১৯০০ সাল। ততদিনে মেয়েদের পড়াশোনা করাটা খানিকটা সহজ হয়ে গেছে। সেই কোন ১৮৮৩ সালে কাদ্মবিনী বসু বি এ পাশ করেছেন। তারপর নয় নয় করে আরও আঠেরো জন বঙ্গমহিলা বিএ পাস করে ফেলেছেন। ১৯০০ সালে পাশ করলেন যে কুড়িতম মহিলাটি তার কথা বলব বলেই এই লেখা। এই কন্যাটি অনর্গল ইংরাজী আর ফ্রেঞ্চ বলতে পারে , আর ফ্রেঞ্চ নিয়ে পড়ে সে পেল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা বিভাগের সর্বোচ্চ নম্বর । নিয়মগত কারণে প্রেস্টিজিয়াস ঈশান স্কলারশিপ পেল না বটে, কিন্তু তাতে তো তার কৃতিত্ব খাটো হয় না। কন্যাটির নাম লিলিয়ান পালিত, বন্ধুরা ডাকে লিল বলে।
কলকাতার যে ইঙ্গ-বঙ্গ সমাজকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রভূত ব্যঙ্গ করেছেন, তাদের অভিহিত করেছেন সিসি-লিসি-কিটি দের দল বলে, লিল বোধহয় তাদেরই একজন । তিন দাদার এক বোন। ১৮৭৯ সালে লন্ডনে জন্ম, বাবা তারকনাথ পালিত, মা কুমুদ কামিনী। বাবা তারকনাথ কলকাতা হাইকোর্টের ডাকসাইটে ব্যারিস্টার। বিশাল বড়লোক। সে সময়ের ইঙ্গবঙ্গ সমাজের মাথাদের একজন। কুমুদ কামিনী শান্ত শিষ্ট, ছোট্টখাট মহিলা, তারকনাথকে খুব ভয় পেতেন। তারকনাথ চেয়েছিলেন তাঁর সন্তানদের ইংল্যন্ডে পড়াশোনা করাতে । সেই উদ্দেশ্যে ইংল্যন্ডের 3, Ormonde Terrace, Primrose Hill, N. W. পালিত পরিবারের আরেকটি ঠিকানা ছিল। দাদাদের পড়াশোনা বিলেতে। লিলিয়ান অবশ্য বেথুন থেকে প্রাইভেটে বিএ দিয়েছিলেন। সম্ভবত স্কুলজীবনে কলকাতার লরেটো কনভেন্টেও কিছুদিন পড়েছেন।
এইখানে তারকনাথ সম্বন্ধে দু কথা বলার লোভ ছাড়তে পারছি না। বিদ্যোৎসাহী এই মানুষটির নাম জড়িয়ে আছে কলকাতার দুটো নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যাদবপুর উনিভার্সিটি আর সায়েন্স কলেজের সঙ্গে। যখন বঙ্গভঙ্গের পরে স্বদেশি নিয়ে সবাই মেতে উঠেছে, তখন তারকনাথ পালিত আরও ক’জনের সঙ্গে মিলে তৈরি করেন “সোসাইটি ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অফ টেকনিক্যাল এডুকেশন ইন বেঙ্গল” । তার আওতায় চালু হয় বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট। ৯২ আপার সার্কুলার রোডের বাড়িতে হই হই করে আরম্ভ হয়ে যায় পঠন পাঠন। পরে অবশ্য ১৯১০ সালে এটা এনসিই বেঙ্গলের সঙ্গে মিশে যায়। আর তারপরই তারকনাথ পালিত এর সংস্রব ত্যাগ করেন। শোনা যায় কাজের আদর্শগত তফাৎ নিয়ে তারকনাথের আপত্তি ছিল। এই বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউটই অনেক ঝড় ঝাপটা পুইয়ে শেষে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের চেহারা