে দু’দিকে মোট দশটি গান। নটরাজ তাঁর নৃত্য বিভঙ্গ ছেড়ে সুরের আকাশে ধ্রুবতারা হয়ে পথ দেখাচ্ছেন।
প্রথম গান মিশ্র দেশি রাগে ভজন, প্রগতে ব্রিজ নন্দলাল, দাদরা তালে ছয় মাত্রায় বাঁধা। কৃষ্ণের বৃন্দাবন লীলার মধুর রসটি ফুটিয়ে তুলেছেন।
তার পরেই একটি ঝুলা। রাধাকৃষ্ণের প্রেম অমর হয়েছে ঘনবরষা আর মেঘকে সঙ্গী করে। রিমঝিম ধারাপাতে সতেজ ঘাস মাথা দোলায়। সবুজ মাঠে বৃষ্টি পড়ে আর তমাল ডালে বাঁধা হয় ঝুলনা। সেই চিরন্তন প্রেমের দৃশ্য-কল্পটিকে ধরে রাখতে 'ঝুলা'র জুড়ি নেই। কি দরদ দিয়ে গেয়েছেন, 'ঝুলতা রাধে নওলকিশোর'।
এর পরেই পট পরিবর্তন! আকাশে ওঠে বাসন্তী পূর্ণিমার চাঁদ। হোলির সময় এল, আবির আর কুঙ্কুমের রঙে রাঙিয়ে নিতে হবে মন। গানও বদলে যায়। 'হোরি' গানের মাঝেই যেন এসে পড়ে ফাগের ছটা। 'কানহা খেলো কাহাঁ অ্যায়সি হোরি গুঁইয়াঁ' - মিশ্র গারা রাগে অভিমানের জাল বোনা হয়। 'কাসি কহুঁ, নাহি মানোগি মোহন' - 'আমার কথা তো কানহা শুনবে না, কোথায় না কোথায় গিয়ে হোরি খেলছে আজ!' শ্রীরাধিকার মন প্রিয়কে পাশে চায়, আবির-কুঙ্কুমে রাঙিয়ে দিতে চায়। সে অসহায় চাওয়ার ব্যাকুলতা ফুটল গানে। চোখে এল জল। এ গানে খুব কৌশলে তালের ব্যবহার করা হয়েছে। গানের মাঝে দ্বিগুণ লয়ে দুনি যেন নৃত্যের বিভঙ্গকে গানে নিয়ে আসে।