নেয়। কিন্ত দল ছাড়লে কি হবে, দেশের বিজ্ঞানের ভিত শক্ত করার ইচ্ছে তো তখনও মরেনি। এদিকে বয়স হয়ে যাচ্ছে, সময় ফুরিয়ে আসছে। তখন ১৯১২ সালে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে শলা করে তারকনাথ কলকাতা বিশ্ববদ্যালয়কে দুই দফায় প্রায় ১৫ লাখ টাকা দান করেন। উদ্দেশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় একটি উচ্চতর বিজ্ঞান চর্চাকেন্দ্র তৈরি। এই দানের শর্ত হিসেবেই পালিত অধ্যাপকের পদ তৈরি হয়। নিজের বসত বাটিও বিজ্ঞান চর্চার জন্য দান করেন। তারপরের কথা তো ইতিহাসের পাতায় ঠাই পেয়েছে।
অবশ্য বিদ্যাচর্চা বোধহয় এঁদের বংশগত। তারকনাথ পালিতের বাবা নিজের গ্রাম আমেরপুরে একটি স্কুল চালাতেন, সেটা অবশ্য ১৮৪৪ সালে তাঁর অকালপ্রয়াণের পরে উঠে যায়। তারকনাথ ব্যক্তিগত জীবনে একটু ছিটিয়াল আর বাড়াবড়ি রকমের স্পষ্টভাষী ছিলেন বোধহয়। তাই সবার সঙ্গেই প্রায় ঝগড়া হত। ইনি ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহপাঠী। আমৃত্যু বন্ধুও বটে। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিচারণে তারকনাথ পালিতের বহু উল্লেখ আছে। ঊমেশ চন্দ্র বনার্জির কন্যা জানকি অ্যাগনেস পেনেলোপ মজুমদারের অনবদ্য স্মৃতিকথাতেও ( নাম “ফ্যামিলি হিস্ট্রি” ) তারকনাথ পালিতের পরিবারের উল্লেখ পাই।
যাই হোক লিলিয়ানের কথায় ফিরি। লিলিয়ান একই সঙ্গে কালচার্ড এবং জিনিয়াস ছিলেন। কিন্তু “সংসার সুখী হয় রমণীর গুণে” এই সার কথাটা ইংল্যন্ডে বড় হওয়ার দরুন হয়ত একটু কানে কম ঢুকেছিল। জানকি বলছেন যে she was wild and fighty.
লিলিয়ান নিজ ইচ্ছায় বিয়ে করেন শিশির মল্লিককে। ইনি ভাগলপুরের ব্যারিস্টার অতুল মল্লিকের চতুর্থ ছেলে। খুব সম্ভবত অভয়চরণ মল্লিক, যিনি ভাগলপুরের প্রথম মহিলা সমিতি খুলেছিলেন, শিশিরের পিতামহ। এরাও সব ভাইরা কেউ ব্যারিস্টার, কেউ আই সি এস। এই বিয়েতে লিলিয়ানের একটি পুত্রসন্তানও হয়। অজিত মল্লিক। কিন্তু এই বিয়ে সুখের হয়নি। লিল কলকাতা হাইকোর্টে বিবাহবিচ্ছেদের মামলা ঠোকেন। লিলের পক্ষে দাঁড়ান পিতৃবন্ধু ব্যারিস্টার সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহ। ১৯০৯ সালে।
কেন হয়েছিল ডিভোর্স? জানতে পারি নি। হাজার খুঁজেও কলকাতা হাইকোর্টের এই রকম কোন কেসের সন্ধান পাইনি। কোন ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণেও ডিভোর্সের কারণ নিয়ে কোন তথ্য পাইনি। তবে শৈলসূতা দেবী “পরিণয়ে প্রগতি” বইতে জানিয়েছেন যে “স্বামীত্বের সুযোগ লইয়া স্ত্রীর উপরে যতটুকু প্রভাব খাটানো চলে, লিলিয়ানের স্বামী সেটুকু প্রভাব খাটাইতে চাহিতেন ; কিন্তু ধনী পিতার আদরে বর্ধিতা কন্যা স্বামীকে স্বামীত্বে ততখানি অধিকার প্রদান করিয়া আপনার স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করিবেন কেন ? তিনি স্বামীগৃহ পরিত্যাগ করিয়া পিতৃগৃহে চলিয়া আসিলেন। “ - ঠিক কি হয়েছিল যা জেনে কোন মতামত দেওয়া উচিত না, তবে এই ঘটনায় সে সময় যে বেশ নাড়াচাড়া পড়ে গিয়েছিল সে তো বলাই বাহুল্য। জনশ্রুতি এই যে খুব সম্ভবত এটাই প্রথম ভারতীয়দের মধ্যে ডিভোর্সের কেস। যদিও পক্ষে বা বিপক্ষে কোন প্রমাণ পাই নি।
লিলের জীবন এরপর অন্য খাতে বইল। তিনি আবার বিয়ে করেন। এবার ভাগলপুরের জমিদার দীপ নারায়ণ সিংহকে। অসম্ভব ধনশালী, বিহার প্রদেশ কংগ্রেসের হর্তাকর্তা দীপ নারায়ন নিজেও ব্যারিস্টার, যদিও একদিনও আদালতে পা দেন নি। কলকাতার ইঙ্গ বঙ্গ সমাজে খুবই পরিচিত একটি নাম। দীপ নারায়ণের কিন্তু এটা দ্বিতীয় বিবাহ। প্রথম স্ত্রী রামানন্দী দেবীর একটি কন্যা সন্তানও আছে। তাহলে লিল কেন এই বিয়েতে রাজী হলেন? জানা নেই।
দীপ নারায়ণকে বিয়ে করে লিল বিভিন্ন সমাজসেবা মূলক কর্মকান্ডে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন। নতুন পরিচিতিও হল , লীলা সিংহ। চিত্রা দেব জানিয়েছেন যে লিল ভাগলপুরে মেয়েদের জন্য স্কুল খোলেন। তার কোন প্রমাণ যদিও মেলে নি, তবে ভাগলপুরে অনাথাশ্রম খোলা, লেবার ওয়েলফেয়ারের জন্য কাজ করা, বিভিন্ন বৃত্তির বন্দোবস্ত করা এইসবই তাদের কাজের মধ্যে পড়ত। এ ছাড়া, দীপ নারায়ণের মৃত্যুর আগে তাঁর দান করা সম্পদ দিয়ে তৈরি লীলা-দীপনারায়ণ ট্রাস্ট ভাগলপুরের টেকনিক্যাল শিক্ষার ক্ষেত্রে একটা নতুন যুগের সূচনা করে। বিহারের অসহযোগ আন্দোলনেরও তিনি এক পরিচিত মুখ।
তবে লীলা সিংহের সবথেকে বড় ভূমিকা বোধহয় ভারতের মেয়েদের ভোটাধিকারের লড়াইতে। সরকারের এনকোয়ারি কমিশনে বিহারের হয়ে লীলা প্রতিনিধিত্বও করেন। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে ভারতের মেয়েরা তো পর্দানশীন, তাহলে তারা কি করে ভোটে দাঁড়াবে বা ভোট দেবেন? সঙ্গে সঙ্গে লীলার সপাট উত্তর দিয়েছিলেন, যেভাবে ভূপালের বেগম পর্দার আড়াল থেকে রাজ্যপাট চালান। মেয়েদের স্বাধিকারের প্রশ্নে তিনি একেবারে সমঝোতাহীন। বিভিন্ন দেশে দেশে ঘুরে ভারতীয় মেয়েদের ভোটাধিকারের পক্ষে জনমত তৈরি করেছেন। ১৯৩৫ সালে দীপনারায়ণ সিংহ মারা যাওয়ার পরে লিল প্যারিসে চলে যান। সেখানেই ১৯৪১ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। স্বাধীন ভারতে মেয়েদের ভোটে দাঁড়ানো আর ভোট দেওয়ার অধিকার দেখে যাওয়ার সৌভাগ্য তাঁর হয় নি।
আগেই বলেছি পালিত বংশের কোন স্মৃতিকথা, চিঠিপত্রের আমি সন্ধান পাই নি। তিল তিল করে বিভিন্ন স্মৃতিকথা, ইন্টারভিউ থেকে জুড়ে জুড়ে এইটুকু খাড়া করা। ইন্দিরা দেবী তার স্মৃতিসম্পূটে তারকনাথ পালিত সম্বন্ধে বলেছেন যে তাঁর পারিবারিক জীবন সুখের হয় নি। ছেলে-মেয়েকে বিলিতি আচার-ব্যবহারের স্রোতে ভাসিয়ে দেওয়ার জন্য পরে তাঁর অনুতাপ হয়েছিল। জানি না এই পারিবারিক অসুখের কতখানি লিলের কারণে। অবশ্যই বাঙ্গালী মেয়েদের যে লক্ষ্মী মেয়ের ছাঁদ আমরা দেখতে অভ্যস্ত, লিল সেই ছাঁচে পড়েন না। যতই বিলেতি ধরণে বড় হন, কি করে তিনি এতখানি সমাজ সংস্কারকে নস্যাত করার সাহস পেলেন? অনেক ভেবে মনে হয়েছে, ছোট থেকে বাঙ্গালী মেয়েদের যে “মেয়ে করে তোলার” ট্রেনিং দেওয়া হয়, বৃহত্তর- পরিবার বর্জিত বিদেশবাসের কারণে তাঁর বোধহয় সেই আত্মবিসমৃতির শিক্ষায় কিঞ্চিত কমতি পড়েছিল। তাই হয়ত আত্মকে তিনি বেশি গুরুত্ব দিতে পেরেছিলেন। দীর্ঘ বিলেতবাসের জন্য বিলিতি ধরণের নারী স্বাধীনতার বক্তব্যেও তিনি ঘোর প্রভাবিত ছিলেন। তার সমসাময়িক বাঙ্গালী লক্ষ্মী মেয়েরা যখন হিন্দুধর্মের পক্ষে গ্লানিকর হিন্দু-মুসলিমের ( শান্তি দাস -হুমায়ুন কবীরের ) বিয়েতে বাগড়া দিতে চেষ্টা করেন, তখন তিনি নিজেকে ডুবিয়ে দেন মেয়েদের ভোটাধিকার আদায়ের কাজে। কোনটা যে বেশি ভাল কাজ!
বিবাহ বিচ্ছেদের মাধ্যমে লিল ভারতীয় সমাজকে যে ধাক্কাটা দিয়েছিল, সেটা কিন্তু খুব আকাশ থেকে পড়া না। তার অনেক আগে থেকেই ভারতীয় মেয়েরা বিবাহবিচ্ছেদের প্রশ্ন তুলছেন। কিন্তু তারা সংখ্যায় এতই কম যে সমাজ নাকে সর্ষের তেল দিয়ে ঘুমিয়েছে। বেশির ভাগ মেয়েই তো যা চলে আসছে তার থেকে অন্যরকম কিছু করার কথা ভাবতেই পারেন না। আর তারপর বাবা-মা বা পরিবারের অন্যদের থেকে বিরোধিতা পেলে তো আর কথাই নেই। বিদ্রোহের মুকুল ওখানেই ঝড়ে গেল। ফলে আমাদের মেয়েরা স্বামী-পরিত্যক্তা হয়ে চোখের জল ফেলে যেতে পারেন যাবজ্জীবন, কিন্তু বিবাহ বিচ্ছিন্না হওয়ার সাহস দেখাতে পারতেন না। লিলের পরেও কাজটা সহজ হয় নি। ১৯২৫ নাগাদ নিরুপমা দেবী যখন কুচবিহারের রাজকুমারকে ডিভোর্স করেন, তখনও আবার তুমুল ঝড় ওঠে।
নোট - তারক নাথ পালিত কেমন মানুষ ছিলেন একটি ঘটনায় আভাস মেলে, আজন্ম ছেলেদের বিলিতি পরিবেশে মানুষ করলেও বড় ছেলে ইংরেজ দুহিতা বিয়ে করায় তার সঙ্গে সংশ্রব ত্যাগ করেন। আর মেয়ে শিশির মল্লিক কে ডিভোর্স করলেও সেই শিশির মল্লিককেই লোকেন পালিতের সঙ্গে নিজের উইলের executor করেন।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।